
ফ্রানৎস কাফকা এবং তাঁর আঙ্গিকের উত্তরাধিকার
সোম রায়চৌধুরী
‘I can not make you understand. I can not make anyone understand what is happening inside
me .I can not even explain it to myself `
Franz kafka
কাফকা ,তাঁর বিশেষ বন্ধু ম্যাক্স ব্রড কে বলেছিলেন তার ডায়েরি এবং লেখাগুলি পুড়িয়ে ফেলতে , বলা বাহুল্য ম্যাক্স তা করেননি ,প্রধান অনুবাদক হয়ে ওঠেন তিনি কাফকার লেখাগুলির ।অল্পসংখ্যক কিছু লেখা যা ওঁর জীবৎকালে ততটা আলোচিত নয় ,যে লেখা উনি পুড়িয়েই ফেলতে বলছেন ,সেই লেখাগুলি নতুন করে আজ প্রাসঙ্গিক শুধু নয় ,নতুন করে আবিষ্কৃত , আলোচিত । ফ্রানৎস কাফকাও আজ বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান লেখক হিসেবে স্বীকৃত ।
কাফকাস্ক Kafkaesque শব্দটি আজ অভিধানে গৃহীত । রিয়েলিজম এবং ফ্যান্টাসটিক এই দুই ধারার সংমিশ্রণে লিখিত তার অধিকাংশ গল্পের প্রধান চরিত্ররা সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন ,সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার শিকার ।
কাফকা সম্পর্কে স্বীকৃত সত্য এই যে কাফকার শিল্পকর্মগুলো ইউরোপীয় কথাসাহিত্যের বা ইউরোপীয় ফিকশন সাহিত্যের ইতিহাসের উত্তরাধিকার বহন করে না , প্রায় শেকড়হীন, বায়বীয় কাফকার সাহিত্য কর্মের না আছে কোনো পূর্বজ না কোনো সার্থক উত্তরসূরী,তাঁর গল্পগুলি আদপে গল্প নয় , নভেলগুলিও নয় প্রকৃত নভেল কারণ কাফকার ছোট গল্প বা নভেলে না আছে বাস্তব কোনো প্লট, না আছে কোনো বাস্তব চরিত্র।
তাঁর সমস্ত গল্পে আধুনিক মানুষ রাষ্ট্রের পুলিশি ব্যবস্থা এবং জার্মানি হলোকাস্টের শিকার এবং বিচ্ছিন্ন ,অসুখী, প্রতিবন্ধী , খর্ব । কাফকা সম্পর্কে সর্বজনস্বীকৃত সত্য এই যে তাঁর লেখাগুলো জিউস কাব্বালা বা ইহুদী মিস্টিসিজম প্রভাবিত , কাফকা সর্বদা সিরিয়াস, এমনকি কোনো ফটোগ্রাফে তাঁকে হাসতে দেখা যায় না,তাঁর জীবন সম্পর্কে না জানলে তাঁর লেখা সম্পর্কে বিশদে জানাও যাবে না , প্রকৃত প্রস্তাবে কাফকার সমস্ত লেখাই আত্মজৈবনিক । তিনি একজন জিনিয়াস, আমাদের চেনা জানা যে সাহিত্যসীমা তাঁর ঊর্ধ্বে ওঁর বিচরণ ক্ষেত্র, উনি একক, পৃথক , এবং প্রেরিত ।কাফকা সম্পর্কে এই সবগুলিই হয়তো সত্য,অথবা কিছুই সত্য নয় ।
অপ্রকাশিত একটি ছোট গল্প ‘a common confusion ‘ মাত্র কয়েকটি অনুচ্ছেদে লেখা, চরিত্রের কোন নাম নেই, শুধুমাত্র দুটি চরিত্র যাদের A এবং B বলে উল্লেখ করা হয়েছে , যারা একটি ব্যবসায়িক চুক্তি সম্পাদনের জন্য আরেকটি নামহীন স্থান H এ দেখা করার জন্য সম্মত হয়েও কখনও দেখা করতেই পারেন না , A প্রথমদিন সময়ের অনেক আগেই পৌঁছে যান , দ্বিতীয় দিনে সকালে বেরোলেও ওই একই স্থানে পৌঁছতে তাঁর সন্ধ্যে হয়ে যায় এবং B কিছু আগেই বিরক্তি নিয়ে A যে গ্রামে থাকেন সেখানে চলে গেছেন শুনে A শশব্যস্ত হয়ে অসম্পূর্ণ চুক্তিটি সম্পূর্ণ করবেন বলে নিজের গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হন ,সেখানে B অপেক্ষা করছেন শুনে মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহে সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে উঠতে গিয়ে পড়ে যান ,যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে শুনতে পান অপেক্ষার শেষে উল্টোদিকে সিঁড়ি দিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে B চলে যাচ্ছেন ।
মাত্র কয়েকটি অনুচ্ছেদে লেখা এই গল্প আমাদের চেনা বাস্তব নয় , স্বপ্ন বাস্তব বা ড্রিম রিয়েলিটি বলা যেতে পারে একে , উল্টে আমাদের পরিচিত গল্পের যে কাঠামো তাকেই প্যারোডি করার একটি প্রচেষ্টা এখানে দেখা যায় এবং কাফকা কতখানি সংকুচিত করতে পারেন একটি গল্পের বিস্তার কে সেটিরও একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই অনুগল্পটি যার তেমন কোনো গতানুগতিক প্লট নেই । অবশ্য কাকেই বা বলে প্লট ! মেটামরফসিস গল্পে একটি চরিত্র সকালে উঠে দেখে সে বিশাল গুবরে পোকা হয়ে গেছে ,গ্রেট ওয়াল অফ চায়না গল্পে কেউ ভাবেন যে দেওয়ালগুলো কেন পৃথক অংশ জুড়ে জুড়ে নির্মাণ করা হয়েছিল, কি তার উদ্দেশ্য হতে পারে, আবার কোনো একটি গল্পে একটি কুকুর ভেবে দেখছে তার খাবারের উৎস এবং অন্যান্য রহস্য কি , অন্য একটি গল্পে জনৈক স্কুল মাস্টার একটি বৃহৎ আঁচিলের বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন …
ভ্লাদিমির নবকভ ,নিকোলাই গোগোলের গল্পের সম্পর্কে বলেছিলেন যে তাঁর গল্পের আসল প্লট প্রায়ই থেকে যায় গল্পের উপরিতলের যতটুকু আমরা দেখি তার অনেক গভীরে, আমাদের পরিচিত গল্পের যে কাঠামো তাকেই নকল করে চলে সেই প্লট ,গোপনে পল্লবিত হয় বিকল্প কাহিনী ।
কাফকার গল্পগুলিও ,নিকোলাই গোগোলের গল্পের মতোই কেবলি গল্পের নিছক প্লটের থেকে দূরে ,ভাষার কারিগরি এবং কারুকৃতির কাছে ,সূক্ষ্ম বিন্যাস এবং সমবায়ের কাছে সমর্পিত,বলাই যেতে পারে লিঙ্গুইস্টিক স্টাইলিংই কাফকার প্রধান ঝোঁক বা ভরকেন্দ্র,গল্প বলার কোনো চেষ্টাই কাফকার প্রধান হয়ে ওঠেনি ।
কাফকার লেখাগুলি ক্রমশ সংহত হয়ে বর্জন করতে থাকে সমস্ত অলঙ্কার, ঝরিয়ে ফেলতে থাকে মেদ, একইভাবে শব্দের যে অহেতুক বাহুল্য তার থেকে দূরে, শব্দ ছুঁয়েই নৈঃশব্দ্যের সাধনা করবেন কবি শঙ্খ ঘোষ , কিয়ার্কেগার্ড এর ধাঁধা দিয়ে শুরুই করবেন প্রবন্ধ – শব্দ হলে কি ভেঙে যায় ‘ ?
খুব কমে অনেকটা বলার এই প্রবণতা থেকেই কাফকা সরে আসেন কনভেনশনাল প্লট বা গল্পের ব্যবহৃত পরিচিত চলন থেকে , এমনকি চরিত্রেরও নাম দেন না অনেক গল্পে এই ঝোঁক থেকেই ।
কাফকার অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই যে চিরাচরিত গল্পের যে স্ট্রাকচার সেটির একটি বিস্তৃতি উনি দেন ,অপ্রয়োজনীয় বিশদ বিবরণ বা ন্যারেটিভ ডিটেলিং এর থেকে সরে এসে তার গল্পগুলি হয় বহুমাত্রিক , অথবা একমাত্রিক, হয় চরম অস্বস্তির জন্ম দেয় অথবা পরম প্রশান্তির ।
এই লেখার প্রথমেই কাফকার লেখাগুলি সম্পর্কে কিছু মিথের মধ্যে অন্যতম বলেছি তার কাজের কোনো ঐতিহাসিক অগ্রজ নেই , না আছে কোনো পূর্বজের প্রভাব , কিন্তু আমরা দেখবো রবার্ট ওয়ালসের থেকে গুস্তাভ ফ্লব্যের এমনকি চার্লস ডিকেন্সের প্রভাব কত দীর্ঘস্থায়ী ছিল ওঁর লেখার ওপরে ।
কাফকা নিবিড় পাঠক ছিলেন রবার্ট ওয়ালসের, যিনি ছিলেন সুইস জার্মান লেখক ,ওনাকে অন্যতম পথিকৃৎ বলা হয় অনুগল্পের ,ছোট গল্পের আয়তন কে ছোট করে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা উনি করেছিলেন ,রবার্ট ওয়ালসের ছিলেন অন্যতম প্রধান যিনি ছোট গল্পের ভাষাগত ,তার কাঠামোগত পরীক্ষা করবেন ,বিচার করবেন তার বিপুল সম্ভাবনার,
‘He was one of the first people to develop the story as a place for linguistic delicacy and experiment .’
রবার্ট ওয়ালসের থেকে কাফকা শিখেছিলেন একটি গল্পের আদৌ গল্প বলার কোনো প্রয়োজন নেই আর , প্রচলিত ন্যারেটিভ থেকে বেরিয়ে একটি গল্পের কোনো দায় থাকবে না নীতিবাগীশ হয়ে ওঠার , নিজেকে গুটিয়ে রাখবে সে , যতটুকু বলার ঠিক যেন ততটুকুই, এই নির্মেদ অনুশাসনের দিকেই কাফকা পরবর্তীতে অগ্রসর হবেন । এই যে প্রায় কিছুই না বলা ,উত্তমপুরুষ নির্মোহ হয়ে, ‘ আমি ‘ ব্যতিরেকে গল্প বলার যে স্টাইল সেইটি প্রধান হয়ে উঠবে কাফকার লেখায় ক্রমশ ।
কাফকার ওপরে রবার্ট ওয়ালসের প্রভাবের থেকেও বৃহত্তর ,সর্বব্যাপী এবং গুরুত্বপুর্ণ প্রভাব ছিল গুস্তাভ ফ্লব্যের-এর ।
১৮৮২ সালে ,ম্যাক্সিম দ্যু ক্যাম্প ,যিনি বিশেষ বন্ধু ছিলেন ফ্লব্যের-এর , তিনি বলছেন কোন একটি সালোনে ,বন্ধুবৃত্তে আলোচনায় ফ্লব্যের বলেছিলেন যে প্রকৃত সাহিত্যে লেখক তার নিজস্ব অনুভূতি প্রকাশ করবেন না ,থাকবেন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ,যদি কখনও কোনো সাহিত্যে লেখকের ব্যক্তিগত মত সোচ্চার হয় তাহলে সেটি অগ্নিতে নিক্ষেপ করা শ্রেয় । আর্ট সাবজেক্টিভ কখনও হবে না আর , হবে সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক,কি বলছে তার থেকে কিভাবে বলা হচ্ছে সেটি অধিক গুরুত্বপুর্ণ হবে ,স্টাইলিং আর এক্সিকিউশন এ জোর দেবেন তিনি । ম্যাক্সিম পরে ফ্লবার্টের নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনায় বলছেন তাঁর সাহিত্য কখনোই কোনো মরাল বহন করবে না , হয়ে উঠবে না বিশেষ কোনো অর্থবহ ,বিশেষ অর্থ বহনের কোনো দায় থাকবে না তার লেখায় , না বলা বাণীর মাঝেই খুঁজে নিতে হবে পাঠককে তার চেতনার রঙে রাঙানো ভিন্ন ভিন্ন ইন্টারপ্রিটেশনগুলি ,পাঠকের মত করেই ।
ফ্লবার্ট একান্ত সাক্ষাৎকারে টরজেনেভ কে বলছিলেন ডিটেলিং আর ডেভেলপমেন্টের কথা , কিভাবে একটি যে কোনো বিন্দু থেকে শুরু হয়ে ক্রমশ বিশদে এবং বিস্তারে গেলে সেটি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে পাঠকের কাছে ,লেখকের সঙ্গে বিশ্বাসের একটি সেতুও যেন তৈরি হয়ে ওঠে ,মনে হয় কোথাও সততা আছে , কোথাও সম্পৃক্তি ।
পরে ,কাফকা বেছে নেবেন রবার্ট ওয়ালসের সঙ্গেই গুস্তভ এর এই বিশেষ পদ্ধতিটি , মেটামরফসিস বা গ্রেট ওয়াল অফ চায়না বা অন্যান্য গল্পে আমরা দেখবো প্রায় অলীক এবং আশ্চর্য কোনো বিন্দু থেকে শুরু হয়ে তার গল্পগুলি বিশদে এবং বিস্তারে যেতে থাকবে ,ক্রমশ সেতু তৈরি হবে পাঠকের সঙ্গে লেখকের । সুররিয়াল ,মিনিয়েচার ন্যারেটিভ এর যে পদ্ধতি এবং প্রকরণ সেগুলি আজও আলোচিত এবং প্রাসঙ্গিক হতে থাকবে ।
পরিহাস কি , কেন সেটি হাসির উদ্রেক করে , কেনই বা প্রচ্ছন্ন বিষাদ এবং দুঃখবোধ পরিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকে সেগুলি না বুঝলে কাফকার লেখাগুলি সম্পূর্ণ অনুধাবন করা শক্ত।
স্বপ্ন যেমন অযৌক্তিক , তেমনই পরিহাসগুলি সেই ধারণার ওপরে ভর দেয় যেখানে যুক্তিহীনতা প্রাসঙ্গিক এবং তখনই অর্থবহ যখন সেগুলি যুক্তির পথ বর্জন করে । একটি স্বপ্নদৃশ্য এবং পরিহাস সেখানেই মানে খুঁজে পায় যেখানে সে অযৌক্তিক ,র্যাশনাল নয় ।
সেভাবেই ,যা আপাত মজার নয় , সেটি ও মজার হয়ে উঠতে পারে , তুমুল পরিহাস ঠিক ততটা হাসির নয় আর ,অল্প দুঃখ সেখানে মিশে থাকে। কাফকার প্রায় সবকটি চরিত্র এভাবে তাদের strange এবং funny পরিস্থিতিতে নিদারুণ যন্ত্রণার সঙ্গে এবং সততার সঙ্গে ভেবে যেতে থাকে যুক্তিপরম্পরা , একটা অশেষ ট্র্যাজেডির মধ্যে যুক্তির গ্রাহ্যতা খুঁজতে থাকে । তাই , গ্রেগর সামসা একদিন বিশাল গুবরে পোকা হয়েও ,তার অসম্ভব সব অসহায়তা নিয়েও, হাহাকার এবং চিৎকার না করেও পরিস্থিতিকে বুঝতে চায়, মানিয়ে নিতে চায় নিজেকে, যাপন খুঁজতে চায় এই অলীক ,অযৌক্তিক পরিসরে ।
আমরা বলতে পারি এটি বিশুদ্ধ প্রতীক ,বিশেষ করে আমরা জানি জিউস মিস্টিসিজম, জিউস কাব্বালা এবং তার মেটাফিজিকাল বিষয়গুলি দিয়ে কাফকার লেখাগুলির ইন্টারপ্রিটেশন হতেই পারে , existential angst এর একটি প্রকৃত প্রকাশ হিসেবে ভাবতেই পারেন অনেকেই । সমালোচকরা বলেন এটির আদপে কোনো প্রয়োজন নেই । এই সাহিত্য সৃষ্টিগুলি ,আরো অনেক সার্থক সাহিত্য কাজের মত সম্পূর্ণ ভাবে ভাব নিরপেক্ষ , একমাত্র সাহিত্যের নিজস্ব যে সৃজন , তার কল্পনা এবং মীমাংসার প্রতি সৎ ..
‘I was so lost in the frenzy of big words…’
প্রথম জীবনে ডায়েরিতে লিখেছিলেন কাফকা ,এর পরবর্তীতে উনি মেটামরফোসিস এবং অন্যান্য গল্পে ক্রমশই বেছে নেবেন শব্দের প্রায় নির্জন ,নির্মেদ আয়োজন,যেখানে প্রধান এবং ইন্সট্রুমেন্টাল হয়ে উঠবে তাঁর স্টাইলিং , রবার্ট ওয়েলসার এবং গুস্তাভ ফ্লবার্টের যোগ্য অনুগামী হয়ে উঠবেন তিনি , প্রমাণ রাখবেন ইউরোপিয়ান সাহিত্যের ইতিহাসের প্রবহমান স্রোতে তিনি নিছক প্রক্ষিপ্ত নন , বরং সেই ধারায় দৃঢ়প্রোথিত তার শেকড়, নির্মিতি যথার্থ উত্তরাধিকারে ।
ঋণ : Adam Thirlwell