
কমলিকা রায় দত্ত-র গুচ্ছ কবিতা
তিলোত্তমা -১
সব বিপ্লব থেমে যাবে
সব শব্দ একদিন ক্লান্ত হয়ে
বসতে শিখে যাবে সুখী গৃহকোণের দাঁড়ে
মাইলের পর মাইল মোমবাতি হাতে নিয়ে
হেঁটে চলা মানুষরা ঘরে ফিরে নুনহীন
তরকারি দিয়ে,
ভাত মেখে নিতে গিয়ে হুলুস্থুলু বাধাবে না আর?
হাত বাড়ালেই নুনের শিশির বদলে মুখে উঠে আসবে না খিস্তি খেউর?
চোখ দিয়ে ধর্ষিত হবে না আর, বৃষ্টিভেজা শরীরের অফিসফেরতা মেয়েটি?
ধর্ষণ শুধু পুরুষ নয় যে নারীরাও করে বার বার,
তোমার যোগ্যতা মেপে নেয় ব্যাক্তিগত গল্পের আ৺কে বা৺কে
তারা কি থেমে যাবে এরপর?
পোশাক আর পেশা নিয়ে বারবার অগ্নিপরীক্ষায় দাঁড়াতে হবে না সীতাদের?
সম্মান শব্দটি একটু জায়গা পাবে জিরিয়ে নেওয়ার
প্রতিটি ঘরের বিছানায়?
এত আলো এত প্রতিবাদ,তবু ঘরপোড়া গরু এ মন
দেখেছে বারবার বিকিয়ে যাওয়ার প্রহসন,
প্রতিবাদ শুধু নিরাপদ দূরত্বে থেকে
অথচ তোমার পাশের চেয়ারে বসা সহকর্মী যে অন্যায় ভাবে
প্রতারিত হয়ে প্রায় চাকরি হারা
তার জন্য কবার মুষ্টিবদ্ধ হাত উঠেছে?
পাশের বাড়ির শিক্ষিত ছেলেটি যে আজ সাত বছর চাকরির অপেক্ষায় থেকে গলায় দড়ি দিয়েছে ঘুষ দিতে না পারার অক্ষমতায়
তার জন্য কবার প্রতিবাদ করেছে আপনার আঙুল?
বর্ষা যায় উৎসব আসে,
কূট প্রশ্ন শুধু কুড়ে কুড়ে খায়
এরপর… এরপর কি সব বদলে যাবে?
ধর্ষকের শাস্তিই কি শুধুমাত্র কাম্য তিলোত্তমা মানবীর?
তিলোত্তমা২
এখন শুধু পথ ডাকছে
রক্তে রাঙানো পথ
রাস্তায় থিকথিকে ভিড়
হাতে হাত মানবশৃঙ্খল
সারা শহর জুড়ে চলছে
মোমবাতির মিছিল।
না এখন কোনও দীপাবলি নয়
নয় কোনও জাতীয় উৎসব
এখন সময় জাতীয় শোকের
যার প্রাণ শিকার হল
কিছু বিকৃত মানুষের লোভের,
সে আমাদের বোন, আমাদেরই মেয়ে,
তাই,সময় আজ শুধু প্রতিবাদের
গর্জন করে উঠেছে জনতা সমুদ্র
পাপের ঘড়া পূর্ণ আজ,
আজ বিচার হোক
দুর্বৃত্ত শোষক তোর।
বৃষ্টিদিন
তোমার সঙ্গে আমার কিছু
একলা থাকার গল্প ছিল,
তোমার কাছে আমার কিছু
নিভৃত ক্ষণ পাওয়ার ছিল
বুকের মধ্যে গহন বনে
পাতা ঝরার শব্দ ছিল।
মেঘলা আকাশ, নদীর বুকে
একলা নৌকা সওয়ার ছিল.
তোমার সাথে একটা জন্ম
স্বপ্ন বোনার স্বপ্ন ছিল;
স্বপ্নে তোমার খুব কাছেতে
তোমার হয়ে থাকার ছিল
বাস্তবে তাই পাহাড় চূড়ায়
মন কেমনের গন্ধ ছিল,
স্বপ্নে তোমার ঘরের মধ্যে
আমার ঘরকন্না ছিল।
এখন তাই অন্যদেশে
আজ গোলার্ধ বদল হল।
আমার তুমি বদলে গেলে
আকাশ ভেঙে বৃষ্টি এল
প্রেম এল না, বৃষ্টি এল
স্মৃতির নৌকা সওয়ার হল
আজীবন পার করেও আজ
তবু অন্য রকম ছন্দ ছিল
তোমার সঙ্গে আমার কিছু
জন্মান্তরের গল্প ছিল।
শান্তিনিকেতন
এমন মন কেমনিয়া সময়ে
ঠিক দু এক দিন কেমন পাগল পাগল মেঘ করে,
আকাশ গায়ে জড়িয়ে নেয় রূপকথার মসলিন
অন্য রকম হয়ে যায় দিন গুলো।
কেমন যেন এলোমেলো পাতা ওড়ে খুব;
শাল সেগুন ছাতিমের।
শান্তিনিকেতন মনে আসে খুব, ঘন্টাতলা, আম্রকুঞ্জ পাঠভবনের পায়ে পায়ে চোরকাঁটা স্মৃতি….আর তুমি
এ কদিনই যেন বদলে যাও তুমি পুরোনো স্মৃতির মতো।
তোমার কি অসুখ করেছে কোনো, ভুলে গেছ সব অভিমান?
বার বার কপালে হাত দিয়ে দেখি আমি
ঘর পোড়া গরু।
জানি আবার আসবে কাল রাত
প্রমিথুসের মতো ছিঁড়ে খুঁড়ে খাবে হৃদয়
হিংস্র ঈগল এক।
তবু প্রেম এসেছে আজ দুয়ার জুড়ে
শান্তিনিকেতন আবার এই গহন মনে।
পাল্টে যাওয়া সময়ের কথকতা
অন্ধকার লিখি না আমি কবিতায়,
এই আত্মপ্রত্যয় পায়ে পায়ে
মুছে যায় আজকাল,
বৃষ্টিভেজা শৈল শহর
দূর থেকে ডাক পাঠায়-
সবুজ গালিচা আর গভীর খাদ
দুটোই অপেক্ষায় আছে জানি;
যে কোনওদিন বেছে নেব
একটা অথবা দুটোই।
ক্রমাগত অবলুপ্ত হয়ে যায়
টেলিগ্রামের টরেটক্কা, কলকাতার ট্রাম
আর মানুষের মূল্যবোধ ;
একদিন ঘুম থেকে উঠে
এ শহর অচেনা হয়ে যাবে একদম,
আমাকেও চেনা যাবে কি আর মুখোশে অথবা মুখোশ হীনতায়।