
সোনার তরী
সব্যসাচী মজুমদার
(১)
শ্রীরামপুর মিশন কিংবা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার পর বাংলা সাহিত্য একটি বিবর্তনের সম্মুখীন হয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকারগণ এই সময় থেকে ‘আধুনিক যুগ’ -এর সূত্রপাত বলে মনে করেন। এই আলোচনায় সেই প্রসঙ্গে প্রবেশ না করে এই বিভাজনকে স্বীকার করে নিলে , আমরা দেখতে পাচ্ছি, মোটামুটি এই দুশো বছরের পর্বের ( এখনও যা জায়মান। নতুন বিভাজন রেখা এখনও নির্মিত হয়নি ) প্রথম অর্ধে অর্থাৎ আঠার’শো খ্রিস্টাব্দ থেকে উনিশ’শো খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পর্বে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। তারমধ্যে কয়েকটি পরবর্তী অর্ধকেও নিয়ন্ত্রণ করে। এরমধ্যে প্রধান চারটি ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করতে চাই — মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই চারটি ঘটনাকে উল্লেখ করতে চাইছি এই কারণে যে, উক্ত চারটি বিষয় পরবর্তী বিংশ এবং এমনকি একবিংশ শতককেও এমন সর্বাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছে, আর কোনও কিছুই এতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। অন্তত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে এ কথা মনে হয় আমরা মেনে নিতে পারি।
বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমনভাবে বাঙালি জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছেন যে, তাঁর প্রভাবই সবচেয়ে বেশি একথা বলা বাহুল্য। তবুও সেই বাহুল্য আরেকবার দেখাতে হচ্ছে, কেননা আমরা মনে করে নিতে চাইছি যে, এই দু’হাজার পঁচিশ সনে যখন ভারতবর্ষের মানুষ হিউম্যানিজমকে তার সমস্ত অঙ্গসহ আক্রমণ করে ডেটাইজমকে গ্রহণ করতে চাইছে কর্পোরিজম আরও জোরদার করার জন্য, তখন তাঁরা সাম্প্রদায়িকতার স্বপক্ষে কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে ব্যবহার করছেন। আবার উল্টো দিকে এটাও সত্যি, মানবতাবাদের বিভিন্ন অঙ্গের কর্মীরাও কিন্তু এখনও রবীন্দ্রনাথকেই শেষ যুক্তি হিসেবে মনে করছেন। রবীন্দ্রনাথ এমন একটি বিষয় হয়ে গিয়েছেন যে, বাঙালি অন্তত তাঁর রচনা কর্মকে উপস্থাপন করতে চাইছে এখনও উভমুখি দ্বন্দ্বে। যদিও উপস্থাপনাগুলি ভঙ্গির প্ররোচনায় প্রদত্ত তথ্য কেবল পরস্পর বিরোধী হয়ে যাচ্ছে। তবুও এমন একটি বিভ্রান্ত সময়েও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকছেন, এ বড় ভরসার কথা। ভরসা এ কারণেই যে, তথ্যও যখন রবীন্দ্রনাথকে ব্যবহার করতে চাইছে, তখন, মানবতাবাদের কিছুটা অন্তত সম্পৃক্ত হতে পারছে পরবর্তী বিবর্তনের সঙ্গে। আমরা জানি না, দু’হাজার পঞ্চাশ বা ষাট খ্রিস্টাব্দে আমাদের রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব কোথায় অবস্থান করবে, কিন্তু তখনও রবীন্দ্রনাথ যদি এরকমই প্রাসঙ্গিক থাকেন, মানুষ তার পুরোনো মনস্তত্ত্বের সূত্রের সঙ্গে কিছুটা যুক্ত থাকতে পারবেন, নিজের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত হয়ে যাবেন না — এই ভরসাটা তৈরি হচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিভিন্ন প্রসঙ্গে এ কথা জানিয়েছেন যে, তিনি মনে করেন, গানের জন্য তিনি আপামরের স্মৃতিধার্য হবেন। আবার পরবর্তী সময়ে একাধিক গুণীজনও মনে করেছেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের জন্য মূলত কালোত্তীর্ণ হয়েছেন। বস্তুত, তাঁর মৃত্যুর আশি বছর পেরিয়ে এসে, আমাদেরও কি মনে হয় না যে, রবীন্দ্রনাথ রচিত অনেক কবিতার সঙ্গে আর আমাদের প্রসঙ্গের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। তারা অনেকটাই হারিয়ে যাওয়া নক্ষত্রের মতো যেন। অথচ গানগুলি কী আশ্চর্য শক্তিতে, সুরে, ভাষায় জুড়ে আছে আমাদের জীবনশৈলীতে ! কিন্তু, তারপরও আজও অনতিক্রম্য কবিতারা সুরের সাহায্য ছাড়াই আমাদের সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। আমরা ব্যর্থ হই রবীন্দ্রনাথের সীমাবদ্ধতা সন্ধানে।
(২)
বিপুল সৃষ্টি সম্ভার। তার ভেতর থেকে অতি উজ্জ্বল কবিতা হিসেবে যারা আমাদের স্মৃতিকে, সত্তাকে প্ররোচনা দেয়, তাদের মধ্যে ‘সোনারতরী’ কাব্যকে তার সম্পূর্ণ বিস্তার সমেত মনে পড়ে অনেকটা প্রথমেই ।
মূলত দীর্ঘ কবিতার সংকলন হিসেবে দেখা যেতে পারে ‘ সোনার তরী ‘ কে। নাম কবিতা দিয়ে শুরু এবং ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’য় শেষ হচ্ছে দীর্ঘ কাব্যটি। আটটি সমিল চোদ্দ লাইনের কবিতা সংকলিত হয়েছে এ কাব্যে। বস্তুত ‘সোনার তরী’ বাংলা কাব্যের তথা চিন্তার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। কেননা, তখন, রবীন্দ্রনাথ ভাবাচ্ছেন বাঙালিকে, ভারতীয়কে। অন্তত নতুন চিন্তার যতটা সংস্পর্শ পাচ্ছে তখন আমাদের ভূখণ্ড, তার অনেকটাই তো রবীন্দ্রনাথ সূত্রে — এ কথা আবারও বাহুল্য নির্মাণ করল। আসলে রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে আমার যদি কিছু বলতে হয়, তার সবটাই হয়তো প্রতিধ্বনি।
কিন্তু, যদি কেবল প্রতিধ্বনি ভাবি , তবে, রবীন্দ্রনাথের কবিতা কেই লঘু করে দেখা হয়ে যাবে। কেননা, প্রতিটি কবিতা পুনঃপাঠে নতুন করে আবিস্কৃত হয়। প্রতিটি পাঠ বহুকৌণিক, বহু স্তরিক কবিতার এক একটি পর্যায়কে আবিস্কার করতে সক্ষম হয়। হয়তো একজন সর্বোচ্চ শ্রেণির পাঠক একটি কবিতার বহু স্তরকে একটি পাঠে নির্ণয় করতে সক্ষম হন। কিন্তু অনন্ত সম্ভাবনাময় কবিতা তারপরেও আগামী পাঠকের জন্য আরও কিছু প্রসঙ্গকে বাকি রাখে। নতুন পাঠক তার কালীক বাস্তবতার মধ্যে জায়মান থেকে খুঁজে পায় সেই গোপন প্রসঙ্গকে। অতঃপর আরও নতুন পাঠককে আসতে হয়। এবং এ ভাবেই তো প্রসঙ্গের পর প্রসঙ্গের পরত খুলতে খুলতে একটি কবিতা সময়ের সঙ্গে বাজি ধরে অনেকটা পর্যন্ত জিতে যায়। যেমন ‘সোনার তরী’।
এখন, এই ভরসাতেই আলোচনায় প্রবৃত্ত হচ্ছি যে, রবীন্দ্রনাথের কবিতাকে নিজের মতো করে পড়ে নিজের প্রাসঙ্গিকতাকে আবিস্কার করা যায়। অন্তত এই আলোচনা রবীন্দ্র জীবনের বিক্ষেপ বা প্রসঙ্গ ব্যাতিরেকে, এমনকি রবীন্দ্র মনস্তত্ত্ব বলার দুঃসাহস ব্যাতিরেকে একটি পাঠের ওপর নির্ভর করতে চাইছে। একটি একান্ত ব্যক্তিগত পাঠ। যে কোনও মাপকাঠিতে তা পরিত্যক্ত হলেই স্বস্তি পাব।
সোনারতরী এবং নিরুদ্দেশ যাত্রা’কে নির্ভর করে যদি এই পাঠে প্রবৃত্ত হই , আমাদের কাছে মানুষ এবং তার সময় ধারণার সঙ্গে সম্পর্কটি যেভাবে স্পষ্ট হয়, তা বস্তুত সমকালীন পৃথিবীর অন্য কোনও টেক্সট করতে পেরেছে কিনা — এই পাঠকের জানা নেই। এক্ষেত্রে একটি বিষয় আগে স্পষ্ট করে নিতে চাই। মানুষের সময়ের সম্পর্কটি সম্পর্কে এই আলোচকের ধারণার কথা।
বস্তুত, বৃহত্তর অর্থে দেখতে গেলে, মানুষ এবং তাকে প্রসঙ্গ করে গড়ে ওঠা সবকিছুই আদৌ ঘটছে কিনা, তার কোনও বস্তুগত অস্তিত্ব আছে নাকি — সেটাই সন্দেহের। কিন্তু, যেহেতু একটি চেতনার অধিকারী হয়েছে ‘মানুষ’ নামক রাসায়নিক ও আংকিক বিক্রিয়াটি, তাই, একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির ভেতর সে নিজের অস্তিত্ব এবং অস্তিত্বের বিশিষ্টতা তৈরি করে নিতে পারে। পারে তার সাপেক্ষেই মাত্র। তবুও পারে। এই মহাবিশ্বের অনন্ত প্রসারণশীলতার মধ্যে কোনও একটি স্তরের কোনও একটি মুহূর্তে তার সচেতনতা কি একটি ঘটমান অস্তিত্ব নয় ? জায়মান নয়? আর সেই জায়মানতার প্রেক্ষিতেই তার সময়ের ধারণা। নিজের সামান্য অস্তিত্বের সাপেক্ষে সে একটি প্রসারণের অনুভব করতে পারে। কিংবা বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাওয়ার হিসেব রাখতে পারে। যার নাম সে দিয়েছে সময়। তাকে ‘কাল’ বলেও তো ডাকা হয়। আবার এই ‘কাল’ শব্দটি ভারতীয় পৌরাণিক ভাষ্যে পরিণত হয় ‘মহাকাল’ অর্থাৎ মৃত্যু নামক অচেতন বা অন্য চেতনের ব্যঞ্জনায়। অর্থাৎ কাল বা সময়ের এবং মানুষের সম্পর্কের বিষয়ে আমরা যাইই আলোচনা করি না কেন,তা, একটি নির্দিষ্ট গড়ে তোলা সাপেক্ষ অনুসারে ঘটে থাকে।
‘সোনারতরী ‘ শীর্ষক প্রথম কবিতাটি আমরা এখানে স্মরণ করে নিই,
“গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা।
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা,
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসীমাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাতবেলা–
এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা-পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু-ধারে–
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে,
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও,
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।
যত চাও তত লও তরণী-‘পরে।
আর আছে?– আর নাই, দিয়েছি ভরে।
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে–
এখন আমারে লহ করুণা করে।
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই– ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি–
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।”
( রবীন্দ্র রচনাবলী : দ্বিতীয় খণ্ড : সুলভ সংস্করণ: পৌষ ১৪১৭ : পৃঃ ৯-১০)
কবিতাটি আমাদের সকলের ভীষণ চেনা। তবুও আরেকবার পড়ে নিলে পরিশুদ্ধি ঘটে। এ কবিতার একটি রবীন্দ্রকৃত ব্যখ্যা রয়েছে
“মানুষ সমস্ত জীবন ধরে ফসল চাষ করছে। তার জীবনের ক্ষেতটুকু দ্বীপের মতো- চারি দিকেই অব্যক্তের দ্বারা সে বেষ্টিত ঐ একটুখানি তার কাছে ব্যক্ত হয়ে আছে- সেইজন্য গীতা বলেছেন-
অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত।
অব্যক্তনিধনান্যেব তত্র কা পরিদেবনা ॥
যখন কাল ঘনিয়ে আসছে, যখন চারি দিকের জল বেড়ে উঠছে, যখন আবার অব্যক্তের মধ্যে তার ঐ চরটুকু তলিয়ে যাবার সময় হল- তখন তার সমস্ত জীবনের কর্মের যা-কিছু নিত্য ফল তা সে ঐ সংসারের তরণীতে বোঝাই করে দিতে পারে। সংসার সমস্তই নেবে, একটি কণাও ফেলে দেবে না- কিন্তু যখন মানুষ বলে, ঐ সঙ্গে আমাকেও নাও, আমাকেও রাখো, তখন সংসার বলে, তোমার জন্যে জায়গা কোথায়।- তোমাকে নিয়ে আমার হবে কী। তোমার জীবনের ফসল যা-কিছু রাখবার তা সমস্তই রাখব, কিন্তু তুমি তো রাখবার যোগ্য নও! (রবীন্দ্র রচনাবলী : দ্বিতীয় খণ্ড : সুলভ সংস্করণ: পৌষ ১৪১৭ : গ্রন্থপরিচয়: পৃঃ ৮১০)
এই সূত্রেই আমরা জানতে পারি যে, এ কবিতা বস্তুত মানব জীবনের নির্মাণ – সৃষ্টি এবং তার সঙ্গে সময়ের অন্তর্ঘাতী সম্পর্কের কথা বলতে ইচ্ছে করেছে। মানুষ তার সারাজীবন দিয়ে গড়ে তোলে শিল্প, সুর, ভাস্কর্য। তারপর সেই নির্মাণ সময়ের প্রবাহে প্রবেশাধিকার পেলেও মানুষের পার্থিবতার, যাপন বৃত্তান্তের কিছুই গ্রাহ্য হয় না এই অনন্ত প্রসারিত মহাবিশ্বের সময় নামক পরিস্থিতিতে। কিন্তু, এখানেই জানতে ইচ্ছে করে, আদৌ গৃহীত হয় কি মানুষের কোনও নির্মাণ ? বা, গৃহীত হলে তার অস্তিত্ব কতটাই বা প্রসারিত ?
আমরা জানি না আমাদের পৃথিবী এর আগে মানব সভ্যতার স্পর্শ পেয়েছিল কিনা ! অর্থাৎ সেপিয়েন্স যে সূত্র ধরে পৃথিবীতে বসত করতে এসেছে, তারও পূর্বে উন্নততর মানব সভ্যতাকে পেরিয়ে এসেছে কিনা পৃথিবী — এ প্রশ্নকে অস্বীকার করার উপায় নেই। হয়তো সেই বিগত সভ্যতার কোনওরকম নমুনা ফসিলে পরিণত হয়নি। হয়তো সেই মানব সভ্যতার সবকিছুই চিহ্ন হারিয়ে আকরিকে পরিণত ! কৈ তাদের সৃজন তো তারপরও সময়ের সঙ্গী হতে পারল না !এমনটি না হলেও, আমরা জানি, পৃথিবী শেষ হওয়ার আগেই হোমো সেপিয়েন্স আস্তে আস্তে হোমো ডিউসে পরিণত হবে। পুরোনো সভ্যতার বোধ, চিন্তা — তার কাছে কতটা স্বাগত হবে, সেটা যেমন চিন্তার এবং এটাও বলার যে, তখনও সময়ের ধারণা হয়তো থেকে যাবে । কিন্তু সে ধারণা একান্তই হোমো সেপিয়েন্সের মতো নয় নিশ্চয়ই। কিন্তু, তরীতে জীবনের যাবতীয় নির্মাণ তুলে দিয়ে সময়ের সঙ্গী হয়ে যাওয়ার ধারণা ততটাই আবছা হয়ে যেতে পারে তখন। একজন মানুষের সৃজন ততদিন পর্যন্ত মানুষের সমষ্টিগত স্মৃতিতে ধার্য হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত সে পরিস্থিতি অনুযায়ী বিবর্তিত হতে পারে। উন্মুক্ত যত সে সৃজন, যত সে প্রোপাগান্ডাহীন, ততই সে সমষ্টির স্মৃতিতে জাগরুক থাকে। এখন, এখানেও একটি প্রশ্ন আসে, ভারতীয় উপমহাদেশে ক’টি সাহিত্য সহস্রাধিক বছরের স্মৃতি ও প্রসঙ্গ বিবর্তনের ঝঞ্ঝা অতিক্রম করে এখনও স্মৃতিকে প্ররোচনা দেয় ! এ প্রশ্নের উত্তরে আমরা অন্তত তিনটি উদাহরণ বলতেই পারি , রামায়ণ – মহাভারত এবং কালিদাস। এই সঙ্গে এটাও লক্ষ করতে পারছি যে, রামায়ণ এবং মহাভারত দুটো মহাকাব্যই কোনও একজনের রচনা নয়। অনেকগুলো বছর ধরে, অনেক মানুষের সম্মিলিত রচনা। একটি সমষ্টির স্পর্শ রয়েছে বলেই হয়তো রামায়ণ – মহাভারত আমাদের সঙস্কৃতির অভ্যাসে পরিণত। কিন্তু কালিদাস? কালিদাসের ক্ষেত্রে এ কথা আমরা ভাবতে পারি যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কালিদাস ঐতিহাসিকভাবে জায়মান। তাঁর যতটুকু প্রবাদে পরিণত, তার সঙ্গে, সমষ্টির একটি অমোঘ স্মৃতি জড়িত। যেমন বর্ষা এবং ভারতীয় মানুষের সম্পর্ক জড়িত রয়েছে বলেই মেঘদূত বারবার আমাদের চৈতন্যের মধু হয়ে ওঠে। বলার কথা এটাই , একটা আপাত সময় ধারণার মধ্যে ওই কালের ‘তরী ‘ – তে আপন্ন হতে গেলে অবশ্যই সমষ্টির সংস্পর্শ প্রয়োজন কি ? আবার এ কথাও আমাদের মনে পড়ে যে, বস্তুত একক মানুষের সৃজন বলে তো কিছু হয় না। সবটাই অনেক দিনে, অনেক বিবর্তনে, দ্বন্দ্বে জাত স্বভাবের তাড়নায় রচিত। আর এই স্বভাবে মিশে থাকে অনেক মানুষের অনেক অভ্যাসের অভিঘাত। এই গণের প্ররোচনাতেই একটি সৃজন হতে পারে, একটি সংকলন। এবং সময় নৌকোয় সে যদি উঠতে পারে, তবুও তার সার্থকতা ততক্ষণই যতক্ষণ সে প্রসঙ্গ বজায় রাখতে পারে। কালের নৌকো মানুষের সৃষ্টিকে নিলেও কতক্ষণ বইবে তার অনিশ্চয়তা কিন্তু থেকেই যায়। কখন যে ফেলে দেবে, পরিত্যাগ করবে — বোঝার উপায় নেই। নৌকো ফসল কেবল নেয় না, ফেলেও দেয়। মনে রাখা ভাল, কালিদাস বা জয়দেব যতটা সময় অতিক্রম করেছেন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ততটা করতে পারবেন কিনা আমরা জানি না। মাইকেল কিংবা বঙ্কিমের ক্ষেত্রেও একই কথা। আমরা জানি না কত শতাব্দী পর্যন্ত উজ্জ্বল থেকে কালিদাস সমকালীনেরা ধূসর হয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ ইন্ডিভিজুয়ালিজমকে কখনই স্বীকৃতি দেননি। ক্ষুদ্র অংশকে আসলে বৃহত্তরের অংশ হিসেবে দেখেছেন। কিন্তু, ‘ আপন’ বা ‘ আমার ‘ শব্দে কী তিনি একক ‘ব্যক্তি’র অস্তিত্বকে স্বীকার করেননি ? আত্ম-এর উন্মোচন ঘটিয়েছেন। এই উন্মোচন সম্ভব হয়েছে আত্ম রয়েছে বলেই। অথচ, আমরা এখন বুঝতে পারছি এই আত্ম বিষয়টাই অলীক, ইউটোপিয়া। হয় না। ‘আমি’ বলতে বস্তুত একটা দীর্ঘ সময়ের, প্রচুর মানব জীবনের মনস্তাত্ত্বিক ফসল। ফলত ব্যক্তি অস্তিত্বকেই যখন অস্বীকার করতে চাইছে মানুষেরই চিন্তা, তখন তার ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে ভাবনা প্রবাহ মানুষের আত্ম বোধ বিলোপের সঙ্গে সঙ্গে প্রসঙ্গ হারানর পরিস্থিতিতে আপতিত হতে পারে না কি !
এবার লক্ষ করতে চাইছি কবিতার ‘ ফসল ‘ -এর তাৎপর্যে। আমরা সকলেই এ কথা জানি, স্তন্যপায়ী যে পার্থিব আবহাওয়ার ধরনের জন্য পৃথিবীতে বসত করার অধিকার পেয়েছে, সেই আবহাওয়াকে দ্রুত বদলে যাওয়ার দিকে সবচেয়ে বেশি তরান্বিত করেছে মানুষ। এই তরণের পদ্ধতির একটি নাম দেওয়া হয়েছে ‘ পরিবেশ দূষণ ‘। বলে রাখা ভাল প্রতিটি প্রাণিই কার্বন ডাই অক্সাইডের উৎস।সবাই মিলেই পরিবেশকে আবার বিবর্তনের দিকে নিয়ে যায়, ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। যা পৃথিবীর বিগত দিনে ঘটে এসেছে। সব প্রাণিই দূষণ ঘটায়। মানুষ একটু বেশি করেছে। এখন সেই দূষণের প্রথম পদক্ষেপ হল ফসল। নিজের প্রয়োজনে স্বাভাবিক উদ্ভিদের প্রবণতাকে নষ্ট করে মানুষ ফসল ফলিয়েছে। প্রাণির স্বাভাবিক বাসভূমিকে ফসল ফলিয়ে নষ্ট করেছে। কিন্তু, মানুষের সাপেক্ষে যদি ধরা যায়, তবে এই ফসলের সঙ্গে জুড়ে আছে কত না চোখের জল ! কিন্তু, পরিবেশের, স্তন্যপায়ীর বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশের সাপেক্ষে এই ফসল কত না ক্ষতির। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু, আশু পরিত্যক্ত মানুষের সৃজন সম্ভারকে ব্যঞ্জিত করলেন, রূপক বদ্ধ করলেন এই ‘ফসল’ -এই। অর্থাৎ, তার অসম্পূর্ণ প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত, তার উভমুখী বাস্তবতার কথা ইঙ্গিতে রাখলেন রবীন্দ্রনাথ। এবং এ কারণেই তিনি পুনরাবিষ্কৃত হন। ফসল এবং চাষী — চিহ্ন দুটির সম্পর্ককে যেমন উল্লেখযোগ্য করে উপস্থাপন করলেন, তেমনই মনুষ্য সৃষ্ট ফসল যে তরী আরেকটু এগোলেই পরিত্যাজ্য হয়ে যাবে — এরকম ভাবার অবকাশও তৈরি করে রাখলেন।
(৩)
“আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে
হে সুন্দরী?
বলো, কোন্ পার ভিড়িবে তোমার
সোনার তরী।
যখনি শুধাই, ওগো বিদেশিনী,
তুমি হাস শুধু, মধুরহাসিনী-
বুঝিতে না পারি, কী জানি কী আছে
তোমার মনে।
নীরবে দেখাও অঙ্গুলি তুলি
অকূল সিন্ধু উঠিছে আকুলি,
দূরে পশ্চিমে ডুবিছে তপন
গগনকোণে।
কী আছে হোথায়— চলেছি কিসের
অন্বেষণে?
বলো দেখি মোরে, শুধাই তোমায়
অপরিচিতা—
ওই যেথা জ্বলে সন্ধ্যার কূলে
দিনের চিতা,
ঝলিতেছে জল তরল অনল,
গলিয়া পড়িছে অম্বরতল,
দিকবধূ যেন ছলছল-আঁখি
অশ্রুজলে,
হোথায় কি আছে আলয় তোমার
ঊর্মিমুখর সাগরের পার
মেঘচুম্বিত অস্তগিরির চরণতলে?
তুমি হাস শুধু মুখপানে চেয়ে
কথা না ব’লে।
হুহু ক’রে বায়ু ফেলিছে সতত
দীর্ঘশ্বাস।
অন্ধ আবেগে করে গর্জন
জলোচ্ছ্বাস।
সংশয়ময় ঘননীল নীর,
কোনো দিকে চেয়ে নাহি হেরি তীর,
অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া
দুলিছে যেন।
তারি ‘পরে ভাসে তরণী হিরণ,
তারি ‘পরে পড়ে সন্ধ্যাকিরণ,
তারি মাঝে বসি এ নীরব হাসি
হাসিছ কেন?
আমি তো বুঝি না কী লাগি তোমার
বিলাস হেন।
যখন প্রথম ডেকেছিলে তুমি
‘কে যাবে সাথে’
চাহিনু বারেক তোমার নয়নে
নবীন প্রাতে।
দেখালে সমুখে প্রসারিয়া কর
পশ্চিমপানে অসীম সাগর,
চঞ্চল আলো আশার মতন
কাঁপিছে জলে।
তরীতে উঠিয়া শুধানু তখন
আছে কি হোথায় নবীন জীবন,
আশার স্বপন ফলে কি হোথায়
সোনার ফলে?
মুখপানে চেয়ে হাসিলে কেবল
কথা না ব’লে।
তার পরে কভু উঠিয়াছে মেঘ
কখনো রবি-
কখনো ক্ষুব্ধ সাগর কখনো
শান্তছবি।
বেলা বহে যায়, পালে লাগে বায়—
সোনার তরণী কোথা চলে যায়,
পশ্চিমে হেরি নামিছে তপন
অস্তাচলে।
এখন বারেক শুধাই তোমায়,
স্নিগ্ধ মরণ আছে কি হোথায়,
আছে কি শান্তি, আছে কি সুপ্তি
তিমিরতলে?
হাসিতেছ তুমি তুলিয়া নয়ন
কথা না ব’লে।
আঁধার রজনী আসিবে এখনি
মেলিয়া পাখা,
সন্ধ্যা-আকাশে স্বর্ণ-আলোক
পড়িবে ঢাকা।
শুধু ভাসে তব দেহসৌরভ,
শুধু কানে আসে জলকলরব,
গায়ে উড়ে পড়ে বায়ুভরে তব
কেশের রাশি।
বিকল হৃদয় বিবশ শরীর
ডাকিয়া তোমারে কহিব অধীর,
‘কোথা আছ, ওগো, করহ পরশ
নিকটে আসি।’
কহিবে না কথা, দেখিতে পাব না
নীরব হাসি।’
( রবীন্দ্র রচনাবলী : দ্বিতীয় খণ্ড : সুলভ সংস্করণ: পৌষ ১৪১৭ : পৃঃ ১১৩-১১৫)
প্রায়োগিক নৈপুণ্য এবং তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠার জন্য শিল্পবিপ্লবোত্তর পৃথিবীতে পশ্চিম গোলার্ধ যে উৎস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এবং আগামী পৃথিবীর বেশ খানিকটা সময় পশ্চিম গোলার্ধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে — এই জায়মানতাকে স্বীকার করতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কখনও দ্বিধা ছিল না। বস্তুত এ কবিতায় তেমন ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া তো স্বাভাবিক। এবং একই সঙ্গে একটি বিক্ষুব্ধ জ্বলন্ত প্রায় চালচিত্র প্রাচ্য পৃথিবীর তৎকালীন বিহ্বলতার রূপক হয়ে যায় অনায়াসে। স্পর্শ – অস্পর্শের সঙ্গে সেই এক পৃথিবী থেকে আরেক পৃথিবীর দিকে যাত্রা যেন খানিকটা জানা আর অনেকটাই সংশয়ের। সেই সংশয়, যা, মানুষকে কৌতুহল দেয়। সেই সংশয়, যা, বাক্যকে কবিতার স্ফূর্তি দেয়, যা ভাবনার বিবর্তনের সমস্ত সম্ভাবনাকে মুক্তি দেয়, একটি রচনাকে পরবর্তী প্রসঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করে,
‘আছে কি হোথায় নবীন জীবন,
আশার স্বপন ফলে কি হোথায়
সোনার ফলে?’
যাত্রা প্রস্তুত হওয়ার পর এই সংশয় কেবল কাব্যিক প্রবণতা বোধ করলে বোধহয় আমরা কিঞ্চিত অসম্পূর্ণ ভাবব। উত্তর পৃথিবীতে পাশ্চাত্য প্রভাব কতটা প্রলম্বিত হতে পারবে, সে বিষয়ের সংশয়ও কি মিশে ছিল না ওপরের বাক্যে ? বস্তুত, অনেকদিন আগেই এই গোলার্ধের প্রবণতা, এই প্রাচ্য – পাশ্চাত্যের ধারণাই মুছে গেছে। এখন পৃথিবীর যে কোনও মানচিত্র থেকে মানুষ বা একটি ছোট গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠতে পারে। ঠিক করে দিতে পারে আমাদের বিজ্ঞান বা শিল্প চিন্তার অভিমুখ। এবং আমরা এও দেখেছি, তথাকথিত ‘পাশ্চাত্য’-এর দেশগুলি কি প্রবল অর্থনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক চ্যুতিতে ভুগছে ! রবীন্দ্রনাথ জানতেন আসলে ‘ শেষ নাহি রে…’ এই অশেষ যে কী বিপুল সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে, রবীন্দ্রনাথ জানতেন। ফলত সুন্দরী বা তাঁর দেহ সৌরভ কিংবা তাঁর কেশ অমরায় কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে লক্ষ্য রাখব তিনটি শব্দের ওপর — ‘নবীন জীবন’, ‘আশার স্বপন’ এবং ‘সোনার ফল’। এই তিনটি চিহ্নকে উদ্দেশ্য করেই সমস্ত কবিতা গড়ে উঠেছে বলে মনে হয় এই পাঠকের। সমস্ত যাত্রা, পরিবেশ, অলৌকিক সুন্দরী কিংবা কুহক সমস্তই তো এই তিনটি চিহ্নের উদ্দেশ্যে। মূল লক্ষ্য তো এরাই। এরা কারা ?
নতুন জীবন তো এক জীবনে আবার পাওয়া সম্ভব নয়। দার্শনিক ভাবে সম্ভব হলেও বাস্তবিক ভাবে অন্তত রবীন্দ্র পর্বে নিশ্চয়ই সম্ভব ছিল না। তাহলে এখন এতো আমরা সকলেই জানি যে, এক্ষেত্রে নতুন জীবন বোধ’কে বুঝব। এখন, প্রশ্ন হল, তখন উপনিবেশে বসত করা একজন কবি নতুন জীবন বোধ বলতে দুটো বিষয়কে দেখতে পাচ্ছেন প্রধানত — ১. রাশিয়ার সাম্যবাদী প্রয়োগ ২. আমেরিকা সহ প্রায় গোটা ইউরোপের মুক্ত বাণিজ্যের প্রস্তুতি গ্রহণ। রবীন্দ্রনাথ কাকে তাঁর অভিপ্রায় হিসেবে মনে করেছিলেন ? এ প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর উপযুক্ত প্রাজ্ঞেরা রেখেছেন এবং আরও রাখবেন। আমার যোগ করার এটুকুই যে, যাকেই গ্রহণ করুন না কেন রবীন্দ্রনাথ, অন্ধত্বের আওতায় পড়ে তাকে গ্রহণ করতে চাননি নিশ্চয়ই। কারণ এই কবিতার শেষে এসে আমরা এই সংবাদও পাচ্ছি যে, পশ্চিমে সূর্য আবার ঢলছেও। এখন পরিত্রাণই অভিপ্রায়। সোনার ফল তখন শান্তি ও সুপ্তি প্রার্থনায় পরিণত। কবিতার শেষে এসে আমরা জানতে পারি, যে, অলৌকিক সুন্দর প্রশ্নের উত্তরে নিশ্চয়াত্মক কোনও জবাবই দিলেন না শেষ অবধি। অস্পর্শসম্ভব, অনস্তিত্ব কেবল কুহক দিলেন। কেবল ব্যঞ্জনা। তাহলে কি আমরা এই সিদ্ধান্তে আসব যে, মুক্ত বাণিজ্য বা মার্ক্সের প্রয়োগ কোনও কিছুর ওপরেই সম্পূর্ণ ভরসা স্থাপন করেননি রবীন্দ্রনাথ ! বরং আরও কোনও চিন্তার খোঁজ করছিলেন রবীন্দ্রনাথ ? বলেছিলেন আমাদের? নাকি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন! যদি দিয়ে থাকেন, তবে, এই হোমো সেন্ট্রিক যুগের একেবারে শেষ প্রহরে এবং ডেটা সেন্ট্রিক যুগে প্রবেশ পর্বে দাঁড়িয়ে কি হতে পারে সেই চিন্তা, যা আমাদের উপশম দিতে পারে ! অথবা, বিগত শতাব্দী থেকে যুযুধান এই দুই মতের মিথোষ্ক্রিয়া ! রবীন্দ্রনাথ কী ভেবেছিলেন?
যা আমাদের কাছে ‘ আশার স্বপন ‘ বা ‘ সোনার ফল ‘ হতে পারে। কঠিন পরিশ্রমের ফলাফলের রূপক সোনার ফল কি তবে শ্রমের সঠিক মূল্য ?
নাকি এমন কোনও অশেষ যার কোনও উত্তর নেই ! প্রতিঘাতকে আত্মস্থ করে পথ চলতেই চলতেই মানুষের চিন্তা বিবর্তিত হয়। পথ চলতেই চলতেই সে পাল্টাতে থাকে। শেষের দিকে এগোতে থাকে, ফুরুতে থাকে। তার সম্পর্কে ধারণা করার উপায় আছে, কিন্তু ধারণা মিলতে নাও পারে। কারণ মানুষের আবেগ, বলা ভাল, ভালবাসা মানুষকে দিয়ে পরক্ষণেই কি করিয়ে নিতে পারে, আমাদের পক্ষে অনুমান করা অসম্ভব। সে পথে রবীন্দ্রনাথ হাঁটেননি বলাই বাহুল্য। তিনি এটুকুই কেবল জানিয়েছেন যে, পশ্চিম একমাত্র গন্তব্য নয়। ধীরে ধীরে বদলাবে গন্তব্য। অনিবার্য সেই বদল। কেবল সেই বদলটুকু স্বীকার করে নিয়ে একটি ‘নীরব হাসি’ কেবল বুঝিয়ে দেয় — এটুকুই অপার বিচ্ছুরণ।
(৪)
‘সোনারতরী’ একটি বিপুল দর্শনের চর্চা। তার সম্পূর্ণ রূপ’কে দেখা আমার পক্ষে অসম্ভব। এও অসম্ভব — রবীন্দ্র জীবন প্রবাহের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতার তুলনা করে মহাজীবন ও দর্শনকে নতুন করে আবিষ্কার। যেটুকু সম্বল, তা হল নিজের মতো পড়া। মূর্খের পাঠ আদৌ পাঠযোগ্য কিনা—সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। এ লেখার একটা কৈফিয়ত একটাই সমকালীন পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথকে পড়ার চেষ্টা মাত্র। আসলে তো শুশ্রূষার আয়াস।