
দ্রৌপদী মুর্মু, রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর
বেবী সাউ
আমাদেরই রাষ্ট্র
আমাদের ভক্ষণের
কলা কৌশল এবং
গুণাবলী সম্পর্কে দীর্ঘ এক হলফনামা জারি করেছে…
যদিও কিছুদিন আগে
এ ছিল নির্মম এবং কঠোরতায় ভরা…
কিন্তু
আজ আমাদের কৃষকেরা মৃত
তাদের দাবি দাওয়া মৃত
তাদের আশা ভরসা
বৃষ্টির জন্য বারবার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা
শ্রাবণ অগ্রহায়ণ মনে রাখা——
এবং…
এবং
যেভাবে ফেলত বীজধান,
তিথি নক্ষত্র মিলিয়ে
যেভাবে রচনা হত
মাটির পূজা
যেভাবে তারা শিখেছিল
প্রপিতামহদের কাছ থেকে
কৃষিকাজের কৌশল
এবং
প্রকৃতির সঙ্গে জুড়ে
প্রকৃতি ভালোবেসে
প্রকৃতির মধ্যে প্রকৃতি হয়ে ওঠা——
আজ সে সবই মৃত এবং নষ্ট…
মহামান্যা, এসবের ঢাল হিসেবে
এসবের কন্ঠ হিসেবে
এসবের সমস্তটাই
সম্মানের মুখোশ পরিয়ে,
সাজিয়ে পেশ করা হয়েছে আপনাকে—
বিনিময়ে কেড়ে নেওয়া হয়েছে
আমাদেরই শিল্প, সংস্কৃতি এবং যুগ-যুগান্তের ঐতিহ্য
এবং বাক স্বাধীনতাকে…
আমাদের জমি জামানত
শস্যখেত
বন জঙ্গল মাটি
পাহাড় পর্বত
বিশাল বিশাল শাল সেগুনের দেহ
এমনকি আমাদের গায়ের রং
আমাদের আদিমতম জনবসতি
আদিতম ভূখণ্ড
সব শব করে মুড়ে দেওয়া হয়েছে
শক্ত শক্ত কংক্রিট
এবং পাথরে
ফলে, ধনী যারা তারা,
আরও ধনের লোভে
কিনে নিয়েছেন
পাহাড়, ডুংরি
সেখানে জন্মানো গাছ
তার লতাগুল্মআদি
এবং ঝিরিঝিরি বয়ে চলা
শান্ত ঝরনাটিও
যে বনবালিকা
কষ্টে নয় ছন্দে
দুলতে দুলতে
ভরে আনত কলসি
এবং জানত এতদিন
এই জল, মাটি, পাহাড়
দিয়েছেন তাদের ঈশ্বর;
এবার বোঝানো হল তাকে
সব আসলে সরকারের…
অধিকারহীন হলাম আমরা
আমাদের ঈশ্বরও এবং
ধনীরা আবারও একবার
ধনী হওয়ার লোভে
মেতে উঠল
নদীগুলো বন্ধ করার কৌশলে
নকশা এঁকে
বালির ট্রাকে ভরে গেল
পৃথিবীর ভূমি
রাতের অন্ধকারে ধর্ষিত হলো সুবর্ণরেখা, কাঁসাই-এর বালুতট
শুকনো নদীর দিকে তাকিয়ে যখন
আমাদের বৃদ্ধ মাতামহী
মাঝে মধ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলে
আর শাপশাপান্ত করে
অদেখা, অচেনা সেই সরকারকে
মহামান্যা, সেই আঁচটুকু কি লাগে না আপনার গায়ে?
আপনি তো মাটির মানুষ
আপনি তো জঙ্গলের, নদীর, মাটির
আপনি তো বোঝেন দারিদ্র্য
আপনি তো দেখেছেন রুখা শুখা মানুষের অবস্থান…
জানেন বোঝেন
ভাতের জ্বালা
অধিকার কেড়ে নেওয়ার জ্বালা
নিজের দেশে বন্দি জীবনের কষ্ট!
কিন্তু এরা বললো
মাটি যেহেতু কাদা এবং ধুলো ছড়ায়
এবং পাথর শক্ত করে হৃদয়
সেই শক্ত পাথরের ওপর বসে
আমরা নতুন বেকারের দল
তরুণ যুবক -যুবতী
যাদের বহু আগে বলা হত
দেশের ফিউচার
বেকার জীবন কাটাচ্ছি
আর
চিবোচ্ছি
মুরগীর ঠ্যাং
শুয়োরের মাংস
ছাগলের ভুনি
গরুর গলকম্বল
আর
প্রপিতামহদের মাথার শক্ত খুলি
এক বালখিল্য বৃদ্ধ
রাষ্ট্রের নিয়ম মানতে চান নি বলে
অধিকারের কথা মুখ ফসকে
বলে ফেলেছিল বলে
দেশের প্রণম্য সিপাহিরা তুলে নিয়ে গেছে
বিরিয়ানির দোকানে
সেখানে পাওয়া যাবে আজ
ম্যান-বিরিয়ানি…
হো হো করে হেসে উঠছে সময়
হাততালি দিচ্ছে নরখাদকের দল
ভয় করে
ডর লাগে মহামান্যা
আমাদের ঝাড়খণ্ড
ওদের উত্তরাখণ্ড
মধ্যপ্রদেশের জঙ্গল
এবং ছত্তিসগড়
এবং
এবং ছত্তিসগড়
গভীর ছমছমে রহস্যময়তা
আদিতম বাসস্থান
পরিশুদ্ধ অক্সিজেন
সুন্দর প্রাকৃতিক আলো বাতাস
সহ্যকৃত তাপমাত্রা
পুষ্টিকর শস্যকণা
সবকিছু কালির আঁচড়ে
মুছে দিয়েছেন মহামান্য সরকার!
অবাক হই না আর,
শুধু ভাবি এই ভালো
নিলাম আর নিলাম…
আমাদেরই রাষ্ট্র আমাদেরকেই
ন্যুনতম নিলামে তুলে দিয়ে
তামাশা দেখছে
ঘরে আজ শস্য নেই
পুকুরে পানি নেই
শরীর গরমে জ্বলে
প্রবল শৈত্য প্রবাহে মরে যায়
আমাদের ঐতিহ্যের জঙ্গল আজ বিস্তৃত ফাঁকা মাঠ
ধর্মের বলি হওয়ার চেয়ে
প্রয়োজনের এই মাংস খাওয়া
আমাদের কিছুটা তো সত্য করে তুলবে!
কিন্তু আফশোস হয়
রুখা শুখা মাঠে
আমাদের বনসম্পদ
আমাদের ভাষা
লোকগান, সংস্কৃতি
আমাদের বাঁচাটুকু হারিয়ে যাওয়া দেখে!
আপনি কি একবারও পারেন না, মহামান্যা,
এইসব গাছ-খুনিদের থামিয়ে দিতে?
পাহাড় জঙ্গল এবং নদীর স্রোতকে বইয়ে দিতে?
উপজাতিদের উপজাতি হয়ে থাকতে দিতে?
বীরসা মুণ্ডার জঙ্গল ও তার অধিকার ফিরিয়ে দিতে?
একবার যদি এটা হয়,
আমাদের জনসমাজ পুষ্পরেণু ছড়াবে শাল জঙ্গলে
আমাদের উপজাতি আপনাকে ভেবে নেবে মারাং বুরুর সমান
আমাদের বৃদ্ধ পিতামহ বৃদ্ধা মাতামহী বলবে:
মেয়ে বটে দোপদী! মেয়ে হয়ে রাখলো বটে গাছদের সম্মান…
কিন্তু…
কিন্তু,
প্রবাদের কথা মনে পড়ে
আশা করে বারবার মরে চাষা
বারবার মরে যায় কৃষক ও তার কৃষিকাজ
আর নিষ্ঠুর রাষ্ট্র বিকল্প খুঁজে
তাদেরই মৃতদেহের ওপর দাঁড়িয়ে
হাততালি দেয়…
মহামান্যা, আপনারই চোখের সামনে…
প্রতিবাদের উল্কাপিণ্ড এভাবেই প্রজ্বলিত হলো:
“বারবার মরে যায় কৃষক ও তার কৃষিকাজ
আর নিষ্ঠুর রাষ্ট্র বিকল্প খুঁজে
তাদেরই মৃতদেহের ওপর দাঁড়িয়ে
হাততালি দেয়…”
নির্বিকার, পারমাণবিক রাষ্ট্রের প্রতি এর থেকে ভালো কিছু আর বলার নেই।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
Spontaneous overflow of power feelings বলতে যা বুঝায়, এটা তাই। দুর্দান্ত উচ্চারণ, দেশপ্রেম ও প্রকৃতিপ্রেমের এক অনবদ্য কবিতা। অভিভূত, প্রিয় কবি।
অসামান্য…অসাধারণ…অনবদ্য…এইসব ক্লিশে এ আগুনকে সৌজন্যের মোড়কে মুড়ে রাখতে পারছে না…তাঁর গনগনে আঁচ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে কিঞ্চিৎ ফাঁকফোকর দিয়েও…সমাজ প্রমাদ গুনছে…আওয়াজ উঠছে – ওকে গলা টিপে ধর, পেছনের সারিতে ঠেলে দাও, ধাক্কা মারো মূলস্রোত থেকে…আসলে ভয়কে আস্ফালন দিয়ে পরাভূত করে রাখতে হয়…
এ এক আশ্চর্য কবিতায়ুধ যার ধারালো ফলায় ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে ভণিতা, ভড়ং ও পোশাকি সহবত।
এ লেখার কাছে প্রণত রইলাম এবং ইচ্ছেপ্রকাশ করলাম, এ লেখার তর্জমা হোক অন্য ভাষাতেও। কারণ এর সার্বজনীন আবেদন ছুঁয়ে যাক সকল মরমী পাঠককে।
অনিঃশেষ শুভকামনা, কবি।
আরও একটি উল্লেখ্য বিষয় হল, আপনি আপনার পরিচিত জঁর নিজেই ভেঙে বের করে এনেছেন এক অন্য কবিসত্তা। বাংলা কবিতায় এই উৎসব আনন্দ স্থায়ী হোক।
ধন্যবাদ আপনাকে
এমন হাহাকার,এমন অশ্রুসিক্ত অথচ সত্য সাহসী বিরল উচ্চারণ কবিতাটিকে করে তুলেছে অনন্য। বহুকালের শোষণ, বহু দশকের নিপীড়ন আর নিরন্তর বঞ্চনা প্রতিটি শব্দে স্পর্ধা নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
কবিকে হার্দিক অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা।
এই লেখা ভারতের প্রতিটি ভাষায় অনূদিত হোক।
আমার প্রণাম নেবেন দাদা
সময়োপযোগী বিশিষ্ট এই কবিতাটির দ্বারা বারংবার মগজপ্রহারের “সপাৎ” শব্দ জেগে উঠছে। হাতি শুনবে না এই গণকণ্ঠ। কবি বেবী সাউকে এই অধমসাধারণের শুভেচ্ছা।
ধন্যবাদ
স্পষ্ট কথায় প্রতিবাদের জন্য প্রণম্য হয়ে উঠলে ।
ধন্যবাদ দিশারীদা