পুজোর একসপ্তাহ আগে লেখা আমার ধারাবাহিক গদ্য
দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়

১.
মোড়ে মোড়ে আবার বাঁশ বাঁধা হচ্ছে। কানাগলিতে ঢুকেই বাঁশের কেল্লা। কে বলবে, ছ মাস স্তব্ধ ছিল শহর! মানুষ দূরে ছিল মানুষের! পূর্ণ দাস রোডে গভীর কুয়োর মতোই কালো গাছের ছায়া রাস্তার দুপাশে। শান্ত। ধীর। অতল দিঘি যেন। কেয়াতলা লেনে হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে দুটি ছেলে-মেয়ে। তাঁদের মুখে মাস্ক। একটু পরে, যখন ওরা লেকে ঢুকে চুমু খাবে, মাস্ক দুটো বেঞ্চিতে রেখে দেবে। কারণ, শরত এসে গেছে। চুমু আড়াল করার কিছু নেই। মাস্ক বরং এবারে নিপাত যাক..অনেক হয়েছে..

এ এক আজব সিজন। মহালয়ার পর থেকেই মন কেমন করে। এবার তায় আবার এক মাস এডভান্স মহালয়া। কি কেলো! যেন, গত ছ মাসের হিসেব চুকিয়ে দিচ্ছে ভগবান। অনেক তো চাপ নিয়েছিস..এবারে একটু ফূর্তি করে নে’ টাইপ। মাধ্যমিকের পর যেমন তিন মাস ছুটি থাকত। এও তেমন। সকালে উঠেই দিকে দিকে ভ্যান গখের ছবির রংয়ের রোদ ঝকঝকে। দেখেই মনটা ভালো হয়ে যায়। হাওয়ায় চটের গন্ধ। দুপুর হলেই, কেমন থম মেড়ে যাচ্ছে আকাশ-বাতাস। যেন বিয়ের আগের রাতের বধূয়া। চাপ চাপ কান্না বুকে চুপ করে আছে। কপালে লেপ্টে সিদূর। একটু পরেই হয়তো তেড়ে ঝড়জল নামবে। তাই ছাতা নিয়ে বেরলাম। কোথায় ঝড় কোথায় জল! কিছুই নামল না। কাজ সেড়ে বিকেলে দিব্যি হাওয়া খেতে খেতে গোলপার্ক ধরে হাঁটছি..দেখছি, নতুন দুটো মোমোর দোকানে রং করা হচ্ছে..নাকে এসে লাগছে নতুন রংয়ের গন্ধ..দার্জিলিংয়ের ছেলেটি মোমো প্যাক করতে করতে জানাচ্ছে, আবার ছন্দে ফিরছে পাহাড়..”আপ পুজা মে আওগে সারজি হামাড়ে পাহাড় মে? আপকো আচ্ছা লাগে গা…”

হাওয়া দেয়। এ এক অলীক ডাকের হাওয়া। শরত। স্মৃতির শহরে সব মনে পড়ে যায়। যে সব কোনওদিন মনে করতে চাইনি। মুখোমুখি হতে চাইনি। রাসবেহারীর কাছে আমি আর স্যার হাঁটছি। দেখছি, একটা ভাঙা সেকেলে বাড়ি। কি আভিজাত্য তার আজও। রাজকীয় স্থাপত্য নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে যেন জলসাঘরের ছবি বিশ্বাস। ফাটা দেওয়াল থেকে বেরিয়ে আসা অশ্বত্থের উঁকি..অনামা ছোট ছোট ফুল..ঘুরঘুর করছে প্রজাপতি..আমি আর স্যার দাঁড়িয়ে পড়ি..রাসবেহারী মোড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ট্রাম-বাস-রাস্তা-ঘাট…ভবানীপুরের দিক থেকে আজান ভেসে আসছে..হাজরায় পথ অবরোধ করেছে সুন্দর..

মেদুর। আর, খোলা। এ দুই শব্দ ফিরে ফিরে আসে আমার কাছে এই সময়টা বোঝাতে। তাও ধরতে পারিনা। আকাশের দেবতারা পাতালে ফুল ঝড়িয়ে দেয়। সেই ফুলের গন্ধে সকালে ঘুম ভাঙে। এসব সকালের নাম মহালয়া সকাল। অদ্ভূতুড়ে কিসসা যত। সেপ্টেম্বরের সন্ধ্যাও মায়াময়। রাসবেহারী এভিনিয়ের সস্তা দোকানে আজ বিরিয়ানি খাওয়ার ভিড়। ৬০ টাকায় এক প্ল্যেট। দোকানি বলছে, অক্টোবরে জমে যাবে বাজার। অটো চালকও তাই বলছে। অক্টোবরটা জমে যাবে বুঝলেন। উবর চালক জানান, গতকাল রাত থেকে টানা ট্রিপ করছে। অনন্ত ট্রিপ। সারারাত ঘুমোননি। সামনে পুজো কি না..ছ মাসের আলস্যটা একটু কাটিয়ে নিচ্ছেন…বলেই লাল চোখে হ্যাহ্যা করে হেসে দেন..

সমস্যা হল, এ সিজনে প্রেম পায়। বন্ধুত্ব পায়। মেয়েরা ছেলেদের মেসেজ করে, বিকেলে কি খুব ব্যস্ত? একটু গড়িয়াহাট যাবি? একটা জিনস কিনতাম..ছেলেটিকেও এদিকে বন্ধুরা শাসিয়ে রেখেছে, দেখা করতে হবে..অনেকদিন দেখা হয়নি…পুজোর দেখা…সে বোঝে না, মেয়েটাকে কি বলবে! আপনারা জানলে অবাক হবেন, এই ছেলে আর মেয়েটির কিন্তু দু মাস আগেই ব্রেক আপ হয়ে গেছে। মানে, বিচ্ছেদ। কিন্তু এই প্রজন্ম, ব্রেক-আপের পরেও “বন্ধু” থাকে। মানে, সিঙ্গল হয়েও মিঙ্গল। আর, “খেয়েছো” “বাড়ি ফিরেছো” বলে প্রেম করে না আজকের ছেলে-মেয়েরা। তারা দুবার ব্লক করলে, চার বার এভাবেই আবার দেখা করে। আপনি বলবেন, আজব তো। আসলে, ওরা এই সিজনের মতোই। সকালবেলার রোদের মতোই। তপতপে। টকটকে। স্পলনেডের টোকো থুকপা দোকান যেন। পার্ক স্ট্রিটের গলিতে বাজনা দোকানের মত। অকারণ তাই সুন্দর..অদরকারি তাই যৌথ..

ছেলেটি আর মেয়েটি এবার নিউ মার্কেটে জিনস কিনতে যাবে। ওদের একটু একা থাকতে দি আমরা, কি বলেন? পাঠক? পুজো তো চলে এলো..তাই না! আপনিও বেরিয়ে পড়ুন এবার..

২.
মহাত্মা গান্ধী রোড মেট্রো স্টেশানের সামনে লুম্পেনরা সাবানের বুদবুদ ওড়াচ্ছে ফুঁ দিয়ে। আর ক দিন পরই পুজো। ভবানীপুরের অলিগলি পাকস্থলির পুরোনো বাড়িগুলোর ওপর ঝোলানো হচ্ছে আলোর চাদর। লাইটিং। ক দিন পর দপ করে জ্বলে উঠবে সেসব। তখন হেসে দেবে এই জীর্ণ বাড়িগুলো। তখন ম্যাডক্স স্কোয়ারে অষ্টমীর খোলা পিঠ সুন্দরীর। অম্লান নিজেকে সামলাতে পারবে না। যেমন কালকেও পারছিল না। হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে পড়ছিল। তারপর ছাতিমের গন্ধ নিচ্ছিল চোখ বন্ধ করে। আর আমি দেখছিলাম, বসন্ত রায় রোডের কোনও শৌখিন বাড়ির আলোছায়ায় জ্বলে থাকা ডিম লাইট। আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল, প্রথম প্রেম। পুজোর প্রেম। দুর্গাবাড়ি।

রাসবেহারীর এ কাফেতে একটা নতুন ছেলের সাথে তোকে দেখতে পাই আজকাল। এদ্দিন পর আর অস্বস্তি হয় না আমার। হালকা একটা চিনচিন শুধু। পুজোর মাস বলেই। আজ ছ মাস পর এসেও আবার দেখছি তোকে অদূরে। পাশে সেই ছেলেটাই। আমার কেন জানিনা, অসম্ভব রাগ হচ্ছে আবার। নির্বোধ রাগ। দাঁত চেপা রাগ। টেবিলে ঘুঁষি মারতে ইচ্ছে করছে। অম্লান বলছে, কি হয়েছে? কোনও সমস্যা? আসলে, অজানা একটা তেঁতো কষ্ট। মনে হচ্ছে, আমি পারিনি। মনে হচ্ছে, আট বছর আগে, এতদিনের সম্পর্কটা এক লহমায় ছুঁড়ে ফেলে, তুই কীভাবে চলে গেছিলি? তুই কি জানতি না, শহর তারপর আমায় গিলে খাবে? জানতি না, রাত্রি জানোয়ার নিভিয়ে দেবে সব আলো হঠাৎ? পুজোর আগের এসব সন্ধ্যা আমি কীভাবে কাটিয়েছি সেসব দিন, তোর কোনও ধারণা নেই..

তবে তুই বলেছিলি, আজীবন তোর আমার প্রতি সংবেদন থাকবে। তাই তুই মুখোমুখি হতে পারিস না আমার। এত বছর পরেও। আমার চোখ আজও তোকে অস্থির করে। তাই তুই তাকাস না আর আমার দিকে। এখনও তাকাচ্ছিস না। ওই ছেলেটির দিকে একটা মিথ্যে-তাকানো তোকে আশ্বস্ত করছে, দেখতে পাচ্ছি। তুই নিশ্চয়তা চেয়েছিলি। আমি দিতে পারিনি। তবু আজ তুই আড় চোখে তাকাচ্ছিস কেন? কেন? আমার দিকে? এই কাফেতে তো আমি আমার বন্ধুর সাথে দিব্যি আছি। তোর মুখটাই বা এত শুকিয়ে যাচ্ছে কেন? আমি তো তোদের কোনও অসুবিধে করছি না। কোনওদিন করিনি। নিজের আড্ডায় আছি। তাহলে?

রাসবেহারী এভিনিউয়ের এই কাফেটা আজব। পুজোর আগে আরও কেমন লাগে। কত পুরোনো বন্ধুরা হঠাৎ পিঠ চাপড়ে দেয় এসে। এটা যেন একটা রিউনিয়ন সেন্টার আমাদের! পুজোর এ সিজনে দুর্গাবাড়ি যেমন। ম্যাডক্স যেমন! তুই পিছন ফিরে বসলি আমার দিকে। হয়তো অস্বস্তি এড়াতে! চুল ছেটেছিস। হাতে সিগারেট। ছেলেটি দু-চারবার আমায় মাপল। তুই মুখ ফেরালি না!

শেষ দেখায় কিছুটা চিন্তিত ছিলি, তুই চলে গেলে কি হবে আমার! কিন্তু এই তো দ্যাখ, আমি বেঁচে আছি দিব্য! লেখালেখি করে নাম-টাম হয়েছে। কত কত বিকেল যাদবপুরে তুই অপেক্ষা করেছিস আমার জন্য, আমি লেখা জমা দিয়ে ছুটে ছুটে ফিরেছি। তোর অপেক্ষাগুলো আমি আজও কিন্তু ভুলিনি। এ জীবনে ভুলতে পারবও না জানিস। সার্দান এভিনিউজুড়ে আজ পাতা ঝরে আছে। আর ক দিন পর শীত আসবে শহরে। তোর অপেক্ষাগুলো আমার একার পথ হাঁটায় এসে জানতে চাইবে তারপর, কি হবে তাদের? ট্রামে মাঝ দুপুরে বেলা নামবে।

তুই বলেছিলি, এত বড়ো একটা শহরে তুই একা হয়ে যাবি দেবর্ষি! কিন্তু কোথায় একা? মার খেতে খেতে খেতে আমি কিন্তু বেঁচে গেলাম জানিস। হালকা শীত শীত লাগছে। অক্টোবরের কলকাতায় হলুদ আলো আছড়ে পড়ছে বিবেকানন্দ রোডে। কত ছেলেমেয়ে পুজোর আগে হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। যেমন আমরাও হেঁটে যেতাম। গাছ লাগাচ্ছেন এক বয়স্কা দেশপ্রিয় পার্কের পাশের তাঁর ফ্ল্যাটে। উনি তো বেশিদিন নেই, তবে গাছটা লাগাচ্ছেন কেন? কার জন্য?

কার জন্য শহর আবার সেজে উঠছে? রাসবেহারী এভিনিউ ধরে চলে যাচ্ছে ট্রাম? যুগলসে মিষ্টি কেনার ভিড়? ডিসেম্বর মাসের দূরপাল্লার টিকিট কাটার হুড়োহুড়ি? কার জন্য, আমি আর অম্লান আজ সন্ধায় গোলপার্ক থেকে গড়িয়াহাট হেঁটে হেঁটে পুজোর আগের কলকাতা দেখছি? ক দিন পর এসব রাস্তা ভরে যাবে মানুষে। তাই অম্লান বলছে, ‘দেবর্ষি, ফাঁড়ি অবদি হাঁটবি? অসুবিধে হবে? আসলে, এদ্দিন পর এসব রাস্তায় তো! সামলাতে পারছি না..’

কার জন্য? তুই বল।

৩.
গত বছর এই দিনে পুজো শুরু হয়ে গেছিল। আকাশে বাতাসে শরতের ইশারা এ বছরও এখন অবিরত। কিন্তু পুজো আসেনি। এ যেন অনেকটা, দু জনেই টের পাচ্ছি, ভেতরে ঝড় উঠছে। কিন্তু মুখে বলছি, আমরা তো বন্ধু। জাস্ট ফ্রেন্ডস। এ সময়ে নরলোক আর দেবলোক কাছাকাছি চলে আসে। সন্ধ্যা হলেই রবি ঠাকুরের “শারদপ্রাতে” শব্দটা বারবার মনে পড়ে। তোমায় দেখেছি শারদ(ও)প্রাতে/ তোমায় দেখেছি মাধবী রাতে। আরেকটি গানে লিখেছেন, “একদিন যদি খেলা থেমে যায় শারদপ্রাতে।” আরও একটি গানে লিখেছেন, “আমার রাত পোহালো শারদপ্রাতে”। কেন বারবার রবি ঠাকুর শারদপ্রাতে লিখছেন? ঠিক কি ঘটছে ওঁর মধ্যে? কেন?

আমার গগন ঠাকুরের ভাসানের ছবির রং মনে পড়ছে। মনে পড়ছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। অপুর সংসারের সেই অমোঘ সংলাপ। অপর্ণা লিখছেন অপুকে, আমার শরীর ঠিকাছে। মন ঠিক নেই। তুমি এলে মনের রোগ সারবে। তুমি আসবে?- আরণ্যক, পথের পাঁচালি আর রবি ঠাকুরের চিঠিগুলি ছিন্নপত্রের এ সময়ে খুব অস্থির করে আমায়। প্রকৃতি কি ভয়াবহ ভাবে যৌনতা ছাপিয়ে আধ্যাত্মে হাত রাখছে একজন একা মানুষের! তানসেন গাইলে আকাশ কালো হয়ে আসছে। নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় বাজাতে বাজাতে ঘেমে যাচ্ছেন। সন্ধ্যারতি চলছে পাড়ার প্যান্ডেলে। মাইকে দ্রুত মন্ত্র উচ্চারণ করছেন বীরেন ভদ্র। প্যাণ্ডেলের পিছনের অন্ধকারে তারই মধ্যে প্রথম চুম্বন মনে পড়ছে..মনে পড়ছে..তার ঠোঁট, নাক, লিপস্টিক, চুল, গলা, গ্রীবা, কোমর, গালের নরম…মনে পড়ছে, প্রথম উন্মাদ হয়ে যাওয়া..ঢাক বাজতে থাকা আবহমান…হলুদ আলোর আছড়ানো..

গত ক দিন ধরে খুব ঘুরতে যাওয়ার নানা স্মৃতি ভেসে আসছে। ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছে। বারবার মনে ভেসে উঠছে হোটেলের ঘর। অরণ্য। পাহাড়। ফেসবুকে ছবি দেখছি নানা মানুষের। সেখানে একদিকে ভেসে উঠছে জঘন্য ধর্ষণ। আর অন্যদিকে সুখী মানুষের সপরিবার ছবি। উঠতি সেলিব্রিটিদের ইগোময় মুখ। দুটো গান গেয়েছে হয়তো পুজোয় তারা। বা, একটা সিনেমা বানিয়েছে সবে। কিন্তু ওরেব্বাবা! কি ঘ্যাম। যেন ক্যান্সারের ওষুধ আবিষ্কার করেছে। বা, মুন ল্যান্ডিং তাদের ব্রেন চাইল্ড! শরীর থেকে তাদের ফেটে পড়ছে পারফিউম আর বোকামি। আমার তাদের বোকাচোদা বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বলছি না। আকাশের দিকে তাকাচ্ছি। রাস্তায় দেখছি, মূর্তি বানাচ্ছেন কারিগর। কোনও অহং নেই এই শিল্পীর। মাটির নগ্ন মূর্তি দাঁড় করানো রাস্তার পাশে সারারাত। প্লাস্টিকে মোড়া মুখ। চক্ষুদান হয়নি। এখনও। আজ জ্যোতস্না রাতে সবাই গেছে বনে..

জয় বাবা ফেলুনাথ মনে পড়ে এই চক্ষুদান শব্দে। যিনি ছবির শুরুতে চোখ আঁকছিলেন দুর্গার, সেই নিষ্পাপ বয়স্ককে খুন করেছিল মগনলাল। মনে পড়ে পুজোর বেনারসে ফেলুদার রেগে যাওয়া। ‘আমি হয় এর বদলা নেব/নয়তো গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেব’। কাশীর ঘাটে। ফেসবুক স্ক্রল করে দেখি, এত অন্ধকারেও কেমন শুধু নিজেরটা বুঝে নিচ্ছে মানুষ। আবার বলছে, আপন হতে বাহির হয়ে..টয়ে..একেকটা ছবি যেন একেকটা ফ্যামিলি প্যাকেজ। শুধু আমরা খাব। আমরা। আমি-বাবা-মা-বর-বস-ফেসবুক। বাকিদের মগনলাল মেরে দিক। আমাদের কি! আমরা আজ সন্ধায় কোয়েস্টে যাবই। ফুড কোর্টে গ্রুপফি তুলবই। তারপর আইনক্সে পপকর্ন কিনবই। গড়িয়াহাট মোড়ে গাড়ির কাচের উপর ভিখিরি শিশু হামলে পড়লে কুকুরের মত তাড়াবই..তারপর এসিটা হালকা করে বাড়ি ফিরে শিশুকে শেখাবই, রাস্তার ওসব ডার্টি লোকগুলোর দিকে একদম তাকাবেনা..প্রমিস?বাবি??

অনেক বয়স্কদের কাছে এ ক”টা দিন হাঙ্গামার। জানলা বন্ধ করে তারা ধুনো দেওয়া ঘরে সন্ধায় বই পড়েন। চুপ করে। তাঁদের বয়স আশি। বাড়ির মেঝের রং লাল। তাঁরা কেউ থাকেন বাগবাজার, কেউ কালীঘাট, কেউ গড়িয়া, কেউ বেহালা। মাঝে মাঝে তাঁদের দেখতে ভালো লাগে মানুষের ভিড়। দূর থেকে। জানলা দিয়ে। সামান্য হাসেন। বহু বছর আগের মারা যাওয়া স্ত্রীর ছবির দিকে তাকান দেওয়ালে। তাঁরও প্রথম চুমু মনে পড়ে-মনে পড়ে ঘুরতে যাওয়া-শারদপ্রাতে-অপুর সংসার-গগন ঠাকুরের ছবি সবসবসব। ঝড়ের মত নাতনি শাড়ি পড়ে ঘরে ঢুকে তাঁকে প্রণাম করে বলে, দাদাই কাম ফাস্ট। প্রণামটা সেরে বেরতে হবে। রৌনক পাঁচটা মিসড কল দিয়ে দিয়েছে। প্লিজ, কাম কাম। এদিকে এসো।… পার্লারে সেজে ওঠা নাতনিকে আশীর্বাদ করেন দাদু..এই তো আমাদের উমা! দাদু হাতে সামান্য পেনশানের টাকা গুঁজে দেন। বলেন, “দুপুরে কিছু খেয়ে নিস। তোরা। কেমন?”

৪.
বসন্ত বিলাপের সেই বিখ্যাত মুহূর্ত। একবার বলো উত্তম কুমার। চিন্ময় রায় আর তাঁর প্রেমিকা আলো জলের ধারে বসে আছে। চিন্ময় বলছেন, ‘এই সিনেমা যাবে?’ আলো-‘এই দুপুরে? কাকিমা এলে কি বলবে..’ এরপরেই রেগে ওঠেন চিন্ময়, ‘কে..কে..ক্কে? কাক্কিমা! বাদ দাও যত্তসব ওল্ড ক্যাডাভেরাস লেডি..’ সাথে সাথেই কাকিমার প্রবেশ। আর পালাবার পথ না পেয়ে জলে ঝাঁপ দেওয়া চিন্ময়ের।

বাবা-মাদের প্রজন্ম কেমন ভাবে প্রেম করত, জানতে এ মুহূর্ত যথেষ্ট। এ ছবিতেই আরেকটি মুহূর্তের কথা মনে পড়ছে। পাড়ার ডাক্তারবাবু দেখে ফেলেছেন বান্ধবীর সাথে অনুপ কুমারকে। তাতে, সিঁড়ির নীচে লুকোনোর চেষ্টা করছেন অনুপ, পাছে সৌমিত্রকে সব বলে দেন ডাক্তারবাবু তরুণকুমার। সৌমিত্রর সাথে বসন্ত বিলাপের ঝামেলা সুবিদিত। ছবির শুরুতেই খামোখা অপর্ণা সেন রাস্তায় রীতিমত অপমান করেছেন তাঁকে। তাতেই প্রবল রেষারেষি। অথচ সৌমিত্রর আড়ালে তাঁর দলেরই অনুপ, রবি ঘোষ, চিন্ময় সকলেই তলায় তলায় প্রেম করছে অপর্ণা বাহিনীর সাথে। তাই, অনুপ লুকিয়ে পড়েছে ডাক্তারবাবুকে দেখেই সিঁড়ির নীচে। আর সেই ফাঁকে সাইকেল নিয়ে চলে যাচ্ছে চোর। সাথে সাথে একটা হইচই পড়ে যাওয়া পাড়ায়।

তরুণ কুমারের চরিত্রটি এখানে ইন্টেরেস্টিং। তিনি ডাক্তারবাবু। বয়স্ক। কিন্তু তাঁর কনসার্ন- কে কার সাথে পাড়ায় প্রেম করছে! অথচ, সৌমিত্র ও অপর্ণা বাহিনী সকলেই প্রাপ্তবয়স্ক। তবু পাড়ার এক প্রবীণকে ও তাঁর ডাক্তারখানার বন্ধুদের তাঁরা সমীহ করে। এ জায়গাটা ইন্টেরেস্টিং। সেই সমীহ থেকে আজীবন প্রবীণদের দেখে সিগারেট ট্যাপ করেন অনুপ কুমাররা। লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম চালান রবি ঘোষ, চিন্ময়রা। কাকিমা চলে এলে, জলে ঝাঁপ মারেন!

পুজোর মরশুম। প্রেমের মরশুম। তর্পণের মুহূর্তও। দাদার কীর্তি ছবিটির কথা মনে পড়ছে। গোটা ছবি জুড়েই প্রবাসের বাঙালিরা। ছন্দবাণী ক্লাব। একদল সরল সিধে মানুষ। গিরিডি বা মধুপুরের ল্যান্ডাস্কেপ। আদর্শ মধ্যবিত্ত জীবনের চালচিত্র। একদল বাবা-মা’দের প্রজন্মের সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার, যেখানে সম্ভ্রম-সম্মান আছে। মেয়েরা বাবার সামনে সকালে রবীন্দ্রসংগীত গান। আর বাইরে থেকে তা শুনে ফেলে দাঁড়িয়ে যান তাপস পাল। দূর থেকে অনুপ কুমার বাহিনী হাতে সেফটিপিন নিয়ে প্রেমে পড়া সরল সিধে তাপস পালকে টার্গেট করে। পরবর্তী ছবি জুড়েই কতভাবে তাপসের প্রেমের বেলুন চুপসে দেবেন অনুপ বাহিনী, তা সবার জানা।

দু দশক আগেও এমন একটা সহজ সমাজ ছিল। দুটি ছবির রেফারেন্স টেনে সেটাই ধরতে চাইলাম। আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। দিচ্ছি না। এ দুটি ছবির মুহূর্তগুলি কি বলে আপনাদের? আমায় বলে, একটা আড়ালের কথা। আব্রুতার কথা। যা সমাজের গায়ে আলতো করে চাপানো ছিল। নব্বইয়ের বিশ্বায়ন যা খসিয়ে দিল এসে। কাচুলি খুলে দাঁড়িয়ে পড়লেন তারপর মা। নাভির নীচে শাড়ি নামিয়ে পা তুলে দিলেন আকাশে। সন্ততিরা বাবা-মায়ের সামনেই বলল ‘ফাক’। চুমু খেল রাস্তায়, বিপ্লবে। তাতে বাবা-মা এর গর্বের শেষ নেই। শান্তভাবে যৌনতার পর ব্লেড চালিয়ে দিল গলায় পার্টনারের। রাজারহাটের কুড়ি তলা জানতেই পারল না কিছু। হাইরাইজের আলো পেরিয়ে তারপর ছুরিটা মুছে, পার্টনারের লাশ ব্যাগপ্যাক করে, ফ্লাইট ধরল খুনি/ আততায়ী/ লিভ-ইন পার্টনার।

পুজো এসে গেল। আমি এসবের গভীরে আর ঢুকব না। আমার নানা লেখাতেই চলে আসে এই ডার্ক ডিপ্রেসড সাইকোটিক প্রজন্ম আমার। আমি বলতে চাইছি, মাত্র দুটো দশকে একটা সম্পূর্ণ ইডিওলজি বিহীন প্রজন্ম কীভাবে তৈরি হল? কারা বানাল?কেন বানাল? ভাবুন। কেন দুটো দশকে শিল্পসাহিত্যে রাজনীতি ব্যপারটাকেই খিল্লি করে দেওয়া হল? কারা করল? ভাবুন। ভাবা প্র‍্যাক্টিস করার সময়ও আর নেই।

‘বৃদ্ধরা নির্লজ্জ হলে মানুষের বড়ো অসম্মান!’ আর ‘আমরা পৃথিবীর লোক/আমাদের অভিমান হোক।’ বিষ্ণু দে আর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বড় প্রিয় দুটি লাইন আমার। আমাদের মাস্টারমশাই সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় প্রায়ই বলেন লাইন দুটি। পুজো এসে গেল। শরতের আকাশ নীল। বান্ধবীরা কাজল পড়বে। দেখা করতে চাইবে তারপর। বন্ধুরাও তাই সেজে উঠছে। সেজে উঠছে শহর। যেন আস্ত একটা শহর এখন আর্ট গ্যালারি হয়ে ওঠে। মোড়ে মোড়ে মাটির দুর্গা বানান শিল্পীরা। ইন্সটল্যেশান শিল্পীরা মণ্ডপ সাজিয়ে তোলেন।

আমাদের মাস্ক পড়তে হচ্ছে। কারণ, চারপাশ অন্ধকার। কিন্তু, এখনও শিউলি আর ছাতিমের গন্ধও পাচ্ছি যে..এ তো তর্পণের সময়..ঘাটে এসে দাঁড়াই চলুন….দেখি অশ্রুনদীর সুদূর পাড়ে এখনও সৌমিত্র আর তাঁর দলবল পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছেন অগ্রজদের..ডাক্তারবাবু নাড়ি ধরেই বুঝে যাচ্ছেন, সময়ের রোগ..দাদার কীর্তির তাপস পাল নরম হেসে বলছেন, ‘পুজো ভালো কাটুক, সকলের..’

৫.
শরতকাল রহস্যের। অনেক কিছু বলেও বলে না। প্রেম যেমন। যতক্ষণ হচ্ছে না ততক্ষণ সুখ। হয়ে গেলেই শেষ। তাই প্রেমের পথে অনুসারী যাওয়ার পথটুকুর জন্যেই কাঙালপনা। মিলন হবে কত দিনে/আমার মনের মানুষের সনে। মিলন হয়ে গেলেই খেলা শেষ। শরতকালও তেমন। ঝাপসা। ঘোলাটে। বলা আর না-বলা মেশানো। আলো-অন্ধকারের। কবিতার মত। তাই মায়াবি। রহস্যময়। গগন ঠাকুরের ছবির মত। রবি ঠাকুরের গানের মত। এঁদের ছবি ও গানে তাই বারবার শরত। বর্ষা সব কিছু প্রকট ভাবে বলে। আর শীত তো চিরঘুমের দেশ। মাঝের শরত তাই গোধূলি। ধাঁধার থেকেও জটিল। ল্যাম্পোস্টের হলুদে জ্যালজ্যালে মায়াজালক লেগে থাকে।

বালিগঞ্জ ফাঁড়ির আশপাশে কিছু রাস্তা আছে। যেমন পাঠভবন স্কুলের সামনের রাস্তাটা। বা, ফাঁড়ির মোড় পেরলেই ওদিকে সার্কুলার রোডের রাস্তাটা। সব এলাকাতেই থাকে। সন্ধ্যের আগে কেমন একটা হয়ে যায় রাস্তাগুলো। ল্যাম্পোস্টের আলো হলুদ হয়ে আসে…ছাতিম ঝরে থাকে…শেতলামন্দিরের রাস্তা আটকে চিরাচরিত প্যান্ডেল বাঁধা হচ্ছে..সার্কুলার রোডের সামনে সাইন্স কলেজের রাস্তায় নুয়ে পড়েছে গাছ..তারপর ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে দিগন্ত..যেন ওপারে সমুদ্র..রবি ঠাকুর সেই আঁধার নিয়ে লিখবেন, রাত পোহালো শারদপ্রাতে..জন্মান্তর..কত হেঁটে গেছি, আমার পাশে কারা হাঁটছে, আজ আর চিনতে পারছি না..

শিল্প কারুবাসনা। কথাটা জীবনানন্দের। সুন্দর আপনাকে একবার ধরলে, জগৎ মিথ্যা হবে ক্রমশ। কিছুই আর ভালোলাগবে না আপনার। আপনি কবিতা লিখবেন অধরা মাধুরী ধরতে। ভাস্কর্য বানাবেন। তবু ধরতে পারবেন না। এই না-পারা আপনাকে অশান্ত ভাঙচুর করবে। অস্থির করবে। কেউ বুঝবে না আপনি কি চান। আপনি বুঝবেন আপনাকে আত্মা ভর করেছে। ঘোরের মত মাথায় লাইন আসছে। একের পর এক ঢেউ। যেন মেঘ গাইছেন আমীর খান। আসছে একটার পর একটা গত জন্মের ইমেজ। আপনি ধরতে চাইছেন। ছিটকে যাচ্ছে বিদ্যুৎ। আপনি তলিয়ে যেতে চাইছেন। পারছেন না। এ যে কি অভিশাপ শিল্পীর, সন্ন্যাসীর। সাধনা তার সাথে ছলনা করে যাবে আজীবন। কেন মেঘ আসে…তোমারে দেখিতে দেয় না..

একটা গানের কি কোনও মানে থাকে? বা, একটা লেখার? ছবির? অনেক বড় বড় লেখা আছে এ বিষয়ের। আমি সে সবে যাচ্ছি না। বলতে চাইছি, একটা পলেটিক্যালি ইনকারেক্ট উচ্চারণের কি মানে থাকে কোনও কংক্রিট? চন্দ্রবিন্দুর গান শুনছিলাম সম্প্রতি। একটা গানে উপল গাইছেন, ‘মোটামুটি এ জীবন কিছু লালে-নীলে কিছু তলানির ঢোক..’ এ লাইনটার মানে কি? বা, ‘কেন এভাবে তাকালে/ কেন বাঁশি নিলে সন্ধ্যের কিনাড়ায়..বা, ‘কে নিল তার হাত/যৌন ব্যবহার’..’কি মানে? রবি ঠাকুর লিখছেন, ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ্রমধুর হাওয়া..’ এ তো অন্য কোনও রূপের কথাই বলছেন তিনি। নেহাত একটা ছবি তো ব্যখ্যা করছেন না। এ ছবিটার মানে কি? বা, ‘কেবল কে গো এমনি ভাবে রাঙিয়ে মোরে পালিয়ে যাবে?’/ ‘আজি যে রজনী যায়’, ‘মুখখানি করো মলিন বিধুর যাওয়ার বেলা..’বা সুমন যখন লেখেন, ‘রেখেছি ধরে এতটুকু আশা’ বা ‘কর্ণ’ নামের ছোট্ট এক হাসপাতালে জন্মানো বাবা-মার পরিচয়হীন এক সদ্যোজাতকে নিয়ে গান বা ‘প্রতিদিন সূর্য ওঠে তোমায় দেখবে বলে’ -এই শিশু, এই ‘তোমায়’ কারা? এরা তো স্রেফ ব্যক্তিমানুষ না, তার বাইরে এক বিরাট আকাশ? সে আকাশ কোথায় রাখা? কার চোখে?

শপিংমলের সামনে ছেলেমেয়েরা বসে থাকে বিকেল হলেই। ফোয়ারা ঝরে পড়ে। বুঝতে পারি, উৎসব আসছে। মানুষ কিনতে বেরোয় বিকেলে। কি কেনে জানে না। কিন্তু কেনে। কেনে। কিনতে থাকে। বাজার। বাজার। বাজার। বাজার। বাজার।ফুলেফেপে ওঠে একটা দৈত্য। একটা পা ফেলে গড়িয়াহাটে। একটা পা ফেলে শ্যামবাজারে। একটা হাত এক্রোপলিসে। আরেকটা সাউথ সিটি। তার গরম নিঃশ্বাসের গন্ধ পাই সন্ধ্যে হলেই। মাস্ক পেরিয়েও। সে বাজারে কেচ্ছা দিয়ে সাহিত্য লেখা হয়। রাজনীতি মাখা হয়। কে কার সাথে শুয়েছে। কে কার পেট করলো। এই হল বিষয় বুদ্ধিজীবীদের। একদল লোক ঢুকে পড়েছে কোনওভাবে শিল্প মারাতে। বাজারে। তাদের পুঁজ জমতে জমতে ওই দৈত্য তৈরি হয়েছে। ওর নাম কালচার ইন্ডাস্ট্রি। সেই ঠিক করছে, কে কবি হবে, কে গায়ক আর কে দালাল..

শরতকালের কথা লিখতে বসেছিলাম। লিখছিলাম ঘোলাটে বিকেলের কথা। মাঝে ঢুকে পড়ল বাজারের দৈত্য! পুজোর আর দশ দিন বাকি। অনেক কিছুই আজও বুঝিনি। সেই না-বোঝার লেখাই থাকল এখানে। বাকিটা আপনারা বুঝবেন আমি জানি..

৬.
গানের স্মৃতি থাকে। আবার স্মৃতির ভেতর গান থাকে। একটা গান বারবার শুনছেন আপনি। বারবার না শুনলে আপনার মন শান্ত হচ্ছে না। খিদে প্রবল। একটা সময়ে ধার কমে গেল গানটার। তখন, এ গানের সাথে জড়িত স্মৃতিগুলোই বারবার ভেসে উঠল আপনার চোখে। আপনি তখন স্মৃতির একটা সিনেমাই দেখতে থাকলেন। গানটা নতুন করে কিছু আর বলল না। বহুদিন পরেও গানটা শুনলে সেই মুহূর্তের স্মৃতিগুলোই আবার ফিরে আসবে। গানটার কথা ভাবলেও তাই হবে। মনে পড়ে যাবে, সে মুহূর্তে আপনি কার সাথে ছিলেন। কি করছিলেন। সবকিছু। সবকিছুই।

এই গান আর স্মৃতির ব্যপারটা বিচ্ছেদের মত। প্রেম ভেঙে যায়। ফুরিয়ে যায়। প্রেমের স্মৃতি থাকে। বিপদজনক ভাবেই থাকে। সেই সব রাস্তা, সেই সব কাফে, এমনকি সেই মেয়েটির আদলে কোনও মেয়েকে দেখলেই সব মনে পড়ে যায় মুহূর্তে। রিবাউন্ড-যেমন। একটা প্রেম থেকে বেরতেই জোর করে আর একটা প্রেমে পড়া। এত ভাড় এই প্রেম ব্যপারটার, যে শেষ হয়েও শেষ হয় না। জাতিস্মরের মত বারবার ভেসে ওঠে নতুন প্রেমিকার মুখেও। কে কোনজন গুলিয়ে যায়। রবি ঠাকুর লেখেন, ‘যে আমার নতুন খেলার জন/তারই এই খেলার সিংহাসন/ভাঙারে জোরা দেবে সে/ কিসের মন্তরে..’ বা ‘যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায়/নব প্রেমজালে/তবু মনে রেখো’…

এই মনে রাখা বিপদজনক। স্মৃতি একরকম খুনি। তা থেকে পালাতে কেউ বিচ্ছেদের পর শহর বদলায়। কেউ নিজেকে বদলায়। কিন্তু সেই মেয়েটির আদল, পাগলামো, ছোট চুল, সিগারেট খাওয়া, দ্রুত কথা বলা, বলতে গিয়ে জড়িয়ে ফেলা, এই সবের আদল আবার দেখতে পেলেই সব মনে পড়ে যায়। ঘড়ির সময় মিথ্যা হয়ে যায় সেখানে। শরীরের সময়, মনের সময় আরও মারাত্মক। অর্গানিক। অরণ্য আর পাহাড়ের স্মৃতির মত। সেখানে সব মানুষ দার্শনিক।

বিচ্ছেদের পর বেশ কিছু বছর ভালো ভাবে কিছু বোঝা যায় না। একটু দূরে গেলে, কিছু বছর পর, দেখা যায় গোটা ব্যপারটা। ততদিনে আপনি হয়তো চুমু খেয়ে ফেলেছেন কয়েক জনকে আরও। খুচরো সম্পর্ক হয়ে গেছে আপনার দু একটা। তাই আপনি আরও লজ্জা পাচ্ছেন। সেগুলো মিলিয়েও গেছে। কিন্তু মিলিয়ে যায়নি সেই চোখ..সেই তাকানো..সেই মনের বাঘ..মাঝে মাঝেই সে তাই ঘুমের মধ্যে জেগে ওঠে..ডেকে ওঠে..আপনিও এত বছর পর, মনের ভেতর তাঁকে তাড়াতে চান না..আপনিও বুঝে গেছেন, রাতের সব তারাই থাকে দিনের আড়ালে..স্বয়ং রবি ঠাকুরের তা জীবনদেবতা..থাকুক সে। তাকে নিয়েই চলতে হবে। শুধু কোনও কোনও গান তাকে প্রকট করে ভাসিয়ে তোলে। তখন হয় সমস্যা। আপনি গানটা থামিয়ে দেন হেডফোনে। তারপর একটু সন্ধ্যার ঝিলপারে হেঁটে আসেন একা। জলের সামনে গেলে, একটু হালকা লাগে। জল নিয়ে নেয় সমস্যা ব্যথা। তারপর ঝিল কালো হয়ে যায়, আরও।

হেমন্ত আসন্ন। পুজো আজ আমার কাছে স্মৃতির চোরা কুঠুরি ছাড়া আর কিছু না। আমাকে প্রতিদিন এই শরতে মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় নিজের। বুঝতে হয়, কোথায় আমি ভুল ছিলাম, কোথায় বন্ধুরা বা সেই মেয়েটা ভুল ছিল। হিসেব মেলাতে মেলাতে একটা গানে এসে থামি। পুজোর গান। বা, পুজোর সময় শুনেছিলাম এমন গান। পরপর ঘটনাগুলো মনে পড়ে। অষ্টমীর রাতের ঝগড়া, দশমীর ভাসানের চুমু, সিলুয়েটের একাকী দাঁড়ানো ছাত, লাইটিং জ্বলে থাকা, সন্ধিপুজোয় ঘেমে ওঠা নাভি..বুঝতে পারি, বয়স হচ্ছে। আর, কলকাতা স্মৃতির শহর। বর্তমানের ছদ্মবেশে এ শহরে সব অতীত। এই যে গড়িয়াহাট, ফাঁড়ির রাস্তা আমার সব লেখায় চলে আসছে, কারণ এ চত্বরে আমি বড় হয়ে উঠেছি। এখানে মা’কে দাদামশাই একদিন স্কুলে নিয়ে এসেছেন। তার বহু বছর পর, মা আবার আমাকে প্রথম স্কুলে নিয়ে এসেছেন। বাবা এখানেই আমাকে ছোটবেলায় চিনিয়ে দিয়েছেন, ‘ওই দ্যাখো, ওটা রামকৃষ্ণ মিশন।’ পুজোর সকালে বাবা হাজার ঝামেলাতেও ঘরে একা গান শুনেছেন প্রতি বছর। এভাবেই শুরু হয়েছে তাঁর সকাল। কাজেই গানের স্মৃতি আমার লেখায় বারবার এই যে আসছে, এও নতুন কিছু না। যুগ যুগ ধরে প্রবাহিত এই গণস্মৃতি। গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো।

এই গণস্মৃতি থেকেই মানুষের ইতিহাস আসে। সে ইতিহাস এড়িয়ে কিছু করতে গেলেই মুশকিল। দু দিনের তারকারা সেটা বোঝে না। গত কাল ছিল চে গেভারার প্রয়াণ দিন। সারাদিন একটা ছবি ঘুরে বেরিয়েছে ফেসবুকে। যীশুর মত চে-র শেষ মরদেহ। চোখ খোলা। আর কিছু পরে তাঁর হাত কেটে নেবে মার্কিন সেনারা। মারা যাওয়ার আগে চে শেষ বলেছিলেন, ‘তোরা আমাকে মারতেই পারবি ভীতুর দল। গুলি কর আমায়। কি হল কর। এখুনি। একটা মানুষকেই তোরা মারতে পারবি মাত্র…’ চে-র স্মৃতি আমায় কাল আছন্ন করে ছিল। সুনীল লিখেছিলেন, চে-র ওই মুখ তাঁকে খেতে দিচ্ছে না ভাত। তাঁকে অপরাধী করে দিচ্ছে।

স্মৃতি মানুষকে অপরাধী করে দেয়।

৭.
প্যান্ডেল প্রায় রেডি। কোথাও সামান্য ফিনিশিং টাচ চলছে। শহর ছেয়ে গেছে হোর্ডিংয়ে। অনেক জায়গাতেই এখনও টাঙানো হয়নি বিজ্ঞাপন। কাঠের কাঠামোটা শুধু লাগানো রয়েছে। টিউবগুলো ঝুলছে। সাদা সাদা দাঁত যেন। ক দিন পরেই সেই হোর্ডিংও সেজে উঠবে পুরোপুরি। তখন হেসে উঠবে চৌমাথা। কলকাতা তখন পুরোপুরি বিয়েবাড়ি হয়ে যাবে। চলছে তারই প্রস্তুতি। সতর্কতা মেনেই চলছে। কিন্তু চলছে..

বিকেল হলেই শহরে কে ছিটিয়ে দেয় জল। শরত মুখার্জি রোডের সূর্যাস্ত। সামান্য শীত শীত করে। গোলপার্কের মৌচাকের সামনে অপেক্ষা করে কত যুবক-যুবতী। এরা কারা? যেন স্বর্গের পরিত্যক্ত প্রেমিক-সকল। যেন একবিংশ শতকের শেষতম প্রেমের বিন্দু এদের মুখে চোখে। অপেক্ষায়। ওই যে মেয়েটি বারবার ফোনের ঘড়িটা দেখছে আর ইয়ারফোনে গান শুনে চলেছে। টাইমপাস। সে ভাবছে, কখন আসবে তাঁর প্রেমিক। গড়িয়াহাট মোড়জুরে কত অপেক্ষা! কত অপেক্ষা দেশপ্রিয় পার্কে। রুবিতে। কসবায়। সবাই আজ ঘড়ি দেখছে আর টাইমপাস করছে গান শুনে। মোড়ে মোড়ে। কখন আসবে তাঁর প্রেমিক। কখন আসবে প্রেমিকা। একটাই প্রশ্ন। চোখেমুখের ভাষায়। একটাই প্রশ্ন, এখনও আসছে না কেন সে? কোথায় রয়েছে এখন? কোন রাস্তায়? উড়ে কি চলে যাওয়া যায় না তার কাছে??

২০২০ সালের শরতেও খোদ কলকাতায় এভাবে রচিত হয় মেঘদূত। অপেক্ষার মেঘদূত। এই সব অপেক্ষার অবসান হলে, ওদের দেখা হলে, ছেলেটি আর মেয়েটি কোথায় যাবে? কোথায়? এত ভিড়! জন-অরণ্য! এর ভেতরেই ওরা হারিয়ে যাবে। হয়তো, উদ্দেশ্যহীন বেড়াতে বেড়াতে দেখে নেবে আগেভাগে ক’টা প্যান্ডেল। হয়তো, কসবার সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দি রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পর বেলার চোখের দিকে তাকিয়ে অঞ্জন দত্ত সুদূরের ডাক শুনতে পাবেন। তারপর বলবেন, চুপ করে কেন এ কি বেলা তুমি কাঁদছ! স্বপ্ন এবার হয়ে যাবে সত্যি..

স্বপ্ন নিয়েই তো মানুষ এ কদিন মোড়ে মোড়ে দোকান দিয়েছেন। ফুটপাতের পাশে। একরত্তি জায়গায়। একটু আয় হবে সামান্য। সবারই আশা। কেউ দিয়েছেন সস্তা জুতোর দোকান তো কেউ সেলফোনের কভার বিক্রি করছেন। কেউ বিক্রি করছেন লাইটার আর সিগারেট। সেই লাইটার কিনে জ্বালাতে গিয়ে দেখি ডিজেল ছড়িয়ে পড়ে আকাশে…শরত মুখার্জি রোডের আকাশে পিচগলা সোনা..কলকাতা আনমনা হয়ে যায় তখন..হিসেবি রাজনীতিকও কবিতা বলে..আর কবিরা হয়ে যায় ভবিষ্যৎদ্রষ্টা..যতীন বাগচী রোডের ফুটপাত জুড়ে যত্ন করে কারা গাছ লাগিয়ে যান..অদরকারি ডালপালা ছেটে বড়-বড় গাছকে সুন্দর করা হয় গোলপার্কের দিকে। পুজোর আগে যতটা সুন্দর হতে পারে চারপাশ, শহর-মানুষের মন- সবারই সেটুকু চেষ্টা..

দক্ষিণ কলকাতার কাফেগুলো সন্ধ্যা হলেই জমজমাট। ড্রিফটার, এইথ-ডে কাফেতে উপচে পড়ছে যুবক-যুবতীরা। মুখোমুখি বসে, ঝুঁকে পড়ে, কি যে কথা বলার এত নেশা। কথা-কথা-অনন্ত কথা। যতটা সুন্দর করে বলা যায় সে সব কথা-তারই চেষ্টা সকলের। পাছে কেউ আঘাত না পান। রাজনীতিকরাও বিরোধী দলকে কম আঘাত দিয়ে কথা বলেন এ সময়। পুজোর মরশুম বলে কথা। কেউ আঘাত পেলে, খারাপ লাগে মানুষের। মানুষ এ সময়ে সুন্দর হতে চেষ্টা করে। আশ্চর্য!

আমার পুজোর স্মৃতি গোলমেলে। বিরিয়ানি দ্রুত খেলে যেমন গলায় বেঁধে, আমারও সুখ সহ্য হয় কম। পুজোতে কোনও না কোনও ঝগড়া ও কান্নাকাটির স্মৃতি আমি দেখতে পাচ্ছি পিছন ফিরলে। কে জানে কেন! অথচ বারবার আমি দেখতে চেয়েছি বন্ধুতা ও সুন্দর। কিন্তু জীবন ল্যাং মেরেছে অষ্টমির ভরা সন্ধায়। যার আসার কথা ছিল, সে আসেনি। বাড়িতে ঝগড়া হয়েছে। রাস্তায় মারামারি হতে দেখেছি। বা, অফিসের গণ্ডগোল। আরও কত কাছের মানুষের দেওয়া আঘাত বা পিঠে ছুরি। কিছু না কিছু একটা কষ্ট আমায় ঢাকতে হয়েছে এ মরসুমে। খলবলে রক্তের উপর লাগাতে হয়েছে ব্যন্ডেজ। বিয়েবাড়িতে ঝগড়া হলে যেমন সুর কাটে, কিছু-না-কিছু কেটে দিয়েছে আমারও সুর, বারবার। তাই আজকাল ভয় করে, এ সময়টা এলেই। যতই ভালো লাগুক, ভয়টাও পিছু ছাড়ে না৷ যে সুন্দর বা সুখের কথা বলছিলাম, মানুষ যে সুন্দর খোঁজে থাকতে চায় এ সময়ে বলছিলাম, তার পিছনেই যেন দাঁখ-নখ নিয়ে লুকিয়ে থাকে এই সব পুজোর খারাপ স্মৃতি, অপবাদেরা, সুযোগ পেলেই বেরিয়ে আসবে..

তবু ইচ্ছে করে মানুষকে বিশ্বাস করি। তবু তো অপেক্ষা মোড়ে-মোড়ে। লাইটিং। মানুষের ভিড়। রোলের দোকানে ডেকচিতে টং করে শব্দ করল হাতা। জমে উঠেছে বাজার। দুঃখগুলোকে আদর দিয়ে আড়াল করেই। বেজে উঠেছে শহর, এবারেও। এত অন্ধকার, এত খিস্তির দলা, এত মারের উপর দিয়েও নন্দিনীকে রক্তকরবী এনে দিচ্ছে রঞ্জন। আমরা যাইনি মরে আজও। তাই পুজোর এক হপ্তা বাকি, তার আগেই নতুন জামার গন্ধ কলকাতার আকাশে। মানুষ মানুষের সাথে হাত ধরে কথা বলছে পাঁচ মাথায়। কত কথা! ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে পড়েছে সদলবলে মানুষ, মুখে মাস্ক পরেই..পুরোনো স্কুল কলেজের বন্ধুরা একে অপরকে লিখছে, বিকেলে কি করছিস?

একটা গোটা শহর সেরে উঠেছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সেরে উঠবেন না, হতে পারে না। ঠাকুরকে বলব আমরা সবাই, সৌমিত্রবাবু যেন দ্রুত সেরে ওঠেন। দ্রুত। আমাদের আর ভালোলাগছে না! আজ গোটা কলকাতার সমস্ত প্রেমিক-প্রেমিকাদের অপেক্ষায় ঝরে পড়ুক সৌমিত্রবাবুর সেরে ওঠার বার্তা, একমাত্র!

৮.
‘আমাকে একটু খাটের উপর থেকে ফোনটা দিবি?’ আর, ‘এ ব্যাগটার ভেতর আমার টাকা-এটিএম কার্ড সঅঅব আছে। তোর কাছে রাখ একটু। সাবধানে। এখুনি আসছি’…কি আছে, সামান্য এ কথা দুটোর মধ্যে? এমন কি আছে, যার জন্য, শরতের এই সন্ধ্যা বলছে, কেন এভাবে তাকালি? তুই তোর নিজের কিছুটা আমার কাছে জমা রাখলি আসলে। বিশ্বাস করলি আমায়। না-বলে, এভাবেই। এই ফোন দেওয়া আর ব্যাগ রাখা আসলে একটুকরো গোপন। অন্তর্বাসে লেগে যাওয়া ঘামের গন্ধ। বা, ঘুমের সময় মুখে জড়ানো লালা। কখনওই বলে না, ‘তুই আমার’। বলে, তুই নষ্ট তাই তুই আপন। তুই অশ্লীল তাই তুই দেবী। তোর স্তনতিলের মত, যেখানে আমার চোখ চলে যাবেই। কেউ বুঝবে না, মানুষ মানুষকে কতটা গভীরে ছুঁলে, একশো-তিন জ্বর আসে…শুধু পুজোর মরশুমে সামান্য এই বলাটুকু, ‘একটু ফোনটা দিবি’ আর ‘আমার ব্যাগটা সাবধানে..রাখিস..আসছি’ কয়েকশো দাম্পত্যের থেকে কতটা সত্য কেউ বুঝবে না..শুধু মেঘে ঢাকা তারা’র নীতা সামান্য এক চাকুরীরতা মেয়ে থেকে ক্রমশ হয়ে উঠবেন দেবী..যে রাতে মোর দুয়ারগুলি গানে..সব যে হয়ে গেল কালো/নিভে গেল দীপের আলো…ঘরভরা মোর শূন্যতারই…

আলোময় হয়ে আছে শহর। একটা লোক ঝুলতে ঝুলতে হলুদ টুনির আলো ঝোলাচ্ছে শপিং-মলের দোতলায়। বাড়ির বারান্দাগুলো ভরে আছে আলোয়। সপ্তমীর সকালে বন্ধুরা দেখা করবে। তাই প্ল্যান চলছে জোরদার। অরিজিত, অম্লান, ভীষ্ম, সম্রাট, সুলক্ষণা, সোমদ্যুতি, সায়ক, স্বাগতা সবাই একজোট হব দক্ষিণ কলকাতার এই কাফেতে। দুপুর-দুপুর। তারপর? তার আর পর নেই। নেই কোনও ঠিকানা। এটুকু জানি, বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে আমাদের। যতই রোদ উঠুক। যতই জ্যাম থাকুক রাস্তায়। উত্তর থেকে দক্ষিণে চলে আসবেই বন্ধুরা। একজোট হবেই। ষষ্টীর রাত পর্যন্ত চলবে হাজার প্ল্যান, ওয়াটসাপ গ্রুপে। ভীষ্ম বলবে, কসবার ভিড়ে দেখা করে লাভ নেই, তার চেয়ে পার্ক স্ট্রিট যাওয়া হোক। সম্রাট বলবে, পার্ক স্ট্রিটে তো রেস্তোরাঁগুলোয় প্রবল ভিড়। এই দক্ষিণ কলকাতার কাফেতেই আড্ডা হোক না। তারপর না হয়, বিকেলে হিন্দুস্তান পার্কে একটু বেড়ালাম? সুলক্ষণা বলবে, আমি কিন্তু বেশি হাঁটতে পারব না। সোমদ্যুতি কিছুই বলবে না। শুধু একটু লেটে এসে, মিষ্টি হেসে বলবে, এই আমার কিন্তু জোর খিদে পেয়েছে। কিচ্ছু খেয়ে আসিনি…অর্ডার করেছিস তোরা…এভাবেই আমাদের জমে যাবে পুজো। আমাদের বয়স বাড়বে তবু বেজে উঠবে বারবার স্মৃতির ক্যাপবন্দুকের আওয়াজ। আমরা বড় হব না। বুড়ো হব না। সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এভাবেই আজীবন লং-ড্রাইভের দিকশুণ্যপুরের সওয়ারি হয়ে সামনের সিটে গা এলিয়ে দেব, হুড খোলা জিপে। দিল চাহাতা হ্যায়ের তিন বন্ধুর মতো। জোরে গান চলবে। চোখে চশমা থাকবে, তাই বোঝা যাবে না, আমাদের চোখ বন্ধ না খোলা…শুধু বোঝা যাবে, আমরা জীবনকে বলছি, ‘গুরু চাপ নিস না..’

তবে, এত আলোর অপেরার মাঝেও আমার চোখ চলে যায় কানাগলির কোনও অন্ধকার দো-তলার জানলায়। বারবার। এ সময়েও। দেখি, সস্তা টিউব জ্বলছে কোনো সেকেলে ঘরে। খাটের কিছুটা অংশ দেখা যায় রাস্তা থেকে। দেখা যায়, কোনও বয়স্ক বা বয়স্কার মুখ। রাস্তার ভিড় দেখছেন তারা। তাদের ঘরে পুজো আসেনি। তবু, তারা তাকিয়ে দেখছেন মানুষ..মানুষ..মিছিল..আলো..এভাবেই সামিল হচ্ছেন পুজোয় তাঁরাও..এককালে তাঁদের কন্যাও ঘুরে ঘুরে ফোনে কথা বলতেন ওই ঘরে..কোনও বিশেষ বন্ধুর সাথে…পুজোর প্ল্যান করতেন সেই কন্যাও..তার বিয়ে হয়ে গেছে বহুকাল..আজ আর তাই পুজোর আসে না ওই সস্তার টিউবজ্বলা চিলেকোঠার অন্ধকার বারান্দায়..সে বারান্দা বন্ধ..অন্ধ..’ঘর ভরা মোর শুন্যতারই…’ এই সব সস্তা টিউব্জ্বলা দোতলা বাড়ির এই সব বয়স্ক মুখ আর এই সব কানাগলির রাস্তা নিশির ডাকের মত ডাক পাঠায় আমায়..পুজোর সময়, এই সব মায়াবি ডাক বলে, মনে রেখো, আমাদের মনে রেখো, আমরাও বেঁচে ছিলাম, আমরাও কিন্তু এখানেই বেঁচে ছিলাম..তোমাদেরই মতো..

বন্ধুদের সোল্লাস গর্জনে আমার চোখ ফেরে এই কাফেতে আবার। আমরা এখানেই আজ জড়ো হয়েছি। এখানেই তুই একটু আগে আমায় ব্যাগ আর ফোন রাখতে দিয়ে একটু বাইরে গেলি। আমার কাছে এখন, তোর যা কিছু গোপন, ফেরারি মন। তোর বইয়ের তাকের ধুলোর কথা রবি ঠাকুর কখনও লেখেননি। পাখায় জমে থাকা ঝুলের কথাও লেখেননি। লেখেননি তোর লাল নীল ঘরগুলোর কথা। সাদা বারান্দায় গাছ নুয়ে পড়ার কথা। বিছানায় কানের দুল গড়ানোর কথা। সেটা খুঁজে পেয়েও, “তুই দুলটা দেখেছিস আমার?” বলে প্রশ্রয় কাড়ার কথা। একঘর লোকের মাঝে তোর সেই চোখ কি আর কেউ দেখবে? জানা নেই। রবি ঠাকুর দেখলে লিখতেন, “আর কি কখনও কবে/ এমন সন্ধ্যা হবে?” আমি কি লিখব? এটুকুই বুঝতে পারছি, তুই আমার জীবনে বারবার ফিরে আসিস, তাই তুই আমার সত্য। ইন্দির ঠাকুরণ যেমন ফিরে আসেন ভাঙা সংসারে হাজার অশান্তির পরেও। বয়েস হওয়ার পরেও যেমন মা-বাবার ওই ঘরের গন্ধ নিতে ইচ্ছে করে। তুইও তেমন। তোর ছদ্ম-রাগ, “একটু ফোনটা দে তো ওখানে থেকে?”, “দুলটা পেলি না..এই দ্যাখ..এখানে” বলে লেগ প্যুল, এক ঘর লোকের কেউ কিছু বুঝবে না। তোর চোখ, গাল, গলা বুঝবে। পা হড়কে যাওয়ার পর আমার তোকে ধরতে চাওয়া হাত বুঝবে। আর বুঝবে, বাড়ি ফেরার সময়, তোকে রাস্তা পার করে দেওয়ার শুশ্রূষা। এ সব চিহ্নই গত জন্মের। এই সাদা বাড়ি-রাস্তাঘাট-আলোর চাদর-গাছপালা আমি আগেও দেখেছি। আগের প্রত্যেকটা জন্মে তোর সাথে আমার দ্যাখা হয়েছে আর তুই চাপা হাসিতেই নানা ভাবে লেগপুল করেছিস। খেপিয়েছিস আমায়। তারপর হেসেছিস হোহোহোহো। বন্ধুরাও হেসেছে। তারপর একটা শরতের সন্ধ্যা দ্রুত নেমে এসেছে, আমাদের ভরিয়ে দিতে, আমাদের জড়িয়ে দিতে..বন্ধুরা চিতকার করে বলে উঠেছে, ‘চিয়ার্স’…

CATEGORIES
TAGS
Share This
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
410 Gone

410 Gone


openresty