কবিতায় কাহিনির চিত্রকর  <br />  অনির্বাণ কুণ্ডু

কবিতায় কাহিনির চিত্রকর
অনির্বাণ কুণ্ডু

একটি রোহিনী যেমন একটি বনস্পতিকে আশ্রয় করে অভিকর্ষের বিরুদ্ধে আকাশের দিকে বেড়ে ওঠে, বিস্তার করে তার অকিঞ্চিৎকর অস্তিত্ব,…ঠিক তেমনি ভাবেই আমাদের জীবনের অবলম্বন হয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বস্তুতঃ জ্ঞানোন্মেষের পরেই বাঙালির সন্তান মা, বাবা, আকাশ, বাতাস, মেঘ বৃষ্টি, সূর্য চন্দ্রের সাথে সাথেই রবীন্দ্রনাথকেও চিনতে শেখে। তারপর যখন সে বৃহত্তর জীবনে প্রবেশ করে, মানসিক পরিণতি প্রাপ্তির সাথে সাথে সে বুঝতে পারে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিসম্ভারের ব্যাপ্তি সম্ভবত তার জীবনকালের দৈর্ঘ্যের থেকেও বেশি। অনুভব করতে পারে তার জীবনের ছোট বড় সুখ ও আনন্দের ঘনীভূত শব্দরূপই শুধু নয়,…জীবনের যাবতীয় জ্বালা-যন্ত্রণার ওষুধও লুকিয়ে আছে ওই মানুষটির লেখার ছত্রে ছত্রে….তার মনের অগ্রন্থিত ভাব আর অব্যক্ত ভাষার নিখুঁত প্রতিচিত্র এঁকে দিয়ে চলে গেছেন সেই দীর্ঘদেহী ঋষিপ্রতিম মানুষটি, তার ভূমিষ্ঠ হওয়ার সুদীর্ঘকাল আগেই। তাঁর তিরোধানের এতগুলো বছর পরেও আমরা প্রতিদিন প্লাবিত হয়ে চলেছি তার সৃষ্টির মন্থন থেকে উঠে আসা নিত্য নতুন বিস্ময়ে।
রবীন্দ্ররচনার বিভিন্ন দিক নিয়ে জাগতিক বৌদ্ধিক সমাজে এযাবত অগণিত আলোচনা হয়েছে, টীকা হয়েছে, বিশ্লেষণ হয়েছে, গবেষণা হয়েছে,…এবং এখনো হয়ে চলেছে, কিন্তু তবুও মনে হয় সমুদ্রের তলদেশ আজও আমরা স্পর্শ করতে পারি নি। রবীন্দ্রনাথের রচনার বৃহত্তম আকর্ষণ অজস্র কবিতা আর অফুরন্ত গান। রবীন্দ্রনাথের গানকে যেমন পূজা, প্রেম, স্বদেশ ও প্রকৃতি ইত্যাদি চারটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়,…আমার মতে তেমনই এই কবিতাগুলিকে ভাগ করা যায় অনুভূতি-আশ্রিত এবং কাহিনি-আশ্রিত এই দুই ভাগে। যদিও অনুভূতিই সকল কবিতার প্রাণস্বরূপ, তবুও মনে হয় কাহিনি-আশ্রিত কবিতাগুলির বিশেষ আবেদন আর আকর্ষণ আছে, তারা পাঠকের মনকে অন্যভাবে টানে, সে টান গল্প শোনার টান। গল্প শুনতে কে না ভালোবাসে! তাই, এই প্রবন্ধে ধরার চেষ্টা করলাম রবীন্দ্রনাথের কাহিনিমূলক কিছু কবিতার সংক্ষিপ্ত রূপরেখা।
সূচনাতেই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে ছড়িয়ে থাকা বিমূর্ত অনুভূতি-আশ্রিত কবিতাগুলির পাশে কাহিনিমূলক কবিতাগুলিকে রেখে বিচার করলে, কাহিনিমূলক কবিতাগুলির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দৃষ্টিগোচর হয়।
আবার যদি বিভিন্ন কাহিনি-কবিতাগুলিকে তাদের রচনার সময়ানুক্রমে সাজানো হয়, তাদেরও একটি চিত্তাকর্ষক ক্রমবিবর্তন চোখে পড়ে। এই বিবর্তন ভাবে, ভাষায়, ছন্দে ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই পরিলক্ষিত হয়।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবি জীবনের উষালগ্নে বেশ কতকগুলি আখ্যান কাব্য ও খন্ড কবিতা রচনা করেছিলেন। বর্তমানে লুপ্ত ‘পৃথ্বীরাজের পরাজয়’ কাব্যটি কিশোর কবির কবিতা কর্মের প্রথম প্রকাশ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। তবে কাব্যটি লুপ্ত হওয়ার কারণে এর গঠণ সম্বন্ধে পাঠকের আর ধারণা করা সম্ভব নয়। তবে জীবনস্মৃতিতে এই কাব্যটিকে স্বয়ং কবি বীর রসাত্মক কাব্য বলে বর্ণনা করেছেন। ‘পৃথ্বীরাজের পরাজয়’ কাব্যটির পর ‘বনফুল’ (১৮৭৬) কাব্যগ্রন্থটি আলোচনার দাবি রাখে। এটি যেন কবিতার আকারে লেখা উপন্যাস। রচিত হয়েছে মিত্রাক্ষর ছন্দে।
এই খানে আলোচনার আরো গভীরে প্রবেশের আগে রবীন্দ্রনাথের কৈশোরকালীন রচনাশৈলীর একটা বিশেষ লক্ষণের প্রতি আলোকপাত করা অত্যন্ত জরুরি। লক্ষ্য করা যায়, এ সময়ে কবি মনের অন্তরে কবি হওয়ার সাধনা সবে শুরু হয়েছে, কিন্তু সৃষ্টির এই প্রাথমিক অধ্যায়ে অর্থাৎ একেবারে গোড়ার দিকের রচনাগুলিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পূর্বসূরী কবিদের অর্থাৎ কালিদাস, বঙ্কিমচন্দ্র, হেমচন্দ্র, মধুসূদন এঁদের অনুসরণেই আখ্যান কবিতা রচনা করতে চেষ্টা করেছেন। বনফুল এর কাহিনির সাথে কালিদাসের শকুন্তলা এবং বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলার কাহিনির বেশ সাদৃশ্য রয়েছে। আবার গঠন শৈলীতে মধুসূদন, হেমচন্দ্র বিহারীলাল ও অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর রচনাশৈলীর প্রভাব অনুমিত হয়।
‘বনফুল’ রচনার দুই বছর পরে রচিত হলো ‘কবি কাহিনি’ (১৮৭৮)। এটি রবীন্দ্রনাথের প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থে কিশোর কবির খানিকটা নিজস্বতা ফুটে ওঠে। এই কাব্যটিও বনফুলের মত ট্র্যাজিক রোমান্স। রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী কাব্যজীবনে মানবপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম একটা বিশেষ স্থান অধিকার করেছিল তারই পূর্বাভাস রয়েছে এই ‘কবি কাহিনিতে’। তবে পূর্বের কাব্যটির মতো এতে নাটকীয়তা নেই।
‘বনফুল’ ও ‘কবি কাহিনি’ কাব্যে ভাব ছন্দ প্লট ইত্যাদিতে পূর্ববর্তী কবিদের অনুসরণ করার প্রবণতা লক্ষ্য করার গেলেও, এ কথা ঠিক যে কাব্যগ্রন্থ দুটিতে লিরিক ও কল্পনার যে বিস্তার লক্ষ্য করা যায় তা কবির মৌলিক অবদান।
এরপর রবীন্দ্রনাথ ‘রুদ্রচন্ড’ ও ‘ভগ্নহৃদয়’ (১৮৮১) নামে দুটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। তবে এই দুটিকেই মূলতঃ নাট্যগুণসম্পন্ন কাব্য বললে অত্যুক্তি হয় না। পাত্র-পাত্রীদের সংলাপের মাধ্যমে কবিতার কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।
এ পর্যন্ত যে সমস্ত কাব্যগ্রন্থগুলির কথা আলোচিত হলো, তাদের প্রত্যেকটি লক্ষ্য করা যায় কাহিনির নায়ক স্বয়ং কবি। কাহিনির সঙ্গে কবি নিজে একাত্ম হয়ে গেছেন, তাই স্বভাবতই কবিতাগুলিতে এক আবেগময় সুরের অব্যাহত গতি ও মুক্ত-পক্ষ কল্পনার সঞ্চার লক্ষ্য করা যায়।
কৈশোরে রচিত বেশ কিছু গাথা গান পরবর্তীকালে ‘শৈশব সংগীত’ গ্রন্থে সংকলিত হয়। পূর্বের কাব্যগুলিতে যে ধরনের আবেগ উচ্ছ্বাস এবং পূর্ববর্তী কবিদের অনুসরণে রচনার প্রবণতা ছিল সেই একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের মনে কাহিনি বা গল্প বলার আগ্রহ প্রবল এবং দেখা গেল তিনি কবিতাকেই সেই কাহিনি বর্ণনার প্রথম মাধ্যম হিসাবে বেছে নিয়েছেন।
এর পরে এলো ‘সন্ধ্যা সঙ্গীত’ (১৮৮২)। এই পর্বে এসে যেন কবি নিজের স্বকীয়তা আবিষ্কার করলেন। তবে সন্ধ্যা সঙ্গীত এর কবিতাগুলির মূল সুর দুঃখ-বিলাস, অস্পষ্ট বেদনা এবং সেই সঙ্গে কবির বয়সন্ধিপর্বের অস্থিরতা, তাই সন্ধ্যা সঙ্গীত ও ভীষনভাবেই ভাব প্রধান।
এর পরবর্তী কাব্য ‘প্রভাত সঙ্গীত’ (১৮৮৩)। তার সম্পর্কেও প্রায় একই কথা বলা চলে, তবে এর ভাবটি একটু ভিন্ন। সন্ধ্যা সঙ্গীতে যেন বিভিন্ন আবেগের বিশাল অরণ্যে পথ হারিয়ে কবি বেদনা প্রকাশ করেছেন, প্রভাত সঙ্গীতে এসে যেন তিনি সেই পথের সন্ধান পেয়েছেন আবার, তাই ফুটেছে আনন্দের আভাস।
এর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ ‘ছবি ও গান’ (১৮৮৪)…ঠিক যেন টুকরো টুকরো ছবি দিয়ে গাঁথা মালা। এটিও নিঃসন্দেহে কবির আরেকটি নতুন আঙ্গিক এর ফসল। কবির নবযৌবন তখন একটি পরিণত শিখরবিন্দুতে এসে স্থির হয়েছে, উচ্ছ্বাস অনেকটা প্রশমিত হয়েছে, তবে ভাষায় তখনো যেন রয়ে গেছে কিছুটা ছেলেমানুষী। দৃষ্টিভঙ্গি ও ছন্দ প্রয়োগের দিক থেকে কবি নতুন ক্ষমতা অর্জন করেছেন বলা যাবে।
এর পরে বলতেই হবে ‘ভানুসিংহের পদাবলী’ (১৮৮৪) র কথা, এটি কবির কিশোর বয়সের রচনা। এর এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে,… বৈষ্ণব পদকর্তাদের অনুকরণে ও জয়দেবের গীত গোবিন্দ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে যে কবিতাগুলি রচনা করেছিলেন সেগুলিতেও টুকরো টুকরো গল্পের আভাস দিয়েছেন পাঠককে। ব্রজবুলি ভাষায় অন্ত্যমিলযুক্ত পংক্তিতে এই কবিতাগুলি রচিত। জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
“একদিন মধ্যাহ্নে খুব মেঘ করিয়াছে। সেই মেঘলাদিনের ছায়াঘন অবকাশের আনন্দে বাড়ির ভিতরে এক ঘরে খাটের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া একটা শ্লেট লইয়া লিখিলাম ‘গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে’। লিখিয়া ভারি খুশি হইলাম; তখনই এমন লোককে পড়িয়া শুনাইলাম বুঝিতে পারিবার আশঙ্কামাত্র যাহাকে স্পর্শ করিতে পারে না। সুতরাং সে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়া কহিল, “বেশ তো, এ তো বেশ হইয়াছে।”
পূর্বলিখিত আমার বন্ধুটিকে একদিন বলিলাম, “সমাজের [ব্রাহ্মসমাজ] লাইব্রেরি খুঁজিতে খুঁজিতে বহুকালের একটি জীর্ণ পুঁথি পাওয়া গিয়াছে, তাহা হইতে ভানুসিংহ-নামক কোনো এক প্রাচীন কবির পদ কপি করিয়া আনিয়াছি।” এই বলিয়া তাঁহাকে কবিতাগুলি শুনাইলাম। শুনিয়া তিনি বিষম বিচলিত হইয়া উঠিলেন। কহিলেন, “এ পুঁথি আমার নিতান্তই চাই। এমন কবিতা বিদ্যাপতি-চণ্ডীদাসের হাত দিয়াও বাহির হইতে পারিত না। আমি প্রাচীন কাব্যসংগ্রহ ছাপিবার জন্য ইহা অক্ষয়বাবুকে দিব।”
তখন আমার খাতা দেখাইয়া স্পষ্ট প্রমাণ করিয়া দিলাম, এ লেখা বিদ্যাপতি-চণ্ডীদাসের হাত দিয়া নিশ্চয়ই বাহির হইতে পারে না, কারণ এ আমার লেখা। বন্ধু গম্ভীর হইয়া কহিলেন, “নিতান্ত মন্দ হয় নাই।”

অবশেষে এই দীর্ঘ অনুকরণের পথ কবি অতিক্রম করলেন ‘কড়ি ও কোমল’ (১৮৮৬) এ এসে। তবে এই কাব্যগ্রন্থটি হয়তো কবির সার্থক সৃষ্টি নয়, এই গ্রন্থে কাহিনিমূলক কবিতাও তেমন একটা নেই।
পরবর্তী ‘মানসী’, ‘সোনার তরী’, ‘চিত্রা ‘, ‘চৈতালি’…. এই গ্রন্থগুলির বিভিন্ন কবিতায়, বিশেষত কাহিনি কবিতাগুলির মধ্যে সূক্ষ্মতর ভাবের বিকাশ ও উচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়।
নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে কবি পূর্ণ সচেতন হলেন ‘মানসী’ (১৮৯০) কাব্যগ্রন্থে পৌঁছে। মানসীর কাহিনি কবিতাগুলিতে একদিকে যেমন গল্প বলার দারুণ আকর্ষণীয় টেকনিক ব্যবহার করেছেন, তেমনি ভাবগম্ভীর অপূর্ব ছন্দ সম্পদে ও ব্যঞ্জনায় সেগুলি অতুলনীয়। কথার রঙ তুলিতে পাঠক চিত্তপটে চিত্র ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা, শব্দ নির্বাচনের দক্ষতা, ধ্বনি ও ছন্দকে বশীভূত করে কাহিনি পরিবেশনের ক্ষমতা এত সুচারুরূপে আগে আর দেখা যায়নি। মানসীর অন্তর্গত ‘বধূ’ আর ‘সুরদাসের প্রার্থনা’ কবিতা দুটিই তার প্রমাণ। বধূ কবিতায় গ্রামের উন্মুক্ত চিরপরিচিত পরিবেশ ছেড়ে চার দেওয়ালের মধ্যে হাঁপিয়ে ওঠা শহর জীবনের সঙ্গে বধূটি কিছুতেই যখন খাপ খাওয়াতে পারে না….তখন তার মনে পড়ে তার গ্রামের কথা। তার মনের গভীর বেদনা ও ব্যঞ্জনা প্রকাশের জন্য যে পদ্ধতি ব্যবহার করলেন তা পূর্বে দেখা যায়নি কবিতায় বর্ণিত গল্পটি বধূটির স্বগতোক্তির মাধ্যমে প্রকাশিত….
“অশথ উঠিয়াছে প্রাচীর টুটি,
সেখানে ছুটিতাম সকালে উঠি
শরতে ধরাতল শিশিরে ঝলমল,
করবী থোলো থোলো রয়েছে ফুটি”
(মানসী, বধূ)
এর থেকে স্পষ্ট, যে প্রকৃতিকে বর্জন করে কবি কোনো কাহিনি রচনা করার চেষ্টা করেননি, প্রকৃতির যে কাহিনির রচনার একটা অন্যতম অবলম্বন হওয়া জরুরী, এতে যে কাহিনির বিষয়ের ব্যঞ্জনা স্পষ্টতর হয় সেদিকে কবির দৃষ্টি সজাগ ছিল।
ঠিক এই সময়ে জমিদারি দেখাশোনার সূত্রে রবীন্দ্রনাথকে শিলাইদহ এবং পূর্ববঙ্গের আরো কয়েকটি জায়গায় বেশ কিছুদিন অতিবাহিত করতে হয়। এই সময়েই প্রকৃতির সঙ্গে কবির নিবিড় প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটলো, প্রকৃতি যে মানব জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত একথা কবি উপলব্ধি করলেন। ‘সোনার তরী’ (১৮৯৪), ‘চিত্রা’ (১৮৯৬) ও ‘চৈতালি’ (১৮৯৬) কাব্যগ্রন্থে কবি তাঁর মনের বন্ধ দুয়ার খুলে প্রকৃতির উন্মুক্ত উদার অঙ্গনে এসে দাঁড়ালেন, একই সাথে বাস্তবময় বৃহত্তর জীবনের মধ্যেও প্রবেশ করলেন। শিলাইদহে পদ্মার চরে বজরায় বসবাস করতে গিয়ে দিনের পর দিন দেখেছেন কোনোদিন পদ্মার শান্ত, কখনো উন্মত্ত বা কখনো বৈরাগী রূপ, ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়ে নদীর দুপাশের মানুষ আর যাদের সংসারের বিচিত্র লীলা। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ঘাত প্রতিঘাত খুব কাছের থেকে কবির চোখে ধরা দিল….যেন অবারিত খুলে গেল গল্পলোকের প্রবেশদ্বার।
চৈতালির গল্পভিত্তিক ছোট ছোট কবিতাগুলোতে কবি পরীক্ষামূলকভাবে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছেন যে, নিসর্গের সঙ্গে মানব জীবনের রয়েছে অপূর্ব যোগ। নিসর্গের অমোঘ সত্য আর মানব জীবনের একটি করুণ মুহূর্ত তাই নিটোল কাহিনির আকারে ধরা পড়েছে ‘সোনার তরী’র ‘যেতে নাহি দিব’ এবং ‘প্রতীক্ষা’ কবিতায়।
‘যেতে নাহি দিব’ কবিতার নায়ক তথা ছোট্ট বালিকাটির পিতা যখন বেশ ক’টা দিন ছুটি কাটিয়ে নিজের কর্মস্থলে ফিরে যাচ্ছিল তখন সেই বিদায় মুহূর্তে স্ত্রী ও কন্যার বিচ্ছেদ ব্যথা বুকে নিয়ে পথে যেতে যেতে তার মনে হয়েছিল,
“এই অনন্ত চরাচরে স্বর্গ মর্ত্য ছেয়ে
সবচেয়ে পুরাতন কথা সবচেয়ে
গভীর ক্রন্দন-যেতে নাহি দিব হায়
তবু যেতে দিতে হয় তবু চলে যায়
চলিতেছে এমনি অনাদিকাল হতে
প্রলয় সমুদ্রবাহী সৃজনের স্রোতে”
(সোনার তরী, যেতে নাহি দিব)
সোনার তরী কাব্যগ্রন্থে কবি যে আরো চারটি রূপকথা ভিত্তিক কাহিনি কবিতা রচনা করেছেন সেগুলো হলো ‘বিম্ববতী’, ‘রাজার ছেলে ও রাজার মেয়ে’, ‘নিদ্রিতা’, ‘সুপ্তোত্থিতা’। এইগুলিতে পংক্তির অন্ত্যমিল বজায় রেখেই কাহিনি বর্ণনা করেছেন। কবিতাগুলি গভীর ব্যঞ্জনাধর্মী হলেও এক্ষেত্রে কিন্তু কাহিনিই প্রধান।
“রাজার মেয়ে শোয় সোনার খাটে,
স্বপনে দেখে রূপ রাশি,
রুপোর খাটে শুয়ে রাজার ছেলে
দেখিছে কার সুধা হাসি…”
(সোনার তরী, রাজার ছেলে ও রাজার মেয়ে)

চৈতালি কাব্যের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল এর চতুর্দশপদী কবিতাগুলি। তবে এই প্রচেষ্টা প্রথম দেখা গিয়েছিল কড়ি ও কোমল গ্রন্থে। চৈতালির ছোট ছোট গল্পভিত্তিক কবিতাগুলি পাঠ করলে মানুষ ও প্রকৃতির এক অপূর্ব পূর্ণতাচিত্র পাওয়া যায়।
তবে আঙ্গিক ও ভাব প্রসঙ্গ দুদিক থেকেই সোনার তরী ও চিত্রার সঙ্গে চৈতালির বেশ পার্থক্য রয়েছে। সোনার তরী আর চিত্রায় রয়েছে বর্ণনার প্রাচুর্য কিন্তু চৈতালীতে এসেছে বাক সংযম। কবি এখানে নিরপেক্ষ বর্ণনার মাধ্যমে ছবি এঁকেছেন, নিজে থেকে কোন ব্যাখ্যা বা টীকা আরোপ করেননি। যে ছবি আঁকা হয়েছে তা পাঠকের মনে অজান্তেই অনুভূতির রং লাগিয়েছে,
“একদিন দেখিলাম উলঙ্গ সে ছেলে
ধুলি পরে বসে আছে পা দুখানি মেলে
……….
অদূরে কোমল লোম ছাগবৎস ধীরে
চড়িয়া ফিরিতেছিল নদী তীরে তীরে
সাহস আসে কাছে আসি থাকিয়া থাকিয়া
বালকের মুখ চেয়ে মুখপানে উঠিল ডাকিয়া
বালক চমকি কাঁপে কেঁদে ওঠে ত্রাসে,
দিদি ঘাটে ঘটি ফেলে ছুটে চলে আসে
এক কক্ষে ভাই লয়ে অন্য কক্ষে ছাগ
দুজনেরে বাঁটি দিল সমান সোহাগ”
(চৈতালি, কবিতা – পরিচয়)
কবিতাটি চতুর্দশপদী এবং পংক্তিগুলি অন্ত্যমিলযুক্ত। অত্যন্ত সহজ ও স্বাভাবিক এক চিত্রের মাধ্যমে গল্পের ভঙ্গিতে কবি এক গভীর তত্ত্বকথা বলেছেন। কর্তব্যের ক্ষেত্রে মা ও দিদি উভয় সম্পর্কই সমান এবং স্নেহের ক্ষেত্রে নরশিশু ও ছাগশিশুর মধ্যে কোন ভেদরেখা টানা যায় না।
এরপরেই আসে ‘কণিকার’ (১৮৯৯) কথা। কণিকার প্রায় প্রত্যেকটি ক্ষুদ্র কবিতাই দুই বা চার পংক্তির, খানিকটা বচন জাতীয়। এই কবিতাগুলোতে অতি সাধারণ ভাষায় কখনো বা গল্প বলার ভঙ্গিতে ব্যক্ত হয়েছে নৈতিক, তত্ত্বমূলক, উপদেশমূলক ও ব্যঙ্গ হাস্যমূলক গভীর কথা। দীর্ঘ কাহিনি কবিতা এখানে অনুপস্থিত।
কনিকার পরেই কবি প্রতিভার হঠাৎই এক অভাবনীয় উত্তরণ লক্ষ্য করা যায় ‘কথা’ কাব্যগ্রন্থ এবং ‘কাহিনি’র নাট্যকাব্যগুলি মধ্যে। এই দুটি গ্রন্থ একসাথে প্রকাশিত হয় ‘কথা ও কাহিনি’ (১৯০০) নামে নাট্যকাব্যগুলির ঘটনার বিবৃতির বর্ণনা আবেগ নাটকীয়তা ইত্যাদির অপূর্ব সমাবেশ লক্ষ্য করা যায়। বলাবাহুল্য যে ‘কথা ও কাহিনি’ রবীন্দ্রনাথ সৃষ্ট প্রথম পূর্ণাঙ্গ আখ্যান কাব্য….অর্থাৎ এই গ্রন্থের সব কবিতাই কাহিনি কবিতা।
কাহিনি কাব্যগ্রন্থে ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় উপেনের জন্মভূমি প্রীতি ও তাকে কেন্দ্র করে শোষণ ও বঞ্চনার যে করুন কাহিনিটি ব্যক্ত করেছেন কবি তা এক মুহূর্তে পাঠকের হৃদয়কে গভীরভাবে নাড়া দেয় ও পাঠককে উপেনের দুঃখ ও বেদনার সঙ্গে একাত্ম করে দেয়। কবিতায় ব্যবহৃত অনুপ্রাসের প্রয়োগ অপূর্ব মাধুর্য সৃষ্টি করেছে, “হেনকালে হায় যমদূত প্রায় কোথা হতে এলো মালি,
ঝুটি বাধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি
বা,
বাবু ছিপ হাতে পারিষদ সাথে ধরিতে ছিলেন মাছ শুনি বিবরণ ক্রোধে তিনি কন মারিয়া করিব খুন”
(কাহিনি, দুই বিঘা জমি)
এক্ষেত্রে দুটি বিষয় স্পষ্ট,…প্রথমত: কবি এই সব কাহিনি-কবিতায় যে চরিত্রগুলির বর্ণনা করেছেন তাদের তিনি যেন খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করে তবেই কাহিনিতে উপস্থাপন করেছেন, তাদের দুঃখ-বেদনা বঞ্চনার কথা গভীরভাবে অনুভব করেছেন।
দ্বিতীয়ত: কবি ওই চরিত্রগুলির বর্ণনার সময় নিজেকে নিরপেক্ষ রাখতে পারছেন অর্থাৎ কবির ব্যক্তিগত উপস্থিতি সেখানে নেই,…যেমনটা ছিল প্রথম যুগের কাহিনি-কবিতাগুলিতে, সেখানে নায়ক ছিলেন স্বয়ং কবি।
‘কাহিনি’ কাব্যগ্রন্থে ‘গানভঙ্গ’, ‘দীনদান’ ইত্যাদি কবিতায় যে রাজাদের কথা উল্লিখিত হয়েছে তারা কিন্তু ইতিহাসের কোনো বিশেষ পরিচিত চরিত্র নন। গানভঙ্গ কবিতায় এমনই এক রাজা প্রতাপ রায়, সংগীত শিল্পী বরজলালের একজন সহানুভূতিশীল বন্ধু ও সংগীত বোদ্ধা। সুতরাং কাহিনির রাজারা কথার কবিতাগুলি রাজাদের সমগোত্রীয় নন। শুধু তাই নয় ‘কথা’র রাজাদের ঐতিহাসিক সত্যতা রয়েছে। কিন্তু ‘কাহিনি’র রাজারা প্রায় সকলেই কাল্পনিক। ‘কথা’র আখ্যানগুলির মাধ্যমে কবি উদাত্তকণ্ঠে অতীতের ইতিহাস ও অনুশাসনের মহিমা কীর্তন করেছেন, কিন্তু ‘কাহিনি’র সুরটি ভিন্ন,…এখানকার কবিতাগুলি যেন নিতান্ত ঘরোয়া জীবনের অশ্রুভারাক্রান্ত ও গভীর ভাবপ্রকাশক। কাহিনির কবিতাগুলি দীর্ঘ অথচ তার ভাবে ও ভাষায় কোন অতিরঞ্জন নেই, কাহিনির আখ্যান কবিতাগুলির বিষয়বস্তু কাল্পনিক হলেও তাদের মূল ঐতিহ্যগত। সেগুলি বর্ণনার সময়ে কবি নেমে এসেছেন সাধারণ মানুষের পাশে, তাদের প্রতি কবির সহমর্মিতা ঝরে পড়েছে। কাহিনি বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে অলংকারবহুল শব্দ প্রকাশ কবিতা গুলির ব্যঞ্জনাকে নিয়ে গেছে।
“যত পায় বেত, না পায় বেতন
তবু না চেতন মানে”
(পুরাতন ভৃত্য)
এই বর্ণনা নিঃসন্দেহে উচ্চ ব্যঞ্জনাধর্মী।
‘মস্তক বিক্রয়’ কবিতায় কাশীরাজ ও কোশলরাজের যে বিরোধ দেখা যায়, তা কীর্তি প্রতিযোগিতার ফল, এতে কোন বৈরিতার ঘটনা নেই। কাশীরাজ উদারতার দ্বন্দ্ব যুদ্ধে হার না মানার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর, এই সূক্ষ্ম বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি রেখে কবি কবিতায় করুন রসের প্রাদুর্ভাব এর মধ্যেও লঘু ও স্মিত কৌতুকময় রসের সৃষ্টি করেছেন। তাই যখন বনবাসী ও দাতা কোশলরাজ নিরাশ্রয় অসহায় বণিককে সঙ্গে নিয়ে এসে কাশীরাজের সভায় উপস্থিত হয়ে বলেন,
“আমার ধরা পেলে যা দিবে পণ,
দেহো তা মোর সাথীটিরে….”
তখন উপায়ান্তর না দেখে কাশীরাজ মৌন হেসে থেকে বলেন,
“ওহে বন্দী, মরিয়া হবে জয়ী আমার পরে
এমনই করিয়াছো ফন্দি!
তোমার সে আশায় হানিব বাজ,
জিনিবো আজিকার রণে,
রাজ্য ফিরি দিব হে মহারাজ
হৃদয় দিব তারি সনে”
(কথা, মস্তক বিক্রয় )
একই সঙ্গে আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে এখনো অবধি কাহিনি বর্ণনা করলেও কবিতা থেকে অন্ত্যমিলকে বর্জন করেননি রবীন্দ্রনাথ।
‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতায় নিষ্ঠুর রাণীর খেয়ালসঞ্জাত অন্যায়ের প্রতিবাদে রাজার ক্রোধ ও ন্যায় বিচারের অটল সংকল্প কবিতায় ব্যবহৃত ছন্দের অপূর্ব দ্যোতোনাময় বর্ণনায় সুচারু রূপে প্রকাশিত হয়েছে।
“কহিলেন রাজা উদ্যত রোষে
রুধিয়া দীপ্ত হৃদয়ে
যতদিন তুমি আছো রাজরানী
দীনের কুটিরে দীনের কী হানি
বুঝিতে নারিবে জানি তাহা জানি
বুঝাবো তোমারে নিদয়ে”
(কথা, সামান্য ক্ষতি)
‘বিচারক’ কবিতায় দেখা যায় পেশোয়া রঘুনাথরাও যখন হায়দার আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার আয়োজন করেন তখন যে ধরনের যুদ্ধ ধ্বনিময় শব্দ ব্যবহার করেছেন কবি তাতে যেন যুদ্ধের উত্তেজনা পাঠকের মনে সঞ্চারিত হয়।
“দেখিতে দেখিতে পূরিয়া উঠিল
সেনানী আশি সহস্র।
নানা দিকে দিকে নানা পথে পথে
মারাঠার যত গিরিদরী হতে
বীরগণ যেন শ্রাবণের স্রোতে
ছুটিয়া আসে অজস্র।

উড়িল গগনে বিজয়পতাকা
ধ্বনিল শতেক শঙ্খ,
হুলুরব করে অঙ্গনা সবে,
মারাঠা নগরী কাঁঁপিল গরবে,
রহিয়া রহিয়া প্রলয় আরবে
বাজে ভৈরব ডঙ্ক।”
(কথা, বিচারক)
আবার ‘নকল ঘর’, ‘হোরিখেলা’, ‘বিবাহ’ এই তিনটি কবিতায় কিছুটা লঘু সুরে গম্ভীর বিষয়ের উপস্থাপনা করেছেন কবি। অতি তুচ্ছ সাধারণ কাহিনির আড়ালে ধরা পড়েছে দেশপ্রেমের মহৎ দৃষ্টান্ত। এগুলিতে ব্যালাডের বর্ণনা ভঙ্গি ও বাচনভঙ্গির চমৎকার কলাকৌশল লক্ষ্য করা যায়।
বর্ণনাধর্মী কাহিনি কবিতার পাশাপাশি নাট্যগুণসম্পন্ন কাহিনি কবিতাগুলির উল্লেখ করাও জরুরী। গান্ধারীর আবেদন, সতী, নরকবাস, কর্ণ কুন্তী সংবাদ, লক্ষীর পরীক্ষা এই সবকটি রচনাই একান্তভাবে গীতিধর্মী অথচ এদের মধ্যে নাটকীয় গুণের অপরূপ সমাবেশ রয়েছে। একমাত্র লক্ষ্মীর পরীক্ষা ছাড়া সব কটি কবিতারই বিশেষ উপাদান আমাদের দেশের প্রাচীন ঐতিহ্য। সবকটি কবিতাতেই কবি প্রচলিত লোকাচার, ধর্মাচার ও সামাজিক সংস্কার প্রভৃতি সবার উপরে মানব ধর্মের জয় ঘোষণা করেছেন।
‘কর্ণ কুন্তী সংবাদ’ কবিতার শিল্প গৌরব অতুলনীয়। এই কবিতাটি আখ্যান কবিতার জগতে যেন এক অনবদ্য স্বার্থকতা দাবি করে।
‘লক্ষীর পরীক্ষা’ সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে রচিত একটি দীর্ঘ কাহিনি কবিতা, এর ভাষা কথ্য, ভাব গৃহস্থালি এবং কবি ছড়ার ছন্দ ব্যবহার করেছেন।

এরপরে আসে কাব্যগ্রন্থ ‘কল্পনা’ (১৯০০) র কথা, তবে কল্পনাতে কয়েকটি কৌতুক রসের দীর্ঘ কাহিনিকবিতা থাকলেও এখানে কবির শিল্প সার্থকতা নিতান্ত সীমাবদ্ধ।
কল্পনার পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ ‘ক্ষণিকা’ (১৯০০)। কোনো অতীত নয়, বর্তমান নয়, সমস্ত বন্ধন অতিক্রম করে কবি শুধুমাত্র ক্ষণকালের দৃশ্যমান আনন্দকে প্রকাশ করেছেন বলে কাব্যটির ভাষায় ছন্দে এক বেপরোয়া ভাব প্রতিফলিত। কবিতাগুলিতে অতি সহজ ভাষায় গভীর কথা ব্যক্ত হয়েছে। তাই মেঘলা দিনে পাড়াগাঁয়ের মাঠে কালো মেয়েকে দেখে কবিচিত্তে যে অকারণ সুখ জেগেছে তাকে ব্যক্ত করেছেন ‘কৃষ্ণকলি’ শীর্ষক কবিতায়। রবীন্দ্রনাথের কাব্যশিল্পের ক্রমবিকাশের পথে ক্ষণিকা একটি পরম আশ্চর্য মুহূর্ত। পূর্বের কাব্য রচনা রীতিতে যেটুকু আড়ষ্টতা জড়তা অবশিষ্ট ছিল, তা ক্ষণিকায় একেবারেই অদৃশ্য হয়েছে!
পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ ‘নৈবেদ্য’ (১৯০১)। এটি সম্পূর্ণভাবে আধ্যাত্মিক অনুভূতি সম্পন্ন কবিতায় সমৃদ্ধ, এখানে কোনো কাহিনিমূলক কবিতা গড়ে ওঠেনি, কবিতাগুলি গীতিধর্মী ও সনেট জাতীয়। ‘স্মরণ’ কবিতাটি কবির সদ্যমৃতা পত্নী মৃণালিনী দেবীর উদ্দেশ্যে রচিত।
‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থে (১৯০৩) কবি হঠাৎ করে এক অপূর্ব সরলতায় পৌঁছেছেন। শিশুমনের উপযোগী এই কবিতাগুলির সবগুলি নিরলংকার সরলতায় পূর্ণ। মাস্টার বাবু, রাজার বাড়ি, পূজার সাজ ইত্যাদি কবিতায় ক্রমবর্ধমান নমনীয়তার পরিচয় পাওয়া যায়।
এরপর এলো ‘বলাকা’ (১৯১৬)। বলাকার গল্পগুলির মধ্যে এসে মিশেছে কবির নিসর্গ প্রীতি। বলাকার মাত্র কয়েকটি কবিতা সুনির্দিষ্ট স্তবকে বাধা বাকি প্রায় সবগুলিই দীর্ঘ পঙক্তির সমন্বয়ে রচিত। এই গ্রন্থে গল্প ভিত্তিক কবিতা ‘ছবি’ আর ‘শাজাহান’ উৎকৃষ্ট রচনাগুলির মধ্যে অন্যতম।
পরবর্তী ‘পলাতকা’ (১৯১৮) কাব্যগ্রন্থে সৃষ্টির একটি নতুন সংযোজন লক্ষ্য করা যায়। পলাতকা সৃষ্টির সময় কবি অত্যন্ত দরদী ও সহানুভূতি সম্পন্ন দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছেন বাস্তব সংসারে লাঞ্ছিত অবহেলিত সমাজের বন্ধন শিকার হওয়া বা বঞ্চনার শিকার হওয়া নারী চরিত্রগুলির প্রতি। মুক্তি, ফাঁকি ইত্যাদি কবিতায় দেখি নারী চরিত্রগুলি পুরুষ শাসিত সমাজে কেমন অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্যে জীবন যাপন করে, তাদের স্বাধীন মত প্রকাশের কোনো উপায় থাকে না।
এরকমই একটি গল্পকাহিনিকে কবিতার মধ্য দিয়ে কবি প্রকাশ করেছেন ‘নিষ্কৃতি’ কবিতায় মঞ্জুলিকাকে প্রতিনিধি করে। মঞ্জুলিকার জীবনের বঞ্চনার করুন কাহিনি উপস্থাপন করতে গিয়ে কবি তার বাবা পঞ্চানন, পুলিন ইত্যাদি চরিত্রগুলিকে উপস্থাপন করেছেন এবং গল্প বলার মাঝেই বিভিন্ন প্রসঙ্গে তাদের মানসিকতার বর্ণনা দিয়ে কাহিনিকে সুগঠিত করেছেন।
“একদা বাপ দুপুরবেলায় ভোজন সাঙ্গ করে
গুড়গুড়িটার নলটা মুখে ধরে,
ঘুমের আগে, যেমন চিরাভ্যাস,
পড়তেছিলেন ইংরেজি এক প্রেমের উপন্যাস।
মা বললেন, বাতাস করে গায়ে,
কখনো বা হাত বুলিয়ে পায়ে,
“ যার খুশি সে নিন্দে করুক, মরুক বিষে জ্বরে
আমি কিন্তু পারি যেমন করে
মঞ্জুলিকার দেবই দেব বিয়ে। ”

বাপ বললেন, কঠিন হেসে, “ তোমরা মায়ে ঝিয়ে
এক লগ্নেই বিয়ে কোরো আমার মরার পরে,
সেই কটা দিন থাকো ধৈর্য ধরে।
এই বলে তাঁর গুড়গুড়িতে দিলেন মৃদু টান।
মা বললেন, “ উঃ কী পাষাণ প্রাণ”
(পলাতকা, নিষ্কৃতি)
পূর্ণাঙ্গ কাহিনি বর্ণনার ক্ষেত্রে এই সাংসারিক পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত জরুরী,…নচেৎ কাহিনিটির রস পাঠকের হৃদয়ে সুস্পষ্ট রেখাপাত করে না।

পলাতকা কাব্য রচনার পরেই হঠাৎই কবি আবার ফিরেছেন শৈশবের কাছে। শিশুমনের গভীরে প্রবেশ করে শিশুজীবনকে কেন্দ্র করে কিছু গল্প ভিত্তিক কবিতা রচনা করেছেন যা ‘শিশু ভোলানাথ’ কাব্যগ্রন্থ রূপে পরিচিত। শিশুমনের উপযোগী সহজ-সরল অনাড়ম্বর শব্দ প্রয়োগ করে বিচিত্র খেয়াল ও কল্পনাকে ভাষায় রূপ দিয়েছেন কবি, যেন দূরে দাঁড়িয়ে সুগভীর দরদী দৃষ্টি দিয়ে শিশুর জীবনের অন্তর্লোকের খুঁটিনাটি খবর সংগ্রহ করেছেন। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি অধিকাংশই ছড়া জাতীয়।
এর পর খেয়া, গীতাঞ্জলি (১৯১০), গীতিমাল্য (১৯১৪) ও গীতালি (১৯১৪) এই চারটি কাব্যগ্রন্থে কোন কাহিনি-কবিতা স্থান পায়নি।

বেলা ক্রমে বাড়ছে, আর রবীন্দ্রনাথের শিল্প জগতে আসছে এক আশ্চর্য পরিবর্তন। গদ্য ছন্দের প্রথম পরীক্ষা ‘লিপিকা’ আবির্ভূত হল। লিপিকা গদ্যে লেখা একটি অপূর্ব কাব্যগ্রন্থ। লিপিকার অল্প কিছু কবিতা আছে যেগুলি পদ্যের মতো খন্ডিত করা হয়নি।
এরপরে এসেছে পূরবী (১৯২৫), বিচিত্রা এবং পরিশেষ (১৯৩২) কাব্যগ্রন্থগুলি। পূরবীতে কবি আবার ফিরেছেন পদ্য ছন্দে। এই কাব্যগ্রন্থগুলির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো কবি স্বল্প থেকে স্বল্পতর কথনের দিকে গেছেন, অর্থাৎ প্রকাশভঙ্গির নিবিড়তা বেড়েছে, ভাষা ও শব্দ ব্যবহারে কবি এখন চূড়ান্ত হিসাবী।
পরিশেষ কাব্যগ্রন্থে তেমনভাবেই প্রকাশ পেয়েছে বাহুল্য বর্জিত কতগুলো কবিতা। এই কাব্যের কবিতায় অনেক ক্ষেত্রেই কবি আত্মবিশ্লেষণ করেছেন এর জন্য ফিরে গেছেন অতীতে। কবিতার নায়ক স্বয়ং কবি, বিচিত্রা কবিতায় তার স্পষ্ট লক্ষণ রয়েছে।
লিপিকার কবিতায় যে গদ্য ছন্দের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল তারই পূর্ণ প্রকাশ লক্ষ্য করা গেল পুনশ্চ (১৯৩২) তে। এখন থেকে দেখা যাচ্ছে কবি ক্রমশই বিষয়মুখী কবিতা লিখতে গিয়ে ছন্দকে মুক্তি দিচ্ছেন। অতি সাধারণ জীবনের কথা ব্যক্ত হয়েছে গৃহস্থ ভাষার মাধ্যমে, গুরুগম্ভীর সাধু ভাষার কোন অস্তিত্ব নেই এখনকার কাহিনিভিত্তিক কবিতাগুলিতে। তাই অতি সাধারণ সাঁওতালপাড়া কবির কলমে এমন জীবন্ত হয়েছে। বাঁশি, সহযাত্রী, শেষ চিঠি, ছেঁড়া কাগজের ঝুড়ি, ছেলেটা, বালক ইত্যাদি প্রায় সব কটি কাহিনি কবিতাই বিষয়মুখী। আমের খোসা, কাঁঠালের ভুতি, মাছের কানকো, ট্রামের ভাড়া বৃদ্ধি, অফিসে মাইনে কাটা যাওয়া মাসিক তিন টাকা মাইনের গুরুর ছেঁড়া ছাতিটা, গাঁয়ের কুকুরটা….ইত্যাদি খুঁটিনাটি তুচ্ছ বিষয়কে সম্বল করেই গল্প বলে গেছেন কবি।
“বেতন পঁচিশ টাকা,
সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানি ।
খেতে পাই দত্তদের বাড়ি
ছেলেকে পড়িয়ে ।
শেয়ালদা ইস্টিশনে যাই,
সন্ধ্যেটা কাটিয়ে আসি,
আলো জ্বালাবার দায় বাঁচে ।
ইঞ্জিনের ধস ধস,
বাঁশির আওয়াজ,
যাত্রীর ব্যস্ততা,
কুলি-হাঁকাহাঁকি ।
সাড়ে-দশ বেজে যায়,
তার পরে ঘরে এসে নিরালা নিঃঝুম অন্ধকার ।
(বাঁশি, পুনশ্চ)
আর একটি উজ্জ্বল উদাহরণ ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতাটি। ক্যামেলিয়া কবিতার নায়কটির জীবনের ব্যর্থতার কথা বোঝাতে নায়কের স্বগতোক্তিতে যে কথাগুলি কাহিনির বর্ণনার ফাঁকে তুলে ধরেছেন তাতে একদিকে যেমন রয়েছে নিখুঁত ব্যঙ্গ কৌতুক, অন্য দিকে নায়কের জীবনের ব্যর্থ কারুণ্যের প্রকাশ। গল্প পাঠ করতে করতে যেন পাঠকের মনে নায়কের প্রতি সহানুভূতি জাগ্রত হয়।
“একদিন ছিল ঠেলাঠেলি ভিড়।
কমলার পাশে বসেছে একজন আধা-ইংরেজ।
ইচ্ছে করছিল, অকারণে টুপিটা উড়িয়ে দিই তার মাথা থেকে,
ঘাড়ে ধরে তাকে রাস্তায় দিই নামিয়ে।
কোনো ছুতো পাই নে, হাত নিশ্‌পিশ্‌ করে।
এমন সময়ে সে এক মোটা চুরোট ধরিয়ে
টানতে করলে শুরু।
কাছে এসে বললুম, ‘ ফেলো চুরোট। ‘
যেন পেলেই না শুনতে,
ধোঁওয়া ওড়াতে লাগল বেশ ঘোরালো করে।
মুখ থেকে টেনে ফেলে দিলেম চুরোট রাস্তায়।
হাতে মুঠো পাকিয়ে একবার তাকালো কট্‌মট্‌ ক’রে —
আর কিছু বললে না, এক লাফে নেমে গেল।”
(পুনশ্চ, ক্যামেলিয়া)

এরপরে বিথীকা (১৯৩৫), শেষ সপ্তক (১৯৩৫) কাব্যগ্রন্থে পূর্বে ব্যবহৃত গদ্যছন্দ আবার ফিরে এসেছে। এই দুটি গ্রন্থের প্রতিটি কবিতা খাঁটি গদ্যছন্দে রচিত।

এরপরে আসে ‘পত্রপুট’ (১৯৩৬) এবং ‘শ্যামলী’ (১৯৩৬) কাব্যগ্রন্থের কথা। দুটি গ্রন্থের আঙ্গিক এক বলে মনে হলেও তাদের স্বাদের সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। পত্রপুটে কল্পনার বিপুল বহিঃপ্রসার ও প্রকাশভঙ্গির তীক্ষ্ণতার বদলে শ্যামলীর কাহিনি ভিত্তিক প্রেমের কবিতাগুলিতে প্রকাশ পেয়েছে এক করুণ ও কোমল পেলবতা। কনি, দুর্বোধ, বঞ্চিত, অপরপক্ষ ইত্যাদি কবিতায় কবি লঘু সুরে নিমীলিত চেতনায় প্রেমের গল্প বলেছেন।
কবি এবার জীবনের শেষপ্রান্তে এসে উপস্থিত হয়েছেন। তার অস্তগামী জীবনের বিচিত্র উপলব্ধি ব্যক্ত হয়েছে প্রান্তিক (১৯৩৮) ও সেঁজুতি (১৯৩৮) কাব্যগ্রন্থে।
‘প্রহাসিনী’ (১৯৩৯), কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি সবই লঘু ছাঁদের , ‘আকাশ প্রদীপের’ কবিতার ভাষা সরল। যাত্রাপথ, স্কুল পালানো, ধ্বনি, বধূ, শ্যামা, কাঁচা আম প্রভৃতি কবিতায় রয়েছে স্মৃতি রোমন্থন। শ্যামা কবিতাটিতে আবার ফিরে এসেছে পদ্য ছন্দ। প্রশ্ন ছোট একটি কবিতা, কিন্তু স্বল্প কথায় ও ভাষার প্রয়োগে সার্থক। ‘সময় হারা’ একটি আখ্যান ভিত্তিক কবিতা।
‘সানাই’ (১৯৪০) কাব্যগ্রন্থের বাসা বদল কবিতাটি পূর্ণাঙ্গ গল্প কবিতা। পরিচয় ও অনসূয়াতে রয়েছে গল্পের আভাস।
“আমি বদল করেছি আমার বাসা।
দুটিমাত্র ছোটো ঘর আমার আশ্রয়।
ছোটো ঘরই আমার মনের মতো।
তার কারণ বলি তোমাকে।
বড়ো ঘর বড়োর ভান করে মাত্র,
আসল বড়োকে বাইরে ঠেকিয়ে রাখে অবজ্ঞায়।
আমার ছোটো ঘর বড়োর ভান করে না।
অসীমের প্রতিযোগিতার স্পর্ধা তার নেই
ধনী ঘরের মূঢ় ছেলের মতো।
আকাশের শখ ঘরে মেটাতে চাইনে;
তাকে পেতে চাই তার স্বস্থানে,
পেতে চাই বাইরে পূর্ণভাবে।
বেশ লাগছে।
(সানাই, বাসা বদল)

রোগশয্যায় (১৯৪০), আরোগ্য (১৯৪১) ও জন্মদিনে (১৯৪১)….জীবনের শেষ বেলায় রচিত এই গ্রন্থগুলিতে তেমন কোনো কাহিনি ভিত্তিক কবিতা খুঁজে পাওয়া যায় না, তবে আরোগ্য কাব্যগ্রন্থের দুই একটি কবিতায় অতীত দিনের স্মৃতিতে অবগাহন করতে দেখা যায়।
কবির জীবদ্দশায় শেষ প্রকাশিত গ্রন্থ ‘জন্মদিনে’। জন্মদিনে গ্রন্থে আখ্যান কবিতা নেই,…এতে এবং কবির মৃত্যুর পরে প্রকাশিত ‘শেষ লেখা’ (১৯৪১) গ্রন্থে দেখা যায় অন্ত্যমিলবিহীন এবং গভীর অর্থ সমন্বিত কিছু সংক্ষিপ্ত কবিতা।
রবীন্দ্রনাথের কাহিনিমূলক কবিতার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে যে বিশেষ বৈশিষ্ট্যটি নজরে পড়ে তা হল বিভিন্ন সময় আঙ্গিকের বিচিত্র পালাবদল, কবির সাহিত্যকর্ম পর্যালোচনা করলে পাঠক মাত্রই অনুভব করবেন যে রবীন্দ্রনাথ কখনো একটি নির্দিষ্ট ধাঁচে আবদ্ধ থাকেনি, রবীন্দ্রনাথের কাব্যভাব সসীম সংসার থেকে অসীম বিশ্ব….সবকিছুকেই স্পর্শ করেছে। এমনটাই ঘটেছে আঙ্গিকের ক্ষেত্রেও। তাই যখনই কোনো বিশেষ ধরনের আঙ্গিকে লিখতে লিখতে কবির লেখনী সীমাবদ্ধ হয়েছে, তখনই সেই ছন্দ ও ভাষা ক্ষেত্র থেকে বহু দূরে সরে গিয়ে আবার এক বিচিত্র পরীক্ষা করেছেন। এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে কখনো রূপকাশ্রয়ী, স্মৃতিবাহী, রূপকথা ভিত্তিক আবার কখনো ছেলে ভোলানো ছড়া আবার কখনো বাস্তব বিষয়মুখী, ইতিহাসমুখী, মানবজীবনমুখী এবং আদর্শভিত্তিক অজস্র কাহিনিমূলক কবিতা।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes