হান কাং-এর ‘ দ্য হোয়াইট বুক’-এর দশটি অনুচ্ছেদ
অনুবাদ- বেবী সাউ
হান কাং : হান কাং (জন্ম নভেম্বর ২৭, ১৯৭০) একজন দক্ষিণ কোরিয়ান লেখক। তিনি তাঁর 'দ্য ভেজিটেরিয়ান' উপন্যাসের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত, যেটি একজন মহিলার মানসিক অসুস্থতা এবং তার পরিবারের অবহেলার শিকার। ২০১৬ সালে, উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ, এটি ছিল প্রথম কোরিয়ান ভাষার উপন্যাস যা কল্পকাহিনীর জন্য আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার জিতেছিল। ১৯৯৩ সালে প্রথম ‘উইন্টার ইন সিওল’ সহ পাঁচটি কবিতা প্রকাশিত হয় তাঁর । মুনহাক-গুয়া-সাহো (লিটারেচার অ্যান্ড সোসাইটি)-এর শীতকালীন ইস্যুতে ছাপা হয়েছিল সেই কবিতা। পরের বছর ১৯৯৪ সালে ঔপন্যাসিক হিসাবে হাতেখড়ি হয় হানের। ১৯৯৫ সালে তাঁর প্রথম ছোটগল্প সঙ্কলন ‘ইয়োসু’ প্রকাশিত হয়। এর পর ‘ফ্রুটস অফ মাই ওম্যান’ (২০০০), ‘স্যালাম্যান্ডার’ (২০১২)-এর মতো ছোট গল্প সঙ্কলন প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। প্রকাশিত হয়েছে ‘ব্ল্যাক ডিয়ার’ (১৯৯৮), ‘ইওর কোল্ড হ্যান্ডস’ (২০০২), ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ (২০০৭) ‘ব্রিদ ফাইটিং’ (২০১০), দ্য হোয়াট বুক(2016), ডোন্ট সে গুডবাই(2021) প্রভৃতি। তিনি ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’-এর জন্য ২০১৬ সালে বুকার পুরস্কার পেয়েছিলেন । তাঁর সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘আই ডু নট বিড ফেয়ারওয়েল’-এর জন্য ২০২৩ সালে ফ্রান্সে মেডিসিস পুরস্কার পেয়েছেন। দ্য ভেজিটেরিয়ান' তাঁর ইংরাজিতে অনুবাদ করা প্রথম উপন্যাস । বাংলাতেও অনূদিত হয়েছে এই উপন্যাসটি। ২০২৪ সালে, হান প্রথম কোরিয়ান লেখক এবং প্রথম এশীয় মহিলা যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। নিচের রচনাগুলো তাঁর 'দ্য হোয়াইট বুক' থেকে নেওয়া হয়েছে।
বুকের দুধ
বাইশ বছর বয়সী একজন মহিলা একা শুয়ে আছেন ঘরে। শনিবার সকাল। এখনও ঘাসে লেগে আছে প্রথম শিশির। তাঁর পঁচিশ বছর বয়সী স্বামী একটি কোদাল নিয়ে পাহাড়ের উপরে গেছেন, গতকাল জন্ম নেওয়া শিশুটিকে কবর দেওয়ার জন্য। মহিলার ফোলা চোখ ঠিকমতো খুলছে না। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা, হাঁটুগুলো ফুলে উঠেছে। এবং তখনই, প্রথমবারের মতো, তিনি উষ্ণতার বন্যা অনুভব করেন তাঁর বুকে। তিনি উঠে বসেন, অনভ্যস্ত হাতে স্তন চেপে ধরেন। প্রথমে একটি জলীয়, হলুদ ট্রিকল, তারপর মসৃণ সাদা দুধ।
সে
তার বেঁচে থাকার কথা ভাবি, সেই দুধ খেয়ে।
আমি একগুঁয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের কথা ভাবি, স্তনের বোঁটায় ছোট ছোট ঠোঁটের কথা ভাবি।
ভাবি তার দুধ ছাড়ানো এবং তারপরে ঝোলে-ভাতে বেড়ে ওঠা, বড় হওয়া, একজন নারী হয়ে ওঠা, একেকটি সংকটের মধ্যে দিয়ে।
প্রতিবার আমি সেই মৃত্যুর কথা ভাবি, সে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যায় যখন তার পিঠের পেছনে মৃত্যুকে নিয়ে।
মরো না। ঈশ্বরের দিব্যি, মরো না।
কারণ এই শব্দগুলোই এরকম, তার শরীরে একটি তাবিজের মতো।
এবং মনেহয়, আমার পরিবর্তে এখানে এসেছে সে।
এই কৌতুকময় শহরের কাছে, যার মৃত্যু এবং জীবন তার নিজেরই।
মোমবাতি
আমি তাকে কল্পনা করি, সে এই শহরের রাস্তায় হাঁটছে। মোড়ে, লাল ইটের দেয়ালের একটি অংশ দেখতে পায় সে। পুনঃনির্মিত করা হচ্ছে এমন একটি বাড়ি, প্রাচীরটি ভেঙে ফেলা হয়েছে তার, সামনে বসানো হয়েছে মাপজোকের জন্য একটা যন্ত্র। একটা ছোট এপিটাফও ছিল সেখানে, যেখানে লেখা ছিল, জার্মান সেনাবাহিনী বেসামরিক লোকেদের একটা লাইন তৈরি করেছিল এখানে এবং গুলি করে মেরে ফেলেছে তাদের। কেউ সেখানে একটা ফুলদানি রেখে গেছে। এবং কয়েকটি সাদা মোমবাতি দোলাচ্ছে তাদের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিমুকুট।
ভোরের মতো না হলেও, কুয়াশা-স্তবক এখনও ঢেকে রেখেছে শহরকে, যদিও ট্রেসিং পেপারের মতো স্বচ্ছ কিছুটা। যদি একটি প্রবল বাতাস এসে সমস্ত কুয়াশাকে সরিয়ে ফেলত, তবে সত্তর বছর আগের ধ্বংসাবশেষগুলি বর্তমান পুনর্গঠনের আড়ালে থেকে নিজেকে দেখে করে চমকে উঠত। সেখানে যে ভূতগুলি একত্র হয়েছিল, তার খুব কাছে, তাদেরকে যে দেয়ালের কাছে খুন করা হয়েছিল,তার বিরুদ্ধে খাড়া হয়ে দাঁড়াবে। তাদের চোখগুলো জ্বলে উঠবে।
কিন্তু এখানে এমন কোন বাতাস নেই। এবং আপাতত বাইরে কিছুই প্রকাশিত করা যাবেও না। উষ্ণ সাদা মোমবাতি জ্বলতে জ্বলতে নীচে নেমে ছাই হয়ে যাচ্ছে। এবার নিজেরা ভক্ষণ করুন সাদা ছাইয়ের শিখা, স্টাবগুলি ধীরে ধীরে নীচে নেমে যাচ্ছে, অস্তিত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে।
এখন আমি তোমাকে একটা সাদা জিনিস দেব,
সাদা হলো সাদাই, যদিও এই সাদাও কালো হয়ে যেতে পারে;
শুধু সাদা জিনিসই দেব, আমি তোমাকে।
কোনো প্রশ্ন করবো না আর আমি
এই জীবন তোমাকে দিতে হবে কি না।
সাদা কাপড়ের থান
নবজাত শিশুর চারপাশে বরফ কুচির মতো সাদা কাপড়। গর্ভ থেকে বেরোলে যেমনভাবে তাকে নার্স মুড়ে দেয় কাপড়ে শক্ত করে, যাতে আকস্মিক অভিক্ষেপণে ধাক্কা খেয়ে অসীমতার দিকে না নিয়ে যায়।
ব্যক্তি যখন প্রথম শ্বাস নিতে শুরু করে, ফুসফুস ভরে। সে ব্যক্তি জানে না এরা কারা, কোথা থেকে এসেছে এবং কী শুরু হল। সমস্ত অল্প বয়স্ক প্রাণীর মধ্যে সবচেয়ে অসহায়, এমনকি একটি নবজাত মুরগীর বাচ্চার চেয়েও সে প্রতিরক্ষাহীন।
নারীটি, রক্তক্ষরণে ফ্যাকাশে, কাঁদতে থাকা শিশুটির দিকে তাকায়। হতবাক হয়ে, সে তার কাপড়ে মোড়া শরীরটিকে নিজের কোলে নেয়। কীভাবে থামবে এই কান্না সে জানে না তখনও। কেমন ছিল সে, অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে। অপ্রত্যাশিতভাবে শিশুটি কান্না থামায়। অচেনা একটা গন্ধের জন্য হতে পারে। কিংবা সে তাকিয়ে আছে অচেনা দুটো কালো চোখ এবং কন্ঠস্বরের নারীটির মুখের দিকে। জানি না, এটা এমন কোন মুহূর্ত, যেখানে দু’জন জুড়ে যাচ্ছে। নীরবতার মুহূর্ত প্রবাহিত হচ্ছে রক্ত-গন্ধে। যখন দু’টি শরীরের মাঝখানে শুয়ে আছে সাদা কাপড়ের থান।
চাঁদের মতো চালের পিঠা
গত বসন্তে, কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল যে আমার “একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা, যখন আপনি ছোট ছিলেন, যা আপনাকে দুঃখের কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল।” একটি রেডিও সাক্ষাৎকারের জন্য।
সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে, এই মৃত্যুই আমার কাছে এসেছিল। এটা একটা গল্প যেটা শুনে আমি বড় হয়েছিলাম। সমস্ত ছোট জীব জন্তুর মধ্যে সবচেয়ে অসহায়, সুন্দর ছোট বাচ্চা, চাঁদের আকৃতির চালের পিঠার মতো সাদা। সেই মৃত্যুর মধ্য থেকে আমি কীভাবে জন্মগ্রহণ করেছি এবং বেড়ে উঠছি।
“চাঁদ-আকৃতির চালের কেকের মতো সাদা” তখনও আমি বুঝতে পারি নি, যখন আমার বয়েস ছ’বছর। যদিও ছ’বছর যথেষ্ট ছিল, চুসেওকের জন্য রাইস কেক বানানোর পক্ষে। আমি লেই কেটে অর্ধচন্দ্র আকার দিচ্ছিলাম। সেদ্ধ করার আগে বোঝাই যায় না এরা এতটাই অপার্থিব হয়ে উঠবে। শুধু তখনই, প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে আশ্চর্যজনক এক হতাশার ভেতর চলে যায় সেগুলো। তিলের তেলে ভাজা, তাদের রং এবং গঠন, তাপ ও ভাপে তৈরি হয়েছিল এবং পাল্টে গেছিল। সুস্বাদুও ছিল। কিন্তু অতটা সুন্দর নয়।
তাই যখন আমার মা বললেন “চালের পিঠার মতো সাদা,” আমি বুঝতে পারলাম, তিনি সেদ্ধ করার আগে চালের পিঠাটিকে বোঝাতে চেয়েছিলেন। চমকে দেওয়া মুখ, আদিমতম। এই ভাবনা চিন্তা আমার বুককে শক্ত করে তুলল, লোহার মতো ভারী।
গত বসন্তে, রেকর্ডিং স্টুডিওতে, আমি এর কোনও উল্লেখ করিনি। পরিবর্তে, আমি আমার পোষা কুকুরের কথা বলেছিলাম, যেটি আমার পাঁচ বছর বয়সে মারা গিয়েছিল। সে একটি অস্বাভাবিকরকম বুদ্ধিমান কুকুর ছিল। আমি বলেছিলাম, একটি মঙ্গল, কিন্তু বিখ্যাত জিন্দো জাত থেকে এসেছে। আমার কাছে এখনও আমাদের দু’জনের একটি সাদা-কালো ছবি আছে। একটি অন্তরঙ্গ মুহূর্তের একটি সুন্দর ফটো। কিন্তু, আশ্চর্যজনকভাবে, আমি তাকে জীবিত মনে করতে পারছি না। একটিই প্রাণবন্ত স্মৃতিই আছে আমার কাছে, সেই সকালের যখন সে মারা যায়। সাদা পশম, কালো চোখ, স্থির-স্যাঁতসেঁতে নাক। তখন থেকে কুকুরের প্রতি আমার একটা ঘৃণা তৈরি হয়েছে, যা আজ পর্যন্ত অব্যাহত। নরম পশমের কাছে পৌঁছানোর পরিবর্তে, আমার হাত আমার কাছেই আটকে থাকে।
ডানা
শহরের উপকণ্ঠেই সে প্রজাপতিটিকে দেখেছিল। নভেম্বরের এক সকালে, একটি একলা সাদা প্রজাপতি, ডানা দুটো ভাঁজ করা। গ্রীষ্মকাল থেকে কোন প্রজাপতি দেখা যায়নি; এটি কোথায় লুকিয়ে ছিল? আগের সপ্তাহে আবহাওয়ার তাপমাত্রা অনেকটা কমে গিয়েছিল, এবং সম্ভবত এর ডানা বারবার জমে যাওয়ার কারণে সেখান থেকে সাদা রং হারিয়ে গেছে এবং কিছু অংশ হয়ে গেছে স্পষ্ট । এতটাই স্পষ্ট যে কালো পৃথিবীর প্রতিবিম্ব সেখানে চকচক করে। এখন আরও কিছুটা সময় দরকার যেখান থেকে ডানা থেকে সাদা রং পুরোপুরি মুছে যাবে। ডানা তখন অন্য কিছু হবে, ডানা না এবং প্রজাপতি এমন কিছু হবে যাবে, যা প্রজাপতি নয় ।
অন্ধকারে কিছু বস্তু
কিছু বস্তু অন্ধকারেও সাদা দেখায়।
যখন অন্ধকারে, এমন কোনো ক্ষীণ আলো এসে পড়ে, তখন ওই বস্তুগুলো যেগুলো সাদা নয়, ধোঁয়াশার মতো সাদা রঙের মনে হয় তাদেরও। রাতে, আমি বসার ঘরে কোণের সোফায় বিছানা পেতে ওই হালকা আলোয় শুয়ে থাকি। ঘুমানোর চেষ্টা করার পরিবর্তে, আমি অপেক্ষা করি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার ইন্দ্রিয়গুলিকে অনুভব করার। জানলার বাইরের গাছগুলো সাদা প্লাস্টারের দেয়ালে ছায়া ফেলে। আমি সেই ব্যক্তিটির সম্পর্কে চিন্তা করি, যিনি এই শহরের মতো, তার চেহারার সঙ্গে মিলাই। তার চেহারা আর ভাবগুলোকে একত্রিত হওয়ার অপেক্ষা করি, যাতে আমি অভিব্যক্তিগুলো পড়তে পারি।
নিঃশ্বাসের মেঘ
ঠান্ডা সকালে, শ্বাসের সেই প্রথম সাদা মেঘটি প্রমাণ করল যে আমরা জীবিত আছি। আমাদের শরীরের উষ্ণতা তার প্রমাণ। ঠাণ্ডা বাতাস অন্ধকার ফুসফুসে ছুটে যায়। ভিজিয়ে দেয় শরীরের উষ্ণতাকে এবং ধূসর সাদা রং ধারণ করে নিঃশ্বাস ছাড়ে। আমাদের জীবনের অলৌকিক এই প্রসারণ শুধুমাত্র ওই শূন্য বাতাসে।
রুমাল
গ্রীষ্মের শেষে, এক বিকেলে তিনি যখন নির্জন টেনমেন্ট ভবনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন, এটি দেখেছিলেন; দোতলায় এক মহিলা বারান্দার রেলিং-এর ওপর তার কাচা কাপড়গুলো ঝুলছিল, ঠিক তখনই কয়েকটি জিনিস পড়ে যায়। এটি একটি একলা রুমাল, সব থেকে ধীরে ধীরে, মাটির বুকে ভেসে গেল। অর্ধেক ডানা ঝোলানো পাখি যেন। একটি আত্মা কিছুক্ষণের মধ্যে যেমন ঝরে পড়ে।
তুষারপাত
তার যেদিন জন্ম হয়, সে দিনটি ছিল তুষারপাতের চেয়েও ঠাণ্ডা। তবুও মা-বাবা নাম রেখেছিলেন সিওল, তুষারকেই বেছে নিয়েছিলেন তাঁরা। বড় হয়ে, সে তুষারের প্রতি ছিল অসম্ভব সংবেদনশীল। এবং তার নাম ঠাণ্ডাকেও লজ্জা দিত।
কিন্তু সে হিম-আচ্ছাদিত মাটি দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে অর্ধশীতল পৃথিবীকে অনুভব করতে ভালোবাসত। প্রথম তুষারপাত, যা এখনো শুরু হয় নি, বিশুদ্ধ লবণ-স্ফটিকের মতো সূক্ষ্ম। তুষারপাত শুরু হওয়ায় সূর্যের আলো কিছুটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। উষ্ণ মুখগুলো থেকে বেরিয়ে আসে নিঃশ্বাসের সাদা মেঘ। গাছগুলো তাদের পাতা ঝেড়ে ফেলে, ক্রমশ হালকা করছে ভার। পাথর বা দালানের মতো কঠিন কিছু বস্তু গাঢ় হয়ে আছে। পেছন থেকে দেখা যায়, ভারী কোট পরিহিত পুরুষ ও মহিলারা নিঃশব্দ আলোচনায় মগ্ন। মানুষ এটাও সহ্য করতে শুরু করেছে।