জয় গোস্বামীর কবিতা এবং তিনটি সাম্প্রতিক গ্রন্থ <br />হিন্দোল ভট্টাচার্য

জয় গোস্বামীর কবিতা এবং তিনটি সাম্প্রতিক গ্রন্থ
হিন্দোল ভট্টাচার্য

জয় গোস্বামীর জন্মদিনে তাঁর কবিতা নিয়েই রইল একটি পাঠ-অভিজ্ঞতা।

কিছু কিছু কবিতার বই লিখিত হয় কবিতা লেখারই লক্ষটিকে মাথায় রেখে। আবার কিছু কিছু কবিতার বই লিখিত হয় মহাজগতের ও মহাপ্রকৃতির এক আশ্চর্য প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে। সেই কবিতাগুলির মাধ্যমে কবি নয়, আত্মপ্রকাশ করে এই মহাপ্রকৃতি। এ প্রসঙ্গে অবধারিত ভাবেই সঙ্গীতের কথা মনে হতে পারে। প্রকৃত প্রস্তাবে, সঙ্গীতের থেকে কবিতার দূরত্ব কখনো কখনো আর থাকে না। কিন্তু এই কাজটিই খুব কঠিন। কারণ সুর-বিহীন লেখা যখন লেখায় সুরসমৃদ্ধ হয়ে ওঠে, তখন সঙ্গীতের বিমূর্ততার প্রেক্ষিত সেই কবিতার অন্তরের বিষয় হয়ে ওঠে। এমন একটি কাব্যগ্রন্থ জয় গোস্বামীর ‘প্রণাম’, যার ভূমিকায় কবি লিখছেন, “পাঠক হয়তো লক্ষ করবেন ‘প্রণাম’ শব্দটি মাঝেমাঝেই ফিরে এসেছে বিভিন্ন কবিতায়— এর একটি সমদৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায় ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব সৃষ্ট রাগ মাঝখাম্বাজে প্রায় সকল স্বরপ্রগতি-ই ঘুরে ঘুরে শুদ্ধ মধ্যম পর্দাটিতে এসে পৌঁছয়, শুদ্ধ মধ্যমকেই প্রাধান্য দেয়— অর্থাৎ ওই স্বর মাঝখাম্বাজ রাগের জান। এইখানে ‘প্রণাম’ শব্দটিও আমার সেই শুদ্ধ মধ্যম।…এই কাব্যগ্রন্থের এক জায়গায় মুরারীমোহন গুপ্ত নামটির উল্লেখ আছে। অনেকেই নিশ্চয়ই জানেন, তা সত্ত্বেও বলে রাখি, লক্ষ্ণৌর বা মতান্তরে মথুরার লালা কেবলকিষণের ঘরের তালবাদ্যের এই বিদ্যা কলকাতা নিবাসী মৃদাঙ্গাচার্য মুরারীমোহন গুপ্তের নিকটেই স্বামীজি লাভ করেছিলেন।” অনেকের বক্তব্য থাকেই, কবিতার বইয়ে কেন ভূমিকা থাকবে। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়, কবিতার বইয়ে কবির ভূমিকা থাকলে, সেই কবিতা ও কবির সঙ্গে পাঠকের এক সংযোগ সৃষ্টির পথ সহজ হয়ে দাঁড়ায়। তার পর তিনি তো নিজের চোখেই সেই সব কবিতাগুলিকে পড়বেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ নিজেই এক কবি ছিলেন। পিঁপড়ের পায়ের নূপুরের শব্দের মতো ঈশ্বরের কথা যিনি বলেন বা যিনি কালো মেঘের নীচে এক ঝাঁক সাদা বকের উড়ে যাওয়া দেখে বিস্ময়ে সমাধিস্থ হন, তিনি কবি ছাড়া আর অন্য কিছু কি? কিন্তু, তাঁর এই সমাধিস্থ হওয়ার মধ্যে মুহূর্তে অনুভূতিমালার সঙ্গে সম্পর্কস্থাপনের এক গোপন সূত্র যুক্ত আছে। আমরা তো মুহূর্তেই খুঁজে পাই যা মুহূর্ত পেরিয়েও সর্বব্যাপী হয়ে আছে। যেমন রবীন্দ্রনাথ তাঁর চতুরঙ্গ উপন্যাসে একজায়গায় লেখেন যে গান শোনে, সে বন্ধন থেকে মুক্তির দিকে যায় এবং যে গান গায় সে মুক্তিকে বন্ধনেই বেঁধে ফেলে। শ্রী রামকৃষ্ণ মুক্তিকে এই বন্ধনের মধ্যে এবং বন্ধনকে মুক্তির মধ্যে দেখতে পেতেন। সহজ সরল কথায় তিনি একের পর এক যে দার্শনিক বীক্ষার মধ্যে ঢুকে পড়তেন, তা বেদান্তদর্শনই বলা যায়। দর্শনকে এত সহজে প্রাকৃতিক ঘটনার মধ্যে দেখতে পান একজন কবিই। ফলে, ‘প্রণাম’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থ যখন পড়ছি, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, জয় গোস্বামী ডুব দিয়েছেন সেই অতল সাগরে, যে সাগরে ডুব দিলে অমৃতলাভ ছাড়া আর অন্য কিছু লাভ করা অসম্ভব। “আস্তিক নাস্তিক কাকে বলে?/আমার চোখে তো দু’টি কলার মান্দাস /ঠিক পাশাপাশি ভেসে চলে/রামকৃষ্ণময় নদীজলে…” (দক্ষিণা) এই যে ভাবজগতে বা ভাবনাজগতে জয় প্রবেশ করলেন, সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়ে গেল কবিতা লেখার সমস্ত প্রেক্ষাপট। জয় গোস্বামীর ‘প্রণাম’ সম্ভবত ‘রামকৃষ্ণ নদীজলে’ সমস্ত দর্শনের সারাৎসারের সঙ্গে কবির মৃত্যুচেতনার এক অভিনব সঙ্গত। এই কবিতার বই পড়লে পাঠকও রামকৃষ্ণ নদীজলে ডুব দেওয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করবেন। শ্রী রামকৃষ্ণদেবের কথকতা এবং ভাবনা যদি আমরা অনুসরণ করি, তো দেখব, সক্রেটিসের মতোই তিনিও তাঁর কথকতার মধ্য দিয়েই দর্শনের গভীর জলে ডুব দিচ্ছেন, ভেসে উঠছেন। এই ডুব দেওয়া ও ভেসে ওঠার চেয়েও উচ্চ এক পর্যায় আছে তাঁর। যাকে আর অনুবাদ করা যায় না, প্রকাশ করা যায় না। তা বিস্ময় না প্রশ্ন – আমরা জানি না। কিন্তু এটুকু বোঝা যায়, তা বাক্য ও মনের অতীত এক স্তর। যে স্তরে বাক্য ও মনের সীমার বাইরের এই উচ্চতা থাকে, তাকে তো প্রকাশ করা যায় না। হয়তো, তা-ই হয়ে যায় লীলা। যে লীলা কোনও অলৌকিক বিষয় নয়। এই মহাজগতের কথা, যা ক্রমেই নিজেকে বিস্তারিত করছে অন্ধকারের ভিতর। অপ্রকাশিত অবাঙ্মনোশগোচরম যা প্রকাশ করছে নিজেকে বিন্দুর মধ্যে। পূর্ণ, খণ্ডের মধ্যে, শূন্যতা, সঙ্গীতের মধ্যে, বাক, কাব্যের মধ্যে। এই অনিবার্য ও অনবরত প্রকাশ ও ধ্বংসের লীলাসমগ্রের মধ্যেই লিখিত হচ্ছে এক আশ্চর্য মনোজগতের ছন্দের কথা। যাকে রবীন্দ্রনাথ ‘নিত্য ছন্দ’ বলেছেন।
এই নিত্য ছন্দের প্রকাশ আমরা দেখছি বিস্ময়ের সঙেই জয়ের কবিতায়। ‘প্রণাম’-এর এক একটি কবিতা যেন জয়ের মনের ভিতর চলতে থাকা এক অনবরত সংলাপ। এই সংলাপ ছাড়া জীবন অসম্পূর্ণ। সংলাপ নিয়েও তো অসম্পূর্ণই থাকে জীবন। শুরুতেও অসম্পূর্ণ এবং শেষেও অসম্পূর্ণ। সেক্ষেত্রে, মাঝের এই অসম্পূর্ণতার মধ্যেই আবহমানতাকে অর্থাৎ খণ্ডের মধ্যেই অখণ্ডকে অনুধাবন করতে হয়। কী আশ্চর্য, মনে পড়ে যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ। ‘প্রণাম’ শীর্ষক একটি কবিতায় তিনি লিখছেন, “অর্থ কিছু বুঝি নাই, কুড়ায়ে পেয়েছি কবে জানি/নানা বর্ণে-চিত্র-করা বিচিত্রের নর্মবাঁশিখানি/যাত্রাপথে। সে-প্রত্যুষে প্রদোষের আলো অন্ধকার/প্রথম মিলনক্ষণে লভিল পুলক দোঁহাকার/রক্ত-অবগুণ্ঠনচ্ছায়ায়।“ জয় গোস্বামীর ‘প্রণাম’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থের আলোচনা প্রসঙ্গে যে রবীন্দ্রনাথের ‘প্রণাম’ কবিতাটি চলে এলো, তাও যেন প্রাকৃতিক এক লীলাই। কারণ যে রামকৃষ্ণ নদীজলের প্রবহমানতার লীলাপ্রসঙ্গ কবির লেখনীতে ধরা দিচ্ছে, তা অন্য ভাবে রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। আমরা পড়ি, “চেতনাসিন্ধুর ক্ষুব্ধ তরঙ্গের মৃদঙ্গগর্জনে/নটরাজ করে নৃত্য, উন্মুখর অট্টহাস্যসনে/অতল অশ্রুর লীলা মিলে গিয়ে কলরলরোলে/উঠিতেছে রণি রণি, ছায়ারৌদ্র সে দোলায় দোলে/অশ্রান্ত উল্লোলে। আমি তীরে বসি তারি রুদ্রতালে/গান বেঁধে লভিয়াছি আপন ছন্দের অন্তরালে/অনন্তের আনন্দবেদনা।“ একেই কি চৈতন্য? ত জানি না, কিন্তু একটি প্রবহমান নদী থেকে চেতনাখণ্ড কখনো তুলে নিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ, কখনো বা তুলে নিচ্ছেন শ্রী রামকৃষ্ণ, আবার কখনো বা রামপ্রসাদ সেন। চেতনা ও চৈতন্যের এই যে রামকৃষ্ণলীলা, তাকেই প্রত্যক্ষ করছেন জয় গোস্বামী। আমি খেয়াল রাখছি এই বিষয়টিকে, জয় কোনও কথকঠাকুর নন, নন কোনও দার্শনিক। তিনি ইন্দ্রিয়-রক্ত-মাংসের এক কবি, একজন প্রবল ভাবে আধুনিক কবি। কিন্তু তাঁর আধুনিকতার জায়গা এখানেই অনন্য, যে তিনি আবহমান দর্শনকে খুঁজে নিয়েছেন তাঁর নিজের সময়েই। সেই দর্শনের জলে অবগাহন করলে, আর আধুনিক থাকা যায় না। চিরন্তন এক প্রবাহের অংশ হয়ে যেতে হয়।
এই প্রবাহের গতি ধীর। রসও ধীর। অর্থাৎ, জয় গোস্বামীর ‘প্রণাম’ কাব্যগ্রন্থের এই কবিতাগুলির মধ্যে এক অপরূপ শান্ত ধীর রসের উপস্থিতি রয়েছে। প্রকৃত কবিতা এভাবেই, নিজের আধারকেও খুঁজে নেয়। প্রণাম কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় জয় নিজেই একজন উপাসক, যিনি ভক্তিরসের মধ্যে অবগাহন করে আছেন। কিন্তু তার প্রকৃতি ভক্তিরসের মধ্যে অবগাহনকারী ভক্তের মতো নয়। বরং এক আসক্ত প্রেমিকের মতো, যিনি নিজে জানেন এই আসক্তি ক্ষণস্থায়ী এক বিষয়। নিরাসক্তির অমোঘ মৃত্যুচেতনাই এই কবিতাগুলিকে নিয়ে গেছে রামকৃষ্ণ নদীজলের শান্ত চৈতন্যের দিকে। এখানে আর একটি বিষয় খেয়াল করার মতো, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সঙ্গে এই ভক্তিরসের মিলনই ঘটছে কবিতাগুলিতে। কারণ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতও প্রকৃতির সেই অখণ্ড চৈতন্যের কাছে নিজেকে সমর্পণ, যার জন্য উপাসনা একপ্রকার আকুতিই হয়ে থাকেন। ভক্তের আকুতি, যেখানে এক করুণরাগিনীতেই পর্যবসিত হয়। আমরা বলতেই পারি জয় গোস্বামীর ‘প্রণাম’ কাব্যগ্রন্থটি ভক্তের আকুতিই। এই আকুতির মধ্যে শুধু রামকৃষ্ণ নয়, রবীন্দ্রনাথ নয়, মিশে আছেন কবীর সাঁই, সূরদাস, দাদূ, নানক, সন্ত তুকারাম এবং লালন ফকির। ভারতবর্ষের কাব্যচর্চার মূল যে স্পন্দন নিহিত রয়েছে পরমের কাছে নিজেকে নিবেদনের দর্শনের মধ্যে, তা জয়ের এই গ্রন্থের কবিতাগুলির মধ্যে স্পষ্ট হয়। তিনি যেন সেই আবহমানকেই প্রতিনিধিত্ব করছেন এবং রচনা করছেন ভক্তিরসের এক আধুনিক ধারা। যে ধারায় কোথাও রুমিও আছেন আবার আছেন সক্রেটিসও। যে ধারার মধ্যে চৈতন্য আছেন, রয়েছে রঘুনাথ শিরোমণির দর্শনও। ভারতবর্ষ এবং বাংলার সনাতন দর্শন ও প্রজ্ঞার যে দীর্ঘ ইতিহাস, তা যেন আবার মৃদু এক শান্ত আলোয় নিজেকে প্রকাশ করল ‘প্রণাম’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থে।
একটি মহৎ কাব্যগ্রন্থের আরও একটি বৈশিষ্ট্য থাকে। আর তা হল, সেই কাব্যগ্রন্থটি পাঠকের রক্ত-মাংস ইন্দ্রিয় ও অস্তিত্বের মধ্যে ঢুকে যায়। জয় গোস্বামীর ‘প্রণাম’ তেমনই একটি কাব্যগ্রন্থ, যা পড়তে পড়তে স্বয়ং কবিকেই ভুলে যাওয়া যায়। কবিতাগুলি কবির চেয়ে পৃথক এক অস্তিত্বে নিজেদের প্রকাশ করে। মনে হয়, কবি শুধু এক পথপ্রদর্শক মাত্র, যিনি পাঠককে হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছেন চৈতন্য নামক প্রবাহের দিকে। সেই প্রবাহে তিনি বারবার ডুব দিচ্ছেন আর ভেসে উঠছেন। পাঠক তাঁর নিজের মতো করেই এই চৈতন্যের কাছে সমর্পণ করছেন নিজেকে। ঠিক যেমন সঙ্গীত, শ্রোতাদেরও সঙ্গে নিয়ে যায় সেই বিমূর্ত বোধের কাছে, যেখানে গায়ক উপাসনার স্বরটুকু পৌঁছে দিচ্ছেন। এই উচ্চতার পর আর যদি কোনও উচ্চতা থাকে, তবে তা অজানা। কবির কাজ শুধু সেই তার সেই উচ্চতাটুকুর কাছে বিন্দু বিন্দু প্রণামের কাব্য রেখে যাওয়া। আর কিছু কবিতা পারে কি? হয়তো থাকে এই আকুতিই, “’আমার চোখ দিয়ে জল ঝরে – তা হলে কি/এইখানে জয়রামবাটী? এইখানেই দক্ষিণেশ্বর?’

জয় গোস্বামীর কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই মনে হয়, হয়তো সব কথাই কেউ না কেউ বলেছেন কোথাও না কোথাও। এত আলোচিত, এত অনন্য একজন কবি কীভাবে যে তাঁর বিভিন্ন কবিতার বইয়ে রেখে গেছেন তাঁর ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি, তা নিয়ে চর্চাও কম হয়নি। সদ্য প্রকাশিত ‘অর্থহারা একমুষ্টি বালি’ পড়তে পড়তে এ কথাই মনে হচ্ছিল, এই কবি তাঁর নিজের কাব্যভাষার ঘেরাটোপে পড়বেন না কখনওই। আর এ কাজটিই খুব কঠিন। অল্প করলে বললে, একজন কবির মৃত্যু তখনই হয়, যখন তিনি নিজের ভাষা, নিজের ভাবনা এবং নিজের কাব্যদর্শনের মানচিত্রেই ঘোরাফেরা করতে থাকেন একটা সময়ের পর। কেন এই ঘটনাটি ঘটে? নির্দিষ্ট কাব্যভাষা ( সিগনেচার) তৈরি হওয়ার পরে যখন ধীরে ধীরে সেই ভাষাই ‘পরিচয়’ হয়ে ওঠে সেই কবির, তখন সেই পরিচয়ের ইমেজই তাকে খেয়ে ফেলতে শুরু করে। দিনের পর দিন সমস্ত ভাবনাই তখন সেই ভাষায় প্রকাশ পেতে শুরু করে। স্বভাবতই কবিতাগুলি সুন্দর হয়, ভালো হয়, কিন্তু তার চেয়ে বেশি কিছু হয় না। অর্থাৎ সেই কবির বয়স থেমে যায়, জীবন চলতে থাকে, তার পর জীবন থেমে যায়, ব্যক্তিগত পরিচয়ের ইমেজ চলতে থাকে। তিনি নিজেও বুঝতে পারেন না হয়তো, কখন নিজের কাব্যব্যক্তিত্বের ভূত তাঁর হাত পা মন ভাবনাকে বেঁধে ফেলল। এটি এক বিশেষ প্রকার মৃত্যু, যা কবি নিজে যখন বুঝতে পারেন, তখন তিনি নিজেকে অনুসরণ ও নকল করতে শুরু করে দিয়েছেন। এই মৃত্যু সেই কবিদের হয় না, যাঁরা নিরন্তর নিজের কাব্যব্যক্তিত্ব এবং কাব্যভাষাকে প্রশ্ন করেন, বিদ্ধ করেন। নিজের ভাবনার মধ্যে থেকে তুলে আনেন অন্য কোনও ভাবনা। নতুন ভাবে দেখতে শুরু করেন দৃশ্যকে, স্মৃতিকে, ভাবনাকে এবং ভাষাকেও।
‘সূর্য পোড়া ছাই’ কাব্যগ্রন্থকে যদি আমরা একটি সূচনাবিন্দু হিসেবে ধরি, তাহলে, এ কথা বলতেই হবে, সেই সময়ের পর থেকে কবি জয় গোস্বামীর কাব্যভাষা পরিবর্তিত হতে শুরু করে একটু অন্যরকম ভাবে। বাচ্যার্থের বাইরের অর্থকে তিনি কবিতায় ব্যবহার করতে শুরু করেন। অথচ এটি শুধুই তাঁর পরীক্ষানিরীক্ষা নয়। কারণ এই ভাষার মধ্যে লুকিয়ে থাকে আবহমান অবচেতনার এক স্রোত। ‘সূর্য পোড়া ছাই’, মৌতাত মহেশ্বর’, ‘ভালোটি বাসিব’, এবং আরও বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ পেরিয়ে তিনি এমন একটি কাব্যগ্রন্থ লিখলেন, যা বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে আরেকটি যুগের সূচনা করল বলা যেতেই পারে। কী সেই যুগ? ভাষাপ্রবাহের কোন সেই অবচেতন প্রবাহ, যা আমাদের চেতনার স্বর বলে মনে হচ্ছে?
বইটির শুরুতেই নাতিদীর্ঘ ভূমিকায় কবি লিখছেন, “ আমার মা যখন প্রয়াত হন তখন চুরাশি বছরের বৃদ্ধ এক পুরোহিত মশাই আমাকে বলেছিলেন যেসব মানুষের গৃহহারা, যারা পথবাসী, তাদেরও তো বাবা-মা মারা যান। তখন তারা পারলৌকিক কাজ করবে কী করে? তাদের তো কণামাত্র সম্বল নেই। পুরোহিত মশাই বলেছিলেন, তখন তারা গঙ্গাতীরে দাঁড়িয়ে পরিপূর্ণ শ্রদ্ধার সঙ্গে একমুঠো বালি স্রোতে নিক্ষেপ করে…”। আসলে, এই রীতিটি খুবই প্রতীকী। কবিতা যাঁরা লেখেন, তাঁরা এই একমুষ্টি বালির মতো নিয়ে স্রোতেই নিক্ষেপ করেন। এছাড়া আর কিছুই হয় না। এ যেন পৃথিবীকে বলা, এই জন্ম তুমি আমাকে দিলে হে জননী, তোমাকে আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সৎ অনুভূতিমালাই দিয়ে গেলাম। জানি, সে সব একমুষ্টি বালি ছাড়া আর কিছুই নয়। কোথাও কি একটু বিষাদের আবহ বেজে উঠল? হ্যাঁ, এই আবহই কবির ‘ অর্থহারা একমুষ্টি বালি’-র মূল সুর। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বা গণেশ পাইনের ছবি যে ভাবে আমাদের একটি ভাবনাতরঙ্গের মধ্যে নিয়ে যায়, এই বইটি তা-ই করে। এই কাব্যগ্রন্থের ভাষা, কবিতাগুলির ভাবনার সঙ্গে সংযুক্ত। গানে যেমন কথা ও সুরের মেলবন্ধন হয়, তেমন, জয় গোস্বামীর এই গ্রন্থের ভাষা ও ভাবনার অচেনা এক বিবাহ চলতে থাকে। পাঠক হিসেবে আমাদের প্রাপ্তি, অর্থহারা সেই সব নতুন নতুন অর্থগুলির সঙ্গে ভাবনাজগতের মধ্যে ডুব দেওয়া, আবিষ্কার করা এক অন্য জগৎ, যা সমান্তরাল ভাবেই রয়েছে আমাদের সঙ্গে, কিন্তু যা সচরাচর আমাদের নজরে পড়ে না।
সব কবিতা তো তুলে ধরা সম্ভব নয় অল্প পরিসরে, তবু কিছু অংশ তুলে দেওয়াই যায়, যেমন—১) “তুমি কত ধূম!/ আমি যত যজ্ঞ করি/ তুমি তত মিলাও চিৎকারে/ আমার প্রশংসা শোনো জানলায় জানলায়, দ্বারে দ্বারে ( শোনো)” ২) “কী অনিন্দ্য দরোজা, রাজন” ( আলো), ৩) “ওরা বলবে : লেখাটি খারাপ/ তারা বলবে : কিছুই বুঝিনি।/ শব্দ শুধু অর্থকে পেরিয়ে/ যেতে যেতে বলবে : পথ চিনি” (ভর)
স্বভাবতই এমন অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায় তাঁর রচনা, উল্লাস, যাত্রীহীন খেয়া, জানা, কত ধনধান্য বিধি, হাতচিঠি, ডাক এবং উল্লেখ না করলেও এই গ্রন্থের বিভিন্ন কবিতায় তিনি যে কাব্যভাষার এক নতুন দিগন্ত তৈরি করলেন, তার।
একটা মধুর বিতর্ক চলতেই পারে, কবিতার অর্থ নিয়ে। কবিতার অর্থ কি আদৌ হয়? না কি কবিতা একপ্রকার অবস্থা? কোনও একটি দৃশ্য, ভাবনা, মনের ভিতর জেগে ওঠা প্রশ্ন এবং বিষাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, এ থেকে একপ্রকার অবস্থা তৈরি হয় কবিকে নিয়ে এবং কবিকে ছাড়াই। হয় কবি দূর থেকে দেখেন সেই অবস্থাকে, আর নয় অপেক্ষা করে থাকেন, কখন তিনি নিজেই সেই অবস্থার এক ধারক হয়ে উঠবেন। তাঁরই মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হবে সেই সুর, ভাবতরঙ্গ, আর তিনি হয়ে উঠবেন যন্ত্র। যন্ত্রী বাজাবেন তাঁকে। কী তার অর্থ, কেন তা বলা হচ্ছে, কেন তা স্রোত থেকে তুলে স্রোতেই ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে প্রণামের মতো, তা আমরা কেউ কি আদৌ জানি? যতই তর্ক প্রস্তুত করতে চাই বা পারি না কেন, সেই তর্ক অমীমাংসিতই থাকে। যেমন আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের ‘পাঠক’ শীর্ষক কবিতায় জয় লিখছেন, “ আমার পাঠক চাই না।/ একজন পাঠক/ পেলেই সম্বল বলে তাকে/ বসাব চেয়ারে/ আমি বাতি হয়ে জ্বলব টেবিলের ধারে…”
‘অর্থহারা একমুষ্টি বালি’ কাব্যগ্রন্থটিকে হয়তো ধ্রুপদী সঙ্গীতের সঙ্গে তুলনা করা যায়। বা, এই কাব্যগ্রন্থটি সেই ধ্রুপদী সঙ্গীত হয়ে ওঠে। তিনি সমাধান নামক কবিতার শুরুতে লিখছেন “ এসো হে সন্ধ্যার রৌদ্র। আমার সমস্যা নীল। লেখা নেই ধান/ শোক মরতে সময় নিল। এখনও জঞ্জাল থেকে ধোঁয়া…/ আবার নতুন ডাক দেখতে পাই, যা কানে ঢোকে না”। পাঠক ভেবে দেখুন, ‘ডাক’ তিনি দেখতে পাচ্ছেন কিন্তু শুনতে পাচ্ছেন না। এ কি সেই কীটসের ‘হার্ড মেলোডিজ আর সুইট বাট দোজ আনহার্ড আর সুইটার’ -এর মতো ? বাইরের যে স্পর্শকাতর কান, তা হয়তো শুনতে পায় না সেই ডাক, কিন্তু ভিতরের যে সঙ্গীতে অবগাহন করে আছে, সে শুনছে সেই সঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথ কি মনে পড়ছে আমাদের, যিনি বলছেন, ‘সে যে আমায় জানি পাঠায় বাণী সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে’? সমকাল চিরকালের হাত ধরে থাকে হয়তো এই কারণেই। হয়তো এই কারণেই ধ্রুপদী সঙ্গীত আবহমান কালের প্রতিনিধিত্ব করে। তার কোনও জল মানে জীবন জাতীয় অর্থ নেই। বরং জল মানে জীবন, জল মানে প্রাণ, জল মানে স্রোত, জল মানে জন্ম, — এমন অনেককিছুই। কবি জয় গোস্বামী আপাত জীবনের নির্দিষ্ট অর্থের সীমাবদ্ধতা থেকে কবিতাকে মুক্ত করে সঙ্গীতের কাছে নিয়ে গেছেন এই কাব্যগ্রন্থে। তবে, সে শুধু সঙ্গীত নয়, একপ্রকার করুণরাগিনীর সঙ্গীত। যে সঙ্গীত ঘুরে বেড়ায় জীবনের নানা কোনে, নানা আলোয়, অন্ধকারে, বিরহে, বিচ্ছিন্নতায়, বিষাদে, দুঃখে এবং বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ কথিত ‘বড়’ দুঃখের জগতে। শোককেও কি মুক্ত করে দিলেন কবি এই কাব্যগ্রন্থে?
কবিতা যে মুক্তির জন্য আলো ফেলে হৃদয়ে, সে বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও, সে বিতর্কও আলোকজ্জ্বল। কিন্তু কবিতার এই মুক্তির জন্য আলো ফেলা তখনই সম্ভব, যখন কবিতায় নিহিত শব্দেরা অর্থের নির্দিষ্টতা থেকে দৃশ্যকে মুক্ত করে। একটি দৃশ্যও তো একটি কথাই শুধু বলে না। বা, একটি সুরের কোনও বিশেষ নির্দিষ্ট ন্যারেটিভ নেই। আমরা শুধু অবগাহন করতে পারি সঙ্গীতে, স্রোতে, দৃশ্যে, কবিতার পংক্তিতে পংক্তিতে, যেখানে নির্দিষ্ট কেন্দ্র নেই কোনও। সমস্ত বিন্দুই কেন্দ্র। জয় গোস্বামী তাঁর ‘ অর্থহারা একমুষ্টি বালি’ কাব্যগ্রন্থটিকে সময়ের প্রবাহের কাছে একমুষ্টি ধুলোর মতোই নিক্ষেপ করেছেন। মহাকালের স্রোতে এই অর্ঘ্যটুকু ছাড়া আর কিছু কি দেওয়ার আছে কবির?
গ্রন্থটির সঙ্গে সাযুজ্য বজায় রেখেই সিগনেট প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদে রৌদ্র মিত্র এমন এক অপূর্ব প্রচ্ছদ এঁকেছেন, যা গগন ঠাকুরকে মনে পড়ায়। বইটি নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ প্রচ্ছদের দিকে তাকিয়ে থাকলে পাঠক এই কাব্যগ্রন্থে প্রবেশের আবহে প্রবেশ করবেন সহজেই। এই গ্রন্থটি আগামীর, এই সময়ের এবং চিরকালের।

গায়ে যখন ছ্যাঁকা এসে লাগে, বা কোনও আঘাত, তখন তার প্রতিক্রিয়ায় মানুষ আর্তনাদ করে। আবার এমনও হয়, ঘটনার ভয়ংকর অভিঘাতে সে পাথর এবং বোবা হয়ে গেল। ভাষাহীন হয়ে গেল। এ প্রসঙ্গে আমরা মুংখের সেই বিখ্যাত ‘চিৎ্কার’ নামক পেইন্টিংটির কথা বলতে পারি। নীরবতা তো অনেক সময় শান্তির হয় না। সেই নীরবতার মধ্যে অনেক আকাশ ছিঁড়ে দেওয়া আর্তনাদও থাকে।লাশের রাজনীতি থাকতে পারে, মৃত্যুর রাজনীতি থাকতে পারে, আবার এই শোকপ্রকাশেরও রাজনীতি থাকতে পারে। কিন্তু আসুন আমরা ফিরে যাই ঘটনস্থলে সেই সময়ে মানসিক ভাবেই, যখন রামপুরহাটে একের পর এক বাড়িতে আগুন লাগাচ্ছিল গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের শিকার উন্মত্ত হিংস্র খুনিরা। সেই সময়ে আপনি নিজে হয়তো সেই বাড়িতে রয়েছেন কিংবা দূরে দাঁড়িয়ে দেখছেন এই ভয়ংকর কাণ্ড। তখন আপনার যে প্রতিক্রিয়া তাও অনেক রকম হতে পারে। আপনি উন্মাদ হয়ে যেতে পারেন, আপনি পাথর হয়ে যেতে পারেন। আপনি প্রতিহিংসার বশবর্তী হতে পারেন। এমন নানা কিছু। সে সময় রাজনৈতিক হিসেবনিকেশের কথা মনে থাকে না। কারণ ঘটনার অভিঘাত হয় তার চোখ খুলে দেয়, নয় তাকে অন্ধ করে দেয়।

একজন কবি তো আসলে কোনও ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ থাকেন না। তিনি থাকেন ক্ষমতাবৃত্তের বাইরে। অথবা হয়ে ওঠেন এনজেনৎসবার্গের মতো ক্ষমতাবৃত্তের মধ্যে থেকেই অন্তর্ঘাতী। এই দ্বিতীয় ভূমিকাটি হয়ে ওঠা খুবই কঠিন। কিন্তু আবার একজন কবি, ভয়ংকর সময়ের এক জীবন্ত দলিল রচনাও করতে পারেন। তার প্রমাণও আমরা পেয়েছি বিভিন্ন কবির লেখায়। জার্মান কবি লিখটারস্টাইনের কবিতায় বা লোরকার কবিতায় তা জীবন্ত, গা শিরশির করে ওঠে। স্পিলবার্গের শিন্ডলার্স লিস্ট দেখে যেমন আমরা অস্থির হয়ে উঠি। এ সময়টা তো তেমনই। সারা বিশ্বেই তো চলছে একপ্রকার হিংসা ও প্রতিহিংসার খেলা। তার তরঙ্গে আমরা নিজেরাও যে সহিষ্ণুতা হারাচ্ছি না তা নয়। হয়তো আমাদের মনের ভিতরেও হয়ে চলেছে একপ্রকার অভিযোজন, যার কথা আমরা জানতেও পারছি না। কিন্তু এই চলমান ধ্বংসলীলার মধ্যে একজন কবি যখন তাকিয়ে থাকেন, তখন তাঁর অসহায়তা ও পাথর হয়ে যাওয়া দুঃখের ভিতর থাকে একপ্রকার অন্তর্দৃষ্টি। তা অনেকাংশেই হয়তো আবেগপূর্ণ, আবার অনেকাংশেই আবেগবর্জিতও বটে।

জয় গোস্বামী এর আগেও নন্দীগ্রামের ঘটনায় যন্ত্রণার ক্ষত নিয়ে লিখেছিলেন ‘শাসকের প্রতি’। না লিখে তাঁর উপায় ছিল না। কদিন আগে রামপুরহাটের কাছে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফসল যে গণহত্যা, তা এতটাই নারকীয়, যে কোনও শিল্পের পক্ষে সহজে তা ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। কিন্তু জয়কে তাঁর মনের ভিতরে থাকা রক্তাক্ত অক্ষরগুলিকে লিখে ফেলতেই হত। আর তিনি লিখলেন একটি চটি বইয়ে। বইটির নাম ‘দগ্ধ’। প্রকাশ করেছেন গুরুচণ্ডালী। মাত্র ৮ টি কবিতা রয়েছে এই গ্রন্থে। কিন্তু প্রতিটি কবিতাই এই রক্তাক্ত সময়ের, এই হিংস্র সময়ের দলিল হয়ে রয়ে গেল।

১২ পাতার একটি বইয়ের আলোচনায় সব কবিতা তুলে দিলে বইটির প্রতি অবমাননা করা হয়। তাই এক্ষেত্রে সেই সংযম দেখাতেই হচ্ছে। কিন্তু ২৩ মার্চ সন্ধ্যা ৬ টার সময়ে লেখা কবিতাটিতে জয়ের এক সূক্ষ্ম রাজনৈতিক বোধ ফুটে উঠেছে, যা আমরা সচরাচর প্রতিহিংসাবশত ভুলে যাই।

ওরা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের শিকার?

কার গোষ্ঠী? কার গোষ্ঠী? কার?
ওই পাঁচজন মহিলার
পোড়া শক্ত কালো দেহ জানাবে কি ওদের ওপর
কীভাবে সক্রিয় ছিল কোন বিশেষ গোষ্ঠীঅধিকার?

প্রশ্নের পর প্রশ্ন রয়েছে এই ক্ষুদ্র কাব্যপুস্তিকাটিতে। পারিবারিক বিবাদের জের না রাজনৈতিক ঘটনা তা আমাদের জানা নেই। কবি কী জানেন? জানেন এইটুকুই একটি বাচ্চা আগুনের মধ্যে ছোটাছুটি করে লাশ হয়ে হাসপাতালের মর্গে বিকৃত দেহ হয়ে পড়ে আছে, যাকে চেনাও যাচ্ছে না।

বিকের সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত সাড়ে তিনটে পর্যন্ত, আতঙ্কে, ভয়ে, অসুস্থ হয়ে একজন সংবেদনশীল কবি লিখে চলেছেন একটার পর একটা কবিতা। রার ১টা ১৫ তে লেখা একটি কবিতায় তিনি বলছেন –“ এখন কী করব আমি?/ কবিতা লিখতেও হাত পুড়ে যায়, পুড়ে যায়, পোড়ে…”। সেইসব গলিত বিকৃত, পুড়ে আংরা হয়ে যাওয়া লাশের মধ্যে তিনি দেখতে পান অভীক, অর্ক, অভিরূপদের, দেখতে পান বুকুন, কাবেরীকে। পিতৃহৃদয়ে, বন্ধুহৃদয় মিশে যায় আবহমান কাল ধরে প্রবাহিত এই রাজনৈতিক হিংসাস্রোতে। তাঁর তো অন্য কোনও রাস্তা জানা নেই। রাত সাড়ে তিনটের সময় তাঁর মনে হয় এই পুড়ে যাওয়া লাশগুলিকে তিনি কোথায় দাফন করবেন? ‘ ওদের দাফন করব এখন কোথায়?/ বলো, কোন কবিতার কাছে?’

এই কবিতার বইয়ে কোনও আশাবাদ নেই। আশাবাদ থাকার কথাও নয়। কারণ কবি এই কবিতাগুলি লিখতে চাইছেন না। অথচ কবিতা ছাড়া আর অন্য কোনও মাধ্যম নেই তাঁর কাছে যেখানে তিনি এই কথাগুলি বলবেন। এই কথাগুলি কি রাজনৈতিক? রাজনীতি মানে কী? দলীয় বিবাদ? মিছিল, মিটিং, নির্বাচন? বিপ্লব শব্দটি তো এখন আভিধানিক। হয়তো দিবাস্বপ্নে মানুষ উচ্চারণ করে। রাজনীতি মানে তবে কি? কোন দল, কোন গোষ্ঠীর মধ্যে হিংসা নেই? আমরা যদি মানুষ হিসেবে উন্নত না হতে পারলাম, তবে রাজনীতি করেই বা আমরা কী করব? যদি না হিংসার বিপরীতে প্রতিহিংসাকে প্রশ্ন করতে পারলাম, তাহলে আমরা কী রাজনীতি করি? আদিম প্রবৃত্তিগুলিকে আধুনিক অস্ত্র করে তোলার নাম তো রাজনীতি নয়। বা, তারই নাম হয়তো রাজনীতি। আমরা জানি না। কিন্তু এর ফলে কী হয়?

মানুষ দগ্ধ হয়। মানুষ চরম অপমানিত হয়। মানুষ এই পৃথিবীতে থাকার সামান্য একটা জীবন থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। জয় গোস্বামীর এই কবিতার বইতে যেমন দুই লাইনের মধ্যবর্তী শূন্যতায় তিনি শ্বাস নিচ্ছেন, এক একটা প্রশ্নের পর তিনি নিরুত্তর তাকিয়ে থাকছেন সময়ের দিকে, তেমনই, এক একটি প্রশ্নচিহ্নকে পাঠকের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছেন ভাবার জন্য। কার গোষ্ঠী, কাদের গোষ্ঠী,কেন গোষ্ঠী—এসবের থেকে বড় কথা সময়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সেই পোড়া পোড়া লাশ। যারা আর কোনওদিনই কোনও প্রশ্ন করতে পারবে না। জানতেও পারবে না, এই হিংসা ও প্রতিহিংসার খেলায় কেন তাদের মৃত্যু হল? কেন কবিকে দাফন করতে হল তাদের এই সব কবিতার মধ্যেই?

দগ্ধ, নির্জন এক শ্মশানক্ষেত্র বা কবরের মতোই পড়ে থাকে এই কাব্যগ্রন্থটি। কিছু প্রশ্ন নিয়ে, যার উত্তর কখনও আসবে না।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes