Novel Part 5 and 6 সুবর্ণরেখার তীরে- সপ্তম ছন্দা বিশ্বাস
সপ্তম পর্ব
নতুন রাজ্য রাজধানী এবং নতুন প্রজাদের নিয়ে রাজা জগৎদেবের দিনগুলো ভালোই কাটছিল। একদিন তিনি পারিষদসহ ঘুরতে ঘুরতে সুবর্ণরেখার তীরে এসে দাঁড়ালেন। অদূরে দেখতে পেলেন এক জায়গা থেকে কুন্ডলীকৃত ধোঁয়া উঠছে। তিনি এর কারণ জানতে চাইলেন। জানতে পারেন এই অঞ্চলে তামার খনি আছে। আদিবাসী মানুষগুলো আকরিক থেকে বিশুদ্ধ তামা প্রস্তুত করছে আর সেই বিশুদ্ধ তামা গলিয়ে নানা জিনিস তৈরী করছে।
জগৎদেব খুশি হলেন। আগেই জেনেছিলেন এই অঞ্চল নানা প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে পূর্ণ। একটু একটু করে তার পরিচয় পেতে শুরু করেছেন আর মুগ্ধ হচ্ছেন। এমনি একদিন পেলেন স্বর্ণরেণুর খোঁজ। আদিবাসী মানুষ নদীর বালি থেকে কীভাবে সোনার কণা আহরণ করছে সেটাও লক্ষ্য করলেন। কত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আসছে এই সোনা কিনতে। তামার গহনা কিনতে। সোমনাথ গুজরাট নিবাসী একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। সে শুনেছে ধলভূম- মানভূমের কথা। তাই সে ঘুরতে ঘুরতে একদিন উপস্থিত হল এই জঙ্গল মহলে।
গুজরাট থেকে আগত সেই যুবকের সঙ্গে পরিচয় হল মেঘমালার। সে জানতে পারল যুবক নিতান্ত একজন ব্যবসায়ী। সে খুব ভাল চিত্রকরও। ছবি আঁকা তার নেশা।
মেঘমালার ইচ্ছা হল এই যুবকের সঙ্গে যদি রাজকন্যা চিত্রলেখার পরিচয় করে দিতে পারত। প্রিয় সখীর একখানি ছবি যদি তাকে দিয়ে আঁকিয়ে নিতে পারত।
তামার খনির খোঁজঃ
তেরো
একদিন বিকেলের দিকে সুবর্ণরেখার শিলাময় ঘাটে এসে দাঁড়ালেন জগৎদেব। তাঁর সঙ্গে আছেন আরো কয়েকজন। তিনি দূরে তাকিয়ে দেখলেন গল গল করে ধোঁয়া উঠছে। আর সেই ধোঁয়া উঠে মেঘের সঙ্গে মিলিয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছু সময় ধরে তিনি এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করছেন।
মন্ত্রীকে বল্লেন, কী ব্যাপার বলুন তো মন্ত্রী মশায়? ওইদিকে অমন ধূম উদ্গীরণের হেতু কী?
মন্ত্রী তাকালেন নগরপালের দিকে। নগরপাল বল্লেন, মহারাজ, বলেছিলাম না, এই অঞ্চলে তাম্র আকরিক পাওয়া যায়।
তাম্র আকরিক তো পাওয়া যায় তামার খনিতে?
ঠিকই, ওই দিকে তামার খনি আছে। মৌ ভান্ডার জায়গাটার নাম। সেই খনি থেকে এখানকার মানুষেরা তামার আকরিক সংগ্রহ করে এবং পরে সেগুলো তাপ প্রয়োগে শুদ্ধি করণ করা হয়। অন্যান্য ধাতু বিগলিত হয়ে বেরিয়ে গেলে বিশুদ্ধ তামা পাওয়া যায়।
তাই নাকি? বিশুদ্ধ তামা? সে তো খুবই মূল্যবান ধাতু। আর তামার গলন সে তো যথেষ্ট কষ্টসাধ্য কাজ।
কষ্ট সাধ্য তো বটেই।
কারা নিযুক্ত আছে জানেন কিছু?
এই দুঃসাধ্য কর্মে লিপ্ত আছে এখানকার ভূমিজ সম্প্রদায়ের মানুষ। খুবই কর্মঠ তারা। নদীর বালি থেকে যারা সোনার রেণু আহরণ করে তাদের অনেকেই আবার এই কাজে নিযুক্ত আছে। মাটি খুঁড়ে, পাহাড়ের গা থেকে পাথর খন্ড গুড়িয়ে আকরিক তামা সং গ্রহ করে আনে এখানকার মানুষেরাই। যুগ যুগ ধরে তো তারাই এই সব কাজ করে আসছে। আগে নিজেরাই বিভিন্ন ধাতু থেকে তামা নিষ্কাশন করে বিভিন্ন ধরণের জিনিস বানাতেন। পরে এগুলো বেনিয়াদের কাছে বিক্রী করে দিতেন। চতুর বেনিয়ারা এই সব অশিক্ষিত গরীব মানুষদের ঠকাতে লাগল।
জগৎদেব বললেন, ওটা কি আমাদের জঙ্গল মহলের ভিতরে পড়ে?
এ অঞ্চল সবই তো জংগল মহলের অধীনস্থ মহারাজ। কিন্তু,-
আবার কিন্তু কি? ওই অঞ্চল একটা সময়ে মুসলমান নবাবের নজরে পড়ে যায়। এখন যেমন দিল্লীর সুলতানের নজরে আছে।
মন্ত্রী ভারী গলায় বললেন।
দিল্লীর সুলতানের হাত এতোদূর বিস্তৃত হয়েছে?
চিন্তিত কন্ঠে বললেন, এদিকেও তাহলেও তার দৃষ্টি পড়েছে? দিল্লীর সুলতানের শ্যেণ নজর এতদূর অবধি প্রসারিত হয়েছে। এদিকের ধন সম্পদের সংবাদ পর্যন্ত তাঁর কর্ণগোচর হয়েছে বলছেন?
শেষের কতাহগুলোতে মহারাজ জগৎদেবের গলায় গভীর উদবেগ আর সংশয় প্রকাশ পেল।
তা আর বলছি কি মহারাজ।
আলাউদ্দিনের লোলুপতার কথা তো কারো অজানা নয়। জগৎদেব নিজেও তো ভুক্তভুগী। আগ্রাসী ক্ষুধার কারণে কত রাজা তাদের রাজ্য হারালেন, একের পর এক হিন্দু রাষ্ট্র মুসলমানদের হাতে চলে যাচ্ছে। বল পূর্বক সেখানকার মানষুগুলোকে হিন্দু থেকে মুসলিম ধর্মে দীক্ষিত করা হচ্ছে। রাজ মহিষীদের বল পূর্বক ধরে এনে তাদেরকে হারেমে রেখে দিচ্ছে। রক্ষিতা, দাসী- বাদী বানিয়ে নিচ্ছে এরপরে। আলাউদ্দিনের যখন যে রাজ্যের উপরে দৃষ্টি পড়ে তখন যতক্ষণ না পর্যন্ত সেই জায়গা তিনি গ্রাস করতে না পারছেন ততক্ষণ তার আহার নিদ্রা ছুটে যায়। একটাই নিশানা তখন যে করেই হোক সেই রাজ্য তার চাই। চাই সেখানকার সুন্দরী মহিষীকে। একেবারে নিজের করে পাওয়ার জন্যে তিনি বাজপাখির মতো উন্মুখ হয়ে থাকেন। শিকার কিছুতেই যেন হাত ছাড়া না হয়।
কোথায় একটু স্বচ্ছন্দ্যে বাস করবেন তা হবার নয়। তবে তামা নিষ্কাশনের ব্যাপারটা মহারাজের বেশ মনে ধরল। ইতিমধ্যে তিনি অবগত আছেন তামার তৈরী বহু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস বানানো হচ্ছে। বাসন পত্র ছাড়াও নানা ধরণের হাতিয়ার, মহিলাদের অলংকারসমূহ , রাজ রাজাদের গায়ের অলংকার, শিরস্ত্রাণ, বর্ম ইত্যাদি নানাবিধ জিনিস বানানোর জন্যে কারিগর আসছে সৌরাষ্ট্র থেকে।
এইসব জিনিস দেখতে যেমন চমৎকার তেমনি তাদের নিত্য ব্যবহার স্বাস্থ্য সম্মত।
মহারাজ পরেরদিন রাজসভায় এসে একজন অমাত্যকে বললেন, যুদ্ধের জন্যে বর্ম, হাতিয়ার, শিরস্ত্রাণ, বক্ষ জালিকা, ইত্যাদি যা যা উপকরণ লাগে সেগুলো বেশী বেশী করে প্রস্তুত করতে হবে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে ডেকে বুঝিয়ে দিলেন রাজ্যের প্রতিরক্ষা দিকে নজর দিন। সেনাপতিদের বললেন, স্থানীয় বলিষ্ঠ কর্মঠ যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সেনার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। রাজ্যকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে গেলে যেমন অর্থনৈতিক পরিকাঠাম দরকার তেমনি দরকার সেনা সংখ্যা বৃদ্ধি, যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সাজ সরঞ্জাম। হাতি, ঘোড়া, গাধা, খচ্চর এদের সংখ্যাও বাড়াতে হবে।
সৌদাস কোথায় যেন চুপটি করে বসে ছিল হঠাৎ পিছনের সারি থেকে মাথা তুলে বলল, মহারাজ পাশেই দলমা পাহাড়ে প্রচুর হাতি আছে। যদিও বুনো, তবে ওদের একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নিলে যুদ্ধের কাজে লাগতে পারে।
মহারাজ কিছু বলার আগেই পিছন দিক থেকে লম্ব কর্ণ হেসে উঠল ফিক করে।
মন্ত্রী মশায় ভ্রু কোচকালেন। এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সভায় আবার এরা কেন?
মহারাজ বললেন, সৌদাস তুমি ঠিকই বলেছ।
তিনি মহামন্ত্রীকে বললেন প্রতিহারীকে ডাকতে।
প্রতিহারী এলে মহারাজ বললেন আগামীকাল হস্তিপালককে আমার সঙ্গে দেখা করতে বোলো।
ঠিক আছে মহারাজ। আর শোনো, বুনো হাতি ধরে যারা তাদের খবর দাও।
ইতিমধ্যে মহারাজ জগৎদেব নতুন এক দুর্গ প্রস্তুত শুরু করে দিয়েছেন। পাহাড়ের বেশ কিছুটা উপরে জঙ্গল কেটে বানানো হচ্ছে সেই দুর্গ। রাজ সুরক্ষা বলে কথা। পাহাড়ের গা কেটে কেটে রাস্তা বানানো হচ্ছে। হাজার হাজার শ্রমিক খাটছে দিন রাত্রি। কেউ পাথর কেটে গো শকট বোঝাই করছে, কেউ পথ বানাচ্ছে, জঙ্গল কাটছে, রাজমিস্ত্রীরা দুর্গের প্রাকার গড়ছে, বিভিন্ন মহলের নকশা এঁকেছেন মান্ডুর একজন স্থপতিবিদ।
সেই দুর্গের বাইরে হাতিদের প্রশিক্ষণের জন্যে বড়সড় আস্তানা বানানো হল। পাদপাশিক জঙ্গল ঢূঁড়ে বুনোদের পায়ে পরিয়ে দিত দড়ির ফাঁস। তারপরে তাদের কিছুদিন না খাইয়ে রেখে একটু বল কমিয়ে আনা হত। তারপরে প্রশিক্ষিত কুনকি হাতি দের নিয়ে এসে বুনোদের শিক্ষা দেওয়া হতে লাগল।
মন্ত্রী পারিষদ বর্গ সকলেই জানে যুদ্ধে হাতি কতটা প্রয়োজন। মস্ত চেহারার প্রাণীটা দেখলেই সেনারা ভিরমি খায়। অন্য পশুরাও থমকে যায় অমন বলশালী জন্তুটাকে দেখলে।উন্মত্ত হস্তি বাহিনি যখন বিপক্ষের সেনাদলের দিকে তেড়ে যায় তখন তার সামনে দাঁড়ানোর সাহস থাকে না কারো।
মহারাজের নির্দেশ মতো প্রচুর অর্থ বরাদ্দ করা হল হাতিদের জন্যে। কবিরাজ, হাতিদের খাবার রান্নার জন্যে ‘বিধাপাচক’, স্নান, খাওয়া দাওয়া পরিচর্যার জন্যে নিযুক্ত করা হল ঔপচারিকদের। বিশাল উঁচু ঘর নির্মাণ করা হল হাতিদের থাকার জন্যে। দেখভালের জন্যে , জঙ্গল থেকে নদীর তীর থেকে সুন্দর ঘাস কেটে নিয়ে আসত ‘যাবসিকে’রা। ‘হস্তিপক’ সেই সব খাদ্য খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে তবে ছাড়পত্র পেত। ‘কুটিরক্ষ’ নিয়মিত লক্ষ্য রাখতে শুরু করল হাতিদের ঘরে যেন হাওয়া বাতাস খেলে, তাদের ঘর নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় কিনা, আলো বাতাস পর্যাপ্ত আছে কিনা যাতে তাদের শরীর স্বাস্থ্য ঠিক থাকে। ‘উপশায়িক’ আসত রাতের বেলায়। দেখে যেত হাতিদের শরীর ঠিক আছে কিনা।
হাতিদের খাবারে তালিকায় চাল, ডাল, ঘি, লবন, ছাড়াও দুধ, দই, মদ ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হল। হাতিদের ঘরের কোণে জ্বলত তেলের প্রদীপ, তাদের গায়ে মালিশের জন্যে ছিল আলাদা তেল।
এই ভাবে কিছু দম্য হাতিদের দিয়ে বুনো হাতিদের প্রশিক্ষন দিয়ে ‘সান্নাহ্য’ অর্থাৎ যুদ্ধের জন্যে শিক্ষিত করে তোলা হতে লাগল।
এর জন্যে রাজকোষ থেকে মহারাজা প্রচুর অর্থ মঞ্জুর করলেন।
চোদ্দ
স্বর্ণরেণুর খোঁজেঃ
সুবর্ণরেখার তীরে ওদের বাস। সকাল হলেই পুরুষ মহিলারা নেমে পড়ে নদীতে। সারাটারাত ধরে জলস্রোতের সঙ্গে বড় বড় পাথরখন্ড, বালি, কাঁকড় কত কিছু চলে আসে এসে পাড়ে জমা হয়। কিছু তলদেশে থিতিয়ে যায় কিছু পাথরের খাঁজে আটকা পড়ে।
নদী তীরের ভূমিজ মানুষেরা নদী থেকে পাথরখন্ড কুড়িয়ে পাড়ে জমা করে। তারপরে সেই পাথর খন্ড হাতুড়ি দিয়ে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে রাস্তা সারানোর কাজে লাগায়। কেউ কেউ বালি, পলি তুলে নিয়ে আসে তারপরে জল নিষ্কাশনের কাজ শুরু করে দেয়। আগে তারা স্বাধীন ছিল। কিন্তু এখন ঠিকাদারের অধীনে কাজ করতে হয়। এই নদী ভগবানের দান এতে তাদের অধিকার ছিল এতোদিন কিন্তু বেশ কয়েক বছর যাবৎ দেখতে পাচ্ছে এই নদীও নাকি রাজার অধীনস্ত। এরা শ্রমিকের ন্যায় মজুরি পাবে কাজের বিনিময়ে। মুন্ডা, সাঁওতাল, চিক বরাইক, হো ইত্যাদি আদিবাসীদের বাসভূমি এই সিংভূম অঞ্চল। এরা এখানকার জনগোষ্ঠী। এদের নিজস্ব একটা সংস্কৃতি আছে। নিজস্ব ভাষা। কিন্তু সেই ভাষার লিখিত রূপ নেই। তাই এরা লিপির পাঠ থেকে বঞ্চিত। স্থানীয় ভাষাতে কথা বলে। তবে হিন্দী জানে কিছু কিছু। কাজ করতে গেলে বাইরের মানুষদের কথাবার্তা চালাতে গেলে হিন্দী জানা দরকার তাই কেউ কেউ প্রয়োজনে শিখে নিয়েছে। আর জানে বাংলার প্রাচীন রূপ। মাগধী প্রাকৃতে কথা বলতে না পারলেও বুঝতে পারে। যীশু খৃস্টের জন্মের হাজার বছর আগে থেকেই ব্রাহ্মণ পুরোহিতেরা সংস্কৃত ভাষার চর্চা করতেন। এর পরে বৌদ্ধরা এলে তারা প্রাকৃত ভাষার প্রাচীন রূপ গ্রহণ করলেন তাদের কথা বলার মাধ্যম হিসাবে। এই ভাষা হল মাগধী প্রাকৃতের পূর্ব রূপ। এরপরে গুপ্ত যুগে মগধ হল বাংলার সংস্কৃতি শিক্ষার প্রাণ কেন্দ্র। সেই সময়ে সংস্কৃত মানুষের কথ্য ভাষাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করতে লাগল। প্রথম সহস্রাব্দে বাংলায় ইন্দো আর্য উপভাষাগুলি বাঙ্গলায় প্রভাবশালী ছিল। এইগুলিকে বলা হতো মাগধী প্রাকৃত। এই ভাষায় বিহার, বাংলা এবং আসামে কথিত হতো। কালক্রমে এই মাগধী প্রাকৃত থেকেই জন্ম নিল অর্ধ মাগধী প্রাকৃত।
প্রথম সহস্রাব্দের শেষের দিকে অর্ধ মাগধী থেকে অপভ্রংশের বিকাশ ঘটে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা তার নতুন রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করল।
এই উপন্যাসের কাহিনী বাংলা ভাষার সেই শৈশব কালের। ১০০০ থেকে ১২০০ সালের ভিতরে বাংলা সংস্কৃত এবং মাগধী প্রাকৃত থেকে ক্রমে বিকাশ লাভ করছে। প্রথমদিকে অপভ্রংশ থেকে অবহট্ট নামে অর্থহীন এক ভাষা জন্ম নিল। কালক্রমে সেই ভাষাই তিনটি ভাষাদল গঠন করল, বাঙ্গালা-অসমিয়া, বিহারী, উড়িয়া ভাষা হিসাবে প্রচলিত হলো। যেটা দাঁড়াল পালি প্রাকৃত- অপভ্রংশ -থেকে অবহট্ট তারপরে এলো প্রাচীনবাংলা ভাষা। এরা হল পূর্ব ইন্দো আর্য- বাংলা অসমিয়া তারপরে সেখান থেকে এল বাংলা ভাষা।
সোমদেব এখানকার মানুষের ভাষা বলতে না পারলেও বুঝতে পারত কিছু কিছু।
বাকিটা হাবে ভাবে বুঝে নিত।
গুজরাটে অবস্থান কালে শুনেছিল ভারতের এই জঙ্গল মহলের কথা। বনজ সম্পদ ছাড়াও রয়েছে অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ।
এখানকার নদীতে নাকি সোনা পাওয়া যায়। এই সোনার লোভে ছুটে আসে কত বণিক ধনী ব্যবসায়ীদের সাথে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও। তারা এখানকার মানুষগুলোর সঙ্গে হাত করে সোনা কিনে নিয়ে দেশে ফিরে যায়।
সম্ভতঃ এই সংবাদ পেয়ে সুদূর গুজরাট থেকে পাড়ি দিল সোমদেব আরো দুইজন ছোটো ব্যবসায়ীর সঙ্গে।
সোমদেব দেখল ওর যা সামান্য পুঁজি তা দিয়ে বড়ো কোনো ব্যবসা সম্ভব নয়। নিজেরই পেট চলে কোনোমতে সামনে বিয়ে থা করতে গেলে ধন উপার্জন দরকার। কিন্তু কীভাবে?
এইসব যখন চিন্তা করছিল তখনি একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সে লবনের ব্যবসা করে। এখান থেকে লবন, মোতি, হরেক রকমের পাথর নিয়ে যায় বঙ্গদেশে, পাটলীপুত্রে।
বঙ্গদেশ। পাটলিপুত্র, কলিংগ রাজ্যের নাম সে এই প্রথম শুনল। খুব আগ্রহ নিয়ে সে তাদের গল্প শুনতে লাগল। তাদের সঙ্গে আরো দুইজন এসে যোগ দিল। তাদের ভিতরে একজন এই স্বর্ণরেণু বহনকারী নদীর নাম শোনাল।
সোম আগ্রহ প্রকাশ করে বলল, আমি যাব তোমাদের সঙ্গে।
বেশ, তাহলে তো আমাদের পক্ষে ভালই হবে। তুমি শিক্ষিত জ্ঞানী মানুষ।
আমরা ছিলাম তিন জন তুমি যোগ দিলে হব চারজন। শুভ কাজে তিন জন যেতে নেই শুনেছি, যাক আর আমাদের যাত্রায় কোনোপ্রকার বাধা রইল না।
তারা ঠিক করল কাল বিলম্ব না করে পরেরদিন প্রত্যুষেই রওনা করবে।
কিছুটা পথ বৃষ শকটে, কিছু পথ হেঁটে কিছু পথ নৌকায় চেপে তারা অবশেষে এখানে উপস্থিত হল।
তৃতীয় ব্যক্তি ছিল দলের ভিতরে বয়ঃজ্যেষ্ঠ। তার অভিজ্ঞতাও তাই অন্যদের তুলনায় অনেক বেশী। তিনি
দলের অন্যদের বললনে, নতুন জায়গায় এসে ব্যবসা শুরু করতে গেলে কিছুদিন এখানে থেকে এখনাকার হালচাল সম্মন্ধে ওয়াকি বহাল হতে হবে। আমাদের কাছে টাকা পয়সা তো তেমন কিছুই নেই। আছে কিছু জিনিস পত্র। সেগুলো বিক্রি করে যা উপার্জন করব তাই দিয়েই তো কিনতে হবে।
সোমদেব বলল, ওর কাছে কিছু ময়ূরের পালক দিয়ে বানানো কিছু শৌখিণ জিনিস, কিছু পাথরের মনোহারী জিনিসপত্র আর কিছু হাতে বোনা বস্ত্র।
সেদিন ছিল হাটবার। পাহাড়ের নীচেয় হাট বসেছে। দূর দূর থেকে আদিবাসী লোকেরা আসছে হাটে। নানা পসরা সাজিয়ে বসেছে হাটুরেরা।
চার কোণে চারটি বাঁশের খুঁটির উপরে পাতার ছাউনি দেওয়া ঘর। তার নীচেয় সার দিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে বসেছে। চাল, ডাল, নানা রকম শাক-সব্জি, মশলা, তেল নুন হলুদ ছাড়াও মাছ, মাং বিক্রী হচ্ছে। এক দিকে সাজান আছে মেয়েদের সাজ গোজের জিনিসপত্র। রঙ্গিন ফিতে, রঙ্গিন মালা, জমকাল শাড়ি, কাপড়, করঞ্জী তেল, খোপার কাটা, ইত্যাদি নানা জিনিস। আদিবাসী মহিলারা ঘুরে ঘুরে জিনিসপত্র কিনছে। সোমদেব আর অন্য তিন জন তাদের জিনিস নিয়ে এক দিকে বসেছে। ভিন্ন ধরণের জিনিস দেখে কয়েকজন কিশোরী এগিয়ে গেল।
বিক্রেতাদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা বাপু দেখছি এ দেশের লোক নও।
সোম বলল, তাতে কি? জিনিস পছন্দ হলে নিয়ে যাও। কোন দেশের লোক সেটা দিয়ে কী দরকার শুনি?
যাই হোক দুই এক কথায় সোমের জিনিসগুলো বেশ ভালো দামে বিক্রী হয়ে গেল।
অন্যদের কাছে এখনো কিছু জিনিস আছে।
সোম সময় কাটাবার জন্যে একটা সাদা কাগজের উপরে কাঠ কয়লা দিয়ে হাতের চিত্র আঁকছিল।
ঠিক সেই সময়ে মেঘমালা হাটে এসেছিল।
ওর নজর গেল সোমদেবের দিকে।
এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। কী সুন্দর ছবি আঁকছে যুবক।
কী সুন্দর ছবি আঁকছে লোকটা!
এই গল্প সে রাজকন্যাকে বলবে।
মনে মনে ভাবল, ইস, এই লোকটাকে যদি কোনোমতে রাজ প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া যেত তাহলে রাজকন্যার সুন্দর একখনি ছবি সে এঁকে দিত।
কথাটা মনে হতেই সে সোমের দিকে এগিয়ে গেল।
সোম তখন নিবিষ্ট মনে হাটের চিত্রাংকণ করছে। একেবারে জীবন্ত ছবি।
মেঘমালা কিছুটা সাহস এনে বলল, আচ্ছা, তুমি কি আমাদের রাজকন্যার একখানা ছবি এঁকে দিতে পারো?
রাজকন্যা? এখানে রাজকন্যা এসেছেন বুঝি?
হি হি করে হেসে উঠল। মেঘমালা বলল, হায়রে, রাজকন্যা এসব জায়গায় কেন আসবেন। তিনি আছেন প্রাসাদে। আমি জানতে চাইছি তুমি কি পারবে তার ছবি আঁকতে?
যার ছবি আঁকব তাকে তো দেখতে হবে। আমি তো রাজকন্যাকে দেখিনি তাই কীভাবে তার ছবি আঁকা সম্ভব?
মেঘমালা মাথা নেড়ে বলল, তাই তো, আচ্ছা দেখি।-
সোম বলল, তুমি কি সামনের হাটবারে এদিকে আসবে?
যদি এই অঞ্চলে থাকি তো একবার আসতে পারি। কিন্তু কেন বলত?
যদি রাজকন্যার একখানা তসবির আনতে পারো তো আমি সেটা দেখে এঁকে দিতে পারি।
আচ্ছা দেখছি। আজ যাই কেমন,-
মেঘমালা সোমের কাছ বিদায় নিল ঠিকই কিন্তু সোমের মনে একটা প্রশ্ন চিহ্ন ঝুলিয়ে রেখে গেল।
এই মেয়ে কি আবার আসবে? যদি আসে সঙ্গে করে কি একটা তসবির নিয়ে আসবে? এরাজ্যের রাজকন্যা দেখতে কেমন, যদি কখনো সে রাজকন্যার সাক্ষাৎ পায়, তবে তার সুন্দর একখানা ছবি সে আঁকবে। এর আগে সে কখন রাজকন্যা দেখেনি। এই সুযোগে যদি রাজকন্যার দেখা পায় মন্দ কি?
সে রাতে গাছের তলায় শুয়ে সোম রাজকন্যার বিভিন্ন মূর্তি কল্পনা করতে লাগল। কখন দেবী সরস্বতী, কখন দেবী দুর্গা কখনো বা পরীদের রূপ কল্পনা করতে লাগল। কখন তার চোখের সামনে খাজুরাহোর বিভিন্ন নর্তকীদের চিত্র ফুটে উঠল। অজন্তা-ইলোরা-খাজুরাহোতে খোদাই করা সেই সব দেবদাসীদের মতোই কি সে সুন্দরী?
না তাদের চাইতেও আরো অনেক বেশী সুন্দরী? নিখুঁত সুন্দরের সংজ্ঞা কী? তার চেহারায় নাকি তার মনে?
চিত্রকর যে ছবি আঁকেন নিখুঁত সুন্দরের কী রহস্য লুকিয়ে থাকে তার ভিতরে? কোন দিকটা তিনি তুলে ধরেন যাতে তার চেহারার নিখুঁত রূপ প্রতীয়মান হয়?