দেবার্ঘ্য সাহা-র একগুচ্ছ কবিতা
আলো-আঁধারি
চরম হতাশার মাঝে আজকাল
ধুলোবালি জীবনের দিনলিপি
যত্ন করে লিখে রাখি ভাঙা পাঁচিলের গায়ে
ঠিক যেভাবে স্লোগান লেখা হয়
উজ্জ্বল আগামীর আশায়!
বিকেলের মরা রোদে ধ্বনিত হয়
ক্লেদাক্ত রাত্রির কথকতা
উপগ্রহের অশালীন ইঙ্গিতে হারিয়ে যাই
কুয়াশার চাদর নেমে আসে অভিশাপ হয়ে
দুয়েকটা ভুল আর
মনখারাপের প্রলম্বিত ছায়ায় বিবশ হই
অবচেতনে শুনতে পাই স্বপ্নের স্পন্দন
অস্তিত্ব সংকটের নিশিডাক উপেক্ষা করে
অসম লড়াই চলতে থাকে
অপেক্ষা একটা কুসুম রঙের ভোরের…
ফলাফল
কোলাহলের মাঝে দিক হারিয়ে
যতবার শান্তির খোঁজ করেছি,
ততবারই পেয়েছি ঝড়ের পূর্বাভাস
ষড়যন্ত্রের চক্রব্যূহে নিরস্ত্র হয়ে
সন্ধি প্রস্তাব পেশ করেছি শত্রুপক্ষের কাছে।
উপহারে পেয়েছি মৃত্যুর শীতল পরোয়ানা।
তারপর ভেবেছি নিজেকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার কথা।পারিনি।
ঘুরে দাঁড়িয়েছি হাসি মুখে
শবাগার
কৃষ্ণাদ্বাদশীর মেঘাচ্ছন্ন রাতে নিজেকে খুঁজে পাই
শহরের পাশে, কোনও উন্মুক্ত প্রান্তরে।
শীতের শোরগোল মেখে অদূরে সার্কাস বসেছে।
অন্ধকারে চোখ সইলে দেখি,
এদিক ওদিক পড়ে থাকা প্রাঞ্জল স্বপ্নগুচ্ছ!
আরেকটু এগোলেই উগ্র গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে।
আদর্শবাদের ধ্বজায় মোড়া কটা কাটা মাথা পড়ে থাকতে দেখে বুঝি
আমারও তো বেঁচে থাকার কথা নয়…
এ শহর শবাগার।
যদিও এসব কাউকে বুঝতে না দেওয়াই ভাল
আসলে নিষ্প্রাণ সৈনিক হয়ে আমাদের এই বেঁচে থাকা
যুদ্ধের বীভৎসতা, ধর্মের চোখরাঙানি আর আগ্রাসনের দামামা গর্জন ছড়িয়ে পড়েছে
প্রত্যন্ত জনপদ থেকে ঝাঁ চকচকে শহরে
আদিম অসভ্যতা থেকে নাগরিক সভ্যতায়
অবনমন থেকে উন্নয়নে
মাথা ঝিমঝিম করে
সারা শরীর জুড়ে ব্যথার প্রলেপ
তবু ভেতর থেকে উঠে আসে ঘরে ফেরার ডাক
টলমল পায়ে ফিরতে ফিরতে ভাবি,
সব শেষ হয়ে আসছে
শেষ থেকেই না হয় আবার শুরু করা যাক।
বৃষ্টি বিনিময়
মাঝে মাঝে তোমাকে একটুও দেখতে ইচ্ছে করে না
কারণ, ভালবাসি তোমাকে।
মাঝে মাঝে তোমাকে ছুঁতে ইচ্ছে করে না একদম
কারণ, ভালবাসি তোমাকে।
তোমার কথা কাউকে কখনও বলতেও ইচ্ছে করে না। কারণ?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভালবাসি। ভালবাসি তোমাকে।
বৃষ্টিস্নাত বিকেলের মৃদু চুম্বনে, আঙুলে আঙুল ছুঁইয়ে
আবেগের বুদ্বুদে ভাসতে এখন আর ইচ্ছে হয়না
কারণ ভীষণ, ভীষণ ভালবাসি তোমাকে।
আমাকে কখনও কেউ যদি জিজ্ঞেস করে ভালবাসা জিনিসটা আসলে কী?
আমি গুছিয়ে বলতে পারব না, জানি।
যারা যথাযথ অনুভূতি ব্যক্ত করতে পারে না,
আমি তাদের দলে।
তবু তুমি সামনে এসে দাঁড়ালে মনে হয়,
তোমাকে ভালবাসি এক বুক মহাকাশ নিয়ে।
লোভ-ক্ষোভ-কামনা-বাসনা-সীমাহীন হতাশা-যন্ত্রণা-অবজ্ঞা-রাগ কী নেই তাতে!
নক্ষত্রের বিস্ফোরণে এত স্পর্ধা নেই
মুহুর্মুহু অগ্ন্যুৎপাতে এত শোভা নেই
দুকূল ভাসানো বন্যায় এত শোক নেই
জ্যোৎস্নালোকিত চরাচরে এত সৌন্দর্য নেই
খরাক্লিষ্ট দুপুরে এত পিপাসা নেই
কালপুরুষের অভিসারে এত রোমাঞ্চ নেই
যা আছে এই ভালবাসায়
অপার্থিব দৈন্য গায়ে মেখে
বঞ্চনার বারুদে ঝলসে
প্রত্যাখ্যানের বরফ বুকে আগলে
দিনের পর দিন অবহেলিত হয়েও
ভালবাসি
ভালবাসি
ভালবাসি
ঈশ্বরের করুণাকে ফুৎকারে উড়িয়ে ভালবাসি তোমাকে।
অবিশ্বাসের মহীরুহ স্বরনালীতে গেঁথে ভালবাসি তোমাকে।
হতাশার চোরাবালিতে প্রোথিত হয়ে ভালবাসি তোমাকে।
কামনার দাবানলে ছারখার হয়ে ভালবাসি তোমাকে।
তপ্ত হিংসার নুড়ি পাথরে স্নান করেও শুধু তোমাকেই ভালবেসে যাব আজীবন।
বিনিময়ে
কিছু না পারো
দু’ফোঁটা বৃষ্টি দিও
স্মৃতি
(১)
মুঠোয় রাখি জমানো সব কথা
বুকের মাঝে জাগলে শতদল
টুকরো কিছু রঙিন বাতুলতা
অতল স্নেহে চোখের কোণে জল
(২)
আষাঢ় মেঘে বৃষ্টি এল দূরে
এক পৃথিবী আনন্দে ঝলমল
এমন দিনে তোমায় মনে পড়ে
স্বপ্নে ভাসে রঙিন মফস্সল
(৩)
বিষাদ নদী শুকিয়ে গেছে প্রায়!
আকাশ ভেঙে বৃষ্টি হবে কাল
উঠবে ফুটে শালুক মোহনায়
চুপ শ্রাবণের এমনি মায়াজাল
আবেগ সমগ্র
লুকিয়ে রেখেছি আগুন রঙের ক্ষত
মিশিয়ে দিয়েছি রোজকার চেনা সুখে
কুড়িয়ে নিয়েছি আবদার অবনত
ফুটেছিল যারা মেঘেদের মুল্লুকে
কুড়িয়ে রেখেছি অলির গোপন কথা
বকুলকে আমি বেসেছি ভীষণ ভাল
লুকিয়ে রেখেছি হৃদয়ের গভীরতা
ছড়িয়ে পড়ছে আবছা শীতল আলো
স্পর্শ করেছি তোমার দুঃখগুলো
তোমাকে সেসব বলিনি তো একবারও
সরিয়ে রেখেছি বেপরোয়া চালচুলো
ভুলে যেও, যদি ভুলতে আমায় পারো…
দাবি
তোমায় আমি সেদিন থেকেই
অল্প স্বল্প চিনি
যেদিন থেকে বৃষ্টিরা ছিল
মেঘের কাছে ঋণী
সেদিন থেকেই তোমায় আমি
বড্ড নিজের ভাবি
পণ করেছি এড়িয়ে যাব
কাঙাল মনের দাবি
এড়িয়ে যাব জমানো সব
সরল অভিমান
স্রোতের টানে ছুটছে দ্যাখো
খেয়ালী সাম্পান
আর কিভাবে শোনাই বলো
সহজ প্রেমের সুর?
তোমায় ছুঁয়ে মন ভেসে যায়
কোন সে হৃদয়পুর!
এসব কথা মুখের ওপর
আদৌ বলা যায়?
দোলনচাঁপা অবশ হল
আনন্দধারায়
চুপিচুপি
আয়নায় ভাসে চেনা মুখ
পরিচিত প্রশ্নের ঢেউ
ভালবেসে পুড়ে গেছে বুক
চুপিচুপি বলে যায় কেউ
মাঝেমাঝে কেন ফিরে আসে
বিলাপের ফাল্গুন মাস
মন চলে ঋণী পরবাসে
ছুঁয়ে যায় শুকনো বাতাস
আলাপের আশাবরী ফেলে
রূপকের আলোড়ন বাড়ে
বোকামন কিভাবে আড়ালে
মুখবুজে যন্ত্রণা কাড়ে?
তবুও তো রূপকথা জুড়ে
কারা যেন রাস্তা সাজায়
‘প্রিয়াকে আদরে রেখো মুড়ে’
চুপিচুপি কেউ বলে যায়…
সেতু
একতরফা ভালবাসা পূর্ণতা দেয়। কথাটা কতটা সত্যি?
আমি তো এমন অনেককে দেখেছি, যারা ভালবেসে কখনও অসীম শূন্যতায় মিলিয়ে যেতে চেয়েছে। প্রবাদপ্রতিম কোনও গল্প উপন্যাস বা কাব্যের অনুষঙ্গ মনে চেপে রেখে অথবা বিশ্ববন্দিত কোনও সুরমূর্ছনা সম্বল করে যারা আস্থা রাখতে চেয়েছে ভালবাসায়, শেষ পর্যন্ত তারাও নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে গ্লানির ঘূর্ণাবর্তে।
অবশেষে যদি ধরি এই ভালবাসা একটি নরম ব্যথার নামান্তর মাত্র, যার কোনও রূপ নিরাময় নেই। তবে সাময়িক স্তব্ধতার পর শোনা যাবে সেই ব্যথার নীলিমায় মৃদু স্বরে ধ্বনিত হওয়া সৃষ্টির গুঞ্জরণ, যা থেকে সহজেই অনুমেয় যে পূর্ণতা আর অপূর্ণতার মাঝে তৈরি হওয়া সেতুটিই হল ভালবাসা আর সেই নড়বড়ে সেতুর মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা একলা আমিটাই তার প্রাণ।
মন ছুঁয়ে গেলো প্রত্যেকটা লেখা❤️
প্রতিটি কবিতা খুব সুন্দর লাগল। আগামী দিনে কবির থেকে আরো নতুন কবিতার প্রত্যাশা রইল।