Novel Part 5 and 6 সুবর্ণরেখার তীরে- পঞ্চম এবং ষষ্ঠ পর্ব
ছন্দা বিশ্বাস
পঞ্চম পর্ব
মহারাজা জগৎ সিং বেরিয়ে পড়লেন। সঙ্গে আছেন প্রধানমন্ত্রী, বাস্তুকার, কূলগুরু এবং আরো কয়েকজন। আগে পিছে রয়েছে অশ্বারোহী সেনারা। তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে স্থানীয় কিছু মানুষ।
পাহাড় দিয়ে ঘেরা এই জঙ্গল মহলের কোন স্থান প্রাসাদ নির্মাণের উপযুক্ত তার জন্যে স্থান নির্দিষ্ট করতে হবে। এমন এক জায়গা নির্ণয় করতে হবে যেখানে শত্রুপক্ষ সহজে টের না পায়। অথচ জায়গাটা হতে হবে মনোরম। বসবাসের উপযুক্ত। যাতায়াতের জন্যে যাতে সহজে পথঘাট নির্মাণ করা সম্ভব হয়।
গ্রীষ্ম প্রধান দেশে নদী তীরে বসবাস করাটা শ্রেয় মনে করলেন। জীবন ধারণের জন্যে জল প্রয়োজন সবার আগে। অথচ বন্যাপ্লাবিত নয় এমন।
এই কাজে সর্বতোভাবে সাহায্য করল স্থানীয় মানুষেরা।
নয়
আলৌকিক দৃশ্য ঃ
দুপুরে আহারের পরে মহারাজ ঘোড়ায় চড়ে বের হলেন। ঠিক কোন জায়গায় প্রাসাদ নির্মাণ করা যায় তার জন্যে বাস্তুকার সঙ্গে আছেন। পাহাড়ের উপরে উঠে প্রথমে নিরীক্ষণ করলেন। তারপরে সকলে সমতলে নেমে এলেন।
পশ্চিমের এক জায়গায় এসে রাজা বিশ্রাম নিতে বাধ্য হলেন। ঘন দুর্ভেদ্য সেই স্থান। তিন দিকে পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত। অদূরে বয়ে গেছে সূবর্ণরেখা নদী। পাহাড়ে প্রতিহত হয়ে সেই জলরাশি দুর্মর গতিতে ছুটে চলেছে। মহারাজা জগৎ সিং প্রথমে এই জায়গায় এসেছিলেন। তার লোক লস্কর নিয়ে রাত্রিটা সেখানেই কাটিয়ে দেবেন মনস্থির করলেন। মহারাজের সঙ্গে আছে তাদের কুল দেবতা দেবী রংকিণী। খুবই জাগ্রত এই দেবী। শক্তিময়ী। রাজার অগাধ বিশ্বাস দেবী সঙ্গে আছে যতক্ষণ তার কোনো ভয় নেই। তিনি সাক্ষাৎ দেবী মহামায়া।
তাঁবুর ভিতরে রাজা এবং রানিমাতা শয়ন করলেন। রক্ষীরা পাহারায় নিযুক্ত আছে।
সুবর্ণরেখার ঢেউ এর কল কল ছল ছল ধ্বনি তার কানে আসছে। ঠিক তার পাশের তাঁবুতে আছে প্রধান মন্ত্রী, তার স্ত্রী এবং কন্যা শৈলজা। সঙ্গে কন্যার দুইজন সখী মুক্তামালা এবং সুখমালা। তিন সখীতে একেবারে গলা জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে। কত গল্প তাদের। মুক্তামালা প্রথমে আসতে রাজী ছিল না। মা বাবাকে ছেড়ে এতো দূরে চলে আসা মানে তো এক প্রকার নির্বাসন।
রাজকন্যা যখন কথাটা জানতে পারল তখন তার সে কী মন খারাপ।
পিতার কাছে এসে সে জানাল সখী মুক্তমালা যেতে নারাচ হচ্ছে। কেন? মা বাবা ছাড়া সে এতো দূরে থাকতে পারবে না কিছুতেই।
ঠিক আছে ওর মা বাবাও আমাদের সঙ্গে যাক।
আমাদের সঙ্গে আরো অনেক প্রজারাও তো যাচ্ছে। সেখানে তাদের জমি দেওয়া হবে। অসুবিধার কি আছে। প্রচুর জমি ফাঁকা পড়ে আছে। সেখানে যত ইচ্ছা চাষাবাদ করে খাবে।
তাছাড়া শুনেছি সেখানে এক নদী আছে তার বালিতে সোনার রেণু পাওয়া যায়। প্রচুর মানুষ আছে যারা বালি থেকে সোনা আহরণের কাজ করে। সুতরাং তারা যদি যেতে চায় কাজের অভাব হবে না। থাকা খাওয়ার কোনোরকম অসুবিধা হবে না।
মন্ত্রী কন্যা আহ্লাদিত হল এবং সঙ্গে সঙ্গে সখী মুক্তামালাকে ডেকে সমস্ত কথা জানিয়ে দিল।
স্বয়ং তাদের মহারাজ যেখানে চলে যাচ্ছেন সুতরাং তাদের যেতে আর আপত্তি থাকার কোনো কারণ নেই।
সেই রাতে রাজা জগৎদেব স্বপ্ন দেখলেন স্বয়ং দেবী রংকিনী তাকে আদেশ করছেন তিনি এই স্থানে আজ থেকে থাকবেন। এই ঘন অরণ্যে যেন তার মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখানেই যেন নতুন রাজধানী গড়ে তোলা হয়।
স্বপ্ন দেখে রাজার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তখন ভোরের আকাশে অন্ধকার মাখানো ছিল। তিনি তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এলেন। দেখলেন তখন তাঁবুর বাইরে আগুন জ্বলছে। কয়েকজন রক্ষী অসি হাতে পদচালনা করছে। তারা মহারাজকে দেখে এগিয়ে এলো।’
কী ব্যাপার মহারাজ?
আপনি এই সময়ে?
এই তো ঘুম ভেঙ্গে গেল, তাই একটু,-
স্বপ্নের কথাটা তিনি এই মুহূর্তে বল্লেন না।
শুনতে পাচ্ছেন জলের শব্দ। নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে যেন অট্টহাস্যে ফেটে পড়ছে কেউ। বাতাসে ভেসে আসছে সেই কলরোল।
পায়ে পায়ে মহারাজ সেই নদীর দিকে এগিয়ে গেলেন।
পিছনে চল্লেন কয়েকজন সেপাই।
ভোরের আলো তখন ফুটতে দেড়ি আছে। সেই প্রাক উষালগ্নে মমহারাজ নদী তীরে এসে দাঁড়ালেন। ঢেউ জাগছে ঢেউ ভাংছে। বড় বড় শিলাখন্ডের উপরে লাফিয়ে উঠে চতুর্দিকে বিশ্লিষ্ট হচ্ছে সেই জলরাশি। ক্রমে আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। তিনি সেই মাহেন্দ্রক্ষণে স্পষ্ট দেখতে পেলেন নদীর মাঝখানে বেশ উঁচু এক শিলা খন্ডের উপরে একটি রমণী মূর্তি। জল স্পর্শ করেছে তার কেশ গুচ্ছ। শ্রাবণের ঘন কালো মেঘের মতোই তার চুল। তার পশ্চাৎ থেকে বাম দিকের কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছে।
মহারাজ কৌতুহলী হয়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছেন সেই নারীর দিকে। কোন এক অমোঘ আকর্ষণ যেন তাকে সেই দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি যেন মন্ত্রপূতঃ পুতুল এখন।
সিপাহি একজন চীৎকার করে উঠল, মহারাজ!
চীৎকার শুনে মহারাজ পিছন ফিরে তাকালেন।
মহারাজ ওইদিকে কোথায় চলেছেন? এই নদী বড়ই ভয়ংকর। বড়ো বড়ো পাথর খন্ড যত্র তত্র ছড়িয়ে আছে। নদীতল সম্মন্ধে কারো কোনো ধারণাই নেই। এই সকল খরস্রোতা নদীর তলদেশ কোথাও সামান্য জল থাকলেও ঠিক তার সামান্য কিছুটা তফাতে দেখা যায় গভীরতা অনেকটাই। নতুন জায়গা, অপরিচিত এই নদী এবং গতি প্রকৃতি সম্মন্ধে কিছুই জানা নেই।
জগৎদেব সেপাইদের কথায় শংকিত না হলেও আর সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া যে বুদ্ধিমানের কাজ নয় সেটা অনুমান করতে পারলেন।
কথা শুনে তিনি ফের ঘাড় ফেরালেন। কিন্তু কোথাও সেই রমনীকে দেখতে পেলেন না।
এতো অল্প সময়ে কোথায় উধাও হয়ে গেল?
কথাটা ভাবছেন ঠিক সেই সময়ে প্রকান্ড একটা ঢেউ প্রায় তার মাথা সমান সামনের পাথরখন্ড অতিক্রম করে তাকে ভিজিয়ে দিয়ে উচ্ছ্বসিত কল কল ধ্বনি তুলে বেরিয়ে গেল।
মহারাজ আর একটু হলে পাথরের উপরে পড়ে যেতেন। খুবই পিচ্ছিল পাথর যার উপরে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন। কোনোরকমে তিনি তাল সামলে স্থির হলেন। আবার একটা ঢেউ পরপর আসছে। স্রোতের টানে কত কিছু ভেসে চলেছে।
মহারাজ ফিরে আসছিলেন। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন স্রোতের সঙ্গে একটা শিলাখন্ড তার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে।
কী আশ্চর্য, শিলা আবার চলতে পারে নাকি?
তিনি ভুল দেখছেন নাতো?
নাহ, তিনি আবার থামলেন, সেও থেমে গেল। তিনি চলতে শুরু করলেন সেও চলতে শুরু করল।
মহারাজ পরম মমতায় সেই পাথরটিকে হাতে তুলে নিলেন। লাল রঙ্গের পাথর খন্ড। চ্যাপ্টা আকৃতির। দুই ইঞ্চী পরিমাণ লম্বা হবে। গড়ন অনেকটা শিশুর পায়ের পাতার মতো। তিনি অবাক হয়ে দেখতে লাগলেন।
তারপরে ফিরে এলেন তাঁবুতে।
ভোরের আলো ফুটতেই লক্ষ্য করলেন সেই পাথরের উপরে বিল্বপত্রের ছাপ স্পষ্ট।
তিনি নিচু হলেন।
ভক্তি ভরে সেই পাথর খন্ডটিকে প্রণাম করলেন মহারাজ জগৎদেব।
সে রাতে তিনি কাউকে কিছুই বললেন না।
সকালে রানিমাতার ঘুম ভাঙ্গলে তিনি গত রাতের কথা খুলে বললেন।
পরেরদিনই অমাবস্যা। কূল পুরোহিত আছেন সঙ্গে। তিনি সমস্ত কথা শোনার পরে বললেন, এই অরণ্য মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হোক দেবীর বেদিকা। লোকালয় থেকে কিছুটা দূরে থাকুক দেবীর থান। দেবী নিরিবিলি পছন্দ করেন।
সেই মতো তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। স্থানীয় আদিবাসী নারী পুরুষ পাথর সংগ্রহের কাজে নেমে পড়ল।
দ্রুত পাথর দিয়ে বেদিকা নির্মাণ করা হল। পার্শ্ববর্তী জঙ্গল থেকে শাল বৃক্ষের মোটা ডাল কেটে তার উপরে পাতার ছাউনি দিয়ে নির্মাণ করা হল এক অস্থায়ী মন্দির।
এরপরে আরো কয়েক মাস কেটে গেল। শত শত শ্রমিক মিলে হাত লাগালেন নতুন প্রাসাদ নির্মাণে। তৈরী হল পথ ঘাট জঙ্গল কেটে নয়া বসতি, নতুন রাস্তা তৈরী হল। চারিদিক যেন আলোকমালায় সেজে উঠেছে। জঙ্গল মহলের ভিতরে এক সুন্দর রাজ প্রাসাদ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। প্রাসাদের শীর্ষে উড়ছেনিশান।
দেবীদাস একদিন বললেন, মহারাজ এবারে দেবীর জন্যে রাজধানীর ভিতরেই প্রাসাদের কাছাকাছি সুন্দর একটা মন্দির স্থাপন করা হক। এই স্থান মূল রাজধানী থেকে বহু দূর। ভোর বেলা যা হোক করে আসা যায় কিন্তু সন্ধ্যের পরে পূজা এবং সন্ধ্যাহ্নিক সমাপ্ত করে ঘরে ফেরার সময়ে খুব ভয় করে। শার্দূল, বুনো কুকুর, হায়না আর শৃগালেরা অতর্কিতে আক্রমণ করতে পারে।
ঠিকই বলেছেন ঠাকুর আপনি। তাই হোক। আপনি জায়গা পছন্দ করুন।
এটিও জঙ্গলের ভিতরে কিছুটা পাহাড়েড় উপরে। বেশ নিরিবিলি। সচরাচর লোকের চোখে পড়বে না। লোক চক্ষুর আড়ালেই নাকি থাকতে চান দেবী রংকিণী। জন কোলাহল তাঁর পছন্দ নয়।
আর কিছুদিনের ভিতরেই পড়ছে অমাবস্যা।
জৈষ্ঠ্য মাসের অমাবস্যার প্রতিষ্ঠা করা হল রংকিনীদেবীর মন্দির।
ওইদিন বিগ্রহ স্থাপিত করা হল মন্দিরে। আয়োজন অতি সামান্য। কিন্তু রাজা জগৎদেব মাতা সুদেষ্ণার ভক্তিতে সেবায় দেবীকে বরণ করে নেওয়া হল।
পাহাড়ের কিছুটা উপরে ঘন জঙ্গলের ভিতরে নির্মিত হল এই মন্দির। সাধারণতঃ লোকচক্ষুর আড়ালেই রাখা হল দেবীকে। মন্দির পাহারায় নিযুক্ত করা হল দুইজন রক্ষীকে।
সেই রাতে শংখ, বাদ্য, ঘন্টাধ্বনিতে মুখরিত হল জঙ্গল। আশেপাশের বহু আদিবাসী মানুষ এসেছিল পূজো দেখতে। মহারাজের নির্দেশ ছিল সকলকে ভোগান্ন বিতরণ করার। কেউ যেন খালি হাতে ফিরে না যায়।
কূলো পুরোহিত যা যা নিদান দিলেন সেই মতো দেবীর বেদিকার নীচেয় রাখা হল পাঁচটি নরমুন্ডের খুলি, পাঁচটি রক্ত জবা, পাঁচটি বিল্ব পত্র, রক্ত বস্ত্র। মহারাজ জগৎদেব বুক চিরে রক্ত দিলেন বস্ত্রে। আর দেওয়া হল দুধ আলতায় রাঙ্গানো কাপড়। পূজোর অন্যান্য উপকরণ স্বরূপ রক্ত চন্দন, পঞ্চমুখী জবা ফুল, মাছ, মাংস, মসুর ডাল, আর নর মুন্ডের খুলির ভিতরে রাখা হল পশুর রক্ত। দেওয়া হল সোমরস।
রক্ত বস্ত্র পরে কূল পুরোহিত দেবীদাস পূজোয় বসলেন। বিশেষ মুদ্রায় হাতটা নিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করে দেবীকে আহবান জানানো হল। দেবীকে সন্তুষ্ট করার জন্যে দেওয়া হল ফুল। এরপর পাঁচটি জবা ফুল হাতে নিয়ে দেবীর পদতলে নিবেদন করা হল। চন্দন, ফুল, দীপ ধূপ, নৈবেদ্য ইত্যাদি দিয়ে দেবীর বন্দনা করা হল। এরপরে শুরু হল মন্ত্রপাঠ,-
ওঁ করাল বদনাং ঘোরাং মুক্ত কেশীং চতুর্ভুজাম…
দশ
ক্লান্ত পথিকঃ
প্রায় তিন ক্রোশ পথ অতিক্রম করেছে সোমদেব। স্বভাবতই ক্লান্ত সে। চলেছে আমেদাবাদের উদ্দেশ্যে। বারোচ থেকে প্রথমে বারোদে এসেছে। সেখান থেকে যাবে নাদিয়াদ তারপরে আমেদাবাদ।
বিকেল গড়িয়ে গেছে। সন্ধ্যে হবো হবো করছে। একটি গাছের তলায় সে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। কয়েকটি স্থানীয় ছেলেকে দেখল জঙ্গলের ভিতরে ঘোরাঘুরি করতে। সোম ছেলেগুলোকে লক্ষ্য করল। তারা জঙ্গলের ভিতরে গাছের ডালে কিছু অন্বেষণ করছে। কিছুটা সময় পরে তাদের এরূপ অন্বেষণের কারণ বোধগম্য হল।
সোম দেখল এই জঙ্গলে প্রচুর ময়ূর ঘোরাঘুরি করছে। গাছের ডালে, বন তলে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তাদের গ্রামে ময়ূর দেখা যায় কদাচিৎ। দুই একটা ক্বচিৎ কদাচিৎ উড়ে আসে আবার চলেও যায়।
খুব ভাল লাগে এই পাখিটিকে। তবে প্রচন্ড ক্ষিপ্র গতি। সোমদেব ছেলেগুলোকে জিজ্ঞাসা করল কী ব্যাপার, তারা ওই ভাবে বনের ভিতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে কেন। ছেলেগুলোর কয়েকজনের হাতে একটি করে দন্ড ছিল। হাতে পতাকা জাতীয় জিনিস।
ছেলেগুলো জানাল তারা সন্ধ্যের নামার অপেক্ষায় আছে
কেন? সন্ধ্যেবেলা কী করবে?
সন্ধ্যা নামলেই আমরা ময়ূর ধরব।
ময়ূর ধরবে কেন?
ময়ূরের মাংস খুব সুস্বাদু, তাই। ময়ূরের মাংস এবং পালক অনেক দামে বিক্রী হয়। আমরা ছোট্ট ময়ূর ধরে নিয়ে যাবো আর বড়ো ময়ূর ধরে বিক্রী করে দেবো হাটে।
জানো ময়ূর মারা অন্যায়? রক্ষীরা জানতে পারলে কিন্তু তোমাদের বড়ো রকমের শাস্তি হবে।
একজন সতর্ক হয়ে একটু ঘুরিয়ে বলল, ময়ূর ফসলের ক্ষেতে ঢুকে ফসল সাবাড় করছে যে।
সোমদেব বুঝতে পারল দুটির একটি সত্য। হয় তারা মাংসের লোভে শিকার করতে এসেছে। নয়তো সত্যি এরা ঝাঁকে ঝাঁকে ক্ষেতে গিয়ে ফসলের সর্বনাশ করে।
সোমদেব গাছ তলায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। বেলা আর সামান্যই অবশিষ্ট আছে। পাখিরা বাসায় ফিরেছে। কলরব জুড়ে দিয়েছে সকলে। এই জঙ্গলে ময়ূরের আধিক্যই বেশী। সে কারণে অন্য পখিদের সংখ্যায় বেশ কম। ময়ূরের কেকা রবে কান মাথা ঝা ঝা করতে লাগল। উচ্চরবে তারা সঙ্গীদের ডাকছে। ক্যাঁও ক্যাঁও…। গাছের শাখাগুলো দুলে দুলে উঠছে। বনের ভিতরে আতা আর নিম্ব গাছের শাখাগুলো তারা দখল করেছে।
ছেলেগুলোর ভিতরে কয়েকজন ছোটোছোটো কয়েকটা ময়ূরের বাচ্চার পিছনে ধাওয়া করে বিফল হল। দ্রুত গতিতে বাচ্চাগুলো ছুটে ঝোপ ঝাড়ের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। সোমদেব চলে যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু একটি দৃশ্য চোখে পড়ায় সে দাঁড়িয়ে পড়ল। কৈশোর উত্তীর্ণ হয়ে যৌবনে পা রেখেছে। তবুও কৌতুহল হচ্ছে। এটা বয়েসের ধর্ম। সোম দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখল ময়ূর ধরার জন্যে যে ছেলেগুলো এসেছিল তারা হাতে ধরা দন্ডের মাথায় পতাকা জাতীয় কাপড় খন্ডটি সুন্দর করে বেঁধে নিল। সে আরো লক্ষ্য করল এই দন্ডের মাথায় একটি করে বাতি জ্বলছে। উৎসাহী হয়ে সে দেখল, সেই আলো এসে পড়েছে কাপড়
খন্ডের উপরে যেখানে একটা ময়ূরের ছবি দেখা যাচ্ছে।
দন্ডের মাথায় দড়ির ফাঁস পরানো আছে।
অতি সন্তর্পণে ছেলের দল জঙ্গলের ভিতরে প্রবেশ করল। সোম নিতান্ত কৌতুহলী হয়ে ওদের পিছন পিছন অগ্রসর হল।
দেখল আলো দেখে ময়ূরের পালের কয়েকটা এদিকে এগিয়ে আসছে। ছেলেগুলো স্থির দাঁড়িয়ে আছে। পিছনে সোম। এক আপ এক পা করে সন্তর্পণে এগিয়ে আসল একটা ময়ূর। সেইদিকে গলা বাড়িয়ে দিল আর সেই ফাঁসে গলা আটকে যেতেই তৎক্ষণাৎ ছেলেরা নীচ থেকে প্রলম্বিত দড়ীটাকে টেনে ময়ূরের গলায় ফাঁস আটকে দিল এবং ধরে ফেলল।
সোম খুব আশ্চর্য হল ছেলেদের ময়ূর ধরার কৌশল দেখে।
কিন্তু আর তো সময় নষ্ট করলে সে বিপদে পড়ে যাবে। এরপরে নগরীর ভিতরে প্রবেশ করতে পারবে না। মূল ফটক সে পেরিয়ে এসেছে বেশ খানিকটা সময় আগেই। এবারে অন্য এক তোরণ দেখতে পাচ্ছে দূর থেকে। ওটিও নগরী মধ্যে প্রবেশের দ্বিতীয় দ্বার। সেখানেও দ্বার রক্ষী আছে। তাকেও জবাবদিহি করতে হতে পারে। তবে সে যে একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সে পরিচয় এবং নিদর্শন তার কাছে বর্তমান। তার পেটিকায় আছে শুকনো আদা, তেঁতুল, সোরা, চিনি এবং হরিতকী। সে এগুলো শহরের বাজারে বিক্রী করবে এবং সেখান থেকে নিয়ে আসবে নীলের পাত, পশমের কাপড়, ঝালর দেওয়া পর্দা ইত্যাদি। সোম পথে পা রাখল। হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকটা পথ সে চলে এসেছে। আজ রাতটা কোথায় কাটাবে ঠিক নেই। ভাবল কোনো সরাইখানাতে কাটালে হবে। সে আমেদাবাদ যাচ্ছে ব্যবসার কাজে। তার পেটিকাতে আছে কিছু মূল্যবান পাথর, কাচ, মুক্তার মালা এবং মরকত মণি। এগুলো খুবই সুরক্ষিত জায়গায় রেখে দিয়েছে যাতে রাতের বেলা ঘুমালেও তস্করেরা চুরি না করতে পারে। পোশাকের ভিতরে জিনিসগুলো রাখা আছে। এগুলো বিক্রী করে সে অন্যান্য জিনিস খরিদ করবে।
দূর থেকে একটি মন্দিরের চূড়া নজরে পড়ল। কাছে যেতেই দেখল আলো জ্বলছে মন্দির প্রাঙ্গনে। ভাবল আজ এই মন্দিরেই রাতটা কাটিয়ে ভোর ভোর বেরিয়ে পড়বে।
পায়ে পায়ে সোম এগিয়ে গেল মন্দিরের প্রবেশ দ্বারে। বেশ কিছু মেষবাহী এবং বৃষবাহী শকট নজরে পড়ল। তার আগেও তাহলে কিছু মানুষ এসেছে। হয়তো তারই মতো রাত্রি যাপনের উদ্দেশ্যে ভাবল সোম। বিশাল বড় একটি মন্দির। আলোকিত প্রাঙ্গন। প্রশস্ত প্রাঙ্গন পার হয়ে সে মূল মন্দিরের চাতালে এসে উপস্থিত হল। একজন বয়স্কা মহিলা তার দিকে কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকাল।
মুখে ইঙ্গিত পূর্ণ হাসি।
সোম দেবের রমণীটিকে মোটেই ভালো লাগল না। বিশেষত তার অর্থপূর্ণ হাসিটা কীসের যেন ইঙ্গিত বয়ে আনে। তার হাসির মানে যাই হোক রমণীটি যে মোটেও সুবিধের নয় এটা সোমদেবের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে বলে দিল।
সোমদেব ওর পোটলা থেকে এক খন্ড কাপড় বের করে সেই চাতালের উপরে পেতে নিল। বড়ো বড়ো থামের ছায়া পড়ে চাতালে এক অদ্ভুত মায়ালোক সৃষ্টি করেছে। মনে হল কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে।
ক্লান্তিতে ঘুম এসে গিয়েছিল। ঘুম ভাঙ্গল নুপূরের ছন্দে। সেই সঙ্গে সুন্দর এক গীত শুনতে পেল। মন হরণ করা সুর। সেই সুরের জাদুতে আবিষ্ট হবে না এমন মানুষ বুঝি বিরল।
কে গাইছে এমন মন কাড়া গান?
নিজেকেই প্রশ্ন করল সোমদেব।
সোম এক পা এক পা করে এগিয়ে গেল। দেখল মন্দির প্রাঙ্গনের প্রাচীর বরাবর লম্বা বারান্দা এবং বারান্দা সংলগ্ন ছোট ছোটো গৃহ। প্রতি গৃহে প্রদীপ জ্বলছে। ধূপ পুড়ছে। দরজা বন্ধ সেই সব গৃহের। সে একটি কক্ষের সামনে অতি সাবধানে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা কি বোঝার চেষ্টা করতে লাগল।
শুনতে পেল সেই সুমধুর গান আর নুপূরের ছন্দ।
সোমের ষষ্ট ইন্দ্রিয় মুহূর্ত্যের ভিতরে সজাগ হয়ে গেল।
যখন সে লক্ষ্য করল ফটকের বাইরে বেশ কিছু শকট দন্ডায়মান আছে। সে বুঝে নিল এই কক্ষগুলি তাহলে গণিকাদের। সোম শুনেছিল এমন এক মন্দিরের কথা। আজ নিজের চোখে দেখল সেই মন্দির এবং তার সেবাদাসীদের গলার আওয়াজ কানে এলো। কোনো কোনো ঘর থেকে চটুল হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। সেই হাসি চাপাপড়ে যাচ্ছে বিরহ বিধুর সঙ্গীতে। সেবাদাসীদের গলা থেকেই এই সুমধুর গীত শোনা যাচ্ছে। তাদের নুপূরের ছন্দে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাচ্ছে। সেই সুর যেন আর্তনাদের মতো শোনাতে লাগল। কিশোরী বালিকাদের কন্ঠ নিঃসৃত সেই সুর। সোমের হৃদয়তটে বারে বারে ধাক্কা খেয়ে ফিরে যাচ্ছে সেই সুর। সোম অস্থির পায়ে দীর্ঘ বারান্দা ধরে কিছুটা হাঁটার পরে ফিরে এলো। নীলাভ জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে মন্দির প্রাঙ্গণ। আশেপাশে কোনো জন বসতি নেই অথচ পুরো চরাচর যেন আবিষ্ট হয়ে আছে মন কেমন করা সুরের জাদুতে। সারারাত ধরে সেবাদাসীদের সুরে জেগে থাকেন ঈশ্বর।
সোম আর এক দন্ড স্থির থাকতে না পেরে মন্দির ত্যাগ করল। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই প্রবীণার হাসি। তার বিলোল কটাক্ষের মানে কী ছিল বুঝতে পারল।
হাঁটতে হাঁটতে রাত শেষ হয়ে এলো। পূব আকাশে শুকতারা সূচিত করছে ভোরের আগমন বার্তা। একটু একটু করে পূব আকাশে ধূসর চাদর সরে গিয়ে হাল্কা আলোর আভাস ফুটে উঠল। পথ পার্শ্বে গাছগুলিতে পাখিদের কলরব শোনা যাচ্ছে। তাদের ডানা ঝাপটানি, কলধ্বনি আর খাদ্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়া সমস্ত কিছু পথ চলতে চলতে নজরে পড়ল সোমদেবের।
কিছুটা যাওয়ার পরে রাস্তাটা বাঁক নিল। বাঁক পেরিয়ে কিছুটা যেতেই সামনেই একটা খরস্রোতা নদী। সোম এর আগেও একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে এই সকল খরস্রোতা নদী পারাপারের জন্যে না আছে কোনো সাঁকো না আছে কোনো নৌকা।
এপারের লোক ওপারে যেতে হলে মাসের পর মাস অপেক্ষা করে থাকে। শীতে নদীর জল কমার অপেক্ষাতে।
দেখল কয়েকজন সেই নদী তীরে উপস্থিত হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের হাতে অদ্ভুত একটা জিনিস।
সোম জিজ্ঞাসা করল, কী এগুলো?
ছাগলের চামড়া সেলাই করে বানানো(মশকের মতো দেখতে)বেলুন বিশেষ। তার ভিতরে বাতাস ভরে মুখ বন্ধ করে সেটা পেটের সঙ্গে বেঁধে খরস্রোতা নদী পারাপার হচ্ছে।
দুইজন স্ত্রীলোকের সঙ্গে একটি শিশুও ছিল। সোম চিন্তা করছে এই শিশুটিকে নিয়ে কীভাবে সে পারাপার হবে। মশকের সাহায্যে না হয় স্ত্রীলোক দুইজন পারাপার হতে পারবে। কিন্তু এই শিশু?
সোম উৎসুক চোখে ব্যাপারটা দেখার জন্যে দাঁড়িয়ে রইল।
দেখল মহিলাদের সঙ্গে একটি মাটির হাঁড়ি রয়েছে।
শিশুটির মা শিশুটিকে আস্তে করে সেই হাঁড়ির ভিতরে বসিয়ে নিল।
ছোটো মুখ হাঁড়ীটা থেকে শিশুটির মাথাটা শুধু বেরিয়ে আছে।
এরপরে তারা ছাগলের চামড়ার সেই বাতাস ভরা বেলুন পেটে বেঁধে মাটির হাঁড়িটিকে জলে ভাসিয়ে দিল। হাঁড়িটি তাদের সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগল।
সোম সেই নদী তীর ধরে হাঁটতে লাগল। এখন প্রায় পনেরো ষোলো ক্রোশ পথ যেতে হবে আমেদাবাদ পৌঁছুতে গেলে। এদেশের যারা বিত্তবান মানুষ আছেন তারা হয় বৃষের শকটে যান নয়তো পালকিতে ভ্রমণ করেন। মালবাহী আর মানুষবাহী শকট আলাদা হয়। মানুষ বহন কারী শকটে দুটি বৃষ শকটের সঙ্গে জোড়া থাকে। বৃষদের নাকের ফুটোর মাংসল অংশের ভিতর দিয়ে রশি ঢুকিয়ে নেওয়া হয়। ঘোড়ার লাগামের মতোই কাজ করে এটি। বিশাল চেহারার বৃষগুলোর শিং দেখলেই চমকে উঠতে হয়। ঘুরতে ঘুরতে একবার একটা হাটে ঢুকেছিল সোমদেব। বৃষ কেনা বেচা দেখছিল আর অবাক হয়ে ক্রেতা বিক্রেতাদের কথা শুনছিল। শকটের মালিকেরা বৃষ পছন্দ করতে এসেছে। তাদের নজর বৃষদের শিং এর দিকে। ইয়া লম্বা লম্বা শিং কারো সোজা কারো আবার বাঁকানো। মালিক পক্ষ শিং দেখছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। বৃষের মালিককে বলছে এতো বড়ো শিং তাই চলবে না। এমনিতে বৃষ আমার পছন্দ হয়েছে।
সোম আশ্চর্য হল, শিং এর জন্যে বৃষ বাদ পড়ছে কেন? শুধু তিনি নন সেই বৃষ কেউই পছন্দ করল না। যার বৃষ তিনি হত চিত্তে সারাটাদিন বসে থেকে অবশেষে সন্ধ্যা হওয়ার আগে বিদায় নিতে উদ্যত হলেন। বেশ ক্লান্ত অবসন্ন এবং বিমর্ষ দেখাচ্ছে বৃষের মালিকটিকে। সোম পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল লোকটির কাছে এবং তাকে জিজ্ঞাসা করল খরিদ্দারের এ হেন অমতের হেতু কী?
লোকটি বলল, বৃষের শিং যদি বাঁকানো না হয়ে সোজা এবং সূচালো এবং এক ফুটের বেশি লম্বা হলে সেটা গাড়োয়ানের পক্ষে ভয়ের। ঘাড়ে মশা মাছি বসলে সেতো মাথা ঘোরাবেই আর তখন গাড়োয়ানের পেটে ঢুকে যাওয়ার সম্ভবনা আছে। তাই সকলে অমত করছে।
এখন কী উপায় হবে? এই বৃষ কি বিক্রয় হবে না তাহলে?
উপায় একটা আছে।
কী উপায় যদি বলেন?
উপায় তো আছেই মালবাহী শকটের খরিদ্দার এলে তবেই বিক্রী হবে।
সোম তার কারণ অনুসন্ধান করে জানতে পারল এই মালবাহী শকটের সঙ্গে দশ জোড়া বৃষ প্রয়োজন হয়। তখন প্রথম দিকের সারিতে এদের জোড়া হয়। তাহলে তো আর কোনো ভয় থাকে না। লোকটা বৃষ দুটিকে নিয়ে গৃহাভিমুখে যাওয়ার জন্যে পথে উঠল।
এই শিং সূঁচালো বৃষেরা বেশ বেয়ারা প্রকৃতির হয় সেটা সোম জানতে পেরেছে। বড় একগুয়ে রোষ এই শিং সোজা বৃষদের।
চিন্তা করতে করতে একটি সুদৃশ্য পালকি ওর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। বেহারারা গানের ছন্দে ছন্দে পা ফেলছ। বেশ দ্রুত এগিয়ে গেল তারা। নিশ্চয়ই বিত্তবান কোনো মানুষ হবে। সোম জানে পালকিতে ভ্রমণ যথেষ্ট ব্যয় সাপেক্ষ। এক একটা পালকি লম্বায় প্রায় ছয় সাত ফুট এবং চওড়ায় তিন ফুট। পালকির দুই দিকে দুটি দুটি করে চারটি ডান্ডা বেরিয়ে আছে। সামনে দুই দুই চারজন এবং পিছনে চারজন মোট আটজন বেহারা পালকিটিকে বহন করে এগিয়ে যান। একজন ছত্র ধর পালকির মাথায় বড়ো একটা ছাতা ধরে থাকে। রোদ কিম্বা বৃষ্টিতে পাল্কীর পর্দা নামিয়ে দেওয়া তার কাজের ভিতরে পড়ে।
সোমদেব হাঁটতে হাঁটতে এই সমস্ত দৃশ্য দেখছিল আর মজা পাচ্ছিল। তার বয়েস বেশ নয়। সবে একুশ পেরিয়েছে। অথচ তাকে দেখলে মনে হবে ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের যুবক। বলিষ্ঠ চেহারা, ঈষৎ শ্যামবর্ণ গায়ের রং, চোখ দুটো একটু ছোটো হলেও অপূর্ব দীপ্তি সেই চোখে। তার চেহারার ভিতরে এমন এক সুষমা আছে যে চোখে মুখে এমনি ব্যক্তিত্বের ছাপ যে সে সকলের কাছে সম্মান এবং ভালোবাসা পেয়ে আসছে।
ষষ্ঠ পর্ব
এগারো
নতুন সাম্রাজ্য
জগৎদেব জঙ্গল মহলে বাস স্থাপন করলেন। সুবর্ণরেখার তীরে গড়ে তুললেন তার নতুন রাজ্য। জঙ্গল কেটে বসতি বানানো হল। প্রজারা চাষাবাদ করা শুরু করল। যদিও উর্বরযোগ্য জমি অভাব এই অঞ্চলে। প্রায় সবই পাথুরে মাটি। তবু কিছু কিছু জায়গার মাটি হিউমাস সমৃদ্ধ। সেখানকার মাটিতে চাষাবাদ করা সম্ভব। এখনকার মানুষেরা কীভবে জীবিকা নির্বাহ করে সেটা দেখে তারাও অনেক কিছু শিখে নিল। দেখল তারা নদী থেকে মাছ আহরণ করত। জঙ্গল থেকে পশু শিকার করে তাদের মাংস খায়।
আস্তে আস্তে এখনকার মানুষগুলোর সঙ্গে মেলা মেশা শুরু করল। জগৎদেবের প্রাসাদ গড়া হল সুবর্ণরেখার পাড় থেকে সামান্য কিছু দূরে। আদিবাসী নারী পুরুষ মাসের পর মাস ধরে গড়ে তুললেন সেই প্রাসাদ। জগৎদেবের সঙ্গে এসেছিলেন একজন স্থপতিবিদ। এর আগেও মান্ডু এবং উজ্জ্বয়িনীতে যে সুদৃশ্য মন্দির, হর্ম্য প্রাসাদ নির্মিত হয়েছিল সে সবই এনার পূর্বপুরুষদের হাতের নকশা অনুকরণে। যুগ যুগ ধরে নগরীর সৌন্দর্য বিধানে তারা যত্নবান ছিলেন এবং আছেন।
মহারাজার নির্দেশ এবং তার পরিকল্পনা মতো বানানো হল সেই প্রাসাদ। বানান হল গুপ্ত কক্ষ। পাতাল ঘর। অনেকগুলো কক্ষ সেই পাতাল ঘরের। বানানো হল গুপ্ত সুড়ঙ্গ। যে সুড়ংগ চলে গেছে নদী পর্যন্ত। নদীর জল যাতে সুড়ঙ্গের ভিতরে প্রবেশ না করতে পারে তার জন্যে ব্যবস্থা করা হল। বানান হল পাতাল পথ। রাজ পরিবারের রমণীদের স্নানের জন্যে মাটির তল দিয়ে সরু পথ চলে গেছে একেবারে নদী পর্যন্ত। আলাদা ঘাট প্রস্তুত করা হল। রাজ পরিবারের নারীরা স্নান সমাপন করে এই পথেই ফিরে আসতেন। অন্য কারো প্রবেশের অধিকার ছিল না এই পথে যাতায়াতের। রাজ পরিবারের মেয়েরা ঋতুমতী হলে তখন তারা নদীতে নামতেন না। তাই নদীর জল ভিতর পর্যন্ত নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হল। সেই জল রাখা হতো একটা বিশেষ জলাধারে। সেই জলাধারের পাশেই ছিল দুটি চৌবাচ্চা। রাজ পরিবারের ঋতুমতী রমণীরা উন্মুক্ত হয়েই এখানে স্নান করতেন। খুবই সুরক্ষিত এই জায়গা। এমনিতে এই অঞ্চল চারিদিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা।
তাছাড়া এটা ছিল প্রাসাদের একেবারে কোণের দিকে লোক চক্ষুর আড়ালে। একেবারে রানি মহলের ভিতরে একদিকের কোণে। বাইরের মানুষদের কদাপি সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল না। এখান থেকে একটা গুপ্ত সুড়ংগ পথ চলে গেছে নদীমুখ পর্যন্ত। পুরুষদের অগোচরে তারা সুবর্ণরেখার ঘাটে উপস্থিত হতেন। নদীর এই অংশটি বিশেষ ভাবে ঘিরে রাখা হয়েছিল যাতে তাদের স্নান করতে কোনোরকম অসুবিধা না হয়। মহিলা ঘাট যে স্থানে সেই স্থান ছিল গাছের আড়ালে। আর নদীর অপর পাড়ে ছিল গহন বন। শাল, শিমূল, মহূয়া পলাশের জঙ্গল। সচরাচর সেই বনে কেউ প্রবেশ করত না।
পাঁচটি মহল ছিল সেই দুর্গে। ছিল শিস মহল। পুরোটাই কাচের তৈরী। সেখানে রাজ রাজারা আমোদ প্রমোদ করতেন। নাচ মহল বলা যেতে পারে। দুইজন বাইজী আনা হয়েছিল দক্ষিণ অঞ্চল থেকে মহারাজের আমোদ প্রমোদের জন্যে। তাদের থাকবার পৃথক ব্যবস্থা ছিল। ছিল চাকর বাকর দাস দাসীদের আলাদা গৃহ।
হাতে গোণা কিছু প্রজাবর্গ ছাড়াও আস্তে আস্তে আরো অনেকে যোগ দিলেন বিশেষ করে জঙ্গল মহলের ভূমিপুত্র যারা। এখনকার আদিবাসী মানুষজন। মন্ত্রী জগৎদেবকে বল্লেন, এই মানুষগুলোকে এই মুহূর্তে খুবই প্রয়োজন। কারণ এরাই পারবে আমাদেরকে এখানকার সমস্ত খবরাখবর দিতে। এই স্থান সমন্ধে আমরা একেবারেই অজ্ঞ।
ঠিক বলেছেন মন্ত্রী মশায়। আমি ভাবছি এদের ভিতরে যোগ্য ব্যক্তিদের রাজকর্যে নিযুক্ত করতে।
তাই হবে মহারাজ।
খুবই পরিশ্রমী এবং সৎ এই আদিবাসী মানুষগুলো। রাজ বাড়ির নানান ফাই ফরমায়েশ খাটতে বহু লোকের দরকার। তা ছাড়া মহারাজ জগৎদেব আস্তে আস্তে তার রাজ্য সম্প্রসারণ শুরু করতে লাগলেন। বন কেটে যেমন বসতি স্থাপন করতে শুরু করলেন তেমনি কৃষি জমির আয়তন বাড়ল। জিবন ধারণের জন্যে যেমন খাদ্যেরর প্রয়জন তেমনি উদবৃত্ত ফসল থেকে আয় বাড়ানো যেতে পারে। চারিদিক গহন বন থাকায় একদিকে যেমন জ্বালানির চাহিদা মিটল। অপরদিকে উন্নত কাঠ দিয়ে পারসাদের কারুকাজ, আসবাব নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদা মিটল।
প্রজারা নদী তীরস্থ জমিতে নানান ফসল ফলাতে লাগলেন।
কিছুদিন যাওয়ার পরেই জগৎদেব জানতে পারলেন এই নদীর নাম কেন সুবর্ণরেখা।
এই নদীর বালিতে সোনার কণা মিশে আছে। আদিবাসী মানুষেরা সারাটাদিন সেই নদীর বালি আহরণে নিযুক্ত থাকে। বালি তোলে বালি শুকায় চালুনি দিয়ে বালি চালে। সেই সোনার কণা একত্রিত করে তুলে দেয় ভিন রাজ্যের কোনো বেনিয়ার হাতে। বহু বছর ধরে চলে আসছে এই সোনা বেচা কেনা।
বহু মানুষ যুক্ত আছে এই কাজে। জগৎদেব লোক নিযুক্ত করলেন। ব্যাপারটা তো সত্যি ভীষণ রহস্যময়। এই ভাবে যদি সোনা পাওয়া যায় তাহলে তো কথাই নেই। তিনি জানেন মধ্য ভারতেও ‘সোনাঝাড়’ সম্প্রদায়ের মানুষেরা নদীর বালি মাটি চেলে পলল সরিয়ে সোনার কণা পৃথক করে বিশেষ পদ্ধতিতে। তারপরে সেই স্বর্ণরেণু আগুনের তাপে গলিয়ে সোনার পাত প্রস্তুর করে এবং স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রী করে। কিছু গোন্দ এবং পাহাড়ি মানুষ এই কাজে নিযুক্ত আছে। পাহাড় থেকে উৎপন্ন নদীগুলি অনেক সময়ে কোনো সোনার খনির ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সমতলে নেমে আসে। তখন সেই সোনার আকরিক পাথর দীর্ঘদিন যাবৎ জল প্রবাহের কারণে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে খুব সামান্য পরিমানে নদীর জলের সঙ্গে বাহিত হয়। নদীর বাঁকে কিম্বা পাথরের খাঁজে পলি মাটি বালি ইত্যাদির সঙ্গে মিশে যায়। মধ্য ভারত, কলিংগ রাজ্যেও এমন অনেক নদী আছে যে নদীর বালিতে সোনা মিশ্রিত আছে। জহুরীরা প্রয়শই সেই সমস্ত নদী তীরে বসবাসকারী মানুষগুলোর কাছে যায় সোনা কিনতে। গোয়া, কেরালা, হিমাচলের কিছু কিছু নদীর বালি থেকে সোনা পাওয়া যায়।
সোমদেব আমেদাবাদে এসে একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচিত হল যিনি বিভিন্ন রাজ্যে গিয়ে সোনা খরিদ করেন। সোমের নির্দিষ্ট কোনো কাজ নেই। যখন যে কাজ পায় তাই সে করে। তার পিছুটান বিশেষ নেই। বাড়িতে তার মা ভাই বোন বাবা আছে ঠিকই তারাও যে যার কাজে ব্যস্ত। মা, আর বোন নদী থেকে মাছ ধরে বাবা আর ভাই জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে পাখি মারে ভেষজ লতা শিকড় বাকর সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রী করে। বাড়ির সামনে যে এক ফালি জায়গা আছে সেখানে যব, বাজরা, ভুট্টা, সরষে ফলায়। কিছু ডাল জাতীয় শস্য চাষ করা হয়। সবই নিজেদের খাদ্যের প্রয়োজনে। বাকিটা জঙ্গল থেকেই আহরণ করা হয়। সোমদেব পিতার কনিষ্ঠ সন্তান। তাই পরিবারের দায়িত্ব তাকে বইতে হয় না।
জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ললিত কুমার বিবাহ যোগ্য হয়ে উঠেছে। পিতা মাতা তার বিবাহের জন্যে চিন্তিত। গ্রামের এক সুদর্শনা গৃহ কর্ম নিপুণা অত্যন্ত বিনয়ী মেয়ে মহালক্ষ্মীকে পুত্রবধূরূপে বরণ করতে আগ্রহী। সংসারের শ্রী বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ললিত কুমার তাই বাড়তি আয়ের পথ খুঁজছে। সেও একজন ভ্রাম্যমান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। আমেদাবাদ থেকে কম দামে কিছুটা নিম্ন মানের পশম এবং রেশমের কাপড়, সূতি বস্ত্রাদি, মহিলাদের প্রসাধনের জিনিসপত্র ক্রয় করে মল্ল ভূমিতে এসে বেশী দামে ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রয় করে। সেখান থেকে কিছু জিনিস ক্রয় করে তাদের গ্রামে ফেরি করে।
সোমদেব দাদার মতোই স্বাধীন ব্যবসাতে আগ্রহী। তাতে অনেক দেশ দেখা হয়, কত নতুন নতুন মানুষদিগের সঙ্গে পরিচয় হয়, কত বিবিধ অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ ঘটে। সোমদেবের মন দূর দেশে যেতে চায়। এই দেশ কালের সীমানা ছাড়িয়ে আরো দূরে বহুদূরে কত নগর জনপদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেখানকার মানুষেরা কেমন তাদের ঘর বাড়ি শিক্ষা- দীক্ষা রীতি- নীতি সমস্ত কিছু জানতে সে আগ্রহ বোধ করে। তার প্রথাগত শিক্ষা খুবই সামান্য। গ্রামের গুরু মশায়ের পাঠশালা থেকে সে সামান্য কিছু পড়া লেখা শিখেছে। বাকীটা সে নিজের চেষ্টায় অর্জন করেছে। সে বিনয়ী মার্জিত, সুস্থ রুচি সম্পন্ন একজন তরুণ যুবা।
সোমদেব সেই রাতটা বারোদে কাটিয়ে বারোদ থেকে আমেদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
সোম জানে আমেদাবাদ সেই সময়ে বণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র বলে পরিচিত। দলে দলে বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্যবসায়ীরা আসছে বিভিন্ন জিনিস পত্র নিয়ে। জিনি বেচে নতুন জিনিস খরিদ করে নৌকা জাহাজ বোঝাই করছে। বন্দরে বন্দরে সে কী ব্যস্ততা । নৌকা এবং জাহাজে মাঝি মাল্লা খালাসি, কুলি, মজুরদের চীৎকার কোলাহলে বাতাস ভারী থাকে সব সময়। বড়ো জাহাজ দেখে তাক লেগে যায় সোমদেবের।
এমনি একটা দিনে সে যখন জাহাজ ঘাটে দাঁড়িয়েছিল তখন কয়েকজন ভিন দেশী যুবকের সঙ্গে ওর পরিচয় ঘটে গেল।
বাড়ি কোথায় তোমাদের?
কথা শুনে মনে হল ছেলেগুলো তেলেগু সম্প্রদায়ের। অন্ধ্রের দিকের বাসিন্দা। যাই হোক সোম জানতে পারল তারা হল হীরে ব্যবসায়ী।
তাদের গোলকুন্ডায় প্রচুর হীরে পাওয়া যায়। সেই হীরে তারা এখানে নিয়ে আসে চড়া দামে বেচার জন্যে। আমেদাবাদে বিদেশ থেকে ধনপতিরা সব আসেন ভারত থেকে উচ্চ মানের হীরে মণি মুক্তা মরকত মণি মূল্যবান পাথর কেনার জন্যে। আর কেনে রেশম, পশমের জিনিস পত্র।
বিনিমিয়ে তারা এদেশের বণিকদের কাছে বিক্রী করে পশমের গালিচা, সুদৃশ্য কাচের জিনিস পত্র, ঝালর দেওয়া পর্দা, আরো কত কিছু।
সোমের স্রেফ কৌতুহল হচ্ছিল আসল হীরে কীরকম দেখতে।
ছেলেদের ভিতরে একজন তার পরিধেয় বস্ত্রের আড়াল থেকে একটা লাল রঙ্গের রেশমের ছোট্ট পেটিকা বের করল। তার ভিতর থেকে ছোট্ট একটা কাপড়ের ভিতরে তুলোয় জড়ানো আছে কয়েকটি হীরে।
রোদে ঝল মল করে উঠল। সোম হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে আবার তাদের কাছে ফেরৎ দিল।
শুনল এগুলো কেনার জন্যে খোদ পারস্য থেকে একজন ধনী বেনে আসছেন।
সামান্য সময়ে পরে একজন অশ্বারোহী ওদের সামনে এসে দাঁড়াল।
অশ্বারোহী পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে একজনের হাতে দিলে সেও তার পকেট থেকে আর এক খন্ড কাগজ বের করে অশ্বারোহীর হাতে দিল। অশ্বারোহী খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে নিল এই সেই ব্যক্তি কিনা। তারপরে তাদের সঙ্গে কিছু কথা বলল। ভাষাগত সমস্যার কারণে সোম বুঝতে পারল না কী বার্তা বিনিময় হল দুই তরফে।
তারপরে সে জোরে অশ্ব ছুটিয়ে বেরিয়ে গেল চোখের নিমেষে।
সোম বুঝতে পারল এবারে প্রকৃত বেনিয়া যিনি তিনি আসবেন। এই লোকটা তাদের অনুচর।
ছেলেগুলো অপেক্ষায় থাকল আর সোম সেই সময়ে বন্দর বাজারের ঘুরে ঘুরে জিনিস্পত্র কেনা বেচা দেখতে লাগল। ভারতবর্ষে কত কিছুই না উৎপাদিত হয়। সে গ্রামের এক কোণে পড়ে ছিল এতোদিন বাইরে না বের হলে জানাই যেত না তাদের দেশ কত সমৃদ্ধ। বিশ্বের বাজারে তার কদর কতটা। বণিকেরা বড়ো বড়ো জাহাজ নিয়ে এসেছে এদেশে ব্যবসা করতে। কী ঠাঁট বাট তাদের। লোক লস্কর রক্ষী বাহিনী নিয়ে চলে এসেছে এদেশে। সোম শুনেছে হাজার হাজার বছর আগে থেকেই জলপথে স্থলপথে এদেশের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য চলছে।
সোমদেব ঘুরে ঘুরে অনেক তথ্য সংগ্রহ করল।
কত বিচিত্র দেশের নাম শুনল, কত আজব জিনিসের নাম শুনল।
কত নদীর নাম জানতে পারল যে নদীর বালিতে পলিতে সোনার কণা মিশ্রিত থাকে। সেই বালি থেকে সোনা পৃথক করার পদ্ধতি আছে। সেই সোনা অনেক মূল্য দিয়ে কিনে নেয় সোনার বেনেরা।
সোম ভারী আশ্চর্য হল যখন জানতে পারল ভারতবর্ষের পূর্বে মগধ পাটলিপুত্রের কাছাকাছি জঙ্গল মহল নামে একটা রাজ্য আছে সেখানকার রাজা হলেন জগৎদেব। তিনি মধ্য ভারতে মান্ডু রাজ্যের অন্তর্গত মল্ল রাজাদের বংশধর। প্রায় তিনশ বছর ধরে এই মল্ল রাজারা ধার জেলায় রাজত্ব করে আসছিলেন।
তাহলে রাজ্য ছেড়ে জঙ্গল মহলে চলে গেলেন কেন?
সে এক ইতিহাস। বিষাদ গাথা বলতে পারো। নইলে সাধ করে কোন রাজা তার রাজত্ব ত্যাগ করে চলে যান।
চারণ কবিদের মুখে মুখে ফিরত মল্ল রাজাদের বীরত্বের কথা। লোকে বটের ছায়াতলে বসে নিম গাছের ছায়ার বসে শুনত চারণ কবিদের সেই সমস্ত বীরত্ব ব্যাঞ্জক গান, গল্প,কবিতা।
বারো
কী হে রামদেব, তোমাদের কাজ কতটা বাকী আছে?
এই ত হয়ে গেল বটেক।
কী হে বেচারাম, তোমার কদ্দূর?
এই যে আর একটো বার চাললেই হয়ে যাবেক।
তাড়াতাড়ি হাত চালাও। বেলা যে বয়ে গেল।
কাজের তদারকি করতে লাগল ঘুরে ঘুরে সব কিছু লক্ষ্য করছে।
এই কাজে বহু জনকে নিযুক্ত করা হয়েছে। বিশেষ ভাবে যারা দক্ষ। বহুদিন ধরে তারা এই সব কাজ কর্ম লক্ষ্য করেয়া সছে। নিজেরাও জানে সোনা আহরণের পদ্ধতি। তাদের বাপ ঠাকুর্দারা এই কাজ করে আসছে যুগ যুগ ধরে। জগৎদেবের বিভিন্ন আদেশ তারা পালন করে। খুবই কর্মপটু যুবক এরা। এদের দেখভাল করছে আর কিছু রাজ কর্মচারী। তারা মান্ডুর বাসিন্দা। রাজ কর্মচারী ছিল এক সময়ে। এখনও সেই দায়িত্ব পালন করে আসছে।
রাজার অনুচরেরা ঘুরে ঘুরে বালি মাটি থেকে সোনা পৃথকীকরণ লক্ষ্য করছে। নদীতীরে চলছে বালি শুকানো। তারপরে সেই শুকনো বালি চালুনিতে ঢেলে চলছে পৃথকীকরণ পদ্ধতি।
সে এক বিরাট কর্মযজ্ঞ। বেশ কিছু শ্রমিক মিলিত উদ্যোগে কাজ করছে। আদিবাসী মানুষগুলো খুবই সৎ এবং পরিশ্রমী। এদের এক বারের বেশি দুইবার কোনো কথা বলতে হয় না। উদয়াস্ত পরিশ্রম করে অথচ সামান্য পারিশ্রমিক দিলেই খুশি থাকে। মাঝে মাঝে বিশেষ বিশেষ পার্বণে ওদের হাতে হাঁড়িয়া খাওয়ার পয়সা গুঁজে দিলেই ওরা খুশি।
এই কাজের তদারকির দায়িত্ব পেয়েছে কর্ণ সুবর্ণ। তার অধীনে আবার পঞ্চাশ জন লোক বহাল আছে। তারাই মূলতঃ সোনা শ্রমিকদের এই সমস্ত কাজ কর্ম দেখা ভাল করছে। কেউ সামান্য এক কণা সোনাও যাতে গায়েব না করতে পারে। লম্ব কর্ণ যার কান দুটো খরগোশের কানের মতো সোজা উপরের দিকে তোলা সে শংখ নদীর দিকটা দেখছে।
শংখ নদী সুবর্ণরেখারই এক উপনদী। এই নদীর মোহনার কাছে বিশাল এক চরা পড়েছে। শীতে যখন নদীর জল কমে আসে চর জেগে ওঠে তখন নদী তীরের মানুষেরা বালি আহরণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যুগ যুগ ধরে তারা এই নদী থেকে বালি, পলি মাটি আহরণ করে আসছে। সোনার কণা সংগ্রহ করে সেগুলো তাপে গলিয়ে সোনার পাত বানিয়ে জহুরীদের কাছে বিক্রী করে দিন গুজরান করে থাকে। আদিবাসী ছেলে মেয়েরা এই কাজে নিযুক্ত।
কর্ণ সুবর্ণ একদিন জগৎ সিংহকে জানাল, মহারাজ, যাতায়াতের ব্যবস্থার মোটেও ভালো নয়। জঙ্গলের বাসিন্দারা জল জঙ্গল ডিঙ্গিয়ে চলাফেরা করতে পারে কিন্তু আপনি বা আপনার লোকেরা কীভাবে যাতায়াত করবে?
তাই তো?
চিন্তিত মহারাজ। কপালের ভাঁজ আরো দৃঢ় এবং সুস্পষ্ট হল।
ঠিক আছে ডাকো স্থপতিকে।
বিশ্ববর্মা এলেন। সকল কথা গভীর মন দিয়ে শুনলেন।
তারপরে ঘোড়ায় চেপে বেরিয়ে পড়লেন। সঙ্গে দশজন সেপাই এবং রক্ষী গেল।
এ জঙ্গল সে জংগল পেরিয়ে, পাহাড়ের বাঁক ঘুরে একে একে সকলে পাহাড়ের উপরে চড়ে বসলেন। শাল- পিয়াল- মহুয়া- পলাশের জঙ্গল ডিঙ্গিয়ে দলমা পাহাড়ের মাথায় এসে উপস্থিত হলেন তারা। এখান থেকে বহুদূর অবধি দেখা যায়। বেশ কিছু সময় ধরে জায়গাটা নিরীক্ষণ করলেন তিনি। পথে দুইজন স্থানীয় মানুষের সঙ্গে দেখা হল। সরল বিশ্বাসী চেহারার দুইজন যুবক। বিশ্ববর্ম তাদের ইঙ্গিতে কিছু কথা বল্লেন। পথের হদিশ জানতে চাইলেন। বিশেষ করে এই জঙ্গলের ভিতরের পথ কোথায় কোথায় গেছে সেটা জানা বিশেষভাবে প্রয়োজন। একেবারে আঁটঘাট বেঁধে কাজে নামতে হবে।
বিশ্ববর্মা ছক করে নিলেন। স্থানীয় দুইজন মুন্ডা যুবক যারা এই অঞ্চল খুব ভালো করে জানে তাদের সহায়তায় পথের নকশা আঁকা হল। দলমা পাহাড়ের কোল ঘেঁষে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলে গেছে কাচা পথ। পাথুরের রাস্তা। এই রাস্তাই মেরামত করে মসৃণ পথ বানাতে হবে।
তাহলে তো অনেক গাছ কাটা পড়বে তো?
যুবকদের চোখে সংশয়। এই জঙ্গল এই গাছ গাছালি তাদের অতি প্রিয়। পারতপক্ষে তারা গাছেদের ছেদন করে না। নিত্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি কাঠ তারা জঙ্গল থেকেই সংগ্রহ করে। সবই মৃত গাছের ডাল পালা।
বিশ্ববর্মা বললেন, সে তো পড়বে। রাস্তা হবে আর গাছ কাটা পড়বে না? রাস্তা তৈরী হলে মানুষের যাতায়াতের সুবিধা হবে, জন বসতি গড়ে উঠবে।
এই ঘর বাড়ি করতেও সেই সময়ে প্রচুর গাছ কাটা পড়েছিল। জঙ্গল পিছু হটেছে। এখন আর আগের মতো পাখি, সজারু, বেজি, বনমোরগ নজরে পড়ে না। জন্তু জানোয়ারেরা অনেক দূরে চলে গেছে। আদিবাসী মানুষগুলোর কাছে জঙ্গল মায়েদের মতো। এই বন থেকেই তারা খাদ্যের রসদ পায়, জ্বালানি কাঠ পায়, এই জঙ্গল তাদের দেয় শান্ত শীতল ছায়া। যখন গ্রীষ্মে চারিদিক আগুন ছড়ায় তখন তাদের গাঁ মায়ের কোলের মতো স্নিগ্ধ শীতল।
কিন্তু রাজার আদেশ, সুতরাং অমান্য করার প্রশ্নই ওঠে না।
সে আর এক কর্মযজ্ঞ শুরু হল। পাহাড় থেকে পাথর কাটা শুরু হল। পথ বানানো চলছে। চুন সুড়কি পাথরের গুড়োর সঙ্গে মিশিয়ে নতুন রাস্তা বানানো হল। প্রশস্ত রাস্তা তৈরী হল, পথের দুই ধারে সৌন্দর্যায়নের জন্যে ফুলের গাছ লাগানো হল। বড়ো বড়ো ছায়াবৃক্ষতলে ক্লান্ত পথিক পথ চলতে চলতে দু দন্ড বিশ্রাম নিতে পারে। স্নিগ্ধ ছায়াময় সুন্দর এক অঞ্চল তৈরী হল দেখতে দেখতে। আদিবাসী মানুষদের সহায়তায় গড়ে উঠল মল্লরাজ ভূমি। বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত করা হল এই অঞ্চলের মানুষগুলোকে। তারা যেমন পরিশ্রমী তেমনি সৎ। তবে তাদের ধর্ম বিশ্বাসবোধ প্রবল। সেই জায়গায় কেউ আঘাত করলে তারা ছেড়ে কথা কইবে না সেটা সকলে জেনে গেছে।
রাজ রাজাদের বিশেষ পরিচিত বর্গ এবং বিত্তবান মানুষ, আমীর ওমরাহরা পথের ধারে সুদৃশ্য সব বাড়ি বানালেন। পাহাড়তলির সমতল ভূমিতে বিরাট হর্ম্য, বাগান, পুষ্করিণী খনন করলেন। সে এক দেখবার মতোই বিষয়।
দেখতে দেখতে জঙ্গল মহল নতুন রূপ পেল। জগৎদেব নিজের হাতে শহরটাকে সাজাতে লাগলেন। একে একে সুদূর মান্ডু থেকে লোকজন চলে এসে এখানেই তাদের স্থায়ী বাসস্থান গড়ে তুলল।
ক্রমে জানতে পারলেন যুগ যুগ ধরে কত মানুষের পা পড়েছে সুবর্ণরেখার এই ঘাটে।