রম্ভার মুক্তি
ড. অনিন্দিতা দে
(১)
—কী ব্যাপার নারদ? এমনিতে তুমি এত হাসিখুশি, কিন্তু আজ কপালে চিন্তার ভাঁজ কেন?
এতক্ষণ ধরে এই প্রশ্নটারই অপেক্ষায় ছিল নারদ। প্রবল উৎসাহের সাথে ও বলে ওঠে—প্রভু, রম্ভার দাবি বিচার চাই। নইলে ও আর সভায় আসবে না, নাচবে না। কতবড় সাহস ভাবুন, আবার বলে কিনা শচীর সঙ্গে এরকম হলে কি ইন্দ্র এভাবে চুপ করে বসে থাকতে পারত?
ইন্দ্রের ফর্সা গালদুটো লাল হয়ে ওঠে। রম্ভার জিভটা বড্ড বেড়ে গেছে। শচীর সাথে নিজের তুলনা করার স্পর্ধা কী করে হল ওর? ঘরের বউ আর বাইরের বউ তো এক জিনিস নয়! তাছাড়া রাবণ নাহয় ঝোঁকের মাথায় একটা ভুল করেই ফেলেছে, কিন্ত তার জন্য ওর মত বীরের সাথে ঝামেলা করে ইন্দ্র নিজের সিংহাসন হারাবে নাকি! সামান্য একটা অপ্সরার জন্য এতবড় ঝুঁকি নেওয়ার মত বোকামি কে করে?
ইন্দ্রকে চুপ দেখে নারদ মিহি গলায় উস্কানি দেয়—কত করে বোঝালাম ওকে, বললাম মেয়েমানুষের এত জেদ ভালো নয়, কিন্ত কে শোনে কার কথা! আর অপ্সরা মানে তো স্বর্গবেশ্যা। বেশ্যার আবার ধর্ষণ, সেই ধর্ষণের আবার বিচার! যতসব হাস্যকর আবদার!
ইন্দ্র মাথা নাড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয়। নারদের যা পরনিন্দা পরচর্চা করা স্বভাব, মুখ ফস্কে ওর সামনে অসাংবিধানিক কিছু বলে ফেললেই সারা দুনিয়া রাষ্ট্র হয়ে যাবে। তারপর সবাই মিলে ইন্দ্রের খুঁত বার করতে বসবে। রাজা হলে যে কতকিছু সামলে চলতে হয়! নাহ, ভেবেচিন্তে কিছু একটা দায়সারা উত্তর দিয়ে নারদের মুখ বন্ধ করতে হবে।
গম্ভীর গলায় ইন্দ্র বলে ওঠে—রম্ভার মানসিক অবস্থা ঠিক নেই এখন। ওকে কিছুদিন বিরক্ত না করাই ভালো। ও যাতে শান্তি পায় তাই করুক। সময় সব ক্ষতে প্রলেপ বুলিয়ে দেয়।
নতুন কোন মুখরোচক গল্পের রসদ জোগাড় করতে না পেরে বিমর্ষ গলায় ‘নারায়ণ নারায়ণ’ বলতে বলতে বিদেয় হল নারদ।
(২)
জানলার ধারে বসে উদাস চোখে বাইরে তাকিয়ে ছিল রম্ভা। নীল আকাশের বুকে কোন আনমনা শিল্পী যেন পরম অবহেলাভরে ছড়িয়ে দিয়েছে গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘপুঞ্জ। পড়ন্ত বেলায় সেই মেঘ থেকে সোনালী আলো ঠিকরোচ্ছে। একটু পরেই সন্ধ্যে ওদের গায়ে কালি বুলিয়ে দিয়ে যাবে, ওরাও ম্রিয়মাণ হয়ে পড়বে রম্ভার মত।
সেদিন গোধুলিবেলাতেই ঘটনাটা ঘটেছিল। রম্ভা কতবার ভেবেছে ওইসব কথা আর ভাববে না। কিন্তু যতই ভোলার চেষ্টা করে, ততই বন্ধ চোখের পাতার আড়ালে প্রকট হয়ে ওঠে রাবণের নৃশংসতা।
আর পাঁচটা দিনের মত সেদিনও ইন্দ্রের সভায় নাচের আসর বসেছিল। নৃত্যগীতে সবার মন ভুলিয়ে ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে সন্ধ্যেবেলা বরের কাছে যাচ্ছিল রম্ভা। অপ্সরাদের বিয়েতে ইন্দ্রের তীব্র আপত্তি, কিন্ত যক্ষরাজ কুবেরের ছেলে নলকুবেরের সাথে ওর সম্পর্কটাকে শেষমেশ মেনে নিয়েছে দেবরাজ। এই সন্ধ্যেটার জন্যই সারাদিন অপেক্ষা করে থাকে রম্ভা। বরের সাথে নীরবে নিভৃতে একান্তযাপন করবে, সুখদুঃখের কথা বলবে, একটু মন খুলে হাসবে—এটুকুই তো চাওয়া।
শ্বশুরমশাইয়ের বাগানে আপন খেয়ালে হাঁটছিল রম্ভা। আর কয়েক পা গেলেই নলকুবেরের প্রাসাদ। এই বাগানে হরিণেরা খেলে বেড়ায়, ময়ূর পেখম মেলে, পাখিরা কিচিরমিচির করে। কিন্ত সেদিন ওরা কেউ ছিল না। নির্জনতার অস্বস্তি কাটাতেই গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে তাড়াতাড়ি পা চালাচ্ছিল ও।
—ওহে সুন্দরী, একা একা কোথায় যাচ্ছ? আমাকে সঙ্গে নেবে নাকি?
পিছন থেকে ভেসে আসা অচেনা কণ্ঠস্বরে নির্জনতার তার ছিঁড়ে গেছিল। রম্ভা তাকিয়ে দেখেছিল, কালো বস্ত্র পরিহিত প্রকাণ্ড চেহারার এক পুরুষ ওর দিকে এগিয়ে আসছে। লাল চোখদুটো ওর সারা শরীরে ঘুরছিল, ওর প্রতিটা শিরা উপশিরা ভেদ করে অন্তরাত্মাকে পুড়িয়ে দিচ্ছিল যেন।
—আমি রাবণ, লঙ্কার রাজা। কুবেরের ভাই। তুমি কে সুন্দরী? বেশভূষা দেখে তো কোন অপ্সরা মনে হচ্ছে।
—আমি রম্ভা। অপ্সরাদের রাণী।
—রম্ভা, ভালোই হল তোমার সাথে দেখা হয়ে। সারাদিন পথশ্রমে আমি ক্লান্ত। কাছে এস। আমাকে শান্ত করো।
পেশাগত কারণে রম্ভা বহুভোগ্যা। বিয়ের পরেও চেনা অচেনা অনেক পুরুষের সামনে ওকে নগ্ন হতে হয়। কিন্ত নগ্নতার জন্য ওর কখনো গ্লানিবোধ হয়নি আগে, লজ্জায় ঘেন্নায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করেনি। সেদিন করছিল। মনে হচ্ছিল, যদি ও কুৎসিত হত, এই অসভ্য লোকটার কামার্ত চোখের দৃষ্টি ওকে সহ্য করতে হত না এভাবে!
রম্ভা যথাসম্ভব সৌজন্য বজায় রেখে বলার চেষ্টা করেছিল—কুবের আমার শ্বশুরমশাই। নলকুবেরের স্ত্রী আমি। আপনার কন্যাসমা। এভাবে কথা বলবেন না আমার সাথে।
হো হো করে হাসতে হাসতে রাবণ বলেছিল—তুমি স্বর্গের এক বেশ্যা। এছাড়া আমার কাছে তোমার আর কোন পরিচয় নেই। বেশ্যাদের বর থাকে না, আর থাকলেও সেটাকে ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয় না। শুধু শুধু সময় নষ্ট করো না। আমি কামার্ত।
রম্ভার শাড়িতে টান পড়েছিল। কালো ছায়াটা গিলে ফেলছিল ওকে।
—এ কী করছেন? ছোঁবেন না আমাকে….সরে যান বলছি….
—এভাবেই নাটক করে তোমরা পুরুষের বাসনা বাড়িয়ে দাও, তাই না? কাছে এস, অনেক আদর করব। দেবতাদের বউদের সান্নিধ্য তো আর আশা করতে পারি না, তোমাকে দিয়েই কাজ চালাতে হবে আর কি…..রাবণের হাসি আর থামছিল না।
রম্ভা বুঝেছিল এই লোকটার প্রাণে কোন দয়ামায়া নেই। সাহায্যের জন্য ও চিৎকার শুরু করেছিল, কিন্ত রাবণের অট্টহাসিতে চাপা পড়ে গেছিল ওর আর্তনাদ। সবটুকু শক্তি দিয়ে রাবণের থেকে ও নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্ত গায়ের জোরে পেরে ওঠেনি। রম্ভা বুঝতে পেরেছিল, ও যত বেশী অনুনয় করবে, তত বেশী ওকে পিষবে এই বিষাক্ত পুরুষ। শেষমেশ ও হাল ছেড়ে দিয়েছিল, মৃতদেহের মত পড়ে থেকে সহ্য করেছিল সমস্ত অত্যাচার। ওকে আঁচড়ে, কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করার পর নিজের পোশাকআশাক ঠিক করে চলে গেছিল রাবণ, যেন কিছুই হয়নি।
রম্ভার অর্ধনগ্ন, অচেতন, রক্তাক্ত শরীরটা বাগানে আবিষ্কার করেছিল নলকুবের। কোলে করে ঘরে নিয়ে গিয়েছিল ওকে, নিজের হাতে পরিষ্কার করেছিল ওর অপমানের সব চিহ্ন। রাবণকে অভিশাপ দিয়েছিল, যদি ভবিষ্যতে ও কোন মহিলাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করে, তখনি ওর মৃত্যু হবে, ওর মাথা খন্ড বিখণ্ড হয়ে যাবে।
পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে রম্ভার চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। যদি মায়াবলে সেই সন্ধ্যেটাকে জীবন থেকে মুছে ফেলা যেত!
মর্ত্যলোক থেকে শঙ্খধ্বনি ভেসে আসছে। বর্তমানে ফেরে রম্ভা। ইতিউতি ভাবনার মাঝে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমেছে। জানলা থেকে সরে আসে ও। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করে। কাজলে ঢাকতে চায় ক্লান্ত চোখের কালি। নলকুবেরের আসার সময় হয়েছে।
অনেক ভেবেছে রম্ভা। এই অভিশপ্ত ঘটনার পর আর অপ্সরা জীবনে ও আর ফিরতে চায় না। যদি ও অপ্সরা না হয়ে কোন সাধারণ নারী হত, তাহলেও কী রাবণ ওকে সহজলভ্য বা অরক্ষিতা ভেবে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত? রম্ভার একটা সাধারণ জীবন চাই, আটপৌরে গৃহবধুর জীবন।
দেবতাদের মনোরঞ্জন আর নয়। স্বামী ছাড়া অন্য কোন পুরুষের দিকে আর তাকাবে না রম্ভা। মা হবে। আজ নলকুবের ফিরলে মনের ইচ্ছের কথাটা বলতে হবে।
(৩)
—তোমার কী মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে? শোককে এভাবে আস্কারা দিলে চলে না রম্ভা। অনেকদিন তো হল, এবার স্বাভাবিক হও।
—একটা মেয়ে মা হতে চাইছে, তাতে তুমি অস্বাভাবিকতার কী দেখলে গো? আমাদের ঘর আলো করে সন্তান আসবে, সংসার পূর্ণতা পাবে….
নলকুবের রম্ভার পাশে এসে বসে। ওর হাতদুটো নিজের কোলে নিয়ে বলে—ইন্দ্র কেমন লোক সেকথা তো দুনিয়াসুদ্ধু সবাই জানে। তোমার বান্ধবীদের ও কী হাল করেছে, তা তো তোমার অজানা নয়। মেনকা বাধ্য হল ওর দুধের শিশু শকুন্তলাকে বনে ফেলে আসতে। উর্বশী আর বিভান্দকের সন্তানও তো মাতৃস্নেহ পেল না। ইন্দ্র তোমাকেও মাতৃত্বের স্বাদ পেতে দেবে না। ধরে নাও আমাদের সন্তান হল। কিন্ত ইন্দ্র তাকে তোমার কাছে রাখতে দিল না। সেই যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে পারবে তুমি? এসব কথা আর ভেব না। এ অসম্ভব সম্ভব হওয়ার নয়।
—কিন্ত উর্বশী তো বিভান্দককে ভালোবাসত না। মেনকাও ইন্দ্রের আদেশেই বিশ্বামিত্রকে ভোলাতে গেছিল, যার ফল শকুন্তলা। ওদের ব্যাপারটা আলাদা। আমি একটু বুঝিয়ে বললে হয়ত ইন্দ্র বুঝবে।
—মানছি উর্বশীর বিভান্দকের উপর কোন টান নেই, কিন্ত পুরূরবাকে তো ও সবটা দিয়ে ভালোবেসেছিল। কিন্ত ইন্দ্র ওদের একসাথে থাকতে দিল কী? ছল করে ওদের আলাদা করেই ছাড়ল। সেইদিক থেকে তুমি কত সৌভাগ্যবতী, নিজেই ভেবে দেখ। দিনের শেষে আমাকে তুমি অন্তত স্বামী বলে পরিচয় দিতে পার। অপ্সরা হয়ে এটুকু সৌভাগ্যও কারোর হয় না গো।
—তুমি কী আমার সাথে থেকে আমাকে দয়া করছ? তুমিই আমাকে প্রেম নিবেদন করেছিলে, আমার পেশার কথা জেনেই আমাকে আপন করে নিয়েছিলে। আমি তো কোনদিন কিছু গোপন করিনি তোমার কাছে। তাহলে আজ আমাকে এত কথা শোনাচ্ছ কেন?
—তুমি আমাকে ভুল বুঝছ রম্ভা। তুমি মা হতে চাইলে ইন্দ্র অসন্তুষ্ট হবে। মুনিঋষিদের তপস্যা থেকে মন ঘোরানোর জন্য তাদের ভুলিয়ে গর্ভবতী হয়ে সেই বাচ্চার দায় তাদের উপর চাপিয়ে দিয়ে চলে আসা আলাদা ব্যাপার, আর বাচ্চার জন্ম দিয়ে তাকে লালনপালন করে বড় করা অন্য ব্যাপার। তুমি অপ্সরা, ইন্দ্র কখনোই তোমাকে এটা করতে দেবে না। রাবণের জন্য আমাকে আর বাবাকে লঙ্কা ছাড়তে হয়েছে, ইন্দ্র রেগে গেলে স্বর্গও ছাড়তে হবে। কোথায় যাব তখন আমরা?
—তার মানে আমি আমার ইচ্ছা অনুযায়ী কিছুই করতে পারব না? ইন্দ্র আমার জন্য কিছুই করল না, রাবণকে ডেকে একবার ধমকাল না পর্যন্ত, কিন্ত আমার জীবনের রাশ ওর হাতে থাকবে? আমি কী ওর ক্রীতদাসী?
—শুধু শুধু জেদ করছ তুমি। তুমি দাসী নও ঠিকই, কিন্ত তুমি প্রজা। প্রজাকে তো রাজার কথা মেনে চলতেই হয়! আমি এটুকুই বোঝাতে চাইছি যে আমরা সাধারণ। যারা ক্ষমতায় বসে আছে তাদের সাথে সরাসরি সংঘাতে গেলে আমরা কিছু করতে পারব না। বরং তাতে আমরাই সর্বহারা হব।
—তাই বুঝি? সেইজন্যেই কী আমি ধর্ষিতা হওয়ার পরেও তোমার বাবা তার ছোটভাইয়ের বিরুদ্ধে একটা আঙুলও তোলেনি? এত ভীতু তোমরা?
নলকুবেরের মুখটা ছাইয়ের মত সাদা হয়ে যায়। কোনরকমে আমতা আমতা করে বলে— আমি….আমি তো রাবণকে অভিশাপ দিয়েছি…
—তাতে কী রাবণের সত্যি কিছু আসে যায়? ওর ঘরে বউ আছে, প্রমোদভবনে শত শত রক্ষিতা আছে। ওর চাহিদা পূরণ করার জন্য মেয়ের তো অভাব নেই। কিন্তু আমার সাথে যে অন্যায়টা হল, তার কোন বিচার কেন হবে না? কেন অপরাধী শাস্তি পাবে না?
—ওই অভিশাপই ওর শাস্তি। এর বেশী কিছু করার ক্ষমতা নেই তোমার এই অযোগ্য স্বামীর। আমি রাবণের কাছে কিছুই না। সরাসরি সংঘাতে গেলে আমাকে শেষ করতে ওর কয়েক মুহূর্ত লাগবে। আবেগের বশে বাস্তববুদ্ধি বিসর্জন দিলে তো আর চলে না।
—তাহলে আমি কোনদিন বিচার পাব না? অপ্সরা বলে কী আমার কোন মানসন্মান নেই?
রম্ভা তেড়েফুঁড়ে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্ত বাধা পড়ল। দরজার কাছে একটা পরিচিত ছায়া। উর্বশী!
—এভাবে অসময়ে বিরক্ত করার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। কিন্ত দরকারটা এমনই যে না এসে পারলাম না। কিছু ব্যক্তিগত কথা আছে তোমার সাথে রম্ভা।
নলকুবের মাথা নীচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
(৪)
—তোমাকে বিশ্বামিত্রের মন ভোলাতে মর্ত্যে যেতে হবে। ইন্দ্রের আদেশ।
রম্ভা অবিশ্বাসী চোখে উর্বশীর দিকে তাকায়। একটা মেয়ে ধর্ষিতা হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই যারা তাকে অন্য এক অচেনা পুরুষের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে বলে, তাদের কি আদেও বিবেক বলে কিছু আছে? ইন্দ্রের ন্যুনতম লজ্জাবোধটুকুও লোপ পেয়েছে। নিজেকে স্বর্গের রাজা বলে, অথচ প্রজাদের নিরাপত্তাটুকু সুনিশ্চিত করতে পারে না। শুধু মিথ্যে আশ্বাস দেয় আর নিজের প্রয়োজনে সবাইকে ব্যবহার করে যায়। নির্যাতিতা নারীর অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া দূরে থাকুক, তাকে ওই দুর্ঘটনা ভোলার সময়টুকুও দেবে না ইন্দ্র?
—আমি পারব না। রম্ভা চিৎকার করে ওঠে—আর তাছাড়া, বিশ্বামিত্র তো মেনকার প্রেমিক। মেনকাকেই পাঠাও না আবার। আমাকে কী দরকার?
উর্বশী মৃদু হেসে বলে—মেনকা বিশ্বাসঘাতিনী। ছল করেছিল বিশ্বামিত্রের সাথে। ওকে পাঠালে যে কাজ হবে না।
রম্ভা ঠোঁট কামড়ায়। মেনকা-বিশ্বামিত্রের কথা স্বর্গে সবাই জানে। মুনিবর তাপসবলে অন্য একটা স্বর্গ বানানোর পরিকল্পনা করছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই গদি চলে যাওয়ার আশঙ্কায় ওনার ধ্যান ভাঙাতে ইন্দ্র মেনকাকে মর্ত্যে পাঠায়। মেনকা ছলাকলা করে বিশ্বামিত্রের সাথে সহবাস করে। ওদের একটা মেয়েও হয়, শকুন্তলা। মেয়েকে একা ফেলে মেনকা ফিরে আসে স্বর্গে। অপ্সরার প্রতি মোহাবিষ্ট হওয়ায় বিশ্বামিত্র লক্ষ্যভ্রষ্ট হন, তার ব্রহ্মতেজ কমে যায়। ইন্দ্র নিশ্চিন্ত হয় সাময়িকভাবে। কিন্ত বিশ্বামিত্র মেনকাকে ভুলে আবার নতুন উদ্যমে তপস্যা শুরু করেছে। নতুন স্বর্গ ও বানিয়েই ছাড়বে। ভয়ে ইন্দ্রের রাতের ঘুম উড়ে গেছে। কিন্ত ও তো আর সরাসরি যুদ্ধে যাওয়ার লোক নয়। ও ভীতু, কাপুরুষ। আবার কোন অপ্সরাকেই বলির পাঁঠা বানাবে। এবার রম্ভার পালা।
—তোমাকে যেতেই হবে রম্ভা। আমাদের মধ্যে তুমিই সবচেয়ে সুন্দরী, বুদ্ধিমতী। মেনকাকাণ্ডের পর মুনিবর একেবারে পাষাণ হয়ে গেছে। সেই পাষাণ গলানোর ক্ষমতা শুধু তোমার আছে গো।
—আমাকে এত কথা না বলে তুমি তো নিজেও যেতে পার উর্বশী?
উর্বশী ঢোঁক গেলে। আসল পরিকল্পনার কথাটা তো আর রম্ভাকে জানতে দেওয়া যায় না! বিশ্বামিত্রকে দ্বিতীয়বার প্রথম রিপুর ফাঁদে ফেলা যাবে না। ওনার তপস্যায় আবার কেউ বিঘ্ন ঘটালে উনি তাকে ধ্বংস করে দেবেন। ঋষিবর বরাবরই একটু রগচটা। ইন্দ্র আবার কোন অপ্সরাকে পাঠিয়েছে দেখলে উনি মেজাজ হারাবেন। দিকবিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে কিছু একটা উল্টোপাল্টা করবেন। তাতে ওনার এতদিনের অর্জিত শক্তি কমে যাবে। ব্রহ্মর্ষি হওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। রম্ভাকে পাঠানো হচ্ছে বিশ্বামিত্রকে রাগানোর জন্য, তার কাম জাগানোর জন্য নয়। এইরকম একটা ভয়ংকর কাজের দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিয়ে মুনির রোষানলের মুখে পড়ে নিজের সর্বনাশ করবে, এতটা বোকা উর্বশী নয়।
—আমি কী করব বল? ইন্দ্র তোমাকেই যেতে বলেছেন। এমনধারা কঠিন একটা কাজ, সেখানে অপ্সরাদের রাণী হয়ে তুমি নিজে ঘরে বসে থেকে অন্য কাউকে পাঠালে সেটা কী ভালো দেখাবে? সবাই তোমাকেই কথা শোনাবে। তাছাড়া ইন্দ্র বলেছে, তুমি তো এখন নাচগান কিছুই কর না, ওনার সাথে দেখা করতেও যাও না, এই কাজটুকুও করতে অস্বীকার করলে তোমার স্বামী আর শ্বশুরকে স্বর্গ থেকে তাড়িয়ে দেবে। তোমার কর্মফল ভুগতে হবে ওদের। এবার তুমিই ভেবে দেখ যাবে কিনা!
রম্ভার মাথাটা ঘুরে যায় হঠা। অসহায়ভাবে ও মেঝেতে বসে পড়ে। উর্বশী সেদিকে দৃকপাত না করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
(৫)
সবুজে ঘেরা এই পাহাড়ে সভ্যতার পদচিহ্ন এখনো পড়েনি। পশুপাখিদের মুক্তাঞ্চল এই পার্বত্য অরণ্য। বন্যপ্রাণীরা আপনমনে খেলা করে, বিশ্বামিত্রকে ওরা বিরক্ত করে না। পাখিরা ওনার মাথার উপর বসে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, মুনিবরের একাগ্রতার বিঘ্ন ঘটে না তাতে।
কিন্ত একদিন এই জনমানবশূন্য স্থানে নূপুরের আওয়াজ শোনা গেল। আতরের তীব্র গন্ধে চাপা পড়ে গেল গাছের সবুজ গন্ধের নির্মলতা। বিশ্বামিত্র চোখ মেলে দেখলেন পরমাসুন্দরী এক নারী হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। দৃষ্টি মাটির দিকে, অঙ্গভঙ্গিতে চপলতা নেই। মেয়েটিকে দেখে ওনার বিন্দুমাত্র উত্তেজনাবোধ হল না।
রম্ভা একটু ইতস্তত করে নিজের পরিচয় দিতে শুরু করল—ধৃষ্টতার জন্য প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি মুনিবর। ইন্দ্র পাঠিয়েছে আমাকে….
ইন্দ্রের নাম শুনেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন বিশ্বামিত্র। কি ভেবেছে ইন্দ্র, আমি ওর মত দুশ্চরিত্র?সুন্দরী দেখলেই বারবার একই ভুল করব? উচিত শিক্ষা দিতে হবে ওকে।
রম্ভাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই চিৎকার করে উঠলেন বিশ্বামিত্র—এত বড় সাহস তোমার, আমার তপস্যা ভাঙতে এসেছ? এই স্পর্ধার দাম দিতে হবে তোমাকে। আমি অভিশাপ দিচ্ছি, তুমি পাথর হয়ে যাবে এই মুহূর্ত থেকে। হাজার হাজার বছর এই নির্জন পাহাড়েই পাথর হয়ে পড়ে থাকবে তুমি, পাপিষ্ঠা নারী….
রাগে আগুন হয়ে হনহন করে সেই স্থান ত্যাগ করলেন বিশ্বামিত্র। কামকে তিনি জয় করেছেন, কিন্তু ক্রোধ এখনো নিয়ন্ত্রণ করে তাকে। মুনিবরের একবারও মনে হল না, ইন্দ্রের পাপের শাস্তি রম্ভাকে দেওয়া যুক্তিযুক্ত কিনা! এমনটাই তো হয়ে আসছে সৃষ্টির আদিকাল থেকে। পুরুষে পুরুষে যুদ্ধ হয়, বলি হয় নারী। তুচ্ছ এক স্বর্গবেশ্যার কথা ভাবার মত বাজে সময় কী আর বিশ্বামিত্রের আছে?
(৬)
—নারায়ণ, নারায়ণ! প্রভু, রম্ভার এ কী হল? স্বর্গ বাঁচাতে গিয়ে ওর জীবনটা যে নরক হয়ে গেল!
—সত্যি, খুবই দুঃখজনক।
ইন্দ্র অনেক চেষ্টা করেও মুখে দুঃখ দুঃখ ভাবটা ফোটাতে পারল না। আজ তো ইন্দ্রের জয়ের দিন, আনন্দ উদযাপনের দিন। রম্ভাকে অভিশাপ দেওয়ার ফলে বিশ্বামিত্রের ব্রহ্মতেজ আবার কমে গেছে। ইন্দ্রের সিংহাসন এখন সুরক্ষিত। রম্ভাটাও বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করেছিল বিচার বিচার করে, ওকেও স্বর্গ থেকে নির্বাসিত করা গেছে। একেই বলে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা।
এই সময় ঝমঝম করতে করতে উর্বশী সভায় ঢোকে। নারদকে দেখে বলে—আজ সন্ধ্যেবেলা ইন্দ্রলোকে জলসার আয়োজন করা হয়েছে। নাচগান হবে, আমোদ হবে। সময় পেলে আসবেন কিন্তু।
—সোমরসের গন্ধ পেলে আমি কী আর না এসে থাকতে পারি? নারদ হাসতে হাসতে বলে, তা অপ্সরাদের রাণী হয়ে কেমন লাগছে?
—ওমা, আপনি জেনে গেছেন এর মধ্যেই?
উর্বশী মুচকি হাসে। অল্পদিনের মধ্যেই ওর জ্যোতি আরো বেড়ে গেছে, বেশভূষারও বদল হয়েছে অনেক। রম্ভার অবর্তমানে উর্বশী এখন অপ্সরাদের রাণী। নতুন পদের মান রাখতে ও নিজেকে হীরে জহরতে এমন মুড়ে রেখেছে, যে বেশীক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে অস্বস্তি হয়, চোখ ঝলসে যায় যেন!
(৭)
কেটে যায় দিন, মাস, বছর। নিঝুম পর্বতের চূড়ায় একাকী দাঁড়িয়ে থাকে পাথররূপী রম্ভা। শুধু গোটাকয়েক পাখি আর ঝরাপাতারা ওর সঙ্গী। ও সব দেখতে পায়, শুনতে পায়, কিন্ত নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করতে পারে না, কাঁদতে পারে না, চিৎকার করতে পারে না। পারবে কী করে? পুরুষতন্ত্র যে ওর গলা চেপে রেখেছে।
তবু এই অভিশাপই রম্ভার মুক্তি। অপ্সরারা অমর, মৃত্যুর মাধ্যমে মুক্তি খোঁজার উপায় তো ছিল না ওর। বিশ্বামিত্র নিজের অজান্তেই ওর উপকার করেছেন। অপ্সরা হওয়ার থেকে পাথর হওয়া ভালো। ওকে আর স্বর্গের ক্লেদ গায়ে মাখতে হয় না। প্রতি রাতে নিত্যনতুন পুরুষের সামনে কাপড় খুলতে হয় না। ইন্দ্রের হাতের পুতুল হয়ে থাকতে হয় না। স্বামীর উদারতার ভরে নুইয়ে পড়তে হয় না। এ জগৎ এক স্বপ্নের জগৎ। এখানে দুর্নীতি নেই, গ্লানি নেই, হিংসা নেই।
পাথরজন্ম রম্ভাকে স্বাধীনতা দিয়েছে, ওর পা থেকে খুলে দিয়েছে নূপুররূপী শিকল। এই সবুজের মাঝে শ্যাওলার আড়ালই ওর মুক্তির ঠিকানা, ওর শান্তি সুখের স্বর্গ।