Sepia Ronger Goli by Ankita Bandyopadhyay
সিপিয়া রঙের গলি – নবম পর্ব
‘বাংলা আমার সর্ষে ইলিশ…’
অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
আমার বন্ধু ইলিশ ভালবাসত না। সে অনেককিছুই ভালবাসত। সন্ধেবেলা ঘুড়ি ওড়াতে ভালবাসত। খেটে খাওয়া শিশু শ্রমিকদের সঙ্গে রাস্তার মাচায় ক্যারাম খেলতে ভালবাসত। মাঝেমধ্যে আমার সঙ্গে খেলনাবাটি সাজিয়ে বসতেও ভালবাসত। শুধু গ্রীষ্মের দিনে পাকা আম ও বর্ষা এলে ইলিশ তার দু’চক্ষের বিষ ছিল। গন্ধের আভাস পেলেও তার নাড়ি উল্টে যেত। আমি ডাকতাম, ‘আজব, এই আজব…।’
যা সবাই ভালবাসে, তা নিয়ে মাত্র এক শতাংশের দলে পড়ে বিপরীত কথা বললে ব্রতভ্রষ্ট হয়ে যেতে হয়। আমার বন্ধুটি সংখ্যালঘুও নয়, একা ছিল। ফলে ভাল না বাসবার অপরাধ ক্ষমা করেননি গুরুজনেরা। সারাবছর একরকম কাটত। গ্রীষ্ম এলেই মুহুর্মুহু শাসনে আমার বন্ধু জেরবার হয়ে যেত। সে কেন আলাদা, সে কেন খাবে না, এই অভিযোগে হতাশ সকলে আমার তুলনা টানত। তাতেও লাভ হত না। শাসন বেড়ে গেলে দু’একবার চিৎকার করেছিল সে’ও – ‘আমি ভালবাসি না, আমার বমি পায়…।’ প্রতিক্রিয়ায় আগুনে খুন্তির ছ্যাঁকা, প্রহারের দাগগুলি ওর আঁধার কালো চামড়া ঢেকে রাখত।
সে আমার চেয়ে মাত্র একদিনের ছোটো ছিল। আমাদের জন্মদিনের বয়স বাড়ছিল। আমরা একসঙ্গে মাথায় বাড়ছিলাম। এই সব ধুলোখেলা দিনের মাঝে একদিন সে চুপ করে গেল। প্রথম গ্রীষ্মের ফল ঈশ্বরকে নিবেদন করা হত, তারপর প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাসিমুখে দিয়ে আসা হত। আমার বন্ধুটি এই সময়ে হারিয়ে যেত। দূরে বন্ধ হয়ে আসা বাজার, তারও পরে অন্য এলাকার সীমানা ছাড়িয়ে কোথাও ছায়া খুঁজে বসে থাকত। সোচ্চারে অপছন্দ জানানো নেই, নীরবে প্রহার সহ্য করার মহানুভবতা নেই। শুধু সরে যেত। তার সাথে রাস্তায় দেখা হয়ে যেত, মুচকি হেসে বলত, ‘এই তো, খেলছিলাম…।’
এরপরে আসত চিরকাঙ্ক্ষিত বর্ষা। প্রথম বর্ষার ইলিশ এলে রুপোলী দুই সুন্দরীকে তেল-হলুদ-সিঁদুর মাখিয়ে রাখা হত। তারপর সামান্য উলুধ্বনি সহযোগে বঁটির গায়ে ধরে একটান। কালচে রক্ত ছড়িয়ে যেত উঠোনে। ‘মাছটা ভাল হে, আগে নিয়ে যাও পরে দাম দেবে’ বলে বাজারের চেনা কাকা নাকি গছিয়ে দিলেন! এইসব মিথ্যে, সত্য-মিথ্যে মেশানো আমাদের প্রথম বর্ষার আনন্দে আমার বন্ধুটি ফের সরে যেত। বৃষ্টিদিনে আমার কাছে তার খোঁজ পড়ত- ‘কোথায় গেছে জানিস?’ আমি জানতাম রেললাইনের ধার বেয়ে মালগুদামের দিকে রেল কোম্পানির জমিতে যে অশ্বত্থ গাছটা আছে, সেখানে বসে আছে। বলতাম না। অপছন্দের মুহূর্ত থেকে এই চুপ করে সরে যাওয়াটাকে সমীহ করে চলতাম।
আমার বন্ধুটি আরও একটি বিষয় পছন্দ করত না। বইমেলা। বইপত্রের ধার দিয়েও যেতে ভালবাসত না। কিন্তু শীতের শেষে একটি রবিবার বাবার সঙ্গে বইমেলা যেতে না পারলে আমি বাড়ি মাথায় তুলে তান্ডব চালাতাম। তারিখের হিসেব জানতাম না, সময়েরও না। সেইসব বাবা খেয়াল রাখত। তারপরে সেই বহু প্রতীক্ষিত রবিবার এলে সকাল সকাল স্নান সেরে ভাত খেয়ে পাট করে চুল আঁচড়ে সবচেয়ে ভাল জামাটা, সবচেয়ে ভাল সোয়েটারটা আর সবচেয়ে ভাল জুতো-মোজা পরে বাবা-মেয়ে ময়দানে ছুটে যেতাম। আমার বন্ধুটি বেছে বেছে সেইদিনই খেলনাবাটি খেলতে আসত। সবদিক দেখে শুনে মুখ চুন করে ফিরে যেত। আমি ছুটে যেতাম এক অমোঘ আকর্ষণের দিকে।
দু’ঘন্টার পথ পেরিয়ে মেলার টিকিটের অপেক্ষা আজ আর নেই। হারানোর যন্ত্রণাটা একই রকম রয়ে গেল। হয়েছিল কী, প্রথম বইমেলায় শিশু সাহিত্য সংসদের স্টল থেকে বাবা কিনে দিয়েছিল গোপাল ভাঁড় ও মোল্লা নাসিরুদ্দিন সমগ্র। বেগুনি রঙের বোর্ড বাঁধাই বইটা একহাতে তোলার শক্তি ছিল না আমার। সারাদিন সেই বইটাকে নিয়ে পড়ে থাকতাম। শীত শেষের বসন্ত, গ্রীষ্ম, ছুটির দুপুর, বর্ষার কামাই দিনে সেই বইটাই সব ছিল। লুকিয়ে বড়োদের বই পড়ার ইচ্ছে জাগবে আর একটি বছর পরে। বাবা মায়ের বিয়ের উপহারে পাওয়া বই তুলে ডুব দেওয়ার অবুঝ আনন্দ মিলবে আরও কিছুদিন পরে। কিন্তু ততদিনে আমি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছি মনে মনে। এইসব ঘোরের মাথায় একদিন ভরা বর্ষায় ঘরে ফিরে দেখি বইটা উধাও। কোথাও নেই। কোত্থাও নেই। যেহেতু গুরুজনেদের অপরাধ স্বীকার করতে নেই, তাই বহুদিন খোঁজার পরেও কেউ হদিশ দিল না গোপাল ভাঁড় ও মোল্লা নাসিরুদ্দিন সমগ্রের। নতুন আরেকটি বই এনে দেওয়ার স্তোকবাক্য এল, একই বই এনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও এল, কিন্তু সেই বইটা অদৃশ্য হয়ে গেল। বোঝাতে পারলাম না, একই বই আর সেই বই হয় না। হয়ে ওঠে না। সেই বইয়ের পাতায় পাতায় কারেন্ট নুন লাগা হাতের ছাপ, পৃষ্ঠার যেখানে সেখানে কাঁচা হাতে নামসই, সূচিপত্রের ওপরে আঁকা গাছ, শেষ পাতায় বেখেয়ালে যোগ-বিয়োগ প্র্যাকটিস, স্কেচপেনে আঁকা মুখ, সেইসব আর নতুন বইয়ে ফিরবে না। বোঝাতে না পেরে আমার বন্ধুটির মতো চুপ করে গেলাম। বছর বছর নতুন বইয়ে ঘর ভরিয়ে দিলাম।
মনে আছে সেবছর বইমেলা নিয়ে গেল না কেউ। সামনে পরীক্ষা, অ্যাডমিশন টেস্ট, মাথা গুঁজে মুখস্থর দিনে আমারও জেদ চেপে গেল। তখন আমার জীবনে ইন্টারনেট একটি কষ্টকল্পনা মাত্র। সাদা-কালো স্ক্রিনে বইমেলার খবর ফুটে উঠত প্রতিদিন। সেইসব রুলটানা খাতায় লিখে রাখতাম। তারপর লিখে ফেললাম ‘এবারের বইমেলা’। দিদিমণিকে গিয়ে দিয়ে এলাম। বললাম, ‘দ্যাখো আমাকে নিয়ে যায়নি। কিন্তু আমি লিখে ফেলেছি। লিখতে গিয়ে মেলায় কত ঘুরলাম!’
দিদিমণি অবাক হাসলেন। সেই হাসি ছাড়িয়ে দূরে কোন পাথুরে জমিতে চোখ গেল আমার। যা দেখা যায় না, তা লিখে ফেললে এমনতরো দেখা যায় তবে?
কৈশোরে পা দিতে না দিতেই বইমেলা সরে গেল দূরে। এইসময়টায় এত দ্রুত বেড়ে উঠলাম যে বইমেলা ভুলে গেলাম। পার্কসার্কাস ময়দান, মিলনমেলা প্রাঙ্গন ঘুরে এসে বইমেলা থিতু হল করুণাময়ীতে। আমার সেই বন্ধুটিও দূরে চলে গেছে ততদিনে। কাজের ফাঁকে বইমেলার খবর পেতাম। কখনও যাওয়ার কথা মনে হত না। আমি ভুলে গিয়েছিলাম পথ। কিন্তু আকাশি খাতা, লিখে রাখা কাঁচা গল্প, সব পাশাপাশেই ছিল। দীর্ঘ তের বছর পরে বইমেলায় এসেছিলাম একা। সেদিন একটি স্টলে আমার নাম লেখা ছোট্ট একটি গল্পের বই বিক্রি হচ্ছিল। বইটার সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো গেল না, পালিয়ে যাওয়ার ভঙ্গিমায় একা ঘুরতে শুরু করলাম মেলায়। কিছু বন্ধু হল, কিছু পরিচিত হল। কেউ থেকে গেল, কেউ সরে গেল। বইমেলায় একা একা ঘুরে বেড়ানো আমার অভ্যেসে পরিণত হল। প্রতিবছর পরিচিতদের চোখ ছাড়িয়ে একা ঘোরার সময়ে আমার মস্তিষ্কে একটি রোগা কালো বালক ঘুরতে থাকে। মেলার ভিতর আছে কোনও রেললাইন, বন্ধ বাজার, আছে অশ্বত্থ গাছ। একটু খুঁজে নিলে দেখা যাবে কত বালক একা ঘুরে যাচ্ছে। তারা প্রত্যেকে পালিয়ে এসেছে। তাদের চামড়ায় মারের দাগ। তারা সরে যেতে শিখে গেছে। সরে যাওয়া বড় সহজ কাজ নয়।
আমার বন্ধুরা তাদের দুনিয়ায় ফিরে যেতে চায়। আমার বন্ধুরা ফিরে যাবে বলে উশখুশ করে। আমি তাদের ফিরে যাওয়া দেখি। মেলার ভিড়ে আমার পায়ে শক্ত পাথুরে জমি, মেলার ভিতর সব শূন্য হয়ে ওঠে। আমি সকলের ফিরে যাওয়া দেখি। সেই বালক সামনে এসে দাঁড়ায়, বলে ‘তুই লোভী, সরে যাওয়ার গল্প বলে যাবি, সরে যেতে পারবি না। কারণ তুই লোভী!’ আমি বালকের থেকে পালিয়ে বাঁচতে আট নম্বর গেট পেরিয়ে আসি। বাস স্ট্যান্ডের ভিড়ে দাঁড়িয়ে একবুক শ্বাস নিই। অশক্ত বাবা দূর থেকে ফোন করে। রাতের বাস আভিজাত্যের নির্জনতা পার হয়ে যায়। চেনা মুখেরা তালগোল পাকিয়ে যায়। ভালবাসা অস্বীকারের কূটনীতি ফিরে যায় নিজের দুনিয়ায়। রাতের বাস একটি মফসসলে ফিরিয়ে দেয়। অকিঞ্চিৎ দু-একটি বই আমাকে আরও ক্ষুদ্র করে তোলে।
মাছরাঙা, বউ কথা কও, চড়াই, জল, বাগান, নদী ঘেরা এই ছোটো ঘরে ফিরিয়ে দেয় বাস। অসামান্য ভিড়ের ভিতর হু হু কান্নায় ভরে যায় বসন্তের লবণহ্রদ। রক্ত-মাংসের একাকীত্ব প্রতিবছর ভিড়ের মধ্যে ঘোরে। রাত হয়। বাঙালি বিষণ্ণতার সর্ষে ইলিশ ঘন হয়ে ওঠে। আমি ফিরে আসি। আমি সরে যেতে থাকি।