ফয়েজ় পরিক্রমা – ৬
নীলাঞ্জন হাজরা
আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, সেরা উর্দু কবিতা যে একেবারে তার আদি যুগ থেকে এই ‘মানছি না’-তে ভরপুর তা খুব কম বাঙালিই লক্ষ করেন। তা নিয়ে চর্চা হয় না। একজন মানুষ কিন্তু এক বর্ণ উর্দু না জেনেও সেটা উপলব্ধি করে ফেলেছিলেন। সাহিত্যের দিক্পাল তাত্বিক এডোয়ার্ড সয়ীদ। পরে এ প্রসঙ্গে সবিস্তারে ফিরব, এখানে ছোট্টো একটা অংশ ইংরেজিতেই তুলে দিলাম— ‘‘The three of us sat in a dingy Beirut restaurant late one night, while Faiz recited poems. After a time, he and Eqbal stopped translating his verses for my benefit, but as the night wore on, it did not matter. What I watched required no translation: it was an enactment of a homecoming expressed through defiance and loss…’’ (Reflections on Exile. Reflections on Exile & Other Literary & Cultural Essays. Edward Said. Granta. 2000)। তিনজন — সয়ীদ, ফয়েজ়, ও দু’জনেরই বন্ধু ইকবাল আহমেদ। নিজের সিদ্ধান্তেই নির্বাসিত ফয়েজ় সে সময়ে, জিয়া উল-হকের ভয়াবহ সামরিক শাসনকালে, বইরুতবাসী হয়ে ‘লোটাস’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন, যে প্রসঙ্গেও আমাদের ফিরতে হবে, কারণ ফয়েজ়ের একটা গোটা কাব্যগ্রন্থ তা নিয়েই — সর-এ-ওয়াদি-এ-সিনা (সিনা উপত্যকার মাঝখানে)।" নীলাঞ্জন হাজরার কলমে ফয়েজ পরিক্রমার ষষ্ঠ পর্ব ।
ফয়েজ পরিক্রমা প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন– প্রথম পর্ব
ফয়েজ পরিক্রমা দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন– দ্বিতীয় পর্ব
ফয়েজ পরিক্রমা তৃতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন–তৃতীয় পর্ব
ফয়েজ পরিক্রমা চতুর্থ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন– চতুর্থ পর্ব
ফয়েজ পরিক্রমা পঞ্চম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন– পঞ্চম পর্ব
শিরায় শিরায় রক্তে ফের প্রদীপ জ্বলুক
শিল্পী এম.এফ. হুসেন।
তুমহারি ইয়াদকে যব জ়খ্ম ভরনে লগতে হ্যায়ঁ
কিসি বাহানে তুমহে ইয়াদ করনে লগতে হ্যায়ঁ।।
হদিস-এ-ইয়ারকে উনওয়াঁ নিখরনে লগতে হ্যায়ঁ
তো হর হরিমমে গেসুঁ সঁওয়ারনে লগতে হ্যায়ঁ।।
হর আজনবি হমেঁ মহরম দিখাই দেতা হ্যায়
যো অবভি তেরি গলিসে গুজ়রনে লগতে হ্যায়ঁ।।
সবাসে করতে হ্যায়ঁ গুরবত নসিব জ়িক্র-এ-বতন
তো চশ্ম্-এ-সুভ মে আঁসু উভরনে লগতে হ্যায়ঁ।।
উয়ো যবভি করতে হ্যায়ঁ নুত্ক্-ও-লবকি বখিয়াগিরি
ফজ়ামে অওরভি নগমে বিখরনে লগতে হ্যায়ঁ।।
দর-এ-কফসমে অন্ধেরে কি মুহর লগতি হ্যায়
তো ফয়েজ় দিলমে সিতারে উতরনে লগতে হ্যায়ঁ।।
আমি মাঝে মাঝে ভাবি, ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ় এ রকম কবিতায় পৌঁছলেন কী করে। আর তার থেকেও বেশি ভাবি, আমি এ রকম কবিতায় পৌঁছে গেলাম কী করে। এই দুইয়ের মধ্যে ক্যালেন্ডারের হিসেবে সময়ের পার্থক্য হবে কম সে কম ৪০ থেকে ৫০ বছর। এখানে অবিশ্যি আমি এই লেখা পড়া আর এই লেখায় পৌঁছনোর মধ্যে একটা জরুরি পার্থক্য রাখছি। যে কোনও কারুর লেখাই যে কোনও সময়ে ঘটনাচক্রে পড়ে ফেলা যেতে পারে। কিন্তু যে কোনও লেখকের লেখায় পৌঁছতে গেলে একটা সফর করা দরকার। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সেই সফরটা আগে থেকেই হয়ে থাকে। মানে, ধরা যাক, আমার প্রজন্মের যাঁরা মোটামুটি বইপত্তর পড়েন তাঁদের মতোই আমিও গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লেখালিখির একটা বড়ো অংশ পড়েছি। কিন্তু আমি মার্কেজে পৌঁছইনি। যেমনটা আমি বিশ্বাস নিয়ে বলতে পারি ফয়েজ়ের ক্ষেত্রে। অন্যান্য পাঠকদের কী হয় বলতে পারি না, কিন্তু আমি নিজের ক্ষেত্রে জানি যে, ফয়েজ় হঠাৎ আবিষ্কার করে তারপর তাঁর লেখালিখি, তাঁর বিষয়ে লেখালিখি অনেক পড়ে তাঁর কবিতায় পৌঁছলাম এমনটা হয়নি। পড়েই বুঝেছিলাম আমি পৌঁছেছি, এইবার এর ভূগোলটা বুঝতে সর-জ়মিন অন্বেষণ করা দরকার।
আমার অকাল প্রয়াত বান্ধবী করাচিবাসী মাদিহা এইজাজ় এ সব শুনে বলেছিল, এতে আবার অবাক হওয়ার কী আছে। এমনটাই তো হওয়ার কথা। মাদিহার পক্ষে এমন কথা বলা সহজ ছিল। কারণ আমার দেখা মানুষদের মধ্যে একমাত্র মাদিহাই সুফি ছিল। মানে, মওলানা জালাল-উদ্দিন রুমির কবিতা কোলম্যন বার্ক্স-এর করা আবোলতাবোল বিপজ্জনক ‘ট্র্যান্সক্রিয়েশন’ (লোকটার স্পর্ধা দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই) ফেসবুকে পোস্ট করা সুফি নয়, ‘শেখ’-এর কাছে নিয়মিত ‘ধিক্র’ (বা জ়িক্র) করা সুফি। বিশ্বাসে সুফি। জীবনচর্যায় সুফি। সুফিরা গভীরে বিশ্বাস করে একটা নির্দিষ্ট কোথাও পৌঁছনোর জন্যই তুমি জন্মাবধি সফর শুরু করে দিয়েছ। ইত্যাদি, ইত্যাদি, সে প্রসঙ্গ এখন থাক।
কিন্তু হিন্দোলকে এই লেখা লেখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বুঝতে পারছি, এ তো মহা মুশকিল কাণ্ড। এ লেখা সৎ ভাবে লিখতে হলে — ফয়েজ় প্রসঙ্গে অসৎ হওয়া আমার দ্বারা অসম্ভব — একসঙ্গে দু’ দুটো সফর মিলিয়ে আমায় একটা তৃতীয় সফর করতে হবে। একটা আমার এ কবিতায় পৌঁছনোর সফর, একটা, এ লেখার পাঠকের জন্যই মূলত, ফয়েজ় কী করে এমন ধারা কবিতায় পৌঁছলেন তার সফর। এবং এ দুইয়ে মিলে, এই ফয়েজ় পরিক্রমার তৃতীয় সফর। এ সফরগুলোকে যদি নদী হিসেবে কল্পনা করা যায়, তবে সেই দুই নদী, ও তার থেকে অবধারিত ভাবে বার হওয়া নানা ফ্যাকরা এই তৃতীয় সফরের ভূগোলটাকে এক্বেবারে সুন্দরবনের ভূগোলের মতো করে তুলবে এই দুশ্চিন্তায় আমি ইদানীং অস্থির। শেষ পর্যন্ত ঝড়ে ডুবে মরব, লোনা পাণি খেয়ে মরব, নাকি পথ হারিয়ে মরব, সেটাই এখন দেখার।
যাক গে, বেরিয়ে যখন পড়েইছি…! একেবারে সমসাময়িক এক করাচিবাসী, আমার বন্ধু, কবির একটা অনবদ্য কবিতা মনে পড়ল। ‘নতুন ভাষার অক্ষর: পাকিস্তানের সাম্প্রতিক উর্দু কবিতা’ নামে আমার করা যে তরজমা সংকলন শিগ্গিরি প্রকাশ হতে চলেছে, তাতে আছে —
স্তোত্র
মানুষ লড়ে
মানুষ ব্যর্থ হয়
মানুষকে মেরে ফেলা হয়
এসব কিছু জানা সত্ত্বেও
মানুষ বেরিয়ে পড়ে
একেকটা পাথর
একেকটা গাছ
হয়ে ওঠে তার চিহ্ন
কত আল্পনা
কত রঙ
কত শব্দ
বলে দেয় তার ঠিকানা
মানুষ কোথায় লড়াই করেছে
কোথায় ব্যর্থ হয়েছে
কোথায় তাকে মেরে ফেলা হয়েছে
এ সবই শুধু সেই মানুষের স্তোত্র
যে একবার বেরিয়ে এসে দাঁড়াল।
(সয়ীদউদ্দিন / রাত)
এবং চলতে চলতে ভাবি, আপনারাও ভাবতে পারেন, একেবারে গোড়ায় উদ্ধৃত ফয়েজ়ের ওই কবিতাটা কি কোথাও নীচের এই জনপ্রিয় গানে এসে মিলতে পারে? আমরা যেন ভুলে না যাই পাকিস্তানের জনসংস্কৃতিতে, পপুলার কালচারে ফয়েজ়কে একেবারে গুলে দিয়েছেন ১৯৫০-৬০ দশকের ফিল্ম দুনিয়ার দুই প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীতশিল্পী — ম্যাডাম নূর জাহান এবং মেহদি হাসান। কাজেই বম্বের ফিল্ম দুনিয়া নিয়ে নাক সিঁটকানোর কোনও দরকার নেই।
https://www.youtube.com/watch?v=0Ic-twQDcl0
রাহুল দেব বর্মণ। আমার সমসময়ে যে দুই ভারতীয় সঙ্গীতকার দশকের পর দশক ধরে সারা দেশের মানুষের মনোজগত আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন, এখনও রাখেন, তাঁদের একজন। অন্য অগ্রজজন সলিল চৌধুরী। স্বরপর্দা, নোট্স নিয়ে তাঁরা কী কাণ্ড করেছেন না করেছেন তা নিয়ে মন্তব্য করার কোনও যোগ্যতাই আমার নেই। সুর যাঁরা জানেন তাঁদের কাছে কিছু কিছু শুনেছি, সাঙ্গীতিক ব্যাকরণের নিরিখে তা রুদ্ধশ্বাস। যেমন, ‘প্রতিবাদের গান, গানের প্রতিবাদ’ নামে প্রকাশিত (কারিগর প্রকাশনা) একটা বই আছে। বেশ কয়েকদিন ধরে কবীর সুমনের যে সাক্ষাৎকার নেওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল, তাতে কবীর গান ধরে ধরে, গেয়ে গেয়ে (হ্যাঁ, বইটির সঙ্গে তাই একটি সিডি-ও নিখরচায় মেলে) বুঝিয়েছেন, কথার বাইরে সলিল ও অন্যান্য বহু সঙ্গীতকারের সুরের বিদ্রোহ। এমনকী রবীন্দ্রনাথেরও। তার সঙ্গে অনেক টীকা যোগ করে সেই বই।
রাহুলের কথা উনি বলেননি। কিন্তু বাবা আলাউদ্দিন খান সাহেবের কাছে নাড়া-বেঁধে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নেওয়া বাজনদারের কাছে শুনিছে রাহুলের সুরের হোলির কথাও। নোটেশন প্রায় বুঝিনা বটে, কিন্তু মুগ্ধ শ্রোতা হিসেবে তবু বলতেই পারি দু’ জনে সম্পূর্ণ দু’ রকমের টানে আমায় টানেন। তার মধ্যে রাহুলের সঙ্গিতসৃষ্টির এক বিপুল অংশ, কী আশ্চর্য, শ্রেষ্ঠ উর্দু গজ়লের বিপুল অংশের মৌলিক তারে অনুরণিত। কিন্তু রাহুল দেব বর্মণ কোনও দিন গজ়লে সুর দিয়েছিলেন বলে তো শুনিনি। দরকার নেই। আমি বলতে চাইছি, কবিতা হিসেবে এক বিশেষ ধারার গজ়লের আবেদনটা ঠিক কোথায় রাহুলের সুরারোপিত অজস্র গান তার দুরন্ত উদাহরণ। যেমন ওপরে যে গানটার লিঙ্ক দিলাম সেটা।
গানটা শোনা এক্ষণে খুব জরুরি। ইচ্ছে করেই এই গানটা বেছেছি। আরও ডজন ডজন গান বাছা যেত। যেমন এই গানটারই যে মূল হিন্দি রূপ (অনেকেরই মনে পড়বে নিশ্চয় প্রথম এক কলি শুনেই, সে গানের কথা লিখেছেন গুলজ়ার) সেটাও তো দিতে পারতাম। দিইনি। কারণ এই বাংলা গানটার যে কথা — যেতে যেতে পথে হলো দেরি, তাই তো যেতে পারিনি / ভুল বুঝে তুমি চলে গেছো, দূরে, ক্ষমা পাবো, আশা ছাড়িনি — এমন চিটে গুড়ের মতো লিরিক সত্বেও যে স্রেফ সুরের ধারে একটা গান কী করতে পারে আমার অন্তত মনে হয়েছে তার এক আশ্চর্য উদাহরণ এই গান। কিন্তু সেটা কী? এই সুরের ধারটা ঠিক কোথায়?
‘Lily, Rosemary and the Jack of Hearts’ নামে বব ডিলানের যে সাংঘাতিক একটা গান আছে (যা আমার সব থেকে ভালো লাগে জোয়ান বায়েজ়ের গলায়) তাতে লিলি-র বর্ণনা করতে গিয়ে কবি ডিলান লিখছেন “She had that certain flash every time she smiled” (বায়েজ় এই জায়গাটা একটু বদলে নিয়ে করেছেন ‘certain something’)। লম্বা গান, তাই এখানে পুরো কবিতাটা দেখে নিতে পারেন — https://www.bobdylan.com/songs/lily-rosemary-and-jack-hearts/
সে গানটা শোনাও অপ্রাসঙ্গিক হবে না—
লিলি রোজ়মেরি অ্যান্ড দ্য জ্যাক অফ হার্ট্স। শিল্পী ক্যাল লিউইস
https://www.youtube.com/watch?v=3AQJZys0cvI
এই যে অনির্ধারিত ‘সার্টেন ফ্ল্যাশ’, বা ‘সার্টেন সামথিং’ এটাই তো কিছু কিছু কবিতা, গান, ছবি-কে ভিড়ের থেকে পৃথক করে দেয়। রাহুলের এই গানটার সুরে সেই ‘সার্টেন ফ্ল্যাশ’-টা কী হতে পারে? আমার মনে হয়েছে সেটা যা, উর্দু গজ়লের এক বিশাল অংশ তার জন্যেই দুনিয়ার আর যাবতীয় কিসিমের কবিতার থেকে একেবারে আলাদা। সেটা ধরতে গেলে আমাদের ওই প্রথম সফরটা করতে হবে — ফয়েজ় কী করে ওপরে উদ্ধৃত ওই কবিতার মতো কবিতায় পৌঁছলেন। এখানে আমরা ফিরব একটু পরে। ততক্ষণে আপনারাও ভাবতে পারানে সেটা কী, ফেরার পর দেখা যেতে পারে আমাদের ভাবনা মিলল কি না।
আপাতত আমি কী করে ওই কবিতার কবিতে পৌঁছলাম তার কথা। মনে পড়ছে, উত্তর কলকাতার ভূপেন বসু অ্যাভিনিউ-তে ‘৫৬-এ’ বলে একটা ঠিকানা ছিল। একটু অদ্ভুত দেখতে একটা বাড়ি। একতলা। হলদেটে। এখন আর নেই। আমার ফয়েজ় পরিক্রমায় এর একটা মৌলিক ভূমিকা আছে। সেটা বেশ বিচিত্র। আমাদের ছোটোবেলায় ‘পত্র-মিতালি’ বলে একটা ব্যাপার খুব চলতো। পেন ফ্রেন্ডশিপ। আমি যখন ক্লাস এইটের ছাত্র সে সময় এই বাড়িরই ক্লাস সিক্সের একটি মেয়ের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের সন্দেশ পত্রিকার মাধ্যমে পত্রবন্ধুত্ব হয়। সৌমী। সন্দেশে ‘হাতপাকাবার আসর’ নামে ছোটোদের কিছু বাছাই লেখালিখি ছাপার একটা বিভাগ ছিল। তাতে সৌমীর লেখা বেরত প্রায়শই। একবার সেখানেই ‘পাখিদের হাসপাতাল’ নামে একটা লেখা পড়ে আমি চমকে উঠেছিলাম। এবং দেখা গেল সেই সংখ্যাতেই পত্রবন্ধু চেয়ে আবেদন করেছে সৌমী। পট করে একটা পোস্টকার্ড পাঠিয়ে দিলাম। বন্ধুত্ব জমে উঠল। যতদূর মনে করতে পারছি আমার থার্ড ইয়ার পর্যন্ত এই বন্ধুত্ব দু’-একবার হোঁচট খেয়েও টিকে ছিল। মানে সেটা ১৯৮৮। এরপরে আমরা যাকে বলে জীবনের বারদরিয়ায় পড়ে দু’ জনে দু দিকে ভেসে গিয়েছি। বিশেষ করে আমি তাচ্ছিল্যভরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা পরিত্যাগ করে, সাংবাদিক হলেই মানুষের পাশে থাকা যায় এমন আজগুবি ধারণায় ব্রতী হয়ে সাংবাদিকের চাকরি নিয়ে শিলিগুড়ি চলে গিয়ে সিপিআই(এম)-এর ট্রেড ইউনিয়ন শাখা সিআইটিইউ-এর সঙ্গে অল্পবিস্তর জড়িয়ে পড়ার পরে।
এই বন্ধুত্বের মূলে ছিল বই পড়া আর সত্যজিৎ রায় চর্চা। বই ছাড়া যে জীবন চলতে পারে না, এ গোলমেলে নেশাটা সৌমীই আমার মনে ঢুকিয়ে দিয়েছিল— সে সময়ে আমার যাবতীয় পড়াশুনার দিশারী। ততদিনে আমি বছর দুয়েকের জন্য দেওঘর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে আমার চতুর্থ স্কুল বাড়ির পাশেই বিষ্ণুপুর হাইস্কুলে স্থানান্তরিত হয়েছি। কাজেই কলকাতায় ও যা পেত বিষ্ণুপুরে আমি পেতাম তার অনেক পরে। বিষ্ণুপুরে তখন একটি মাত্র উল্লেখযোগ্য বইয়ের দোকান — জনভাণ্ডার। মালিক বাঁকুড়ার হোদলনারায়ণপুরের জমিদার বংশের রাধাকান্ত মণ্ডল। সৌমী বইয়ের নাম আর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা পাঠাত, আর আমি ছুটতাম জনভাণ্ডারে।
জনভাণ্ডারে ছোটার আরও দুটো কারণ ছিল। রাধাকান্তবাবু রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্র বসু ও কাজী নজরুলকে দেখেছিলেন। তিনি নিজেই ছিলেন বিপুল গল্পের ভাণ্ডার। ছোট্টো একরত্তি দোকান। খোলা নর্দমার ওপরে বাঁধানো সিঁড়ি দিয়ে দু-তিন ধাপ উঠে ফুট তিনেকের একটা লম্বা জায়গা সেখানে একটা কাঠের টুল রাখা। তারপর কাঠের কাউন্টার। কাউন্টারের ওপাশে চৌকো দোকানের দেওয়াল জুড়ে বইয়ের তাক। সামনে একটা সাদা তোয়ালে দেওয়া কাঠের চেয়ারে রাধাকান্তবাবু। এক কোণে কী-সব ঠাকুরের ছবিতে দেওয়া ধূপের উগ্র জমে থাকা গন্ধ। টুলে বসে গপ্পো শুনতে শুনতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত। দ্বিতীয় কারণ ছিল, ছেলের লেখা চিঠি পড়ে শোনাতেন রাধাকান্তবাবু। ছেলে জয়ন্ত মণ্ডল সেই টিমটিমে বিষ্ণুপুর থেকে বাপের ত্যাজ্যপুত্র করে দেওয়ার হুমকি মাথায় নিয়ে, মাকে কাঁদিয়ে, এক কাণ্ড ঘটিয়েছিল — সাইকেল নিয়ে দুনিয়া ঘুরতে বেরিয়ে পড়েছিল। ১৯৭৬ সালে। ১৭ বছর ধরে ১৫৪টি দেশে তিন লক্ষ ৮৪ হাজার কিলোমিটার সাইকেলে ঘুরে সে ক্ষান্ত দেয়। এখন নাম করা ফোটগ্রাফার। নিউ ইয়র্কে থাকে। সেই জয়ন্তকাকু চিঠি লিখত বাবাকে। তার চুম্বক অংশ আমাকে পড়ে পড়ে শোনাতেন রাধাকান্তবাবু। ক্রমে সৌমীর পাঠান বইয়ের তালিকা এমনই দীর্ঘ হতে থাকে যে আমার পকেট-মানি থেকে তা কিনে উঠতে পারতাম না সর্বক্ষণ। সেই না শুনে, রাধাকান্তবাবু আমার জন্য জনভাণ্ডারকে বইয়ের দোকান থেকে লাইব্রেরি করে দিয়েছিলেন। ধারেও কিনেছি অনেক বই।
বলাই বাহুল্য, এই বইয়ের একটা বড়ো অংশ ছিল কবিতার বই। আর তার মধ্যে, একটা সময়ে, আমাদের আদান-প্রদানের আলম্ব ছিল একটা সংকলন — Palgrave’s Golden Treasury। আমার ছিল ‘বুক ফোর’ পর্যন্ত। তাই এক প্রিয় ইংরেজ কবিকে আমি সেখানে পাইনি, পরে অন্যত্র পেয়েছিলাম — রবার্ট ব্রাউনিং (১৮১৮-১৮৮৯)। কিন্তু ধ্রুপদী ও রোমান্টিক ইংরেজি কবিতা সে সময় এক্কেবারে গুলে খেয়েছিলাম। ইংরেজি কবিতার এই জগতে বিচরণ করতে করতেই ব্রাউনিং আর ওয়াল্ট হুইটম্যান আবিষ্কার (১৮১৯-১৮৯২)। তার মধ্যে এই পরিক্রমায় তুলব ব্রাউনিংয়ের একটা কবিতার কথাই শুধু — The Last Ride Together। সকলেরই পড়া কবিতা, বিশদ চর্চার প্রয়োজন নেই। শুধু কয়েকটা পঙ্ক্তি উল্লেখ করে রাখি —
‘‘Had I said that, had I done this,
So might I gain, so might I miss.
Might she have loved me? just as well
She might have hated, who can tell!
Where had I been now if the worst befell?
And here we are riding, she and I…
What if we still ride on, we two
With life for ever old yet new,
Changed not in kind but in degree,
The instant made eternity, …—’’
আর তার সঙ্গে অজস্র বাংলা বই। ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ পড়ে সৌমীর উত্তেজিত চিঠির কথা এখনও মনে আছে। তার নামই শুনিনি আগে। নামটা শুনে অবাক হয়েছিলাম— বাব্বা! নীলকণ্ঠ পাখিরও আবার খোঁজে যেতে হয়? কারণ, ছোটোবেলায় আমাদের পাঁচমুড়া গ্রামের কোয়ার্টার্সের বারান্দায় নীলকণ্ঠ পাখির পালক পড়ে থাকা মোটেই বিরল ঘটনা ছিল না। মা কুড়িয়ে কলমদানে রেখে দিত। বহু বহু বছর পরে মার্কিন কনসুলেটের ‘ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও অডিও-ভিসুয়াল’ বিভাগের প্রধান হিসেবে ওয়াশিংটন ডি.সি.-র চোখ-টেরিয়ে দেওয়া লাইব্রেরি অফ কংগ্রেসের সংগ্রহের জন্য অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা তাঁর স্বকণ্ঠে পাঠের রেকর্ডিং করতে হয়েছিল। কী অমায়িক সেই বৃদ্ধ মানুষটি। সে সময় বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের রেকর্ডিং বারবার বন্ধ করতে হচ্ছিল কারণ উনি পড়তে পড়তে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। প্রণম্য সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের উজ্জ্বল সংসর্গে পাক্কা দু’ দিন কাটানোর সৌভাগ্য হয়েছিল। আর দ্বিতীয় দিন যখন সুভাষ বাবু বেরোচ্ছেন কনসুলেট থেকে, এবং জয় গোস্বামী ঢুকছেন, কনসুলেটের সশস্ত্র প্রহরী, মার্কিন কূটনীতিকদের স্তম্ভিত করে জয় বাবু একেবারে মাটিতে শুয়ে পড়ে, সাষ্টাঙ্গে, অগ্রজ কবিকে সর্বসমক্ষে প্রণাম করলেন। এক জনপ্রিয় লেখক অভিযোগ করলেন, এই সাহিত্যিকদের মধ্যে তাঁর নাম না থাকা আসলে সি.আই.এ-র চক্রান্ত— দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় খবর ছাপা হলো সেই মর্মে। কিন্তু সে একেবারে ভিন্ন প্রসঙ্গ। এখানে যা প্রাসঙ্গিক, কৈশোরে এই সব আদান-প্রদানের সময়েই সৌমীর সেই ‘পাখিদের হাসপাতাল’ লেখাটার মতো একটা মন্তব্য আমাকে চমকিত করেছিল — স্মৃতি থেকে বলছি — যা সব ঘটনা ঘটছে চারপাশে, তাতে মঙ্গলময় ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখা আর সম্ভব নয়! আমার মধ্যে যে সংশয়টা ছিল তা এবার নিশ্চিত বিশ্বাসে পরিণত হলো। অবিশ্বাসের বিশ্বাস। এবং আমার যাবতীয় পাঠকে প্রভাবিত করতে শুরু করল।
এর পরে সৌমীরা ঘন শ্যামবাজারের বাড়ি থেকে নিশ্চরিত্র সল্টলেকের বাড়িতে উঠে যেতে বাধ্য হলো। সল্টলেক কলকাতার সেই বিচিত্র এলাকা যেখানে গাড়ি নিয়ে গেলেই আমি পথ হারিয়ে ফেলি, কারণ গোটা অঞ্চলটাকেই বিশাল একটা ভেড়ার পাল মনে হয়, পাড়া থেকে পাড়ার কোনও তারতম্য নেই, সব এক। কোনও পাড়ার কোনও নিজস্ব চরিত্র নেই।
সে গেল, গেল, কিন্তু যা আমাকে পীড়া দিতে থাকল ক্রমাগত, তা হলো আসা-যাওয়ার পথের ধারে ওই ঠিকানার বাড়িটাকে গুঁড়িয়ে দিতে দেখলাম মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে। ভূপেন বসু অ্যাভিনিউতেই আমার এক মামার অ্যাপার্টমেন্টে এবং তার থেকেও বেশি বেলগাছিয়ায় ললিত মেমোরিয়াল হস্টেলবাসী আর.জি. কর মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র আমার বন্ধুদের কাছে মদ্যপান করতে আসা-যাওয়ার পথে! ক্রেন, বুলডোজ়ার, আর্থ-রিমুভার ইত্যাকার দানবীয় লৌহ যন্ত্রের দাপটে একটা প্রিয় ঠিকানা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। সেই যে আমার মনে মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে সংঘটিত, সংগঠিত উন্নয়নের প্রতি একটা বিষ তিক্ত স্বাদ লেগে গেল, তা আর জীবনভর ঘুচল না। রক্তের মধ্যে একটা ‘হাল্লাবোল’ দৌড়তে শুরু করল। একটা ‘মানছি না’, ‘ডিফায়েন্স’।
ফয়েজ়ের কবিতা পেয়ে যা অনেক পরে ঝলমলে, প্রত্যক্ষ হলো —
হর রগ-এ-খুঁ মে ফির চরাগাঁ হো
সামনে ফির উও বেনকাব আয়ে।।
(শিরায় শিরায় রক্তে ফের জ্বলুক প্রদীপ
দেখা দিক সে আরবার পর্দা সরিয়ে।।)
আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, সেরা উর্দু কবিতা যে একেবারে তার আদি যুগ থেকে এই ‘মানছি না’-তে ভরপুর তা খুব কম বাঙালিই লক্ষ করেন। তা নিয়ে চর্চা হয় না। একজন মানুষ কিন্তু এক বর্ণ উর্দু না জেনেও সেটা উপলব্ধি করে ফেলেছিলেন। সাহিত্যের দিক্পাল তাত্বিক এডোয়ার্ড সয়ীদ। পরে এ প্রসঙ্গে সবিস্তারে ফিরব, এখানে ছোট্টো একটা অংশ ইংরেজিতেই তুলে দিলাম— ‘‘The three of us sat in a dingy Beirut restaurant late one night, while Faiz recited poems. After a time, he and Eqbal stopped translating his verses for my benefit, but as the night wore on, it did not matter. What I watched required no translation: it was an enactment of a homecoming expressed through defiance and loss…’’ (Reflections on Exile. Reflections on Exile & Other Literary & Cultural Essays. Edward Said. Granta. 2000)। তিনজন — সয়ীদ, ফয়েজ়, ও দু’জনেরই বন্ধু ইকবাল আহমেদ। নিজের সিদ্ধান্তেই নির্বাসিত ফয়েজ় সে সময়ে, জিয়া উল-হকের ভয়াবহ সামরিক শাসনকালে, বইরুতবাসী হয়ে ‘লোটাস’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন, যে প্রসঙ্গেও আমাদের ফিরতে হবে, কারণ ফয়েজ়ের একটা গোটা কাব্যগ্রন্থ তা নিয়েই — সর-এ-ওয়াদি-এ-সিনা (সিনা উপত্যকার মাঝখানে)।
সেই বাড়ি ভাঙা দেখে এক বিচিত্র ঘুরপথে, যেন বেআইনি চোরা পথে আমি এই বাস্তুচ্যুতকারী উন্নয়নবিরোধী আন্দোলনের খানিকটা সাথি হয়ে গেলাম, খানিকটা। প্রথমে টালির নালার পার্শ্ববর্তী বস্তি উচ্ছেদ করে মেট্রোরেল তৈরি করার বিরোধী আন্দোলনে, পরে শিলিগুড়ির চাঁদমণি চা বাগানের একাংশ সাফ করে হাউসিং এস্টেট তৈরির বিরুদ্ধে। একদিন যখন টালির নালার পাশে দেখলাম বিপুল পুলিশ বাহিনী একটা বস্তি ঘিরে ফেলে ভীষণ বিক্রমে চালার পর চালা গুঁড়িয়ে দিচ্ছে নানা কিসিমের লৌহযন্ত্রে, আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া নানা জিনিস — টিনের ট্রাঙ্ক, মলিন জামাকাপড়, স্কুলের ছেঁড়াকোঁড়া বই-খাতা, কৌটোবাটা আরও কতো কিছু চোখ মুছতে মুছতে কুড়িয়ে একপাশে রাখার চেষ্টা করছে ময়লা নাইটি গোছের পরা একটি কিশোরী, দৃশ্যটা বেশিক্ষণ সহ্য হলো না। সৌমীর অনেক চিঠির কথা মনে পড়ল, যাতে বাড়ি বদল নিয়ে আদৌ ওর কোনও অভিযোগ অনুযোগ ছিল বলে আমার মোটেই মনে পড়ে না। আর একটা বিশ্রী বিরক্তির ভাব জেগেছিল এই দেখে যে, একদল লোক জড়ো হয়ে সে মর্মান্তিক দক্ষযজ্ঞের তামাশা দেখছি। লক্ষ করেছিলাম তারা সবাই পুরুষ। এটা আমি পরেও অনেকবার লক্ষ করে দেখেছি, ভীষণ কোনও দুর্ঘটনা ঘিরে তামাশা দেখার ভিড়ে নারীরা প্রায় থাকেন না বললেই চলে। এটা পুরুষালী বিনোদন।
অনেক পরে আমি চাঁদমণি আন্দোলন ভিডিও ক্যামেরায় (পিডি ১৫০ ভাড়া করে, নিজের পয়সায়) ডকুমেন্ট করেছিলাম। অন্তত ১৩ ঘণ্টার ফুটেজ। সিপিআই(এম) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারের পুলিশি হামলা শ্রমিকদের ওপর, দু’জন মানুষকে গুলি করে হত্যা, তাঁদের একজনের কৈশোর থেকে যৌবনে সবে পা-বাড়ানো মেয়ের সাক্ষাৎকার, এমন বহু কিছুই ক্যামেরাবন্দি করা হয়েছিল। প্রথম দফায় মূল কাজ করেছিল সে সময়ে আমার বন্ধু এখন খুবই নাম করা সিনেমাটোগ্রাফার রাণু ঘোষ। এবং পরে আরও কিছুটা করে দিয়েছিল তখনই বেশ নামকরা ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্রকার সৌরভ-দা, সৌরভ ষড়ঙ্গী। এমনকী বুবলাদি, পার্বতী মুখোপাধ্যায়ের গলায়, যার সঙ্গে প্রণম্য প্রতিমা বড়ুয়ার গলার একটা অদ্ভুত মিল আছে, ‘দিনে দিনে খসেয়া পড়িবে রঙিলা দালানের বাড়ি’ গানটা স্টুডিওতে, অপূর্ব লোকগান শিল্পী অভিজিৎ বসুর একটি ক্যাসেট রেকর্ডিং হওয়ার পরে বেঁচে থাকা অতিরিক্ত সময়ে, রেকর্ডিংও করিয়ে নিয়েছিলাম। ইচ্ছে ছিল ডকুমেন্টারিটার শেষ দৃশ্য হবে — চাঁদমণির জমিতে তৈরি অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে রঙ হচ্ছে আর ব্যাকগ্রাউন্ডে অভিশাপের মতো চলছে এই গানটা, যেটার সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছিল একটাই বাদ্যযন্ত্র, বৌদ্ধ গুম্ফায় যে গম্ভীর শব্দের বিশালকায় ঘণ্টা — gong — বাজে তাই। হয়নি। পরে কাকে যেন গোটা ফুটেজটা ধরে দিয়ে দিয়েছিলাম। সেটা হারিয়ে গেছে। যা হারায়নি তা হলো, সেই সময় চাঁদমণি সংলগ্ন গ্রামের পঞ্চায়েতের প্রধান এক আদিবাসী যুবকের সাক্ষাৎকারে বলা একটা বাক্য — কৌশিশ-হি জিৎ হ্যায়! চেষ্টা করাটাই জয়।
আর যা হারিয়ে যায়নি তা হলো সৌমীর চিঠির ভাষা। গোড়ার দিকে আমি বাংলা লেখায় একেবারে তেমন সড়গড় ছিলাম না। একটা চিঠি ইংরেজিতে লিখেছিলাম বলে, ঝাঁঝাল উত্তর এসেছিল। ক্রমে ক্রমে, ভালো হোক বা মন্দ, আমার ভাষার মধ্যে সৌমীর চিঠির ও সন্দেশের লেখালিখির ভাষা ততটাই ছাপ ফেলেছে যাতে রবীন্দ্রনাথের গভীর উচ্চারণ ‘রক্তে রেখে গেছে ভাষা, / স্বপ্নে ছিল যাওয়া-আসা’-র মর্মার্থ চিনে নিতে আমার কোনও অসুবিধা হয়নি।
এতক্ষণ ধরে যা কিছু বললাম, তার মধ্যে আধ-ডুবো হয়ে ভেসে থাকে আর একটা কথা — একটা হারিয়ে ফেলার ভাবনা, sense of loss, যার মধ্যে কোনও ঘ্যানঘেনে ছিঁচ্কাঁদুনি নেই। রাহুলের ওই গান, ডিলানের ‘লিলি, রোজ়মেরি অ্যান্ড দ্য জ্যাক অফ হার্ট্স’, ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ উপন্যাস, রবার্ট ব্রাউনিংয়ের ওই কবিতা, সৌমীর পুরানো আখরগুলির মধ্যে সাধারণ তারও সেটাই। সেটাই সেরা উর্দু গজ়লের অভ্রান্ত সই। আরও কিছুটা আছে। রাহুল দেব বর্মণের গানের সুরের ওই ‘সার্টেন ফ্ল্যাশ’-টা, আমার মনে হয়েছে — আঘাতের উদ্যাপন। আর অন্য কোনও কিছু বলা মুশকিল। টান-টান, উচ্চকিত, সেলিব্রেশন। এবং ‘দ্য লাস্ট রাইড টুগেদার’ কবিতায় সেই উদ্যাপন তো আছেই, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আর একটা আশ্চর্য মাত্রা — মুহূর্তকে অনন্ত করে ফেলা, যাতে ‘আর কি কখনো কবে এমন সন্ধ্যা হবে’-র হাহাকার দৃশ্যমান নয়, ঠিক যেমন উর্দু গজ়লের কবি ‘হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’-ন নিশ্চয়ই, কিন্তু তাঁর কবিতায় বিষণ্ণতার ম্লান চোখ প্রায়শই দৃশ্যমান নয়। কবিতাপ্রিয় পাঠকমাত্রই জানবেন যে, এ আসলে এক প্রকার আত্মপ্রতারণাও, যা আরও বেশি মর্মান্তিক। কবি বিলক্ষণ জানেন এই ঘোড় সওয়ারি দ্রুতই শেষ হবে। জানেন কিন্তু মানতে পারেন না। এইটাও শ্রেষ্ঠ উর্দু গজ়লের স্বাক্ষর চেনার আর এক অভিজ্ঞান। এ দুটোতেই ফয়েজ় পরিক্রমায় আমরা বিশদে আহত ও আপ্লুত হবো।
শুরু করি আমাদের সমসময়ের কাছাকাছি এক কবির একটা গজ়ল দিয়ে। আদীব সাহারানপুরী। জন্ম ১৯২০। ব্রিটিশ ভারতের সেন্ট্রাল প্রভিন্স-এর সাহারনপুরে। পরে করাচি চলে যান। প্রয়াত হন ১৯৬৩ সালে। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে। কোনও অর্থেই মাইলফক কবি বলতে যা বোঝায় তা নন। কিন্তু জনপ্রিয়। আর সেটাও উর্দু গজ়লের একটা মজা, যেটা চর্চা করব পরবর্তীতে। আপাতত কবিতাটা গানের রূপে শুনে নিই —
https://www.youtube.com/watch?v=vrhDztlT0Z4
এক খলিশ-কো হাসিল-এ-উম্র-এ-রওয়াঁ রহনে দিয়া
জানকর হামনে উনহে না-মেহরবাঁ রহনে দিয়া।।
রইতে দিয়েছি চলমান জীবনের সার— একখানি ক্ষত
জেনেশুনে আমি তাকে রইতে দিয়েছি প্রেমহীন।।
কিতনি দিওয়ারোঁ-কে সায়ে হাত ফয়লাতে রহেঁ
ইশ্ক-নে লেকিন হামে বেখানুমা রহনে দিয়া।।
কতো দেয়ালের ছায়া হাত বাড়াতে থেকেছে
ভালোবাসা তবুও আমায় রইতে দিয়েছে চিরআশ্রয়হীন।।
আপনে আপনে হওসলে আপনি তলবকি বাত হ্যায়
চুন লিয়া হামনে উনে, বাকি জাহাঁ রহনে দিয়া।।
নিজ নিজ স্পর্ধার তেজ নিজস্ব যাচনায় বাঁধা
বেছেছি তাকেই আমি, নিজেকে রেখেছি বাকি দুনিয়াবিহীন।।
ইয়ে ভি কেয়া জিনে-মে জিনা হ্যায় বগয়ের উনকে, অদীব
শমা গুল করদি গয়ি বাকি ধুয়াঁ রহনে দিয়া।।
তাকে ছাড়া বাঁচার মতো এ কি কোনও বাঁচা হচ্ছে অদীব
নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রদীপ, রইতে দিয়েছি ধোঁয়া অন্তবিহীন।।
মেহদি হাসান গজ়লটির সবকটা শের গাননি। যে কটা গেয়েছেন পাঠকের কথা ভেবেই সেগুলির মোটামুটি বাংলা তরজমা করলাম। কিন্তু, আমার আসল লক্ষ্য এখানে দ্বিতীয় শেরটি — কতো দেয়ালের ছায়া হাত বাড়াতে থেকেছে / ভালোবাসা তবুও আমায় রইতে দিয়েছে চিরআশ্রয়হীন। এই গোটা গজ়লটার এই একটি শেরই আমার খাঁটি কবিতা মনে হয়েছে। এইখানে দুটো কথা বলে রাখি, যেটা সর্বদাই গজ়ল-পাঠককে মনে রাখতে হবে। এক, গজ়ল কিন্তু আদতে গান নয় কবিতা। উর্দুতে সব সময় ‘গজ়ল কহি হ্যায়’। গজ়ল বলা হয়, গাওয়া হয় না। পরে সুরকাররা এ ধরনের কবিতাকে সুর দিয়ে গানে রূপান্তরিত করেন কখনও কখনও। গজ়লের কবি মোটেই গীতিকার নন। দুই, এক একটি গজ়ল আসলে একাধিক দ্বিপদীর ছন্দোবদ্ধ মালা। ঠিক যেমন মালার এক একটি ফুল স্বয়ংসম্পূর্ণ অস্তিত্ব, গজ়লের এক একটি শেরও তাই— এক একটি সম্পূর্ণ কবিতা। একটি শেরের সঙ্গে অন্যটির ছন্দের সম্পর্ক ছাড়া অন্য কোনও সম্পর্ক নেই। বিরলতম ক্ষেত্রে তার অন্যথা করেছেন কোনও কোনও কবি। এবং প্রত্যেকটি শেরের বিষয় একেবারে পৃথক হতে পারে। প্রথমটি প্রেমের। পরেরটি পূজার। তার পরেরটি নিজেকে নিয়ে একটু হাল্কা চালের কৌতুক। তার পরেরটি কোনও ব্যক্তির প্রশংসা। এমনটা হতেই পারে। আর সেই কারণেই গজ়ল গায়কদের পুরো গজ়লটি গাওয়ার কোনও দায় নেই। এমনকী শে’রগুলো যে ক্রমে লেখা আছে সেই ক্রমেই গাইতে হবে তারও কোনও দায় নেই। কেবল প্রথম ও শেষ শে’রটি ছাড়া। একমাত্র গজ়ল ছাড়া অন্য কোনও প্রকার গানের ক্ষেত্রে এটা সম্ভব বলে আমার অন্তত জানা নেই।
এবারে প্রসঙ্গে ফিরি— এই যে ‘রইতে দিয়েছি আশ্রয়হীন’, ‘বেখানুমা রহনে দিয়া’, ‘করে দিয়েছে, বা করে রেখেছে’ নয়, ‘রইতে দিয়েছি’, এবং একটি ক্ষতকে ‘চলমান জীবনের সার’, ‘হাসিল-এ-উম্র-এ-রওয়াঁ’ করে রাখা, তার উপশমের খোঁজটাকেই অবান্তর করে দেওয়া, এখানেই সেই অনুশোচনাহীন ক্ষতের উদ্যাপন এবং একটা মুহূর্তকে অনন্তে টেনে নিয়ে চলা, সেই ‘the instant made eternity’-র বেশ ধ্রুপদী উদাহরণ বলে মনে হয়েছে আমার।
এখন কথা হলো, উর্দু কবিতা কখন নাগাদ এই ক্ষতোদ্যাপনের বাঁক নিল। মুশকিল এই যে, উর্দু সাহিত্যের ইতিহাস বহু শত বছরের, অজস্র ধারায় প্রবাহিত। তার সামান্যই আমার জানা আছে। নানা সুপণ্ডিতের উপদেশে এ বিষয়ে আমার পড়াশুনার বুনিয়াদ করেছি যে কেতাবটিকে, মহম্মদ সাদিকের A History of Urdu Literature, সে বই ঠিক সেই খাতে প্রবাহিত হয়নি, মানে আমার পাঠের খাতে। কাজেই দিন-ক্ষণের নিরিখে সে খাতের বাঁক নির্ধারণে আমাকে কিছুটা হাতড়াতে হচ্ছে। তবু, আমার প্রায় নিশ্চিত ধারণা, সেই যে মহাকবি মির্জার নিমরাজি স্বীকারোক্তিতে উস্তাদ মীরকে মেনে নেওয়া, সেই মীর তাকি মীর-ই এর প্রথম উত্তীর্ণ উদ্যাপনকারী। যিনি শুধু রসোত্তীর্ণ তেমন উদ্যাপনই করছিলেন না, তাঁর সেই উদ্যাপনে ছায়া ফেলছিল নানা সমসাময়িক ঘটনাও। তাঁর উচ্চারণ হয়ে উঠল আধুনিক। মহম্মদ তাকি মীরের জন্ম ১৭২২ সালে। আকবরাবাদে। যা আমরা চিনি আগ্রা নামে। তাঁর মৃত্যু লখনও-তে ১৮১০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর।
মীর তাকি মীর, আনুমানিক ১৭৮৬। সূত্র উইকিপিডিয়া
ফয়েজ় পর্যন্ত পৌঁছতে গেলে মীরের কাব্য-ভূগোল পার করতেই হবে। কাজেই তাঁর সময়কালটা একটু বিশদে বোঝা দরকার — তাঁর চারপাশটা। রাজনৈতিক ইতিহাসের মানদণ্ডে দেখলে, শেষ দাপুটে মুঘল সম্রাট মুহিউদ্দিন মুহম্মদ আওরঙ্জ়িব আলমগির বাদশা প্রয়াত হয়েছেন ১৫ বছর আগে। টানা ৯২ বছর মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী থাকার পর শাহাবুদ্দিন মহম্মদ খুররম শাহজাহান বাদশার সিদ্ধান্তে ১৬৪৮ সালে রাজধানী উঠে গিয়েছে শাহজাহানাবাদে, যাকে আমরা চিনি পুরানি দিল্লি বলে। মীরের জন্ম যে আকবরাবাদে ৭৫ বছর আগে রাজধানী হওয়ার শান-ও-শওকত হারিয়ে রঙচটা হতে শুরু করেছে। আবার অন্য দিকে যে সাম্রাজ্যে তাঁর জন্ম সেই সাম্রাজ্যের কী হাল তা মালুম চলবে এই তালিকা থেকে — বাহাদুর শাহ, জাহান্দর শাহ, ফাররুখশিয়ার, রফি উদ-দরজাত, দ্বিতীয় শাহ জাহান, মহম্মদ শাহ। ১৭০৭ থেকে ১৭১৯-এর মধ্যে এঁরা সকলে মুঘল বাদশা হয়েছেন!! এই আয়ারাম-গয়ারাম প্যারেড কিছুটা বন্ধ হল ১৭১৯-এ মহম্মদ শাহ মশনদে চড়ায়। সোজা ১৭৪৮। মানে মীরের তখন ২৪ বছর বয়স। তারপরে আবার — আহমদ শাহ বাহাদুর, দ্বিতীয় আলমগীর, তৃতীয় শাহ জাহান, দ্বিতীয় শাহ আলম (মাঝখানে পট করে কয়েক মাসের জন্য চতুর্থ বাহাদুর জাহান), এবং মীরের দেখা শেষ মুঘল বাদশা দ্বিতীয় আকবর শাহ, যিনি মশনদাসীন হন ১৮০৬ সালে। কাজেই ৮৮ বছরের জীবনে মীর দেখেছিলেন ১০ জন বাদশার রাজত্ব।
আর আমরা সবাই জানি এর মধ্যে সব থেকে সব্বোনেশে কাণ্ডটা করে বসেছিলেন অপদার্থ ফার্রুখশিয়ার তাঁর মাত্র ছয় বছরের রাজত্বকালের মধ্যেই (১৭১৩-১৭১৯)। বাদশার কুঁচকিতে অসহ্য ব্যথা সারিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডাক্তার উইলিয়াম হ্যামিলটন কোম্পানির জন্য এক অভূতপূর্ব সুবিধা আদায় করে নিয়েছিলেন। ১৭১৭ সালে বাদশা এক ফরমানে ব্রিটিশ কোম্পানিকে আরও পাঁচ রকম সুবিধার সঙ্গে দিয়ে দিলেন সারা মুঘল সাম্রাজ্য জুড়ে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার, বিনিময়ে কোম্পানি বছরে তিন হাজার টাকা দিলেই চলবে। এই ব্যবস্থাটা বাস্তবায়িত করতে ব্রিটিশ কোম্পানির বেনেদের দেওয়া হলো ‘দস্তক’, পাশ। সেই পাশ দেখিয়ে বিনা শুল্কে জলপথে ও স্থলপথে পণ্য আনা-নেওয়া করা যেত।
এই ফরমানের ফলে এই উপমহাদেশে বাণিজ্যের যেমন অভূতপূর্ব সুযোগ পেয়ে গেল ব্রিটিশরা, তেমনই, অন্যদিকে, স্থানীয় বণিকরা দেখল, বা রে, ওরা বিনা শুল্কে বাণিজ্য করবে, আমাদের দিতে হবে হরেক কিসিমের শুল্ক! কী দরকার? তার থেকে বরং ব্রিটিশ বনিয়াদের মোটা ঘুষ দিয়ে তাদের দেওয়া ‘দস্তক’ বেনামে কিনে নিলেই হয়। মালের সঙ্গে তো আর মালিক ছোটে না। পথের শুল্ক আদায়কারীরা পাশ দেখে, ছেড়ে দেয়, মাঝে সাঝেই পাশ থাকা সত্বেও মোটা ঘুষ নিয়ে। কাজেই গোটা রাজস্ব ব্যবস্থাটায় প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক ঘুষের উই লেগে গেল। ‘The edict of emperor Farrukhshiyar was to become the cornerstone of English commercial and political policy in India,’ জানাচ্ছেন বিশিষ্ট ইতিহাসকার কে.এন. চৌধুরী (The Cambridge Economic History of India. Vol I. Ed. Tapan Raychaudhuri, Irfan Habib. Orient Longman. P 394)। আবার এর পাশাপাশি ‘জাগিরদারি সঙ্কট’ মুঘল সাম্রাজ্যের রাজস্ব ব্যবস্থাকে ফোপরা করে ফেলছিল দ্রুত— যে মনসবদারদের জাগির দিয়ে মুঘল সরকার তাঁদের আদায় করা রাজস্বের একাংশ নিয়ে সরকারি সব খরচ চালাত, সেই মনসবদারদের সংখ্যা এত বেড়ে গিয়েছিল যে জাগির হিসেবে তাদের দেওয়ার মতো যথেষ্ট পরিমাণ ‘পাইবাকি’ জমিই আর ছিল না। একরত্তি জমি ভাগ করে চারজন মনসবদারকে দিলে যা হয়— রাজস্ব ফুটকড়াই, নিজেদের মধ্যে মারামারি রেষারেষি সর্বক্ষণ। কাজেই এক বিরাট বটগাছের ভেঙে পড়ার ধুলো-ঝড় চারপাশে দেখছিলেন মীর। মনে রাখতে হবে মীরের জীবদ্দশাতেই পলাশির যুদ্ধ। তখন মীরের বয়স ৩৫।
কিন্তু তার আগেই আরও দুটো ভয়ঙ্কর কাণ্ডের সাক্ষী থাকতে হয়েছে মীরকে। ১৭৩৯ সালে নাদির শাহের দিল্লি লুঠ। এবং ১৭৪৭ থেকে পরবর্তী ১০ বছর দফায় দফায় আহমদ শা আবদালি-র এই উপমহাদেশের ওপর হামলা। বাবর, আকবর, জাহাঙ্গির, শাহ জাহান, আলমগির ১৮৯ বছর ধরে যে বিত্তবান উন্নত হিন্দুস্তান গড়ে তুলেছিলেন, নিজের জিবন ধরে তার তিল তিল রক্তাক্ত ধ্বংস দেখে যেতে হয়েছে মীরকে।
আর সেই নিজের জীবনও ছিল না খুব সুখপ্রদ। শৈশবেই পিতৃহীন হয়ে তিনি মানুষ হতে থাকেন কোনও নিকটাত্মীয় নয় বাপের এক বন্ধু সয়ীদ আমানুল্লার বাড়িতে। মীরের যখন ১৪ বছর বয়স তখন তিনিও প্রয়াত হলেন। অর্থকষ্ট গ্রাস করল তাঁকে। তিন বছর পরে একেবারেই রুজি-রুটির ধান্দায় ছুটলেন দিল্লি। কারণ সেখানে তাঁকে এক আমির সমসাম উদ-দওলা দিনে এক টাকা বৃত্তি দিতে রাজি হয়েছিলেন। সেটা সেই অভিশপ্ত ১৭৩৯। দিল্লি পৌঁছে থিতু হয়ে বসেছেন কি বসেননি, নাদিরি হামলা। ভয়াবহ সেই লুঠের সময় মারা গেলেন সমসাম। দিল্লি ছারখার। মীর ফিরে এলেন আকবরাবাদ। কোনও সুরাহা হলো না। পরের বছরই ফের তাঁকে দিল্লি যেতে হলো, এবার বাস করতে লাগলেন খান-এ-আর্জু নামে নিজের এক দূর সম্পর্কের কাকার দাক্ষিণ্যে। নানা কারণে দু’ জনের মধ্যে কোনও দিন বনিবনা হয়নি।
মীরের অন্যতম তরজমাকার কে.সি. কান্ডা মৌলবি আব্দুল হকের ‘ইন্তেখাব-এ-কলাম-এ-মীর’ (মীরের নির্বাচিত কবিতা) থেকে উদ্ধৃতি তুলে জানাচ্ছেন এই বনিবনা না হওয়ার একটি কারণ হতে পারে সে সময় ‘কমর’ (যার অর্থ চাঁদ) বা চাঁদনি নামের কোনও নারীর প্রবল প্রেমে মীরের আচ্ছন্ন হওয়া। এবং মীরের আত্মজীবনী ‘জ়িক্র-এ-মীর’ অনুযায়ী এরই মধ্যে কোনও এক সময় তিনি সম্পূর্ণ উন্মদ হয়ে যান। ছ’ মাস তিনি এই অবস্থায় কাটান। এরপর ১৭৫৬ সালে মারা গেলেন খান-এ-আর্জু। দিল্লিতে মীরের জীবনযুদ্ধ কঠোরতর হলো। তবু কিছুতেই সেই ক্রমভঙ্গুর দিল্লি ছেড়ে যেতে পারেননি তিনি। কী ভাবে এই সময় তাঁর দিন গুজরান চলছিল তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়।
তাঁর জীবনের একটা বড়ো মোড় এল ১৭৮২ সালে। লখনওয়ের নবাব আসফ উদ-দওলা তাঁকে নিজের সভাকবি হিসেবে সে শহরে আসতে আহ্বান জানালেন। অনেক দোনোমোনো-র পর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে লখনও গেলেন তিনি। ১৮১০ সালে মারা গেলেন সেখানেই। কিন্তু মহম্মদ সাদিক জানাচ্ছেন, লখনও-তে কোনও দিন মানিয়ে নিতে পারেননি তিনি, পুড়ে যাওয়া দিল্লির জন্য তাঁর হৃদয় সারাক্ষণ জ্বলত। তদুপরি ততো দিনে তিনি হয়ে উঠেছেন তিক্ত মেজাজের। সওদা ও নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে কবি পদবাচ্য মনে করতেন না। আর তেলে বেগুনে জ্বলে যেতেন, আমির ওমরা নবাব সুলতানদের কবিতা-কবিতা খেলা দেখলে। কথিত আছে, একদিন সপারিষদ বাগানে বসে জলাশয়ে পোষা মাছেদের জলকেলি দেখছেন নবাব আসফ। যেমনটা দস্তুর, সভাকবি মীরের এত্তেলা হলো, কিছু কবিতা শোনান জনাব। মীর শুরু করলেন। এ দিকে নবাবের দিল-ও-দিমাঘ তো তখন সরোবরের মীনক্রিড়ায়। সহসা খাতা বন্ধ করে মীর সেখান থেকে পয়গম করলেন। নবাবি জমানায় এ কল্পনা করাও কঠিন। কিন্তু এ কাহিনি আমি তাঁর একাধিক জীবনীতে পেয়েছি। আশ্চর্যের বিষয় মীরের চাকরিটি কিন্তু যায়নি।
এ হেন কবির কেমন কবিতা। স্পষ্ট, নির্মেদ, কথোপকথন বা স্বগতোক্তি (ব্রাউনিংয়ের ড্রামাটিক মনোলোগ মনে আসা অস্বাভাবিক না। আমরা পরে দেখব, এও উর্দু কবিতার এক স্বকীয় চিহ্ন) এবং হাহাকারের তীব্র উদ্যাপনে ভরা। এমনকী ধারাল কৌতুকেও মর্মান্তিক—
ইশ্ক্ মে অ্যায় হামরিহাঁ কুছ তো কিয়া চাহিয়ে
গিরিয়া-ও-শোর-ও-ফুগাঁ কুছ তো কিয়া চাহিয়ে।।
প্রেম করেছো, হে চিরসাথি, কিছু তো একটা করা দরকার
ডুকরিয়ে কাঁদো, বুক চাপড়াও কিছু তো একটা করা দরকার।।
হাথ পর রাখে হাথ ব্যয়ঠে হো কেয়া বেখবর
চলনে কো হ্যায় কারোয়াঁ কুছ তো কিয়া চাহিয়ে।।
হাতের ওপর হাতটি রেখে বসে আছো কী উদাসীন
রওনা হবে যে কাফেলা এবার, কিছু তো একটা করা দরকার।।
ম্যায় যো কাহা তঙ্গ্ হুঁ, মার মরুঁ, কেয়া করুঁ
উয়ো ভি লগা কহনে, হাঁ, কুছ তো কিয়া চাহিয়ে।।
বললাম আমি— আর পারি না, মরেই যাই, কী আর করি
বলল সেও, তা তো বটেই, কিছু তো একটা করা দরকার।।
কেয়া করুঁ, দিল খুঁ করুঁ, শোর হি মৌজু করুঁ
চলতি হ্যায় যব তক জ়ুবাঁ কুছ তো কিয়া চাহিয়ে।।
কী আর করি, রক্তারক্তি এ প্রাণ করি, কিবং তুলি হাল্লাবোল
যতক্ষণ চলবে জিভ, কিছু তো একটা করা দরকার।।
ইয়ে তো নেহি দোস্তি হামসে যো তুমকো হ্যায়
পাশ দিল-এ-দোস্তাঁ কুছ তো কিয়া চাহিয়ে।।
তোমার সঙ্গে যা আছে আমার সখ্য তো নয় তা
সখার হৃদয় টুকরো করতে কিছু তো একটা করা দরকার।।
মীর নেহি পীর তুম কাহেলি আল্লাহ্-রে
নাম-এ-খুদা হো জওয়াঁ, কুছ তো কিয়া চাহিয়ে।।
মীর বৃদ্ধ তো নও তুমি মোটেই, আল্লা-আল্লা এত কিসের
খোদা-সাক্ষি দিব্যি যুবক, কিছু তো একটা করা দরকার।।
ওহ্! একটাই শব্দ মনে পড়ে — সাবাশ। কী নির্ভার। আরব-পারস্য মুক্ত কী খাঁটি ভারতীয় মাটির গন্ধ। আর মাঝে মাঝে ঝলসে ওঠা সেই উদ্যাপন। এক্কেবার প্রথম শের থেকেই — প্রেমের কবিতা লেখার অজুহাতে ইনিয়ে বিনিয়ে প্যানপ্যানানি-র পশ্চাদ্দেশে এমন চাবুক আমি তো আর কবিতায় মনে করতে পারি না। আবার পরেই দেখি, কিসের ভাব-ভালোবাসা, যদি টুকরো টুকরোই না হবে প্রাণ! কীংবা আরও হাস্যকৌতুকের মখমলে মোড়া — ‘সেও বলল, তা তো বটেই, কিছু তো একটা করা দরকার’। কিংবা সেই উচ্চারণ, ‘যতক্ষণ চলবে জিভ…’ যা থেকেই হয়তো — হয়তো, কোনও প্রমাণ আমি অন্তত পাইনি — গজিয়ে উঠবে সেই বিখ্যাত ‘বোল্ কে লব আজ়াদ হ্যায় তেরে!’
এমনই সব উচ্চারণ ছেনে, কখনও পরিশ্রুত করে, কখনও খনন করে, কখনও বা সরাসরি আহোরণ করে ভীষণ এক ধর্মান্ধ অত্যাচারী জমানায় এক অতি মিতবাক মৃদুভাষী হিমালয়প্রতিম মানুষ গড়ে তুলছিলেন নিজের কবিতা। আরও একবার তাঁর কণ্ঠ শুনি —
তোমার স্মৃতির ক্ষত সেরে ওঠে যেই
তোমায় মনে করার কোনও না কোনও ছুঁতো খুঁজে নিই।।
প্রিয়াতমাকথাপাঠ শিরোনামে উদ্ভাসিত যেই
প্রসাধনে চুলবাঁধা শুরু হয় ঘরে ঘরে সেই।।
অচেনা অপরিচিত, তবু মনে হয় কতো না কাছের সকলেই
তোমার গলরি পথে আজও আমি হেঁটে চলি যেই।।
ভোরের বাতাসকেই নির্বাসিত স্বদেশের খবর শুধায়
উপচিয়ে ভোরের দুচোখ শুধু জল ঝরে যায়।।
যতই সে লেগে পড়ে সেলাই ফুঁড়তে দুই ঠোঁটে
আকাশ-বাতাস জুড়ে ততোই যে ঝলমলে সুর বেজে ওঠে
সিলমোহর অন্ধকারের পড়ে কারার গরাদ-দরোজায়
ফয়েজ় হৃদয় জুড়ে একে একে তারা ভরে যায়।।
(তোমার স্মৃতির ক্ষত। মূল গজ়ল ‘তুমহারে ইয়াদকে যব জ়খ্ম ভরনে লগতে হ্যায়ঁ’। ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়। দস্ত-এ-সবা। নুসখাহা-এ-বফা, এজুকেশনাল পাবলিশিং হাউস, দিল্লি, ১৯৮৬। পৃ ১৩৩।)
(ক্রমশ)
এই লেখাটি পড়ার জন্য আগ্রহভরে অপেক্ষা করি। ভারী ভাল লাগছে পড়তে। লেখক নীলাঞ্জন হাজরাকে অকুণ্ঠ সাধুবাদ জানাই।
এক নিঃশ্বাসে পড়া হয়ে যায়, তবু এই পর্বটি ঠিকঠাক হৃদয়ঙ্গম করতে হলে বেশ কয়েকবার লেখাটির ভেতর দিয়ে যাওয়া জরুরি। কবিতা, গান, ইতিহাসের অপূর্ব বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ এই পর্বটি এই সিরিজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ।