কিঞ্চিৎ পরচর্চা – আঠারো
শিশুদিবসে কি শিশুতীর্থ হবে এই পৃথিবী?
রূপশ্রী ঘোষ
আসছে ১৪ নভেম্বর। শিশুদিবস। কিন্তু কেমন আছে শিশুরা? আমরা যেমন ভাবে বড়ো হয়েছিলাম, এ সময়ে শিশুরা তেমন ভাবে বড়ো হচ্ছে না। হয়, তাদের সামনে ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে খুড়োর কল, নয় তাদের জীবনে আজ আর কোনও নিরাপত্তাই নেই। মধ্য এশিয়ায় আমরা দেখছি শিশুদের কবর। দেখছি শিশুদের লাশ। ইজরায়েলের হানায় গাজায় শিশুদের লাশ যেমন দেখেছি, তেমনই দেখেছি, এই ভারতবর্ষে যৌনবিকৃত মানুষের লালসার শিকার হওয়া শিশুদের লাশ। আবার প্রতিভাবান শিশুদের জীবনেও নেমে আসছে ঘোর বিপর্যয়। তাদের প্রতিভাকে নিজের মতো বিকশিত হতে দেওয়ার বদলে তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে খুব দ্রুত বড়ো হয়ে ওঠার জন্য অতিরিক্ত চাপ। একদিকে বনসাই করে রেখে দেওয়া হচ্ছে তো অন্যদিকে কার্বাইডে পাকিয়ে অকালে পাকিয়ে মেরেও ফেলা হচ্ছে। এই বিশ্ব কি সত্যিই শিশুদের বসবাসযোগ্য? এই সব প্রশ্ন নিয়েই লিখলেন রূপশ্রী ঘোষ।
শিশুতীর্থ হোক এই পৃথিবী
সামনেই শিশুদিবস। ঘটা করে অনেকেই পালন করবেন। কিন্তু কন্যাশিশুদের নিয়েই ভয় বেশি। পুত্র শিশুদের নিয়ে কি কোনো ভয় নেই? নিশ্চয়ই আছে। এটা অনেক মা আছেন তাঁরা ক্রমাগত চিন্তা করেন যে, আমার ছেলে যেন বড়ো হয়ে কোনো খারাপ কাজ না করে। কিন্তু মুশকিল আমাদের সমাজের, একটা শিশু কতটা শিশু, তার বোধ কতটা, তার কাছে কী কী জিনিস বলা যায় বা আলোচনা করা যায় সেই বোধ যদি বড়োদের না থাকে মুশকিলটা সেখানে হয়ে যায়। বাচ্চার কাছে একটা সীমারেখা টানতেই হয়, হওয়া উচিত। দুটো ঘটনা বলি। আমার এক বন্ধুর থেকেই শোনা। তাদের বাড়ি গড়িয়ায়। তার স্কুলের এক সহকর্মীর জীবনের ঘটনা। সেই সহকর্মীকে আমার বন্ধু এবং তার হাজব্যান্ড নিজের দিদি হিসেবেই দেখত। নিজের দিদি ছাড়া কোনোদিন কিছু ভাবেনি। সেই দিদির বিয়ের পর থেকে তো কষ্টের পর কষ্ট চলতেই থাকে, অতো গভীর আলোচনায় আর যাচ্ছি না। দিদির বর বড়ো একটা অসুখে পড়েন, দিদি তো দিনরাত সেবা, চিকিৎসা সব দিয়েও বাঁচাতে পারেননি। দিদির একটি বাচ্চা ছিল। ছেলে। তাকে শ্বশুরবাড়ির লোক এতটাই তার মা সম্পর্কে বিষিয়ে দিয়েছিল যে, মা ছেলের জন্য প্রাণপাত করে একা ছেলেকে বড়ো করেও সেই ছেলের আর মন কোনোদিন ফিরে পায়নি। সেই দিদি ওই বন্ধুর বাড়িতেই রাত দুটো নাগাদ কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মারা যান। হ্যাঁ, ওইদিন ওদের বাড়িতে রাতে থাকা খাওয়ার নিমন্ত্রণ ছিল। যাহোক ছেলে বড়ো হয়ে গেছে, এখন বাইরে চাকরি করে। যেদিন মা মারা গেছে সেদিন সে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। বাচ্চা অবস্থায় তার মা সম্পর্কে বিষিয়ে দেওয়ার কারণটা মনে হয় শুনেছিলাম ওই প্রেম করে বিয়ে, এবং বাবার অমন একটা কঠিন অসুখ তাও নাকি তার মায়ের জন্যেই হয়েছিল। মা কতটা খারাপ না হলে তার বাবার ওই হাল হয় কী… গোছের অবস্থা।
আরও একটি ঘটনা, আমি তখন ওই গাঙ্গুলীবাগানের একটা কমপ্লেক্সে থাকতাম। সন্ধেবেলা পাড়ার দোকানগুলোয় যেতাম কিছু কেনার থাকলে। ওখানে একটা দোকান ছিল, বিশাল লম্বা ঘর, অনেকটা ঢুকে গিয়ে দোকানের কাউন্টার। ভিতরে বসার জায়গা ছিল। দোকানটা এক বয়স্ক দম্পতি চালাতেন। এখন আর আছে কিনা জানা নেই। কিন্তু মহিলারা গেলে ওই আন্টি বসে বসে গল্প করতেন ভিড় না থাকলে। দেখতাম এক বিধবা দিদি আসতেন, রোজ গল্প করতেন তাঁর জীবনের। তাঁরও দুঃখ দেখতাম একটাই। তার পুত্র সন্তানকে তার শ্বশুরবাড়ির লোক মা সম্পর্কে বিষিয়ে দিতেন। মা কতটা খারাপ। হতেই পারে কোনো মা খারাপ। ঝগড়ুটে, দুশ্চরিত্র, স্বার্থপর, ঝগড়ার মুখে খুব খারাপ খারাপ কথা বলে এমনটা হতেই পারে। কিন্তু মায়ের কাছে বাচ্চা তো বাচ্চাই। বাচ্চার সঙ্গে নিশ্চয়ই মা তা করেন না। হ্যাঁ, বাচ্চাদের কাছে মায়েরা খারাপ কেন হয়? মায়েরা সারাক্ষণ ছেলেমেয়েদের এটা কোরো না, ওটা কোরো না, পড়াশুনো করো ইত্যাদি প্রভৃতি নিয়ে টিকটিক করেন। যা বাচ্চাদের একেবারেই অপছন্দের বিষয়। তাই মায়েরা খারাপ, তুলনায় বাবারা খারাপ না। বাচ্চারা সারাক্ষণ চায় মা কখন বাড়ি থেকে বেরোবে, ‘বাব্বা বেরোলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি’। এগুলো একেবারেই বাচ্চার স্বাভাবিক ব্যাপার। মা থাকলে টিকটিক করবে, চলে গেলে করবে না। বাবাদের ক্ষেত্রে তা নয়, কারণ বাবারা এতটা টিকটিক করেন না। উলটে কিছু বিষয়ে বাবাদের কাছেই প্রশ্রয়টা পায় বাচ্চারা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটা, কিন্তু উলটো দিকটাও আছে, মা বেশি ভালো, বাবা সব বিষয়ে টিকটিক করে। কিন্তু মায়েরা বাচ্চাদের ক্ষতি বা খারাপ চায় বলে মনে হয় না। আর বাচ্চাদের মাথায় আলাদা করে কোনো বিষ গুঁজে দেয় বলে মনে হয় না। আমি দুজনের কাছেই জানতে চেয়েছিলাম কেন বাচ্চাকে তার মা সম্পর্কে বিষানো হয়? তাঁরা বলেছিলেন, নাতি তাদের বংশের প্রদীপ, স্বর্গে বাতি দেবে তাই। ভাবলাম, এ আবার আলাদা করে মায়ের বিরুদ্ধে খারাপ কথা শিখিয়ে মায়ের থেকে বাচ্চাকে আলাদা করে, এসব শেখানোর দরকার কী? আমাদের তো মাতৃতান্ত্রিক দেশ নয়, মায়ের পরিচয়ে বাচ্চা বাড়েও না। সে তো জন্মসূত্রে ওই বংশেরই এবং বাতি দেওয়ার চল থাকলে সে এমনিই দেখে দেখে বাতি দেবে। আলাদা করে শেখানোর কী আছে। এ তো গেল যৌথ পরিবারে একসঙ্গে থাকার ফল। না থাকলে তাও কী হয় না, হয়। সুযোগ পেলেই। যদিও সত্যিই বাতি দেওয়ার চল আর নেই শহরে, গ্রামেও বেশিরভাগ বাড়িতেও, তবুও।
আমি যখন ছোটো ছিলাম তখন গ্রামের বাড়িতেও ঝগড়া ঝাটি হত। এখনও হয়, আমি অনুপস্থিত থাকি। গ্রামের ঝগড়া একটু আলাদা। শহরের মতো ষড়যন্ত্র করা হয় না ওখানে। ওখানে গ্রামের সহজ সরল মানুষ, মানে গৃহবধূরা হাঁউমাঁউ করে ঝগড়া করল। এ ওকে কিছু বলল, ও ওকে কিছু বলল, তারপর মিটে গেল। দু চারদিন কথা বন্ধ। কিন্তু বাড়িতে কোনো আত্মীয়স্বজন এলে বা কারও অসুখ বিসুখ বা অন্য যেকোনো বিপদেই সবাই ছুটে যায়। তখন আর ওই ঝগড়া ঝাটি হয়েছিলটাকে কেউ পাত্তাও দেয় না। তো এমনই একদিন আমার জ্যাঠতুতো বৌদি আর আমার মায়ের সঙ্গে কোনো একটা বিষয় নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল। মা খুব বেশি চেঁচামেচি করতে পারত না, এখনও পারে না। একটু শান্ত স্বভাবের ভীতু ভীতু মানুষ। কিন্তু ওই বৌদি তো শুরু করলে আর থামত না। আমি পাশে বসে, তাও আমার মায়ের নামে খারাপ খারাপ কথা বলেই চলেছে। আমার সামনে। কিন্তু বৌদি জানত আমি মাকে কিচ্ছু বলব না গিয়ে। আবার ঝগড়া হওয়ার ভয়ে। সত্যিই আমি বলিনি। আর আমি মাকে খুব ভয়ও পেতাম। অত বন্ধুত্বও ছিল না আমার সঙ্গে। কিন্তু আমরা ওখানে সবাই দুটো মানুষকে স্বাভাবিক নিয়মেই আলাদা করে চিনি। কেউ কাউকে সমালোচনা করে বা দুজনের নামে আলাদা করে বলে কিছু বোঝাতে হয়নি। যে যার মতো করেই চেনে মানুষগুলোকে। কিন্তু তার মানে এই নয় কিন্তু ওই বৌদি খুব খারাপ, সে আর আমার মায়ের সঙ্গে কথা বলে না, এমনটা নয়। ঝগড়া হলে দুদিন দুদিন সব রাগ থাকে তারপর আবার মিটে যায়। খুব গভীর সমস্যা হলে আলাদা কথা, সে কোনোদিনই মেটে না এমনটাও নয়। যে দুই বাড়িতে ঝগড়া হয় সেই দুই বাড়ির কেউ একজন মারা গেলেই মোটামুটি সব ভুলে আবার মিল হয়ে যায়। ওই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বেড়া’ গল্পটার মতো আর কী।
অর্থাৎ একজন বাচ্চাকে স্বাভাবিক নিয়মে বড়ো হতে দিলে সে নিজেই নিজের বুদ্ধি দিয়ে শিখে নেবে পরিবার, সমাজ, বন্ধুবান্ধব তার চারপাশ। তার মাথায় আলাদা করে ছোটো থেকেই গুঁজে দিতে হবে না, তোমার মা কতটা খারাপ আর বাবা কতটা ভালো বা ভালো ছিলেন। বাচ্চারা বড়োদের কথায় নাক গলানো বা মাথা না ঘামিয়ে নিজেদের একটা জগৎ তৈরি করতেই ভালোবাসে চিরকাল দেখা গেছে। জোর করে যদি বাচ্চাকে কোনো ষড়যন্ত্রের অংশীদার না করা হয়। বা তার সামনে এমন কোনো বিষয় যা তার জানার প্রয়োজন নেই এমনটা আলোচনা না করা হয়। কিন্তু এ তো গেল আমাদের যুগ বা তার কিছুটা পরের যুগের কথা। আমাদের যুগের যে শৈশব এখনকার যুগের থেকে তো অনেক আলাদা। আমরা আমাদের শৈশবে যেভাবে অবাধে খেলাধুলো করে বড়ো হয়েছি, বাড়ির বড়োদের কথা মেনে চলেছি এখন তো তা সম্ভব নয়। তখন আমাদের বিনোদন বলতে ছিল বই পড়া, বড়োদের কাছে গল্প শোনা, আর বাইরে বা ঘরে কিছু খেলা। টিভি দেখার স্বাধীনতা, মোবাইল গেম খেলা এত ছিল না। বা শহরে কম্পিউটার গেম খেলার সুযোগ কোনো কোনো বাড়িতে থাকলেও তা খুব অবাধে খেলতে দেওয়া হত বলে মনে হয় না। বরং যাদের অনেক বই থাকত বা তথাকথিত শিক্ষিত বাড়ি সেই বাড়ির বাচ্চারা বই পড়তেই শিখেছিল। আমরাও গ্রামে যারা গল্পের বই পেতাম পড়ে ফেলতাম। রূপকথার গল্প, ঠাকুমার ঝুলির পাশাপাশি বড়োদের পড়ার গল্প বলে নিষিদ্ধ বইগুলোও পড়তাম। ইনফ্যাক্ট নিষেধ করত বলেই আগ্রহ বেশি থাকত। কিন্তু এখনকার যুগ শহর গ্রাম মিলিয়েই সম্পূর্ণ আলাদা। এখনকার বাচ্চাদের তাদের যুগে তাদের মতো করেই বাড়তে দিতে হবে। আমরাও আয় মতো বাঁচতে চেষ্টা করি। আরাম কে না চায়। যবে থেকে গাড়ি নিয়ে বেরোতে শুরু করি, ভিড় ট্রেন এড়িয়ে চলি। আমরা নিজেরাও তাই। যা দেব, তারা তাই নেবে। কিন্তু কতটা? যুগ বদলে অনেক বিনোদনের বিষয় বেড়েছে, কিন্তু বই তো লুপ্ত হয়ে যায়নি? আজকালকার বাচ্চারা বই পড়া কমিয়ে সহজে আনন্দ পাওয়া যায় যাতে সেটাকেই বেশি বেছে নিচ্ছে। সবাই বললে ভুল হবে। আমার এক বন্ধুর বাচ্চা, ছেলের ক্লাসমেট সেই মেয়েটি এত গল্পের বই পড়ে যে, তার মা বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে বই কিনে কিনে। তার মানে এতটাও বই পড়া চায় না, কিছুটা বাইরে খেলাটাও দরকার। বা অন্য কোনো বিনোদন। আমার এক সহকর্মীর মেয়েও আছে সে তো পড়া নিয়েই পাগল, পরীক্ষা থাকলে নাকি ভোরবেলা উঠেও পড়তে বসে যায়। পড়াশুনায় খুবই ভালো সে মেয়ে। ছবি আঁকে, কবিতা লেখে এই বয়সেই। ক্লাস সেভেন। কিন্তু ছোটো থেকেই পড়া পাগল। কিন্তু এরকম বাচ্চা হাতে গোনা। বেশিরভাগ বাচ্চাই মোবাইল গেম, নয় টিভি, সিনেমা ইত্যাদি। বাইরে খেলার সুযোগ থাকলে সেগুলোও। কিন্তু যারা ব্যালেন্স করতে পারে ভালো। বা বোঝালে বোঝে যে, না পড়াটায় সময় বাড়াতে হবে তারা হয়তো শুধরে যাবে। এখনকার দিনে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি, বাবা মা দুজনেই চাকরি করেন, ফলে বাচ্চাকে বেশিরভাগ সময় একাও থাকতে হয়, তাই তাদের নিয়ে নিয়মিত খেয়াল রাখতেই হবে ফিরে এসে। কিন্তু যে বাচ্চাদের একা থাকার গল্পই নেই, বাড়িতে বহু লোক তাদের বাচ্চারাই ঠিক ঘরের এক কোণায় বসে মোবাইলে রিলস দেখে, নাহলে রিলস বানায় বা গেম খেলে। এই রিলস বানানোটা বড়োরাই শিখিয়ে দেন। আমি আগের পরচর্চায় বাচ্চাদের রিলস বানানো নিয়ে লিখেছি, সেখানে কীভাবে বাবারা মায়ের বিরুদ্ধে বাজে কথা শিখিয়ে রিলস বানাতে শেখাচ্ছে। একেবারেই দেখা রিলস থেকে লেখা। কোনো বানিয়ে বলা কথা নয়। আপনারা রিলসগুলোর দিকে একটু খেয়াল রাখুন দেখতে পাবেন। যাহোক, গ্রামের বাচ্চাদের কথা বলি, আমার চেনা বাচ্চারাই সাঁতার জানে না, লোক খেলাগুলো আর খেলে না, বড়োদের কাছ থেকে গল্প শোনে না, এমনকি বাড়িতে কেউ গেলে তাদের গা ঘেঁষেও বসে থাকে না। যার জন্য আমরা বকা খেতাম। বাড়িতে কোনো আত্মীয় এসেছে মানে তার গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকা এবং তারপর পড়তে না বসার জন্য বকা খাওয়া। বা বাড়িতে কেউ এলে চলে যাওয়ার সময় মনখারাপ হওয়া। এই মন খারাপ হওয়ার যে ব্যাপারটা। এই অনুভূতি তৈরি হওয়াটা। আজকালকার বাচ্চাদের মনে তা হবে কিনা জানা নেই। তাদের পড়ার চাপ বেশি। হ্যাঁ, কেউ প্রশ্ন করতেই পারে যে, মন খারাপ করে তুমি কী এমন হাতি ঘোড়া করেছ? বা লুকিয়ে দুটো গল্পের বই পড়ে কী করেছ? কিছু করাটা তুলনা নয়। বা আমরা যা হয়েছি তা হতে হবে এমনটাও নয়। আমরা যা দিচ্ছি, তা থেকে তারা যা শিখছে সেগুলো নিয়ে তারপর তারা কী হবে এটাই দেখার। হ্যাঁ, বিল গেটস, স্টিভ জোবস তো আর সবাই হবে না। কিছু হতে গেলেও তা সেই বিষয়ে প্রচুর হার্ড ওয়ার্ক করেই হতে হয়। কিন্তু এরা অবাধেই বড়ো হচ্ছে। আমরা বাবা মায়েরা আগেকার বাবা মায়ের মতো কঠোরও নই। কিন্তু আমরা সবাই তাদের শৈশবটা শৈশবের মতো স্বাভাবিক রাখছি তো? নাকি অযথা কিছু জাঙ্ক জিনিস তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছি ওই উপরের গল্প হলেও সত্যি ঘটনাগুলোর মতো? তারা এমনিতেই লাগামছাড়া, বাড়িতে একা একা থাকে যদি কোনো যন্ত্রে প্যারেন্ট লক করা না থাকে যেকোনো বয়সের জিনিসই দেখতে পারে, এবং যে দেখা উচিত নয় ওই বয়সে বলা হবে তখনই তাদের আগ্রহ ওটার প্রতিই বেশি হবে আমাদের বড়োদের গল্প বই পড়ার মতোই। আর আজকালকার বাচ্চারা বাবা মায়ের উপরও একটা পার্থক্য করতে শিখে যায়। কার আয় বেশি, কার কাছে বেশি জিনিস চাইলে পাওয়া যায়, কার সঙ্গে বেরোলে লাভ বেশি, সেটা যেকোনো জিনিস কেনা থেকে হোক বা বাইরের খাবার খাওয়া সবেতেই তারা তফাৎ করে নেয়। এবং সেই অনুযায়ী বেরোয়ও বটে। নিতান্ত উপায় না থাকলে যার সঙ্গে বেরিয়ে লাভ নেই বেশি জেনেও তবে বেরোয়। সেটা পরিবারের যেকোনো সদস্যই হতে পারে যৌথ পরিবার হলে। আর শুধু মা বাবা হলে সেখানেও বাচ্চারা তফাৎ খোঁজে কার সঙ্গে বেরিয়ে লাভ আছে। মুশকিলটা এখানেই হয়ে যায় বাচ্চা মানুষ করার ক্ষেত্রে। বাবা মা দুজনেই একজোট হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় বাচ্চা আনার, কিন্তু বড়ো করার ক্ষেত্রে দুরকম মতভেদ হয়ে গেলে বাচ্চা যার কাছে সুবিধা বেশি পাবে তাকেই বেছে নেবে। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তার মানে কী? তাহলে যে মা বা বাবা বেশি সুবিধা দেয় সে বাচ্চার ভালো চায় না? তা নয়, শুরুতেই যুক্তি করে নেওয়া ভালো আমরা এই বিষয়ে স্ট্রিক্ট থাকব এই বিষয়ে থাকব না। অর্থাৎ যা করব অভিভাবক হিসেবে করব। বাবা বা মা আলাদা হিসেবে নয়। তাহলে গণ্ডগোল কম হয়। আর বাচ্চার চোখেও এই দুই দুই ব্যাপারটা আসে না। বাচ্চাকে ভালো শিক্ষা দেওয়া হোক, ভালো পরিবেশ দেওয়া হোক, ভালো খাবার দেওয়া হোক এটাই সবাই চায়। কিন্তু তাও কোথাও কোনোভাবে একজন বাচ্চার কাছে প্রশ্ন হয়ে যায় মা ভালো না বাবা ভালো? একজন মা তার বাচ্চার জন্য যা করতে পারেন সেটা তার বাবার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সেটা প্রকৃতির নিয়ম। আমি ছোটো থেকেই শিশুপ্রেমী। শিশুদের নিয়ে খেলতে বা তাদের সঙ্গে আনন্দ করতে করতেই আমি বড়ো হয়েছি বা ভালোবাসি। এর জন্য নিজের সন্তান হওয়ার দরকার নেই। যারা শিশুপ্রেমী, তারা চিরকাল শিশুপ্রেমী। আমাকে যদি ঘরে না পাওয়া যেত, জেঠু বলতেন দেখো বাচ্চাদের সঙ্গে ঠিক খেলছে। আসলে শিশুদের প্রতি ভালোবাসাও মনের ভিতর থেকে জীবনের অল্প বয়স থেকেই আসে। এ এক সুকোমল মনোবৃত্তি।
কিন্তু যা প্রকৃতির নিয়মের বাইরে, দুজনে সমানভাবে করা সম্ভব সেখানে যাতে মতভেদ গড়ে না ওঠে সেদিকে লক্ষ রাখা অবশ্য কর্তব্য, দায়িত্বও বটে। তাই সব সন্তানের কাছে তার বাবা মা দুজনেই সমান হোক। মা খুব খারাপ এটা দেখিয়ে যেমন রিলস বানানো উচিত নয়, একজন মায়ের অনুপস্থিতিতে তার বাচ্চার কাছে মা সম্পর্কে সমালোচনা করাটাও উচিত নয়। আর কিছু জিনিস আছে বোধহয় আইনত অপরাধও বটে। তাই সব বিষয়ের উপর খেয়াল রেখেই বাচ্চাকে তাদের যুগে তাদের মতো করে বাড়তে দেওয়া হোক। মাথায় অতিরিক্ত জিনিস আলাদা করে না ঢোকানোই ভালো। যা হবে স্বাভাবিক নিয়মেই হবে আর বাচ্চা নিজেই বড়ো হয়ে তফাৎ করে নিতে শিখে যাবে, ভালো মন্দ, তার জগৎ, বড়োদের জগৎ সবটা আলাদা করেই। ধাপে ধাপে শেখা যাকে বলে। কার্বাইড দিয়ে অকালে পাকিয়ে বা পচিয়ে না দেওয়াই কাম্য। সব শিশুর মঙ্গল চেয়ে আগামী শিশু দিবস পালিত হোক। সব শৈশব মুক্ত বাতাস পাক। তাদের ভালো হোক, আলো হোক। অভিভাবক হিসেবে এটাই কামনা। একটা বয়স অবধি ভালোটাই শেখানো। তারপর তারাই তাদের পথ যে যেমনভাবে চায় বেছে নেবে। মা বাবার শেখানো পথ কেউ চিরকাল মেনে চলে না। তাহলে সমাজে এত খারাপ ঘটনা ঘটত না কোনোদিন। যারা ঘটায় তারা আমার আপনার মতো বাবা মায়েরই সন্তান। তবুও তারা কন্যাশিশু ধর্ষণ করে। মেয়েদের ধর্ষণ করে। শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে। তবুও আমাদের সকলের চেষ্টা থাকবে একজন বাচ্চাকে ভালো শিক্ষাটাই দেওয়ার। তার তথ্য সমৃদ্ধ শিক্ষার পাশাপাশি সমাজ চেনার দিকেও খেয়াল রাখা দরকার। দেখা যাক এ আই যুগে আমাদের শিশুরা কে কীভাবে কতটা বেড়ে ওঠে। শিশুদের যেমন কারণে অকারণে অত্যাচার করা বা তাদের উপর অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়, তেমন, তাদের প্রতিভা থাকলে, মাথায় তুলে নাচাও উচিত নয়। কোনোভাবেই তার ভিতরে নিজের সম্পর্কে অতিরিক্ত অহঙ্কার তৈরি করা উচিত নয়। তার নিজের যে বিকাশ, বিকাশের যে ক্রমপর্যায়, তাকেই অনুসরণ করে, তার স্বাভাবিক বেড়ে ওঠাকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। তাহলে সকলেই নিজের মতো আকাশ ছুঁতে পারবে। আর আকাশ ছুঁতে না পারলেও ঝড়ে মাথা নত করার মতো পরিস্থিতি যেন কোনো বাচ্চারই ভবিষ্যৎ না হয়। এটাই প্রার্থনা। গাছের ফুল পছন্দ করতে যেমন নিজের গাছ লাগাতে হয় না, যেকোনো গাছে ফুল দেখলেই ভালো লাগে তেমনি যারা শিশুকে পছন্দ করে বা শিশুকে ভালোবাসে তার জন্য নিজের বাচ্চার জন্ম দিতে হয় না। শিশুমাত্রেই ভালোবাসা যায়।