
ফকির ইলিয়াস এর কবিতা
চিতাচঞ্চল মায়ামিত্রগুলো
মিত্রদের সাথে নিয়েই গড়ে উঠে গুচ্ছ গুচ্ছ মায়ারাজ্য।
আমি সেই রাজ্যে বসত করেই আমার কথা বলি।
লিখি তোমার কথা, তোমাকে নিয়ে কবিতা।কখনও
শব্দগুলো ধরা দেয়; কখনও পালিয়ে যায়
অন্য কোনো রাজ্যে।
অথবা চিতাচঞ্চল যে রাতের গল্প তোমাকে
শোনাই-
তার ভেতরেও লুকিয়ে থাকে মেঘছন্দের
নিখুঁত রঙ।নদীর বাঁধনে দীর্ঘকাল জড়িয়ে
থাকে যে ঢেউ, করি তার তপস্যা।
প্রতিবেশী সুন্দরবনের সান্ধ্যঘোর বুকে নিয়ে
আমি এভাবেই রাতকে পুষে রাখি।
দিনকে স্বাগত জানাই। পাতাদের বলি-
তোমাদের পাঁজরেই জমা থাক যুগে যুগে
বৃক্ষবিপ্লবীদের অমর স্মৃতি।
যেভাবে উত্তরতম আলো
একটির পর একটি দেয়াল দাঁড় করিয়ে রাখা যায়।
পথে পথে রেখে যাওয়া যায় কাঁটা।কিংবা দাগগুলো
মুছে দেবার জন্য সাজিয়ে রাখা যায় বিচিত্র ধরনের
মেকআপ। তবু দাগ থাকে,দুঃখ থাকে,
থাকে দূরতম জলের নিশ্বাস।
সব প্রশ্নের জবাব দেয়া যায় না।সব মেঘের বিপরীতে
আঁকা যায় না নিজের মুখ।তবু শ্রাবণ আসে। ঝড়ের
গতি ধ্বসিয়ে দেয় অনেক দেয়াল। সরিয়ে নিয়ে যায়
অনেক প্রাচীন কাঁটা।
উত্তরতম আলো যেভাবে ভালোবেসে মানুষকে
আলিঙ্গন করে- মূলত তার আয়ুই লিখিত থেকে যায়।
বাকী ইতিহাস মিশে যায় ঘূর্ণিজলে। ঢেউয়ের
দুরন্ত শরীরে- উল্লাসে,উল্লাসে।
একটি কবিতা পড়ার পর
ছড়িয়ে থাকে ফসফরাসের ঘ্রাণ। মিথ এবং মন্তব্যের
শব্দে শব্দে ছড়িয়ে থাকে জলের অনুপ্রভা।কিছু বাষ্প
জন্ম দেয় ভালোবাসার।কিছু বিস্ময়, রাতের ডানায়
চড়ে ভ্রমণ করে ধাতুর নগর।
একটি কবিতা পড়ার পর,পাঠকের দমের ভেতর
হারিয়ে যায় অনেকগুলো দম। বেদম প্রহারে সিদ্ধহস্ত
যে মেঘ-
চুপ করে সে’ও দেখে,
পুনরায় পঠিত হচ্ছে অনেকগুলো নিশ্বাসের হেরাগুহ
অনেকগুলো ভালোবাসার সাম্পান,
ভাসতে ভাসতে খুঁজছে কিনার।
অনেক মুখের ছায়া,রেখা রেখে রেখে লিখছে নিজেকে-
অনেক জলকল্প,হারিয়ে যাচ্ছে উজানি ঢেউয়ের ভেতর।
চিহ্ন ও চোখের ব্যবহার
সামনেই গোলাপ বাগান।এর পরেই দাগ,কাঁটার সংসার।
সবুজের ঘন আলিঙ্গন।যার স্মৃতিশব্দ বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে
আছে বৃষ্টি আর তার সুদর্শনা কন্যারা।
চিহ্নের ওপারে রাখো দুটি চোখ।দেখবে তারা যে হলুদ
শাড়ি পরে আছে- এর মাঝেও ডুবে আছে বিগত শীতের
দীর্ঘ বিবরণ। বসন্ত আসবে বলে যে শীত; ক্রমশ তার
কুয়াশা সংসার গুটিয়ে সরে গিয়েছিল অন্য কোনো নক্ষত্রে।
পৃথিবীর ওপিঠে আরেকটি গ্রহ আছে। সেখানেও নক্ষত্রেরা
ফোটে থাকে। যারা সেখানে চিহ্ন কুড়াতে যায়-
তারা ভুলে যায় এই ফালগুনি রাতের গান।
নতুন সুর এসে তাদের মনকে আরেকবার বিমোহিত করে।
যুদ্ধোত্তীর্ণ গোলাপরশ্মি
পোল্যান্ডের গ্রামীণ সীমান্ত মেডিকা।ইউক্রেন থেকে ছুটছে হাজারো মানুষ
প্রতিদিন।একজন নারী,একজন পুরুষ,একজন বৃদ্ধ,একজন কিশোর,একজন
কিশোরী।পুরুষের বুকে তোলা একটি বিড়াল।কিশোরীর হাতে ধরা একটি
কুকুর।বিকট শব্দে একটি বোমা ফাটলো কিছু দূরে! মানুষ দৌঁড়ুচ্ছে, ভয়ে-
দৌঁড়ুতে গিয়ে সড়কেই হোচট খেয়ে পড়ে গেলেন বৃদ্ধ! তাকে টেনে তুলতে
দৌঁড়ে এলেন সাথে থাকা নারী। ছুটে এলো সাথে থাকা কুকুরটিও! আর
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো পোষা বিড়াল’টি!
এবিসি চ্যানেলে দৃশ্যগুলো দেখতে দেখতে আমার একাত্তরের ছায়াচিত্র চোখে
ভাসে। ছুটছে হাজারো শরণার্থী।যারা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে যেতে পারেন’নি
তারা ছুটছেন গ্রামের দিকে।পায়ে হেঁটে পার হচ্ছেন ক্বীনব্রীজ।আজ তাক করা
বন্দুক দেখলেই আমার বসন্ত কাকা’র কথা মনে পড়ে যায়। যিনি বার বার
বলেছিলেন-‘আমাকে তোমরা নিয়ে যাচ্ছ কেন!’
পুড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা নিয়ে এই পৃথিবীতে যেদিন যুদ্ধের জন্ম হয়েছিল,সেদিন
কত ছিল বিশ্বের লোকসংখ্যা! অথবা কতটি পাখি উড়তো বিশ্বের আকাশে!
যে ফুলের কথা তুমি কবিতায় নিয়মিত বলো- এই পৃথিবীতে কতটি ছিল
সে’সময় ফুলের বাগান! ভাবতে ভাবতে অধিক সময়ই আমার চিন্তাশক্তি আর
কাজ করে না! আমি খুব একা হয়ে যাই! একাকী সমুদ্রের বুকে গিয়ে নিবাস
গড়ার ব্যর্থতা জমিয়ে রেখে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে-
অবশ্যই এই মহাগ্রহ একদিন যুদ্ধবিহীন হবে,
আর গোলাপের আলোকরশ্মি ধারণ করে,সূর্যই একদিন বিলীন হবে নিজে!

