ভাবের ভূমিকম্পে ফর্মের ফাটল:  সনেট ও বাংলা সাহিত্য  <br />নিশীথ ষড়ংগী

ভাবের ভূমিকম্পে ফর্মের ফাটল: সনেট ও বাংলা সাহিত্য
নিশীথ ষড়ংগী

বাংলা কবিতার প্রায় সমস্ত ধরণের পাঠকের কাছেই আমন্ত্রণময় স্পর্শ পেয়ে এসেছে সনেট বা চতুর্দশপদী । মধুসূদনের হাত ধরে যার সূচনা হয়েছিল,এই সময়ে দাঁড়িয়েও সনেটের প্রতি সে মুগ্ধতা যে মুছে যায়নি তার প্রমাণ এখনও অব্দি লিখে চলা অনেকানেক চতুর্দশপদী। সময়ের বাঁক ও বিভঙ্গে তার প্রচ্ছদে ও পরিণয়ে অনেক অভিজ্ঞানই রূপান্তরিত হয়েছে তা যেমন সত্যি, তেমনই তার ভাবের হৃদয়েও অসংখ্য তরঙ্গভঙ্গের কলরোল অশ্রুত নয়।
একেবারে সূচনাপর্বে, সনেটের প্রথম ও প্রধান ভর যে তার গাঠনিক বা রাচনিক দিক, তা নিয়ে সঙ্গত-ভাবেই কোনও বিতর্ক থাকার কথা নয়। কিন্তু ওরই মধ্যে ভাব বা আবেগের অবারিত ফল্গুস্রোত যে, তার শরীরের ওপর অধিকার বাড়িয়েছে, তা মেনে নিতে অনেকেরই অস্বস্তি হতে পারে।
যে মধুসূদন ভগীরথ হয়ে বাংলাকবিতার মর্ত্যভূমিতে সনেটকে পরিবাহিত করেছিলেন প্রাচ্য-প্রতীচ্যেরউদার পরিগ্রহণে যাঁর কোনও ক্লান্তি ছিল না, সেই মধুকবি কখন লিখছেন তাঁর চতুর্দশপদী কবিতাগুলি?
আমরা প্রত্যেকেই একথা জানি যে,১৮৬২ তে মধু ইংল্যান্ডে যান ব্যারিস্টার অ্যাট্ ল পড়তে। পড়াশোনা ও থাকার আর্থিক যোগানের বিধি-বন্দোবস্ত করেই তাঁর যাত্রা। কিন্তু অর্থনৈতিক যোগাযোগ কোলকাতা থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হওয়াজনিত তীব্র অস্বচ্ছলতা,বর্ণ-বৈষম্যের অনুদারতা, যতোটাসম্ভব কম খরচে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ১৮৬৩ তে তাঁকে ভার্সাই চলে আসতে হয়।এদিকে কবির পরিবারবর্গও তাঁর কাছে এসে পৌঁছেছেন।এক মর্মন্তুদ পরিস্থিতিতে বিদ্যাসাগরের সাহায্য সহযোগিতায় ১৮৬৫ অব্দি পড়াশোনা চালিয়ে ১৮৬৭ তে কোলকাতা ফেরেন মধু।
এতো কথা বলা এজন্যই যে, মধুসূদনের প্রথম এই সনেটের ভাবনাটি ভেবে ওঠার প্রেক্ষিতটিকে জানার ইচ্ছে। তিনি আরও একটি কাজ করেছিলেন। ভার্সাইতে যখন ছিলেন মধু কবি, তখন সারা ইউরোপ জুড়ে চলছে ইতালিয় কবি দান্তে আলিঝিরি-র ষষ্ঠ শতবার্ষিকী উৎসব। দান্তের সম্মানে একটি কবিতা লিখে,তার ইতালি ও ফরাসি অনুবাদ করে, ইতালিয়
অনুবাদটি পাঠিয়ে দিচ্ছেন সে-দেশীয় রাজার কাছে। আর ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে বসে ১৮৬৫ তে লিখে চলেছেন একটার পর একটা সনেট (চতুর্দশপদী)। স্বভাবতই সেগুলো ছিল ইতালিয় কবি পেত্রার্কের অনুপ্রেরণায় বাংলায় লেখা চতুর্দশপদী কবিতাগুচ্ছ।
একান্তই প্রবাস, নিদারুণ অভাব,পরিবারসহ মধুর কাছে বাধার অন্তহীন সমুদ্র। প্রায় আট-নয় বছর পরে রোগ-শোক-অভাব-জর্জর কবিকে মৃত্যু এসে নিয়ে যাবে। মনে পড়ছে যাপিত জীবনকথা। দেশ, সহপাঠী,বন্ধু-বান্ধব, দেশের মানুষ ও প্রকৃতি এবং আরও অন্য অনেক অনুষঙ্গ। সেসব ভাবনাই অধিকার করে আছে তাঁর সনেটগুলি। ভাবনা-রাজ্যের এই ভূকম্পন কি কবিকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়নি এই লেখাগুলি ?

১৮৬৬-র ১ আগষ্ট ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’-র ‘বঙ্গ দেশে এক মান্য বন্ধুর উপলক্ষ্যে ‘মধুর একটি সনেট–

“হায়রে,কোথা সে বিদ্যা,যে বিদ্যার বলে,
দূরে থাকি পার্থ রথী তোমার চরণে
প্রণমিলা,দ্রোণগুরু।আপন কুশলে
তুষিলা তোমার কর্ণ গোগৃহের রণে?
এ মম মিনতি,দেব,আসি অকিঞ্চনে
শিখাও সে মহাবিদ্যা এ দূর অঞ্চলে।
তাহলে,পূজিব আজি,মজি কুতুহলে,
মানি যারে; পদ তাঁর ভারত-ভবনে!

নমি পায়ে কব কানে অতি মৃদুস্বরে,–
বেঁচে আছে আজু দাস তোমার প্রসাদে;
অচিরেই ফিরব পুনঃ হস্তিনানগরে;
কেড়ে লব রাজপথ তব আশীর্বাদে।
কত যে কি বিদ্যালাভ দ্বাদশ বৎসরে
করিনু, দেখিবে,দেব,স্নেহে আহ্লাদে।”

তীব্র অনুভূতিপ্রবণ, ভাববাদী, আধ্যাত্মবোধ এবং সৌন্দর্য অনুভবের কবি রবীন্দ্রনাথ প্রথম তাঁর লেখা ‘কড়ি ও কোমল ‘কাব্যগ্রন্থে রচনা করেছিলেন বেশ কিছু চতুর্দশপদী কবিতা।কখন লিখছেন রবীন্দ্রনাথ? কবি তখন ২৪-২৫ বছরের যুবক। ২-৩ বছর আগেই বিয়ে হয়েছে তাঁর। নতুন বৌঠান কাদম্বরীর প্রয়াণ(?)ঘটেছে ২১ এপ্রিল ১৮৮৪(২৪ বছর বয়সে)। একদিকে
বিবাহিত যুবক রবীন্দ্রের কিশোরী বধূর প্রতি প্রেম ও অন্যদিকে প্রাণাধিকা বৌঠানের অপমৃত্যুর তীব্র বিষাদময়, বেদনাদীর্ণ মন–এই আবহে লেখা ‘কড়ি ও কোমল’ -র সনেট গুচ্ছ।
তাইতো তাঁর এসব সনেট গুলি এক একটি সম্পূর্ণ কবিতাই। আত্মকথনধর্মী এদের ভর তাই ভালোবাসা। আর মৃত্যুরহস্যের গভীর অনুভূতি দিয়েও গাঁথা। এবং এর সঙ্গে মিশেছে যৌবনের উচ্ছ্বলতা আর বহির্মুখীনতা। খুব স্বাভাবিকভাবেই এ সনেটগুচ্ছের হৃদয় জুড়ে থাকবে তীব্র গীতলতা। প্রধানত গীতিকবিতার স্বর্ণরথে তিনি আরোহী করেছিলেন এসব সনেটকেই।
রবীন্দ্রনাথের সনেটগুলোতে তাই পাঠকেরা গঠনগত আঁটোসাঁটো বাঁধন ও রচনাগত যথার্থতা খুঁজে না পেলেও হতাশ হয়ে পড়েন না। এই ক্ষোভ নিভে যেতে দেরি হয়না এর আশ্চর্য নিটোল ভাব–ব্যঞ্জনা এবং অসাধারণ সাহিত্যমূল্যের জন্য।

“আমি শুধু মালা গাঁথি ছোটো ছোটো ফুলে,
সে ফুল শুকায়ে যায় কথায় কথায়!
তাই যদি,তাই হোক, দুঃখ নাহি তায়–
তুলিব কুসুম আমি অনন্তের কূলে।
যারা থাকে অন্ধকারে, পাষাণকারায়,
আমার এ মালা যদি লহে গলে তুলে,
নিমেষের তরে তারা যদি সুখ পায়,
নিষ্ঠুর বন্ধনব্যথা যদি যায় ভুলে!
ক্ষুদ্র ফুল, আপনার সৌরভের সনে
নিয়ে আসে স্বাধীনতা, গভীর আশ্বাস —
মনে আনে রবিকর নিমেষস্বপনে,
মনে আনে সমুদ্রের উদার বাতাস!
ক্ষুদ্র ফুল দেখে যদি কারো পড়ে মনে
বৃহৎ জগৎ, আর বৃহৎ আকাশ!”

(ছোট ফুল: কড়ি ও কোমল)।

পর্ব বিন্যাস : ৮+৬ এবং মাত্রা : ১৪ তুলে নিলে এই চতুর্দশপদী কবিতাটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ গীতিকবিতা হয়ে ওঠে না কি?
আবার,বন্ধন-অসহিষ্ণু,স্বাধীনতাকামী রবীন্দ্রনাথের হাতে পর্ব বিন্যাস এবং মাত্রা পর্যুদস্তও হয়েছে।

“এ শুধু অলস মায়া, এ শুধু মেঘের খেলা!
এ শুধু মনের সাধ বাতাসেতে বিসর্জন;
এ শুধু আপন মনে মালা গেঁথে ছিঁড়ে ফেলা,
নিমেষের হাসিকান্না গান গেয়ে সমাপন।”
—–আংশিক—

(গান রচনা: কড়ি ও কোমল: পাঠ বিন্যাস: ৮+৮; মাত্রাসংখ্যা: ১৬)।

অথবা আরও ভাঙচুর ঘটালেন রবীন্দ্রনাথ। ভাব কে অপ্রতিহত ও অপ্রতিরোধ্য করে তোলার জন্য চতুর্দশপদীকে কুড়ি মাত্রায় প্রবাহিত করে দিলেন তিনি —

“আকাশের দুই দিক হতে দুইখানি মেঘ এল ভেসে,
দুইখানি দিশাহারা মেঘ-কে জানে এসেছে কোথা হতে
সহসা থামিল থমকিয়া আকাশের মাঝখানে এসে।
দোঁহাপানে চাহিল দুজনে চতুর্থীর চাঁদের আলোতে।
—-আংশিক—-

(ক্ষণিক মিলন: কড়ি ও কোমল: পর্ব বিন্যাস:১০+১০:
মাত্রা সংখ্যা: ২০)।

মধুসূদন ও রবীন্দ্র- অনুবর্তী বেশকিছু কবিদের এই আলোচনায় সরিয়ে রেখে আমরা পৌঁছে যাবো তাঁর সময়ে আধুনিক ও সপ্রতিভ প্রমথ চৌধুরীর সনেটের কাছে। প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬) র সনেট পঞ্চাশৎ ১৯১৩ তে প্রকাশিত হয়।বছরটি ছিল রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির গৌরবময় অধ্যায়। প্রমথ চৌধুরী প্রধানত এক প্রাবন্ধিক। তিনি গল্পকার এবং কবিও। আধুনিকতায় দীক্ষিত, সাহিত্যে চলিত ভাষা ব্যবহারে অগ্রণী তিনি। সনেটে ফরাসি রীতির অনুরক্ত প্রমথ চৌধুরী তাঁর রচনায় সঙ্গতভাবেই নিয়ে এলেন সমসময়ের অনুষঙ্গ,তথ্যনিষ্ঠা ও সমাজচেতনা। আধুনিক মননের কাজইতো তাই।
দেখা যাচ্ছে, এর আগে ১৮৯৩ তে সাধনা পত্রিকায় প্রথম প্রবন্ধ লিখছেন তিনি। পরে,১৯০৬ এ প্রবন্ধগ্রন্থ ‘তেল-নুন-লকড়ি’। তো, প্রমথ চৌধুরী তাঁর সনেটে প্রথম যেটা করলেন,তা হলো,রোমান্টিক ভাবালুতাকে বাদ দিয়ে যুক্তি ও তথ্যের, গাদ্যিক আবহের, ব্যঙ্গ ও কৌতুকের ,লঘু চলনটিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মান্যতা দিলেন। যদিও এতে হয়তো সনেটের গঠনগত দিকটিকে তিনি ততোখানি উথালপাথাল করলেন না ঠিক, কিন্তু, ভাব ও ভাবনার জগতে সনেটের এক মৌলিক পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেললেন তিনি। সময়, কাল এবং মননবিশ্বের এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি তাঁর সনেটে চিহ্ন হিসেবে জেগে থাকলো।
রবীন্দ্রনাথ যতোই তাঁর সনেটের প্রশংসা করুন না কেন, প্রমথ চৌধুরী নিজেই বলেছেন —

” রবীন্দ্রনাথের lyric মূলত গীতধর্মী – তার flow অসাধারণ। সনেট হচ্ছে আমার মতে sculpture- ধর্মী-এর ভিতর উদ্দাম flow নেই। যেটুকু গতি আছে তা সংহত ও সংযত।” আবারও বলেছেন —

“আমি যে সনেট লিখেছি সে অনেকটা experiment হিসাবে… আমার সনেটের অন্তরে হয়ত art -র চাইতে artificiality বেশি…. আমি আসলে গদ্যলেখক তা আমি জানি।”

এইযে, প্রমথ চৌধুরী, তাঁর গদ্যপ্রাণতার কথা কবুল করছেন,সাধু শব্দের সঙ্গে চলিত শব্দকেও তুলে আনছেন সনেটের প্রচ্ছদে, রূপগত পরিবর্তন খুব বেশি না করতে পারলেও তা কিন্তু শেষঅব্দি সনেটভাবনাকেই রূপান্তরিত করে দিল। একটি নমুনা —

” ঘরকন্না নিয়ে ব্যস্ত মানব-সমাজ।
মাটির প্রদীপ জ্বেলে সারানিশি জাগে,
ছোট ঘরে দ্বোর দিয়ে ছোট সুখ মাগে,
সাধ করে’ গায়ে পরে পুতুলের সাজ।।
কেনা আর বেচা, আর যত নিত্য কাজ,
চিরদিন প্রতিদিন ভাল নাহি লাগে।
আর কিছু আছে কিনা,পরে কিম্বা আগে,
জানিতে বাসনা মোর মনে জাগে আজ।।
বাহিরের দিকে মন যাহার প্রবণ,–
সে জানে প্রাণের চেয়ে অধিক জীবন।।
মন তার যায় তাই সীমানা ছাড়িয়ে,
করিতে অজানা দেশ খুঁজে আবিষ্কার।
দিয়ে কিন্তু মানবের সাম্রাজ্য গড়িয়ে,
সমাজের তিরস্কার পায় পুরস্কার!”

(মানবসমাজ: সনেট পঞ্চাশৎ: পর্ব বিন্যাস: ৮+৬: স্তবক বিন্যাস: ৪+৪+২+৪)।

রবীন্দ্র-পরবর্তী সনেট রচয়িতাদের মধ্যে রজনীকান্ত সেন, প্রমথ চৌধুরী, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মৃণালিনী দেবী, কালিদাস রায়, মোহিতলাল মজুমদার , যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত , নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশ প্রধান।
প্রমথ চৌধুরী আগেই সনেট আলোচনায় উল্লেখিত হয়েছেন। বাংলা কবিতার একজন বিশিষ্ট ও উল্লেখযোগ্য কবি হিসেবে জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)সনেটের ফর্ম নিয়ে যথেষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। প্রচলিত ও প্রথাগত ফর্মের বাইরে গিয়ে তিনি একে ২২ থেকে ২৪
এবং ২৬ অক্ষরে বাড়িয়ে দিয়ে ১৪ অক্ষরের সনেটের কাঠামো-বিন্যাসকে প্রশ্ চিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। তো,তাঁর এই ভেঙে ফেলার কারণটিকে আমরা কীভাবে দেখবো?
হতে পারে, সনেটের এই চিরায়ত রীতি থেকে সরে আসতে চেয়েছিলেন তিনি, নতুনত্বের জন্য অথবা নিজস্বতা তৈরির জন্য। আর গড়ে তুলেছিলেন নতুন এক ঘরানা, যাতে তাঁর নিজস্ব চিন্তা ও আবেগকে আরও যথাযথভাবে এর মধ্য দিয়ে পরিবাহিত করে তোলা যায়।
সনেটের পংক্তি-বিন্যাসে অক্ষরগুলিকে বিস্তৃত করে জীবনানন্দ, থিম ও ভাবের গভীরতাকে আরও নিবিড় করে তুলতে চেয়েছিলেন। সেই ভাব ও থিমের সমূহ জটিলতাকে আরও সুনির্দিষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলার কাজে হয়তো ১৪- অক্ষরের কাঠামোটিতে তিনি স্বস্তি
পাচ্ছিলেন না। ভাবনা ও ইমেজের একটা প্রবাহ ও /বা ধারাবাহিকতা তৈরি করতে চাইছিলেন তিনি, অতিরিক্ত পরিবহনকে অক্ষত রেখে।
জীবনানন্দ হয়তো উপলব্ধি করেছিলেন যে, চিরায়ত সনেটফর্ম, স্বাভাবিক পংক্তি-বিন্যাসের পক্ষে অনুকূল হয়ে উঠবে না এবং এর সুর- মূর্ছনা বা সুর- প্রবাহকে বিক্ষত করবে। সনেট-ফর্মের অক্ষরগুলিকে দীর্ঘায়ত করে তিনি আরও স্বাভাবিক, জীবন্ত ও কথোপকথনর স্বরটিকে এর মধ্যে প্রোথিত করতে পেরেছিলেন। এরকমও মনে হয় আমাদের যে, ছন্দ ও মিটারের কঠোর অনুশাসন থেকে নিজস্ব স্বকীয়তা অক্ষুণ্ন রাখতে জীবনানন্দ, ভাবনার বিবিধ স্তর ও আবেগের পরিবহনকে আরও বিস্তৃত ও অভিমুখী করে তুলতে এই অভিনব আয়োজনে আন্তরিক ছিলেন। সুগভীর এক মননের স্তরে, বোধির অপরূপ তলে তাঁর ভাবনা
কে প্রবাহিত করে দেবার জন্যই হয়তো ২২ থেকে ২৪ এবং তার থেকে ২৬ অক্ষরে ধরে দিয়েছিলেন তাঁর সনেটগুচ্ছকে।
বাংলা ভাষায় নিজের কাব্যিক কন্ঠস্বর কে আরও বেশি ঘনপিনদ্ধ ও নতুন একটি ছন্দ-ঝংকার কে ভাব-প্রকাশের প্রকৃত বাহন হিসেবে ব্যবহার করতে এবং প্রথাগত সনেটের মধ্যে সমসময়ের উপাদানগুলিকে সংযুক্ত করতে হয়তো তিনি এই পরিকল্পনার আশ্রয় নিয়েছিলেন।
‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থের (১৯৩৪ এ রচনা ও ১৯৫৭ য় মরণোত্তর প্রকাশ) কবিতাগুলিতেই প্রধানত তিনি তাঁর সনেটের আশ্চর্য আরাধনায় মগ্ন ছিলেন।

“একদিন জল সিঁড়ি নদীটির পারে,এই বাংলার মাঠে
বিশীর্ণ বটের নীচে শুয়ে রবো; পশমের মতো লাল ফল
ঝরিবে বিজন ঘাসে,- বাঁকা চাঁদ জেগে রবে-নদীটির জল
বাঙালী মেয়ের মতো বিশালাক্ষী মন্দিরের ধূসর কপাটে
আঘাত করিয়া যাবে ভয়ে- ভয়ে- তারপর যেই ভাঙাঘাটে
রূপসীরা আজ আর আসে নাকো,পাট শুধু পচে অবিরল,
সেইখানে কলমির দামে বেঁধে প্রেতিনীর মতন কেবল
কাঁদিবে সে সারারাত,- দেখিবে কখন কারা এসে আমকাঠে

সাজায়ে রেখেছে চিতা; বাংলার শ্রাবণের বিস্মিত আকাশ
চেয়ে রবে; ভিজে পেঁচা শান্ত স্নিগ্ধ চোখ মেলে কদমের বনে
শোনাবে লক্ষ্মীর গল্প – ভাসানের গান নদী শোনাবে নির্জনে;
চারিদিকে বাংলার ধানী শাড়ি – শাদা শাঁখা –বাংলার ঘাস
আকন্দ বাসকলতা- ঘেরা এক নীল মাঠ- আপনার মনে
ভাঙিতেছে ধীরে – ধীরে; – চারিদিকে এইসব আশ্চর্য উচ্ছ্বাস –”
(একদিন জলসিঁড়ি: রূপসী বাংলা)।

আবার,

“মানুষের ব্যথা আমি পেয়ে গেছি পৃথিবীর পথে এসে-হাসির আস্বাদ
পেয়ে গেছি; দেখেছি আকাশে দূরে,কড়ির মতন শালা মেঘের পাহাড়ে
সূর্যের রাঙা ঘোড়া;পক্ষীরাজের মতো কমলা রঙের পাখা ঝাড়ে
রাতের কুয়াশা ছিঁড়ে; দেখেছি শহরের বনে শাদা রাজহাঁসদের সাধ
উঠেছে আনন্দে জেগে-নদীর স্রোতের দিকে বাতাসের মতন অবাধ
চলে গেছে কলরবে;- দেখেছি সবুজ ঘাস – যতদূর চোখ যেতে পারে;
ঘাসের প্রকাশ আমি দেখিয়াছি অবিরল।-পৃথিবীর ক্লান্ত বেদনারে
ঢেকে আছে;–দেখিয়াছি বাসমতী,কাশবন আকাঙ্ক্ষার রক্ত, অপরাধ
মুছায়ে দিতেছে যেন বারবার কোন এক রহস্যের কুয়াশার থেকে
যেখানে জন্মে না কেউ, যেখানে মরে না কেউ, সেই কুহকের থেকে এসে
রাঙা রোদ,শালিধান, ঘাস,কাশ-মরালেরা বারবার রাখিতেছে ঢেকে
আমাদের রুক্ষ প্রশ্ন, ক্লান্ত ক্ষুধা,স্ফুটমৃত্যু- আমাদের বিস্মিত নীরব
রেখে দেয় – পৃথিবীর পথে আমি কেটেছি আঁচড় ঢের,অশ্রু গেছি রেখে
তবু এই মরালীরা কাশ ধান রোদ ঘাস এসে এসে মুছে দেয় সব।”

(মানুষের ব্যথা: ২৬ অক্ষর)।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের (১৯৩৪-১৯৯৫)’ চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ নামে একশোটি সনেট সংগ্রহ প্রকাশিত হয় ১৯৭০ এ, যা লিখিত হয়েছিল ষাটের দশকে। তার আগে, অর্থাৎ চতুর্দশপদী প্রকাশের আগে, তিনি একে একে লিখে ফেলেছেন ছয়টি কাব্যগ্রন্থ — হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য (১৯৬১), ধর্মে আছো জিরাফেও আছো(৬৫), অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি, অন্ধকারে (৬৬),পুরোনো সিঁড়ি (৬৭), সোনার মাছি খুন করেছি (৬৭) এবং হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান (৬৯)।এর পরেও লিখবেন আরও সাতাশটিরও বেশি কাব্যগ্রন্থ। কিন্তু কেমন সনেট লিখতেন শক্তি? কবিপত্নী মীনাক্ষী ‘পদ্যসমগ্র ৭’-এ লিখছেন শক্তির সনেট অনুষঙ্গ —

“পরবর্তীকালের রচনাধারা পাল্টে সনেট রচনার মাধ্যমে তাঁর ছন্দের নিগড় শিক্ষার ইতিহাসপর্ব চলে- ছে ১৯৬৪ সালের প্রারম্ভ পর্যন্ত। কবিজীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘অনুশীলনবাসী মাত্রের প্রতি আমার সাদর নির্দেশ হলো– অন্তত একশটা সনেট লিখুন। তারপর নিজের পথ চোখের সামনে খুলে যাবে ‘(এই কাব্য…)। কার্যত দেখি এ শুধু তাঁর কথার কথা ছিল না, সত্যিকারের কবি হয়ে ওঠার জন্য একেরপরএক তিনি চতুর্দশপদী রচনা করেছেন শব্দ, অক্ষর মিলিয়ে মিলিয়ে,abba,cca,bba, abba, abc,abc এভাবে প্রতি পংক্তির পাশে লিখে লিখে, পেত্রার্ক, মিল্টন আর শেক্সপিয়ারের আদর্শ সামনে রেখে তিনি শব্দ আর ছন্দের বাঁধনশিক্ষা করেছিলেন “।

এখানে বলে নেওয়া ভালো যে, হাংরি আন্দোলনের অন্যতম মুখ, কবি শক্তির নাম ১৯৬১-র নভেম্বরের ইশতেহারে উল্লেখিত হচ্ছে সমীর রায়চৌধুরী,দেবী রায় ও মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে। কিন্তু সাহিত্যগত মতান্তরের জন্য ১৯৬৩ তে শক্তি হাংরি আন্দোলনের থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সান্নিধ্য গ্রহণ করেন।১৯৬১ তে প্রকাশিত হয়ে গেছে তাঁর হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য কাব্যগ্রন্থ। ১৯৬৫ তে বেরোবে ধর্মে আছো জিরাফেও আছো কাব্যগ্রন্থ। তাই মীনাক্ষীর কথামতো ১৯৬৪ সালের প্রারম্ভ পর্যন্ত তাঁর সনেটের প্রস্তুতিপর্বের সমাপ্তি ঘটে থাকলে,এই মধ্যবর্তীসময়েই সনেটসমূহ লিখে ফেলেছিলেন তিনি, বোঝা যায়।
কিন্তু কেন এই ‘শব্দ আর ছন্দের বাঁধনশিক্ষা’? আমাদের তাহলে পেছন ফিরে তাকানো দরকার একবার। আমরা জানি,হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ (১৯৬১)। কবিতা আছে বাহাত্তরটি। প্রথম পংক্তি বা তার ছিন্নাংশ সূচীপত্রে গ্রথিত।বছর দুয়েক আগে কবিতাগুলো লিখেছিলেন শক্তি।দু’দুবার পাণ্ডুলিপি হারিয়েও ফেলেন তিনি। মুদ্রিত সব ফর্মাও এক
বার। প্রথমে নাম রাখবেন ভেবেছিলেন যম(হতে পারে তাঁর এই প্রথম কবিতা ১৯১৫ তে ছেপেছিলেন কবি -সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু ‘কবিতা’ পত্রিকায়)। ভাবলেন,পরে, ‘নিকষিত হেম’ রাখলে ভালো হয়। শেষে, হলো ‘কেলাসিত স্ফটিক’। কিন্তু শেষপর্যন্ত কাব্যগ্রন্থের নাম হলো হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য। প্রচ্ছদও স্বাভাবিকভাবেই পরিবর্তিত হলো দু’তিনবার। গোটা প্রক্রিয়াটির মধ্যে একটা অস্থিরতা, চঞ্চলতা ও অব্যব্যস্তচিত্ততার ছবি ছড়ানো থাকলো সঙ্গতভাবেই। শক্তি কি তাঁর কবিতাতে সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না? যা লিখতে চাইছেন তা কি লেখা হয়ে উঠছে না তবে! নাকি এ তাঁর স্বভাব-বৈশিষ্ট্য, স্বভাব -ঔদাসীন্য?
চতুর্দশপদী কবিতাবলী বেরোচ্ছে মে,১৯৭০এ।তার আগে ‘কুয়োতলা ‘ উপন্যাস (১৯৬১), হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য (মার্চ,১৯৬১), রূপকথার কলকাতা (প্রবন্ধ , আগষ্ট, ১৯৬৫), ধর্মে আছো জিরাফেও আছো (অক্টো ,১৯৬৫), তিন তরঙ্গ (ডিসে,১৯৬৫), অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি, অন্ধকারে (জুলাই,১৯৬৬), লুসি আর্মানীর হৃদয় রহস্য (উপন্যাস, জুন,১৯৬৬), পুরোনো সিঁড়ি (আনু-
মানিক ১৯৬৭), সোনার মাছি খুন করেছি ( জুলাই, ১৯৬৭)। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো,১৯৫১ তে শক্তি কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া-র সদস্যপদ পান এবং ১৯৫৮ তে সে সম্পর্কের ইতিও টানেন। ১৯৭০ থেকে ১৯৯৪ অব্দি তিনি আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করেন। সনেটগুলি লিখছেন শক্তি ষাটের দশকে। প্রকাশ করছেন ১৯৭০ এ। এ নীরবতা তবে কেন?
কবিজায়া মীনাক্ষী কথিত এই সমস্ত এলোমেলো থেকে স্বেচ্ছাচারী,বন্ধন-অসহিষ্ণু শক্তির দরকার হয়ে পড়েছিল ‘ছন্দের বাঁধনশিক্ষা’ র — এরকমই মনে হয়েছে আমাদের। ‘সত্যিকারের কবি হয়ে ওঠার’ শব্দবন্ধটিও আমাদের প্ররোচিত করে বৈকি?
তো, এই তাহলে শক্তির সনেট লেখার সম্ভাব্য ইতিবৃত্ত!
কী লিখছেন কবি শক্তি, তাঁর সনেটগুচ্ছে, তা এবার দেখে নিতে পারি আমরা–

“ভালোবাসা পেলে সব লণ্ডভণ্ড করে চলে যাবো
যেদিকে দুচোখ যায় – যেতে তার খুশি লাগে খুব।
ভালোবাসা পেলে আমি কেন আর পায়সান্ন খাবো
যা খায় গরিবে,তাই খাবো বহুদিন যত্ন করে।
ভালোবাসা পেলে আমি গায়ের সমস্ত মুগ্ধকারী
আবরণ খুলে ফেলে দৌড় -ঝাঁপ করবো কড়ারোদে
‘উল্লুক’ আমায় বলবে – প্রসন্নতাপিয়াসী ভিখারী —
চোয়ালে থাপ্পড় যদি কম হয়, লাথি মারবো পোঁদে।

ভালোবাসা পেলে জানি সব হবে। না পেলে তোমায়
আমি কি বোবার মতো বসে থাকবো?চিৎকার করবো না,
হৈ হৈ করবো না, শুধু বসে থাকবো, জব্দ অভিমানে?
ভালোবাসা না পেলে কি আমার এ দিন যাবে
চোরের মতন, কিংবা হাহাকারে সোচ্চার, বিমনা–
আমি কি ভীষণভাবে তাই চাই ভালোবাসা জানে।”

(৬০- সংখ্যক সনেট: চতুর্দশপদী কবিতাবলী: ১৯৭০:
পর্ব বিন্যাস ৮+৬: মাত্রা:১৮)।

ষষ্টকের দ্বিতীয় পংক্তিতে শক্তি নিলেন ২১ মাত্রা।আর তার পরের পংক্তিতে মাত্রা ১৯ এবং ঠিক এর পরের পংক্তি হলো ১৬ মাত্রার। অষ্টকের দ্বিতীয় পংক্তিতে, চতুর্থ পংক্তিতে এবং ষষ্টকের প্রথম ও চতুর্থ পংক্তিতে মিল দিলেন না তিনি। কেন? ভালোবাসা না পাওয়ার জন্যই কি এই স্বেচ্ছাকৃত লণ্ডভণ্ড? না। এই স্বেচ্ছাচার তাঁর সময়ের দাবী। আবেগের সংহত প্রকাশের জন্য
ও সত্যিকারের কবি হয়ে ওঠার অভিপ্রায়ে যে সনেট- অভ্যাসের দরকার পড়েছিল, তার সঙ্গে এই বিরুদ্ধতা -র তফাৎ কিছু আছে বলে মনে হয় না আমাদের।দৌড়-ঝাঁপ ও পোঁদে –শব্দবন্ধের সঙ্গে মুগ্ধকারী এবং প্রসন্নতাপিয়াসী শব্দের আঘাতে আঘাতে কবি শক্তি
যে মধুর বিপর্যয়টুকু ঘটিয়ে তুলতে পারলেন তাকে তো কুর্নিশ জানাতে হয়, আমাদের!

বিনয় মজুমদারের (১৯৩৪- ২০০৬) অনেক কবিতায় বিজ্ঞানচেতনার পদ্ধতিগত পর্যবেক্ষণ ও বস্তুর এক আশ্চর্য অন্বেষণ লক্ষ্য করা যায়। আশ্চর্য হয়তো এই জন্য নয় যে,ছোটবেলা থেকেই গণিত বিষয়ের ওপর ছিল তাঁর তীব্র অনুসন্ধিৎসা। পরে তিনি মেকানিকাল ইন্জিনিয়ারিংও পাশ করেছিলেন। নক্ষত্রের আলোয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। কিন্তু তাঁর বিখ্যাত ও জনপ্রিয়
দুটি বই হলো ফিরে এসো চাকা (১৯৬০), যা ডায়েরি আকারে লেখা হয়েছিল এবং কবির সমসাময়িক ও কোলকাতা নিবাসী গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাককে তা উৎসর্গীকৃত এবং অন্যটি হলো অঘ্রানের অনুভূতিমালা। একান্ন পৃষ্ঠার সাতাত্তরটি কবিতাযুক্ত নামহীন সাল-তারিখ সম্বলিত এ কাব্যগ্রন্থকে একজন কবির ব্যর্থপ্রেমের ও স্পর্শবঞ্চিত আকাঙ্ক্ষার সুদীর্ঘ এপিটাফ বলে ধরে নেওয়া যায়। ফিরে এসো চাকা র অভিনব,একান্ত নিজস্ব ও মৌলিক ঘরানার সনেট, যেন, পাঠককে অচেনা এক সুড়ঙ্গের ওপার থেকে অতিপ্রাকৃত ও অপার্থিব হাত তুলে আহ্বান জানায়। কেন এরকম আশ্চর্য সৃষ্টির দিকে তিনি নিয়ে গেলেন আমাদের? তীব্র দুঃখবোধ, অসহনীয় বিষাদ এবং অপ্রাপনীয়কে ফিরে পাওয়ার অবিশ্বাস্য যন্ত্রণা সম্ভবতঃ তাঁকে এ ধরণের রচনার দিকে ছুটে চলার প্ররোচনা জুগিয়েছিল। ‘আত্মপরিচয়’ শীর্ষক রচনায় (কাব্যসমগ্র: সম্পাদনা, শ্রী তরুণ বন্দোপাধ্যায়: প্রতিভাস: ২০১৪:চতুর্থ সংস্করণ)বিনয় মজুমদার ঠিক কী
বলছেন দেখে নেওয়া যাক একবার —

” …..কাপড়ে বাঁধানো রয়াল সাইজের একটা প্রকান্ড ডায়েরি আমি যোগাড় করেছিলাম।মিল দিতে বিশেষ বেগ পেতে হতো না। মিল যেন আপনিই এসে যেতো। এই কলেজে আসার পর আমি পয়ারে কবিতা লেখার চেষ্টা করতাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় নির্ভুল পয়ার আমি
একবারও লিখতে পারতাম না। কোথায় ভুল হচ্ছে সেটা স্পষ্ট টের পেতাম। কিন্তু সে-ভুল শোধরাবার কোনো উপায় খুঁজে পেতাম না। তখন থেকে শুরু করে চার বছর লেগেছিলো আমার পয়ার লেখা শিখতে- ‘আবিষ্কার করতে ‘ লেখাটাই ঠিক ছিল মনে হচ্ছে। এবং ১৯৬০ সালের শুরুতে আমি পয়ার লেখার নিখুঁত পদ্ধতি আবিষ্কার করি। তারপর পয়ার ভিন্ন
অন্য কোনো ছন্দ লিখিইনি। এখন পয়ারই আমার প্রিয়তম ছন্দ। শুধু পয়ার লিখি। নানাকারণে এখন আমার মনে হয় কেউ নিখুঁত পয়ার লিখতে পারলেই তাকে কবি বলে স্বীকার করা যায়,
স্বীকার করা উচিত।”

এখান থেকে স্পষ্ট যে, বিনয় এ লেখাগুলিকে সনেট বলছেন না, বলছেন নিখুঁত পয়ার। তাই কি? আমরা বরং তাঁর লেখার একটি নমুনা পেশ করি—

“বাতাস আমার কাছে আবেগের মথিত প্রতীক,
জ্যোৎস্না মানে হৃদয়ের দ্যুতি, প্রেম; মেঘ-শরীরের
কামনার বাষ্পপুঞ্জসরোবর, মুকুর, আকাশ,
সাগর, কুসুম, তারা, অঙ্গুরীয়– এসকল তুমি।
তোমাকে সর্বত্র দেখি; প্রাকৃতিক সকল কিছুই
টীকা ও টিপ্পনীমাত্র পরিচিত গভীর গ্রন্থের।
অথচ তুমি কি, নারী, বেজে ওঠো কোন অবকাশে?
এতটা বয়সে ক্ষত– ক্ষত হয় নি কি কোনোকালে?

তৃপ্ত অবস্থা নেই, সমুদ্রের আবশ্যক জল
যতো পান করা যায়, তৃষ্ণা ততো বৃদ্ধি পেতে থাকে।
বৃষ্টির পরেও ফের বাতাস উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
প্রেম, রাত্রি পরিপূর্ণ অতৃপ্তির ক্ষণিক শান্তিতে।
সেহেতু তুমি তো, নারী, বেজে ওঠো শ্বেত অবকাশে;
এতটা বয়সে ক্ষত– ক্ষত হয় নি কি কোনোকালে?”

অষ্টক ও ষষ্টক যথাযথ ৮+৬,কিন্তু মাত্রা সংখ্যায় নিয়েছেন নিজস্ব স্বাধীনতা। সনেট-অনুষঙ্গ ধারণ করেও এ লেখা বিনয়-ভাষ্যে পয়ারের ভবিষ্যকেই মান্যতা দিতে বাধ্য হলো। তবুও তাঁর অগনিত মুগ্ধ পাঠক- সাধারণ এ কবিতার ক্লাসিক্যাল ঘরানা ও প্রায়-সনেট প্রাণস্পন্দন কে হৃদয়ে ধারণ করলেন সঙ্গতভাবেই। ফিরে এসো চাকা যেন বিনয়ের ধ্রুপদী আত্মার এক
অনবদ্য সাক্ষাৎকার। কবিতা-শরীরের মাত্রাগত অবস্থানকে সঙ্কুচিত ও প্রসারিত করার এই প্রচেষ্টাটুকু বিনয় সম্ভবত খুব সচেতনভাবে করেছিলেন বলে মনে হয় না আমাদের। ভাবের ও আবেগের অবিরল স্রোতধারা, তীব্র বেদনা ও সুগভীর অন্তর্দাহের ধারাভাষ্য যেন সহজ ও অবারিত প্রবাহে বিস্তৃত অথবা সংহত হয়েছে। এটি অনিয়মিত ও অনভিপ্রেত — এভাবে না
দেখে ভাবরাশির স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বতশ্চল অভিযাত্রার অন্য এক বাণীরূপ হিসেবে চিহ্নিত করলে সনেট-লগ্নতার সম্ভাব্যতাকে হয়তো স্পর্শ করা যায়। কিন্তু এই যে ব্যর্থ ভালোবাসার তীব্র দহনের অনুষঙ্গ- টিকে এতোক্ষণ ধরে প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছি আমরা,তা কি তবে কুয়াশাচ্ছন্ন এবং আবিল হয়ে পড়ে না, যখন বিনয় নিজেই লেখেন তাঁর ‘ আত্মপরিচয়’ শীর্ষক অনতিদীর্ঘ রচনাংশটিতে —

” এরপর ১৯৬০ খৃষ্টাব্দের গোড়ার দিকে আমি স্থির করলাম সর্বান্তকরণে কবিতাই লিখি।চাকুরি আপাতত থাক। গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় চ’লে গেলাম। সকালে জাগরণ থেকে শয়ন পর্যন্ত সারাক্ষণ কবিতাই ভাবতাম। আশেপাশে শহরের যে দৃশ্যাবলী দেখতাম তার কোনোকিছু কাব্যিক মনে হলে তখনি নোটবুকে টুকে রাখতাম! সৃষ্টির মূলে যে সূত্রগুলি তা জড়ের মধ্যে প্রকাশিত, উদ্ভিদের মধ্যে প্রকাশিত, মানুষের মধ্যেও প্রকাশিত। এদের ভিতরে সূত্রগুলি পৃথক নয় একই সূত্র তিনের ভিতরে বিদ্যমান। এই সারসত্য সম্বল ক’রে ভেবে দেখলাম জড়ের জীবনে যা সত্য, মানুষের জীবনেও তাই সত্য,উদ্ভিদের জীবনে যা সত্য মানুষের জীবনেও
তাই সত্য।অতএব জড় এবং উদ্ভিদের জীবন অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতে লাগলাম আমি। এবং তাদের জীবনের ঘটনাকে মানুষের জীবনের ঘটনা বলেই চালাতে লাগলাম। এইভাবে শুরু হলো কবিতার জগতে আমার পদযাত্রা। আমার নিজস্বতা। এইভাবে সৃষ্টি হলো ‘গায়ত্রীকে’ ,’ফিরে এসো, চাকা ‘।১৯৬০ সাল আমি এইভাবে লিখেই কাটালাম।”

কী লিখছেন কবি বিনয়? কাব্যরচনার নেপথ্যভূমিতে যে তত্ত্বকে হাজির করলেন তিনি, তা-তো দীর্ঘকাল- লালিত,শাখাপ্রশাখাময় বিস্তৃত,প্রায়-স্থিরীকৃত সিদ্ধান্তর সঙ্গে মেলে না! অন্তত গায়ত্রী ও ফিরে এসো, চাকা- র সঙ্গে তো নয়-ই! তাহলে?!
আসলে, আমাদের মনে হয়েছে,কাব্যসৃষ্টির অন্তরাল-বর্তী এই তত্ত্বটির সঙ্গে বিনয়ের রচনাগত প্রাণময়তার মৌলিক কোনও পার্থক্য সবিশেষ নেই। নেই যে,তার কারণ, অসহনীয় আর্তি ও বেদনার, বিষাদের আবহমণ্ডলে পৃথিবীর সমস্ত ও সমগ্রের প্রতি এই যে তাঁর দিব্যদৃষ্টি, নতুনতর উপলব্ধি, নবজাগরণ — তাকে তো এড়িয়ে যাওয়া যায় না। কিন্তু এ বিশ্ববোধ ও সমগ্রের চেতনা — এ-তো নতুন কিছু নয়। রবীন্দ্রনাথ অনেক আগেই তো বলেছিলেন — বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো , সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো….। তাতো অবশ্যই নয়, তুলনা প্রতি-তুলনার কথা সরিয়ে রাখলেও বলতে পারি যে, সবাইয়ের পাওয়া হয়তো কখনোই এক হতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ একরকমভাবে পেয়েছিলেন, বিনয় হয়তো অন্য একভাবে ।
তবে যে বিনয় লিখছেন —

“১৯৭০ খৃষ্টাব্দের মাঝামাঝি থেকে আমি ফের কবিতা লেখার দিকে খুব বেশি পরিমাণে মনোনিবেশ করেছি। গত দেড়বছরে আমি দুইশত-র বেশি কবিতা লিখে ফেলেছি। এখনো অব্যাহত গতিতে লিখে চলেছি। বিষয়বস্তুর অভাব হচ্ছে না, কারণ মানব-জীবনের সম্পূর্ণ অজ্ঞাত একলোক আমি আবিষ্কার করেছি। পৃথিবীর জড়, উদ্ভিদ ও মানুষের একত্রিত বাসের কারণ, উপায় প্রভৃতি ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি।”

‘মানব-জীবনের সম্পূর্ণ অজ্ঞাত একলোক’—বিষয়টি অনুধাবনযোগ্য। বিনয়ের সনেট-লগ্ন রচনাগুলির মৌলিকতা বিচারে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত একলোক আবিষ্কারের পরিপার্শ্বটির
নিহিত তাৎপর্য আমাদের মেধাবী অনুসন্ধান দাবি করে।

জীবনানন্দ-পরবর্তী বাংলা কবিতার একজন শ্রেষ্ঠ কবি জয় গোস্বামী(জন্ম ১৯৫৪)। সনেট নিয়ে একটা গোটা বই আছে তাঁর। ক্রিসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ যা প্রকাশিত হয় ১৯৭৭-এর ১৪ জানুয়ারি।এর আগে জয় লিখে ফেলেছেন প্রায় শ’ দুয়েক কবিতা। বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে তার প্রকাশও ঘটেছে।’দেশ’পত্রিকায় একটা কবিতাও বেরিয়েছে তাঁর। সেসময় তিনি প্রায় বাইশ বছরের যুবক।আমাদের কৌতুহল হয় এই বয়সে জয় কেন সনেট লিখতে এলেন? শুধু তাই নয়, প্রথম কাব্যগ্রন্থটিই (জয় একে পুস্তিকা বলছেন,কারণ এ বইয়ের কবিতাসংখ্যা মাত্র আটটি) সনেট দিয়েই তৈরি। জয় নিজেই জানাচ্ছেন —

” সেবার অক্টোবর মাসের শেষের দিকে খুব অসুস্থ হয়ে পড়লাম। খালি বমি পায়। কিছু খেতে পারি না। মাথা ঘোরে। সেই সঙ্গে থেকে থেকেই জ্বর। বাড়িতে বসে থাকি সারাক্ষণ। মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে তিন মিনিট দূরে মহকুমা লাইব্রেরীর রিডিং রুমে গিয়ে বই পড়ি। রিডিং রুম ফাঁকা। আমি ছাড়া দ্বিতীয় পাঠক নেই। উত্তম দাশের ‘বাংলা সাহিত্যে সনেট’ বইটি পড়ে ঠিক করলাম আমিও সনেট লিখব। নিয়মকানুন শেখার চেষ্টা করলাম। এই সঙ্গে দীপ্তি ত্রিপাঠীর একটা বইও পড়েছি। হ্যাঁ, যে বইটা বিখ্যাত সেটাই। মাইকেল বা শক্তির চতুর্দশপদী পড়ে নয়, ইচ্ছেটা হল প্রবন্ধের বই পড়ে (আমার প্রথম বই: রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২: আনন্দবাজার: সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)।”

দুনিয়াদারি কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জয় আবার বলছেন—-

“আমার অল্প বয়সে আমি সনেট লেখার অভ্যাস করেছি। আমার ‘কবিতা সংগ্রহ ১ম খণ্ডে’ — শুধু ক্রিসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ নয়– অগ্রন্থিত কবিতার মধ্যেও কিছু আছে। তো, আমি বেশিরভাগই বাতিল করে দিলাম। ক্রিসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ যখন বেরোয়, তখন ১৭ টা কবিতা আমি মোট লিখেছি ,বই ১৪ দিনে। কিন্তু বইতে নিয়েছি আমি সাতটা আর এক
টা কবিতা যেটা সনেটের সীমা ছাড়িয়ে গেছিল।’ক্রিসমাস’ নামে যে কবিতা তার থেকে নির্বাচন করেছি।তেমনি, আমি যখন সনেট লেখার অভ্যাস করেছি সেখান থেকে অনেক কবিতা ‘কবি ও কবিতা ‘পত্রিকায় জগদীশ —
প্রশ্ন: হ্যাঁ, রবীন্দ্র গবেষক?
জয়: হ্যাঁ। জগদীশ ভট্টাচার্য সেই কবি ও কবিতা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, তিনি অনেক কবিতা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সেই সব কবিতা আমি যে বইতে নিয়েছি, তা নয়। কোনো বইতেই আমি গ্রহণ করিনি। ওর’অগ্রন্থিত’ তে মাঝে মাঝে কিছু আছে। ওইটা একটা চেষ্টা ছিল যে, আমার হাতের উপর যাতে একটা বশ থাকে, নিয়ন্ত্রণ আসে। তারজন্য আমি সনেট
লেখার অভ্যেস করেছিলাম। কিন্তু আমি পরবর্তীজীবনে মানে, যখন আমার বই বেরতে লাগলো….তখন যে আমি এই অভ্যেসটা কে ধরে রাখলাম তা নয়।
প্রশ্ন:একজন লেখকের সনেট লেখাটা কি আবশ্যিক?
জয়: শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলতেন জরুরি।
প্রশ্ন: আপনি কী বলেন?
জয়: আমি আমার অল্প বয়সে চেষ্টা করেছি। নিজের হাতের ওপর নিয়ন্ত্রণ টা যাতে থাকে। মানে, আমার মনে হতো যে –কবিতারই তো এটা একটা রূপ–এটা
আমার জানা থাকা ভালো। এজন্যই আমি চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ওই ফর্ম থেকে মুক্ত হবার জন্যই পরবর্তী কাজ। মানে, পরবর্তী সময়ে মনে হল–এই বন্ধনটা- র মধ্যে থাকবো না। কিন্তু ওই চলনের সঙ্গে সম্পর্কটা কেমন হয় আমার — আমার শব্দের সম্পর্কটা কেমন হয়–সেইটা বোঝার একটা চেষ্টা।
প্রশ্ন: বুঝতে পেরেছি। অনেকে বলেন আর কি যে, কবি হতে গেলে কিছু কিছু সার্টিফিকেটের দরকার হয়।তার মধ্যে একটা হচ্ছে সনেট লিখতে পারা। এ
রকম কোনো ব্যাপার?
জয়: না না।এটা একটা চেষ্টা ছিল নিজের দিকে দ্যাখার। যে, আমার সঙ্গে এই সনেট নামক রূপবন্ধটার সম্পর্কটা কেমন দাঁড়াচ্ছে। এটুকুই।এটা নিজের ওপর নিজের একটা পরীক্ষা।”

এটুকুই? আর কিছু নয়!কবি জয় অন্তত: এরকমইতো বলতে চেয়েছেন, আমাদের। আবার একইসঙ্গে এও বলছেন —

“আজ বুঝি, ওগুলো সনেট হয় নি।পরেও অনেক সনেট লিখেছি সেসটিনা,ব্যাল্যাড,ওড এসবও চেষ্টা করেছি। কিন্তু আর কখনও কোনও ঘোষণায় যাইনি।কী যে জাহির করার লোভ পেয়ে বসল তখন!”

এসবই হয়তো জয়ের কবিসুলভ বিনয়। কিন্ত কবি মাত্রই বোঝেন, নিজেকে জাহির করার ওইতো বয়স! জয় যাই- ই বলুন না কেন, তাঁর সনেট লেখার একটা পরিপ্রেক্ষিত ও অন্তর্গত অনুপ্রেরণা অবশ্যই ছিল, তা না হলে সতেরোটি সনেটও তিনি লিখে উঠতে গেলেন কেন?
আসলে,জয়-লিখিত সনেটগুলির বিশিষ্টতাই এর একমাত্র উত্তর।
আমাদের মনে হয়েছে, তাঁর সনেটগুচ্ছ ধারণ করেছে প্রেম প্রত্যাশা ও সমাজমনস্কতার অভিনব প্রকাশ কে এবং যা অচিরাচরিত থিমের অপ্রত্যাশিতকে আহ্বান জানিয়েছে সাদরে।
জয়ের সনেটগুচ্ছের ভাষা, ফর্ম, কনটেস্ট এবং স্ট্রাকচার প্রচলিত ও অপ্রচলিত দুই রীতিরই আশ্চর্য এক মেলবন্ধন। এক অভাবিত পরীক্ষা- নিরীক্ষা। জয়ের সনেটগুলি তাঁর পাঠকদের কাছে তুলে আনে এক তাজা, জীবন্ত জীবনবোধের একঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া। নিয়ে আসে ভালোবাসা ও সংসার-লগ্ন এক প্রতিবেশ,যা তাঁর সমসাময়িকতার দ্বারা অনিন্দিত ও নুরণিত।
জয়ের সনেটগুচ্ছ আধুনিক বাংলা কবিতার শক্তিশালী এক অভিমুখ। ফর্মের যে সম্ভাবনা, তার
দিগন্তকে জয় তাঁর সনেটের মাধ্যমে অনেকটা দূর অবধি প্রসারিত ও প্রবাহিত করে দিতে পেরেছেন।জয় তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অবলোকন দিয়ে সনেটগুচ্ছকে আরও সম্পর্কিত ও খাঁটি করে তুলতে পেরেছেন। প্রথম সনেট ই ধরি না কেন? কবিতার মিল বিন্যাসই জয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষার যেন এক আশ্চর্য শস্ত্র হয়ে উঠেছে। মিল বিন্যাসের বৈচিত্র্যে এই সনেটটি আরও রূপবান হয়েছে। তৃতীয় সনেটটিতে দেখা যাচ্ছে জয়ের যাপনের আনন্দঘন মূর্তিটিকে এবং বিস্ময় ও দ্দীপনার আশ্চর্য উৎস হিসেবে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যকে।
জয়ের প্রথম সনেট টি এরকম —

” সম্পূর্ণ ক্ষুধার নীচে বালি আর সোরা আর গন্ধকের গৃহ….
অক্ষরে করুণ ঘন্টা আরো ক্ষিপ্র করে তুলে কিরণ ক্ষমতা
ভরে নিতে প্রক্ষেপণে, তুমি কি সমস্ত শেষে আমাকে সমীহ
করাই মনস্থ করলে শ্যামল ধনুক-তীর? এমন কি শমীও

ভেবে দ্যাখো,এ-পর্যন্ত এ-কথা জানে না। রাত্রে বালু- তীর ধরে
হেঁটে গেছে আর তাঁবু নেমে এল চারিদিকে অবনত, মোটা….
বালির উপরে উঠে অজ্ঞান ঘুমের শ্বাস থেমে থেমে দোরে
ধাক্কা দিল, তারপর স্বপ্নে এসে দেখা দিতে তুমি চমকে ওঠা

হা-খোলা সংক্ষুব্ধ দেহ ঢেকে নিয়ে মুঠোভর্তি শাড়ির প্রান্তকে
আবিষ্কার করে ফের আমাকেও ডেকে দিলে … ‘অন্ধকারে তোকে
সৈকতের পাশে ফেলে এসেছি, এখন বালি সরিয়ে বসুধা
অর্ধখান করতেই জলরাশি ঝকঝকে চোয়াল, ব্যারাকুডা…’

তীরভূমি জ্বলে ওঠে; প্রৌঢ়তা, ধাতুর টুকরো সম্পূর্ণ চুম্বকে
তুলে দেখি শমী আর শ্যামল ধনুক ভস্ম, অবশেষে ক্ষুধা!”

(জতুগৃহ: ক্রিসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ)।

শ্মশ্রুময় নামের পঞ্চম সনেটে প্রতিদিনকার কথ্যভাষার সঙ্গে নাগরিক ইমেজারিকে কী আশ্চর্যভাবে ধরে দিয়েছেন জয়! গ্রামজীবন ও ধ্রুপদীভাষার চিরায়ত দাপট থেকে বেরিয়ে এসে বাংলা কবিতাকে অন্যএক রূপে প্রতিষ্ঠা দিলেন তিনি। তাঁর ‘জন্মপত্র ‘ কবিতাটি হলো সপ্তম সনেট। সনেট টি প্রত্যক্ষ করালো জয়ের ব্যক্তিগত ক্ষয় ও ক্ষতকে। বিচ্ছেদ -বেদনার তীব্রতার সঙ্গে সান্নিধ্যবোধ এবং দুর্বলতা ও অরক্ষণকে। এসব উপাদানগুলিই, মনে হয়েছে আমাদের, জয়ের সনেটগুচ্ছকে বাংলাকবিতায় স্মরণীয় ও মূল্যবান করেছে। তাঁর অনন্য কন্ঠস্বর ,নিরীক্ষাধর্মী প্রত্যয় এবং প্রকাশের প্রাণবান পরিপ্রেক্ষিত, বাংলাকবিতার রূপান্তরের অভিমুখ সূচিত করেছে। অর্থনৈতিক অস্থিরতা,কবি হিসেবে আত্মপ্রত্যয় এবং আত্মপ্রতিষ্ঠার সঙ্কট আর আত্মপ্রকাশের তীব্রতম আবেগের ভিত্তিভূমি থেকেই জয়ের সনেট-রচনার যে নেপথ্য তৈরি হয়েছে, তাতে আমাদের সন্দেহ নেই।

সত্তরের একজন বিশিষ্ট কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল (১৯৪৯-২০২০)। সনেট রচয়িতা হিসেবে তাঁর নাম বাংলা কবিতায় উজ্জ্বল। প্রধানত বর্ণজীবের সনেট (২০১৩) বইখানি তাঁর সনেট রচনার গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞান হিসেবে চিরভাস্বর।এর আগে তিনি লিখেছেন দেবী(১৯৭০),রাত্রি চতুর্দশী (১৯৮৩), দূরের সন্ধ্যা(৮৩) পাঠকের সঙ্গে, ব্যক্তিগত (২০০১), ধর্মপুত্র, এখানে আসুন (২০০৭), বহিরাগত (২০০৮) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ। এছাড়াও পরে লিখেছেন শাদা পাথরের গোলাপগুচ্ছ (২০১৫) ও নবান্ন (২০১৯)। সনেট নিয়ে তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা সত্যিই ঈর্ষণীয়।শুধু
শেক্সপীয়র,পেত্রার্ক, দান্তে ই নন,তানকা সনেট থেকে কামিংস, উবের্তি, গ্যাব্রিয়েল,রসেটি — অনেকের গঠনরীতির তিনি সার্থক পরিগ্রহণকারী। সনেটে , ধ্রুপদী মিলবিন্যাসে তাঁর কৃতিত্ব তর্কাতীত। কী অন্ত্যমিল বিন্যাস,কী অক্ষরবৃত্ত ছন্দ, কী যতিচিহ্ন –সবক্ষেত্রেই পার্থপ্রতিমের প্রতাপ শিরোধার্য হয়ে আছে বাংলা সনেটরচনায়।কাঠামো বা আঙ্গিকের প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত থেকেও তাঁর নিজস্ব কণ্ঠস্বর স্পষ্ট শ্রুতিযোগ্য। কবিভাবনার বিচিত্র সৌন্দর্যে সুগন্ধময় হয়ে আছে শুধু বর্ণজীবের সনেট-ই নয়, তার সৌরভ পাওয়া যায় ‘রাত্রি চতুর্দশী’, ‘পাঠকের সঙ্গে,ব্যক্তিগত’ এবং ‘নবান্ন’ গ্রন্থেও। কেমন তাঁর সনেট,পড়ে নিই একবার —

“লেখার আগে পাণ্ডুলিপি এলো, শূন্যে কোথাও কেউ আদেশ পেয়েছে কাজ করবার জন্য যন্ত্রকে চেয়েছে, সে-যন্ত্র বলতে এই আমি, এলোমেলো।কে কাকে বা পায়, তবু আমাকে তো পেলো সেই চাপ–তা এখন আকাশে ছেয়েছে, বাতাসে গানের নৌকো অনেক বেড়েছে তার মৃদুতীক্ষ্ম,ধ্বনি, কথার ইজেল-ও।আমার দুপুর শেষ,বয়স বিকেলে, সুনিশ্চিত,দম গেছে অনেক টা কমে; ভরে আছি পুড়ে-যাওয়া পুঞ্জপুঞ্জ মোমে।এই পুঁজি তার কাছে ধরতে হবে মেলে,কে জানে সে নিয়ে যাবে ঠিক কোন ধারে, মণিপুরে, আজ্ঞাচক্রে, নাকি সহস্রারে (চাপ: বর্ণজীবের সনেট এবং আগন্তুক)।”

পার্থপ্রতিমের সনেট বরাবরই এক মহাকাব্যিক পরিপ্রেক্ষিতকে স্পর্শ করে থাকে, তাঁর অন্যান্য কবিতার মতোই। একবগ্গা নয়; তাঁর লেখা বহুমাত্রিক,বহুস্তরীয় এবং বহুবাস্তবতাকে ছুঁয়ে থাকে যেন। ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা, রাজনীতি, আস্তিক্যবোধ তাঁর লেখাকে বহুবর্ণময় করে তোলে।

জয় গোস্বামী-উত্তর বাংলাকবিতার একজন সৃষ্টিশীল ও উল্লেখযোগ্য কবি হলেন হিন্দোল ভট্টাচার্য (জন্ম -১৯৭৭-এ)। বেশ কিছুসংখ্যক সনেটের সন্ধান আমরা পাই তাঁর ‘জগৎগৌরী কাব্য ‘-এ। বাংলাকবিতায় তাঁর আবির্ভাব নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে।২০০৯-এ
জগৎগৌরী কাব্য-র আগেই তিনি লিখেছেন ‘ তুমি অরক্ষিত ‘(২০০২),’আবার হেমন্তকাল'(২০০৬) এবং ‘তারামণির হার'(২০০৮)। জগতগৌরী কাব্য সম্পর্কে
কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত লিখেছিলেন —

“একাধারে নির্মম আত্মনগ্নায়ন এবং পরিণামী নির্মল দেবায়নের যুগ্ম প্রেক্ষিতে হিন্দোলের সনেট থেকে সনেটের বিতত ফ্রেস্কোয় অনন্যমনস্ক হয়ে পড়ি।”

প্রায় সাতান্নটি সনেটে হিন্দোল তাঁর স্পর্শ ও প্রতাপে পাঠককে অভিভূত করে দেন।যেমন নতুন তাঁর ভাষা তেমনই তাঁর চিত্রকল্পের অভিনবত্ব।বরং একটি সনেটকেই উপস্থাপিত করি এখানে —

“জগৎগৌরীর কোলে প্রথম জাতক বসে আছি;
যদিও পাথর, তবু কী ভীষণ ফণার বিস্তার
মাথার উপরে; তবু যে আছে মায়ের কাছাকাছি
তার কোনও অশ্রু নেই, বুকে নেই ভয়ের পাহাড়।
বহুদিন কন্ঠলগ্ন, ব্যাঘ্রচর্ম মায়ের পোষাকে
এ কোন স্নেহের গন্ধ, মনসার কোলে ভালোবাসা,–
এক হাত শিশুকে নিয়ে, আশীর্বাদ ঝরছে দুইচোখে
অন্যহাত আলগা রাখা, জানুর উপরে তার ভাষা
বরাভয় হয়তো বা, পদ্মের উপরেই বাঁ পায়ে
বহুযুগ হেঁটে আসা কোমল সাপের বাঁকা তনু;
দশম শতাব্দী ছিল এ মূর্তির ছন্দে গায়ে গায়ে
পালযুগের বাংলাদেশে, তন্ত্র-ইতিহাস তার অণু
ছাপ রেখে গেছে আজও,তাকিয়ে রয়েছি মা’র কোলে
বিধ্বস্ত এ বাংলাদেশ,–ঢেকে যাক তোমারই আঁচলে।”

(১৫-সংখ্যা চিহ্নিত সনেট: জগৎগৌরী কাব্য)।

হিন্দোল যখন জগৎগৌরী কাব্য (২০০৯-এ) লিখছেন তখন তিনি প্রকাশিত অনেক কবিতার সঙ্গেই রচনা করে ফেলেছেন তিন -তিনটি কাব্যগ্রন্থ, যা আগেই উল্লেখ করেছি। কিন্তু চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ লেখা-পর্বে কেন তিনি সনেট আঙ্গিকটিকেই বেছে নিতে চাইলেন?
আসলে, এ কাব্য রচনার আগে, সারাবাংলার মন্দির -মসজিদ নিয়ে একটি গবেষণা কাজের জন্য হিন্দোল ঘুরেছেন দক্ষিণ থেকে উত্তর অবধি।সে গবেষণাকর্ম-র ফসল হয়ে উঠেছে একটি বইও। আমাদের মন্দির-মসজিদ সমূহের টেরাকোটার সমস্ত শিল্পেরই এক-একটি করে গল্প রয়েছে। সে কাহিনির সন্ধানও ছিল তাঁর অন্বিষ্ট ও অভিপ্রায়। তারই খোঁজে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন প্রচুর জায়গায়। যাঁরা শিল্পী, তাঁদেরকে বলা হতো সূত্রধর। এঁদের উত্তরাধিকাররা এখনও রয়েছেন বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে। পরিভ্রমণ পর্বের এ অভিজ্ঞতার সুবর্ণশস্যগুলি আরাধনা হয়ে পরিব্যাপ্ত হয়েছে সনেটগুচ্ছে। তবুও কেন এই সনেট? মন্দির – মসজিদের প্রাণকেন্দ্রে লোকায়ত ভাবনার যে ঐশ্বর্য, উৎকীর্ণ মন্দির – মসজিদ গাত্রে র আশ্চর্য ধ্রুপদী ঐতিহ্যই হয়তো প্রাণিত করেছে কবি হিন্দোল-কে।একাব্যের পরিশিষ্টঅংশে লিপিবদ্ধ তথ্যগুলি তাঁর
শ্রম, সান্নিধ্য ও সংবেদের আশ্চর্য আকর হয়ে আছে।

পাঁচশোরও বেশি সনেট লিখেছেন হিন্দোল এ সময় অব্দি। কিন্তু সনেট -সম্বলিত কাব্যগ্রন্থ জগৎগৌরী কাব্যটিই। যদিও সনেট ছাড়া কিছু অন্য কবিতাও আছে এখানে। তবুও সমসময়ের অবিন্যস্ত, আবিলতাপূর্ণ পারিপার্শ্বিকের মধ্যে দাঁড়িয়েও তিনি যে এ লেখাগুলি লিখে যেতে পেরেছেন, এ অত্যন্ত শ্লাঘার বিষয়। কী লিখছেন ও কেমনভাবে লিখেছেন এ সনেটগুচ্ছ,
হিন্দোল?
১৫- নম্বর সনেটটির দিকে একবার তাকাই না আমরা-সনেটের আঁটোসাঁটো বাঁধনের উপলখণ্ডে প্রতিহত হতে হয় না একেবারে;যেন স্বতোৎসারিত পংক্তিস্রোত অনর্গল, অবিরাম, বাধাবন্ধনহীন ছুটে চলেছে তার আকাঙ্ক্ষিত সঙ্গমের দিকে। পরিণামের দিকে বল্গাহীন। অথচ ভেতরে ভেতরে সংগুপ্ত থেকেছে তার স্থির-নির্দিষ্ট নিশানা। প্রবল ভাঙচুর ও অন্তর্ঘাত ঘটে চলেছে গুপ্ত-তরঙ্গে। একবিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকে, নিউ- কলোনিয়ালিজম-র রক্তমুখ পরিসরের মধ্যে দাঁড়িয়েও বাংলার নিজস্বশেকড়ের সন্ধান জারিরাখার জন্য হৃদয়ের কোথাও একটা অনিঃশেষ তল সঞ্চয়ে রাখতে হয়। হিন্দোল তা সংরক্ষণে দৃঢ়সঙ্কল্প।
দেবায়নের থেকে অনেক দূরসঞ্চারী তাঁর দ্রুতি।নিছক ঐশী মহিমায় অবরুদ্ধ না থেকে এ সনেটগুলি পরিভ্রমণ করেছে গণ-মানসের উদার আতিথ্যময় ব্যপ্ত আকাশে। সংগ্রহের ঝুলি ভরে উপচে উঠেছে সে আহরণের বিস্মিত ঐশ্বর্যে। হিন্দোল তাকে রূপ দিয়েছেন আধুনিকতম অবয়বে, উপলব্ধির সহজাত সরলতায়। এখানেই তাঁর জিৎ,তাঁর জগৎগৌরী-বোধ।
সনেটগুলির ন্যারেটিভনেস একইসঙ্গে ধরে রেখেছে তার ভেতরের মূর্ছনা ও সঙ্গীত-ধর্মিতাকেও। কৌম জীবন ও মৃত্তিকা-লগ্ন মানুষের সামাজিক মুখাবয়ব, দেব-নির্ভরতার ওপরে উঠে স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে বার বার। লোককথা ও লোক-উৎসবের পরি-কেন্দ্র থেকে তিনি হেঁটে চলেছেন বাংলার শান্ত-নির্জন-সহাবস্থানময় পরিধির দিকে।
হিন্দোলের সনেটের রাচনিক দিকটির কথা বলতে চেয়েছি কিছুটা। নির্ভার পংক্তিবিন্যাসের অসামান্যতার সঙ্গে সঙ্গে সমর্পণের ভঙ্গিটির নীচে বয়ে চলেছে আধুনিকোত্তর শব্দ ও ভাষাব্যবহারের অনিবার্য সিদ্ধি, বিশেষত এ সনেটের শেষ দুটি পংক্তি-‘তাকিয়ে রয়েছি
মা’র কোলে/বিধ্বস্ত এ বাংলাদেশ,–ঢেকে যাক তোমারই আঁচলে’–এর অনুরণন গোটা সনেটটির অন্তর্দেশকে পাঠকের সামনে উন্মোচিত করছে অব্যর্থভাবে। আরও একটি কথা এখানে বলার, এবং যা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমাদের মনে হয়েছে যে, এ কাব্যের
বিভিন্ন সনেটে যে সময়ের অভিনিবেশকে প্রত্যক্ষ করাচ্ছেন কবি, তার সঙ্গে রচনাপর্বের সময়টির উৎকেন্দ্রিকতাকেও রিলেট করছেন হিন্দোল। অর্থাৎ মন্দির-মসজিদ-গাত্রে যে শিল্পকর্ম খোদিত অথবা চিত্রিত হয়েছে,তাতে শাসকের দ্বারা পীড়িত সাধারণ্যের প্রতিনিধি হয়ে একজন শিল্পীর সমসময়ের নীরব বেদনার পুঞ্জীভূত ক্রোধ ও অভিমান মূর্ত হয়ে উঠেছে
বিভিন্নভাবে।এগুলি অবলোকনের মাধ্যমে তাঁর সময়-পর্বে সংঘটিত হওয়া অবিচারকেই পুনরাবিষ্কার বা পুনরুপোলব্ধির আলোকে অভিষিক্ত করতে চাইছেন তাঁর সনেটগুচ্ছকে,কবি হিন্দোল। অর্থাৎ সনেটগুলি শুধু হয়তো আত্মনগ্নায়ন ও নির্মল দেবায়নের যুগ্ম প্রেক্ষিতকেই ধারণ করছে, এমন নয়, এদের অন্তর্গত রাজনৈতিক ডিসকোর্সটিকেও কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না।

বাংলাকবিতায় সনেট নিয়ে অনেকেই ভেবেছেন,লিখেছেন। সবাইকে এই ছোট্ট নিবন্ধের মধ্যে নিয়ে আসা খুবই মুশকিল।মাত্র কয়েকজন সনেটরচয়িতার নামই নিতে পারা গেল বলে আমরা মার্জনা চাইছি। আরও অনেকের মতো এঁদের মধ্যে বর্ষীয়ান অনির্বাণ ধরিত্রী পুত্র(লাহিড়ী) যেমন আছেন,তেমনই আছেন অভিরূপ মুখোপাধ্যায়ের মতো তরুণও। কোনও সময়, সুযোগ
মতো আমরা এখানে অনুপস্থিত সনেটরচয়িতাদের নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নেবো। আসলে, এখানে আমরা ভাব বা ভাবনা ও আবেগ কীভাবে সনেটের ফর্ম বা শরীরকে ভাঙচুর করেছে, সেই বিষয়টিকেই এ আলোচনায় রাখতে চেয়েছিলাম। কার্যত হয়তো তা হয়ে উঠতে পারলো না। এ দায় প্রতিবেদকের, অজ্ঞতা ও মূর্খতার।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes