কিঞ্চিৎ পরচর্চা – ১৩
লাকি না আনলাকি?
রূপশ্রী ঘোষ
'লাকি'না 'আনলাকি'? ভাগ্যবান না ভাগ্যাহত? সময় না অসময়? ললাটে ফাটল না কপাল চওড়া? এসব অদ্ভুত বিষয়ের মধ্য দিয়েই উঠে আসে এমন কিছু প্রশ্ন যেগুলির উত্তর আমরা কখনো খুঁজি না, পাইও না। উৎসবের এই প্রাক-উৎসবে সেই সবই উঠে এল রূপশ্রী ঘোষের কিঞ্চিৎ পরচর্চায়। সমসময়ের ব্যবচ্ছেদের পাশে কিছুটা আত্মসমালোচনাও।
কিঞ্চিৎ পরচর্চা ১৩ পর্বে পা দিল। এই তেরো শব্দটা দেখলে বা পড়লে প্রথমেই আমার রাহুলদার কথা মনে পড়ে। রাহুলদার থেকেই শেখা, ‘অনলাকি থার্টিন’ শব্দবন্ধ। তখন জার্মানিতে থাকতাম। একদিন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছে রাহুলদার সঙ্গে দেখা। রাহুলার সঙ্গে জার্মানিতে থাকাকালীনই আলাপ। যাহোক, রাহুলদা জানতে চেয়েছিল, রুপু কীভাবে এলে? আমি বলেছিলাম ১৩ নম্বর বাসে। শুনেই রাহুলদা বলল, ‘আনলাকি থার্টিন’। বললাম কী? আবার বলল। এবং বুঝিয়েও দিল। তখন থেকেই এই শব্দবন্ধটা মাথায় ঢুকে যায়। আজকের পর্বও আনলাকি কিনা জানা নেই, আর রাহুলদাও পড়বে কিনা জানা নেই। খুব ভালো করে ভেবে দেখলে বুঝব এই ‘তেরো’ শব্দ বা সংখ্যা যাই বলি না কেন, শুধু কি এটাই আনলাকি? নাকি তেরোর মতো আরো এমন অনেক সংখ্যা আছে। আর জি করের ঘটনা কত তারিখ ঘটেছিল? নির্ভয়া, ধানতলা, বানতলা, অনিতা দেওয়ান, আসিফা এমন অসংখ্য নামের ঘটনা কবে ঘটেছিল? এখন বা বছরের পর বছর দেশের অন্যান্য রাজ্যের বা আমাদের রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতি কত তারিখ থেকে কত তারিখ ধরে ঘটে চলেছে? আরও ইতিহাস ঘাঁটার কথা যদি ভাবি সেই সবকটা বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে, হিরোসিমা, নাগাসাকিসহ ঘটে চলা ইউক্রেন রাশিয়া, ইজরায়েল, প্যালেস্তাইন, রোহিঙ্গা এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত কোনোকিছুই কি শুধুমাত্র তেরোর মধ্যে আটকে? তেরো কারোর জীবনে হয়তো আনলাকি হয়েছে কিন্তু এমন অনেক আনলাকি জীবন আছে যা তেরোয় বাঁধা নয়। আমাদের বাঙালিদের দুর্গাপুজো এগিয়ে এল। এবারের পুজো মনে হয় তেরো তারিখ ছোঁবে না। তার জাস্ট আগেই শেষ হয়ে যাবে। তাতেও কি আনলাকি মনে হবে?
অনেকেই হোয়াটসঅ্যাপ স্ট্যাটাস বা ফেসবুক পোস্ট দিয়ে চলেছেন ‘উৎসব চাই না, শক্তির আরাধনা চাই’। এতদিন উৎসবের পাশাপাশি তাহলে কি শক্তির আরাধনা হয়নি? যদি হয়ে থাকে তাহলে এমন ঘটনা নিরন্তর ঘটে চলেছে কেন? রাজ্য থেকে দেশ, দেশ থেকে বিদেশ সত্যিই তো কারোরই কোনো উৎসব উৎসব মন মেজাজ নেই। তাহলে এই অন্তঃসারশূন্য মন নিয়ে কী চলছে চারিদিকে? কেনই বা চলছে? কোথাও তো কোনো আড়ম্বরের কমতি কিছু দেখা যাচ্ছে না। যারা বেড়াতে যাওয়ার তারা বেড়াতে যাবে। বেড়িয়ে ফেসবুক ইন্সটাতে ছবিও দেবে। যারা শপিং মলে বা অন্যান্য দোকানে সামান্য হলেও কেনাকাটা, আড্ডা দেওয়ার তারা তা করবে। কাল রাস্তায় বেরিয়ে দেখা গেল চারিদিকে বাঁশ, কেবল বাঁশ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে মানুষ। অনেক বাঁশ দিয়ে ইতিমধ্যেই রাস্তার চারপাশ ঘিরে দেওয়া হয়েছে। অজস্র হোর্ডিং কলকাতাকে রাঙিয়ে দিয়েছে। তাহলে উৎসব বলতে কি মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের? এই যেমন বিজ্ঞাপন দাতা, চ্যানেল, ব্যবসায়ী এরকমকিছু মানুষের জন্য? তাহলে এই বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ তারা কী করবে? যারা ধরুন বেড়াতে গেল না, বা পুজোয় রাত জেগে প্যান্ডেল হপিং করল না। বা পাড়ার পুজো কমপ্লেক্সের পুজোতেও কোনোকিছুতে অংশগ্রহণ করল না। তাদের কাজটা কী? আর গোটা কলকাতা জুড়ে রাস্তার আড়ম্বরই বা কাদের জন্য? তাহলে সত্যিই কি উৎসব হবে না নাকি সবই মুখের কথা? এবছর নীল সাদা আলোয় গোটা কলকাতা আলো ঝলমলে হবে না? তাহলে কী হতে চলেছে? এমন ঝাঁক ঝাঁক প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরছে। এ প্রশ্নও ঘুরছে যে, শুধু শক্তির সাধনাই বা কেন? বিবেক বা বুদ্ধির চর্চা নয় কেন? মেধার চর্চা নয় কেন? তাহলে কি ওটা সমবেতভাবে করা সম্ভব নয়? যে কারণেই এত মেধার বিকৃতি ঘটে যাচ্ছে? শাক্ত হয়ে শক্তির সাধনা দিয়েও যদি বিকৃতি, দুর্নীতি, খুন, ধর্ষণ, প্রতারণা কমানো যায় তাহলে তার চর্চাই হওয়া ভালো। এও তাহলে আলাদা করে আবার অপেক্ষায় থাকার ব্যাপার হয়ে গেল। শক্তির সাধনা চাই ঘোষণা করে, সাধনার পর আর এমন একটাও দুর্ঘটনা সমাজে ঘটে কিনা দেখার অপেক্ষা। এ একেবারেই হিং টিং ছট। কেবল আমার মাথার মধ্যে না সবার মাথার মধ্যেই এসব ঘোরাফেরা করছে। সবাই যদি একটু আন্তরিক হয় তাহলে হয়তো সমাজে অনেক বদল আনা যাবে। কেবল এ ওর দিকে কাদা ছুঁড়ে সে তার দিকে কাদা ছুঁড়তে থাকলে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি খেলার মানসিক আনন্দ হয়তো বাড়বে, কিন্তু আদতে সমাজের বা সাধারণ মানুষের লাভ কিছু হবে না। সমাজ, সিস্টেম সবই যে তিমিরে আছে, সে তিমিরেই রয়ে যাবে। কেবল সময় বয়ে যাবে বন্যার জলের মতো।
আসলে উৎসব মানে তো কেবল আস্তিক মানুষের পুজো করা নয়। তাহলে ঘটা না করে ঘটেও পুজো করা যায়। এই উৎসবকে ঘিরে জুড়ে আছে অর্থনীতি। একজন ফুল বিক্রেতা থেকে শুরু করে উবের মালিক, রেঁস্তোরা মালিক, তাদের কর্মচারী সমাজের প্রতিটি স্তরের কর্মীদের আয় নির্ভর করে এই দুর্গাপুজোর উৎসবকে কেন্দ্র করে। তাহলে অর্থনৈতিক দিকের একটা গতি আনতে বা রাজ্যের জি ডি পি বাড়াতে (যদিও বিষয়টা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান নেই) বিভিন্ন ছোটোখাটো ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীরা উঠে পড়ে লাগেন এবং সরকার, প্রশাসন সহায়তা করেন। করাই উচিত। কারণ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নির্ভয়ে বাঁচার মতো অর্থনীতিও যদি তলানিতে গিয়ে ঠেকে, তাহলে আর দেশের বা রাজ্যের হাতে থাকে কী? তাই অর্থনৈতিক উন্নতির কথা তো ভাবতেই হবে এবং তার গতিতেও তৎপরতা আনতে হবে। এসব বিষয়ে যদি তৎপরতা আনা সম্ভব হয়, তাহলে একটা নারকীয় ঘটনার বিচার ব্যবস্থাতে আনতে সেই তৎপরতা দেখা যায় না কেন? কেন এতদিন মানুষকে অপেক্ষা করতে হবে দোষীদের শাস্তি দেখতে? তাঁরা তো চাইলে সবই পারেন শোনা যায়, চাইলে আইনও ঘুরিয়ে দিতে পারেন। তাহলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার কথাটা কেবল ভোট চাইতে গিয়ে প্রচার না করে, ভোটে জিতে এসে কার্যে পর্যবসিত করছেন না কেন? যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, সাধারণ মানুষই তো তাদের নিয়ে আসেন। তাহলে সেই মানুষগুলোর কথা ভেবে শাসক দল কাজের গতি ত্বরান্বিত করবে না কেন? সাধারণ মানুষ কী কেবল দল বদল আর রঙ বদল দেখতেই থাকবে? গণতান্ত্রিক দেশ কথাটা গালভরা হয়ে যাবে? রাজনীতির আর এক নাম হয়ে যাবে দুর্নীতি এবং সাধারণ মানুষের প্রতিটি লোমকূপের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভয় নিয়ে বাঁচা? তাহলে গণতান্ত্রিক দেশে বাস করি এমন গালভরা কথা বলব কীভাবে। কোনো রঙের বদল চাই না। মানসিকতা এবং সিস্টেমের বদল হোক। যা হবে দীর্ঘমেয়াদী। আজ এই দল আছে কাল অন্য দল আসবে যেভাবে ক্রমান্বয়ে ঘটে চলেছে, প্রত্যেকেই ক্ষমতায় এসে নিজেরাই ক্ষমতা হয়ে যাচ্ছে। তাহলে সাধারণ মানুষের ক্ষমতা কবে আসবে? এই দশকোটি মানুষের একত্র ক্ষমতা? এখনো যেটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে তো দশকোটি মানুষের একত্র ক্ষমতা নয়। এটা শহরের কিছু মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত মানুষের আন্দোলন। শুরুর দিকে গ্রাম, অন্যান্য রাজ্য, বিদেশেও দেখা গেলে এখন সব স্তিমিত। কতদিন আর মানুষ পারবে এ লড়াই চালিয়ে যেতে? যদি তাদের ক্রমাগত ভয় দেখানো হয়? চোখ রাঙানি নয়, সহায়তা করুন। সাধারণ মানুষ আপনাদের দিকেই তাকিয়ে থাকে। তারাই আবার ক্ষমতায় আনবে আপনাদের। ক্ষমতার বদল তো কেউ এই মুহূর্তে চাইছে না। মানুষ চাইছে দোষীর শাস্তি। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। তাতে ধর্ষণ, খুন এসব চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে ধরে নেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু এই শাস্তি ব্যবস্থাতে গতি এনে যদি দ্রুত শাস্তি দেওয়া যায়, পরপর এমন শাস্তি দেখতে দেখতেও তো ওই ধর্ষকাম মানুষের মনের বদল ঘটতে পারে। কিছুটা হলেও যদি এরকম খুন ধর্ষণের মতো নারকীয় ঘটনার সংখ্যা কমাতে হয় তাহলে শাস্তি বাড়াতে হবে এবং বিচারে তৎপরতা আনতে হবে। নাহলে একটা ঘটনার শাস্তি দেখতে দেখতে মাঝে অসংখ্য খুন, ধর্ষণ ঘটেই চলেছে গোটা দেশ জুড়ে।
শান্ত মেজাজেই উৎসব, পুজো আনন্দ সবই চলুক। কারণ এই নয় যে, মৃত্যু কেবল এই পুজোর আগেই ঘটছে। এই মৃত্যু নৃশংস, নারকীয়, এবং সরকারি জায়গায় কর্মরত অবস্থায় ফলে এর প্রভাব প্রতিটি মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছে। তা না হলে রেপ তো আমাদের দেশের কোণায় কোণায় ঘটে চলেছে। তার জন্য কটা মোমবাতি আন্দোলন হয়। পুজোর আগে আগে যেকোনো বাড়িতে মৃত্যু মানেই সেই বাড়ির, তার আত্মীয়স্বজনদের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা। তাবলে কী পুজোর উৎসব থেমে থাকে? কখনোই থেমে থাকেনি এতদিন। মৃত্যু কোনো না কোনো বাড়িতে অহরহ ঘটেই চলেছে। কিন্তু এই ইচ্ছাকৃত কিছু বিকৃত মানুষের দ্বারা আর যাতে মৃত্যু না ঘটে সেদিকে নজর দেওয়া হোক। উৎসবের বৈদ্যুতিন আলোর ঝলকানি কতটা থাকবে জানা নেই, মনের বাতি সবারই প্রায় নিভে গেছে। তবুও উৎসব হবে, শান্ত মেজাজে। কিন্তু ঝলমলে বৈদ্যুতিন আলোর পিছনে আর যেন কোনো অন্ধকার নেমে না আসে। এটা আমাদের সকলের কামনা। গ্রাম গঞ্জের প্রতিটি কোণা থেকে শুরু করে শহরের রাজপ্রাসাদের কোনো কোণাকেও যেন এ অন্ধকার ছুঁতে না পারে। সেদিকেই কর্তৃপক্ষের খেয়াল থাকুক। আশা করব পুজোর উৎসবে পরচর্চার তেরো পর্ব যেন আনলাকি না হয়। সর্বান্তকরণে চাই ‘তেরো’ শব্দ বা সংখ্যার গা থেকে ‘আনলাকি থার্টিন’ শব্দবন্ধ মুছে যাক। আলোর উৎসব আলো বয়ে আনুক আগামীতে। মূর্তির অসুর বধ দুর্গা একাই করুক। সমাজের অসুরদের বধ করুক সমাজ-কর্তৃপক্ষ।