
ধারাবাহিক উপন্যাস – সুবর্ণরেখার তীরে- চতুর্থ পর্ব
ছন্দা বিশ্বাস
মল্লরাজ সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি অতি শীঘ্র রাজধানী মান্ডু ত্যাগ করবেন। কিন্তু ত্যাগ করব বললেই তো আর ত্যাগ করা সম্ভব হয় না। যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় গড়ে ওঠা রাজ্য রাজধানী থেকে কি পা তোলা মুখের কথা। ধন- দৌলত মণি- মাণিক্য এতো প্রজাবর্গ সকলকে ছেড়ে দূরে সম্পূর্ণ অজানা এক দেশে পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু ভাগ্যের এমনি নিদারুণ পরিহাস যে তাঁকে এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তিনি সেই দিনই জরুরী সভা ডাকলেন। খুব বিশ্বাসভাজন রাজকর্মচারীদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক সারলেন। সকলের সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী কর্মপন্থা স্থির করলেন।
চতুর্থ পর্ব
সাত
মল্লরাজের জন্মভূমি ত্যাগঃ
মহারাজা দেশ ছেড়ে নতুন জায়গায় চলে যাচ্ছেন কথাটা খুব বেশী সময় চাপা থাকল না। দৌবারিক, নৈশ প্রহরী, নগর রক্ষীদের কানাঘুষো মন্ত্রী নগরপাল আমাত্যদের সঙ্গে লাগাতার সভা জল্পনা কল্পনাতে দাসী বাদীরা কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছে। বিশেষ করে অন্দরের দাসী যারা দিবারাত্র প্রাসাদের অন্দর মহলে থাকে তারা ভিতরের অনেক কথা জানে। সর্বদা রানিমাতা এবং অন্যান্য রাজ পরিবারের মহিষীদের সঙ্গে তাদের নিত্য ওঠাবসা। রানিমাতা নিজেও হয়তো জানেন না কোন জিনিসটা কোথায় গুছিয়ে রেখেছেন প্রধান সহকারী। দাস দাসীরা সব কিছু সুন্দর করে গোছাগাছ করে রাখে। মহারাজ গতকাল রাতেই নির্দেশ দিয়েছেন একেবারে যুদ্ধকালীণ তৎপরতায় সকলকে গুছিয়ে তৈরী থাকতে হবে। যতুটুকু সামগ্রী না নিলেই নয় সেটুকুই সঙ্গে নিতে হবে। রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকেও একই কথা জানিয়ে দিলেন। জিনিসের মায়া ত্যাগ করে যে জিনিসগুলো সঙ্গে না নিলেই নয় কেবলমাত্র সেই জিনিসটুকু সম্বল করে বেরিয়ে পড়তে হবে। দিল্লীর সুলতানের মর্জি বোঝা মুশকিল। একবার যদি তার কানে যায় যে মান্ডু রাজ পলায়ন করছে তাহলে আর কাল বিলম্ব না করেই যাত্রা পথেই হয়ত অতর্কিতে আক্রমণ করে বসবে। মান্ডু থেকে সিংভুম কম পথ নয়।
জগৎদেব খুবই বিচক্ষণ এবং সুচতুর। চর মারফৎ কথাটা কানে যাওয়া মাত্র তিনি কোষাধ্যক্ষকে ডেকে পাঠালেন। কোষে এ যাবৎ যত সহস্র স্বর্ণ মুদ্রা রাখা আছে যে পরিমাণ অন্যান্য মুদ্রাসকল গচ্ছিত আছে সমস্তই তিনি গুছিয়ে অত্যন্ত গোপনীয় ভাবে গুছিয়ে রাখলেন। রাতে রুদ্ধদ্বার বৈঠক সারলেন। কোন জিনিস কীভাবে সঙ্গে যাবে। মান্ডু থেকে জঙ্গল মহল কয়েকশ ক্রোশ পথ। দস্যু ও তস্করেরা ওৎ পেতে থাকে রাতের দিকে। কোথাও পথ এতটাই ঘন জঙ্গল দ্বারা বেষ্টিত যে দিনের বেলাতেও রাতের আঁধার নেমে আসে। পাহাড় আর জঙ্গল দিয়ে ঘেরা বেশ কিছু অঞ্চল। সেই সকল জায়গা দিয়ে সাব ধানে যেতে হবে। যদি জানতে পারে স্বয়ং মহারাজের জিনিস যাচ্ছে তারা লুঠ করতে জীবন বাজী রাখতেও প্রস্তুত। সুতরাং সাবধানতাই প্রথম এবং প্রধান শর্ত।
তাদের সঙ্গে থাকবে কয়েকশত সেনা, রক্ষীরাও থাকবে সশস্ত্র। রাজপুত সেনারা থাকবে সকলের সামনে এবং পিছনে। সুতরাং লুঠের ভয় নয় জিনিসপত্রগুলো যথাযথ ভাবে নিয়ে যাওয়াটাই আসল কথা। তিনি ইতিমধ্যে বেশ কিছু জিনিস পত্র লোক মারফৎ পাঠাতে শুরু করে দিয়েছেন। সোনা রূপা হীরে মণি মুক্তাসমূহ তাঁর সঙ্গেই যাবে আলাদা হস্তি নয়তো অশ্বপৃষ্ঠে। বিশ্বস্ত লোক থাকবে তার সঙ্গে। নতুন দেশ নতুন পরিবেশ একা একা তো আর সেখানকার রাজা হওয়া যায় না। তার জন্যে চাই লোকবল, আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যেও তো কাছের মানুষদের দরকার।
মহারাজ যখন রাজ ঐশ্বর্য নিয়ে চিন্তিত সেই সময়ে কূল পুরোহিত এসে উপস্থিত হলেন।
মহারাজ?
বলুন ঠাকুর?
শুনলাম দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন?
আর তো কোনো উপায় দেখছি না ঠাকুর।
কিন্তু এই বিগ্রহের কী হবে? যুগ যুগ ধরে যে বিগ্রহ এখানে প্রতিষ্ঠিত আছে তাকে কোথায় রাখা হবে? বিধর্মী সম্রাট আলাউদ্দিন একবার এ রাজ্যে প্রবেশ করলে এই মন্দির সব ভেঙ্গে তছনছ করে দেবে।
প্রয়োজনে দেবীর থান সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে অন্যত্র।
অন্যত্র? তা কীভাবে সরানো সম্ভব?
সরাতে তো হবেই ঠাকুর। দিল্লীর সুলতানের পদস্পর্শে এই মন্দির হবে কলুষিত। সে কি আর কিছু আস্ত রাখবে মুহূর্ত্যের ভিতরে মন্দির মূর্তি ধূলায় লুন্ঠিত হবে। তার মতো পাষন্ড দুনিয়াতে খুব কমই আছে। আপনি তো সকলই অবগত আছেন।
কথাটা বলে জগতদেব মাথা নত করলেন।
চিন্তিত কূলপুরোহিত দেবীদাস। আজ কত পুরুষ ধরে তারা বংশ পরম্পরায় এই মান্ডুর রাজ পরিবারের কূলমন্দিরের সেবক। পূর্ব পুরুষদের মুখে শুনেছিলেন আজ থেকে প্রায় সাত বছর আগে ধর জেলায় অবস্থিত তালান পুর নামক স্থানে একটি মূর্তি খুঁজে পান। মান্ডু রাজারা ছিলেন শৈব। দেবতা পার্শ্বনাথের বিগ্রহকে তারা নিত্য পূজা করতেন। তখন সেই মূর্তিটাকে নিয়ে এসে স্থাপন করা হল পার্শ্বনাথের মন্দিরের গর্ভগৃহে দেবতা পার্শ্বনাথের পাশেই। প্রাকৃত ভাষায় এই মান্ডবী দুর্গার অপভ্রংশ রূপ থেকে এই মান্ডু রাজ বংশ। শিলালিপিতে উল্লিখিত আছে সাল তারিখ। সম্ভবত ষষ্ঠ শতকের কোন এক সময়ে।
খুবই সুরক্ষিত ছিল এই মান্ডু রাজ্য। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে মোড়া এই মান্ডু রাজ্য। যার একদিকে বিন্ধ্য পর্বতমালার বর্ধিতাংশ হয়ে মালব মালভূমি রূপ ভূমি গঠন করেছে। অন্যদিকে রয়েছে পবিত্র নর্মদা নদী। মান্ডু শহরের প্রাণ ভোমরা। যার জলে পুষ্ট রাজ্যের মানুষ পশু-পাখি জীব- জন্তু সকল। এই দুই মান্ডু রাজ্যকে এতোকাল রক্ষা করে আসছিল। কিন্তু গোল বাঁধল আলাউদ্দিন দিল্লীর মসনদে বসে। একের পর এক রাজ্য গ্রাস করতে শুরু করল। এমনি অদম্য তার নেশা। এতকাল মান্ডু তার নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐক্য, পরম্পরা নিয়েই বেঁচে ছিল। কত বিদগ্ধ মানুষ ছিলেন এবং আছেন এই রাজ্যে। নর্মদার উর্বর অববাহিকায় কত ধরণের ফসল ফলেছে। গম, সোয়াবীন, ভুট্টা আরো কত কিছু। রাজ্যবাসীরা অধিকাংশই কৃষিজীবী। কৃষিই রাজ্যের অর্থনৈতিক ভিত্তি। রাজকোষের সঞ্চিত অর্থের বিরাট অংশ আসে এই কৃষি থেকেই। পাশেই উজ্জ্বয়িনী রাজ্য। শিক্ষার সেরা পীঠস্থান। তার পাশেই রয়েছে মাহিষ্মতী রাজ্য। সবই তাদের প্রতিবেশী রাজ্য। সকলের সঙ্গেই জগৎদেবের সুসম্পর্ক বর্তমান।
জগৎদেব কিছু সময়ের জন্যে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন। স্মৃতিকাতর হয়েছে তিনি।
মহারাজ?
কূল পুরোহিত এতক্ষণ ধরে লক্ষ্য করে আসছেন খুবই চিন্তিত মহারাজ।
বলুন?
আমি একটা উপায় বলে দিতে পারি।
কী উপায়?
আপনি মাতা রংকিনী দেবীকে সঙ্গে নিয়ে চলুন।
তারপরে?
তারপরে আপনি যেখানে থাকবেন মনস্থির করেছেন সেই স্থানে দেবীকে একটা উত্তম জায়গা দেখে মন্দিরে স্থাপনা করলেই হবে।
দেবী অসন্তুষ্ট হবেন নাতো? কূপিতা হলে যে কী ভয়ংকর সর্বনাশ হবে সে তো আপনি অবহিত আছেন।
নাহ, আমি বলছি দেবীকে সঙ্গে নিয়ে চলুন। অন্যথায় মাতার ঘোর অমঙ্গল হবে। বিধর্মী আলাউদ্দিন মান্ডু আক্রমণ করলে মন্দির বিগ্রহ সব তছনছ করে দেবে। এর আগেও তিনি নানা হিন্দু রাজ্য ধ্বংস করেছেন।পুড়িয়ে ছারখার করেছেন দেবালয়।
দেবীর অমঙ্গল হলে মল্ল রাজ্যের উপরে সে অভিশাপ বর্ষিত হবে।
সেটা আর বললেন না দেবীদাস।
তাই ভালো। ও দিকটা আপনি দেখুন। আমি এতো সব চিন্তা একসঙ্গে মাথায় নিতে পারছি না।
আপনি এ ব্যাপারে কিছু চিন্তা করবেন না মহারাজ। দেবী রংকিনীর দায়ভার আমার উপরেই ছেড়ে দিন। কবে যাবেন মনস্থির করুন। আমাকে জানালে সেই মত আমি তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করব।
আপনিও তাহলে যাচ্ছেন আমাদের সঙ্গে?
না গিয়ে উপায় কি বলুন? স্বয়ং মহারাজ যেভাবে নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন, আমরা সামান্য প্রজা হয়ে সেইস্থানে বাস করি কী উপায়ে। তাছাড়া আমি আপনার অন্নদাস। মন্দিরের সেবাইত পূজারী ব্রহ্মণ। আমি না হলে চলবে কী করে। দেবীকে সকাল- সন্ধ্যায় অন্নভোগ দেওয়া মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ এ যাবৎকাল ধরে তো আমরাই করে আসছি। সুতরাং অন্য কিছু ভাবা আমার পক্ষে অন্যায় হবে।
জগৎদেব বললেন, ঠাকুর, আপনি আমায় বড়ো একটা দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত করলেন। আমার কয়েক রাত ঘুম হয়নি এই বিগ্রহ আর এই মন্দিরের চিন্তায়। কত নিষ্ঠার সঙ্গে আপনি দেবীর যত্ন করেন পূজা করেন সেকথা আমি বিলক্ষণ জানি। আমার রাজ্যের এবং রাজ পরিবারের সৌভাগ্য জড়িয়ে আছে দেবী রংকিনী মাতার আশীর্বাদ। তাঁর অনুমতি ব্যতিত আমি আজ পর্যন্ত কোন কাজ করিনি। দেবী অনুমতি দিলে তবেই আমি সেই কাজে অগ্রসর হয়েছি। কিছুদিন আগে দেবী আমায় স্বপ্নে দেখা দিলেন। আমি স্পষ্ট দেখলাম দেবী বলছেন, সামনে ঘোর অমঙ্গল ঘনিয়ে আসছে রাজ্যে। দেবীর মুখে কখনো ক্রোধের আগুন জ্বলছে কখনো আবার তাঁর দুটি নয়ন অশ্রুপূর্ণ।
স্বপ্নের ভিতরে দেবী আদেশ দিলেন দ্রুত এই স্থান ত্যাগ করার।
ঠিক তার দুইদিন বাদে গুপ্তচরেরা জানাল, আলাউদ্দিনের নজর পড়েছে এই মল্লরাজ্যের উপরে।
সে কী, তাই নাকি?
হ্যাঁ, ঠাকুর। আমি এ কথা আজ প্রথম আপনাকেই বললাম। স্বপ্নের এই কথা আর কাউকেই আমি বলিনি। আপনিও এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলবেন না। রাজ্যে ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে। আমার গুপ্তচরেরা জানিয়েছে এর ভিতরে আলাউদ্দিনের গুপ্তচরেরা নাকি কাজ শুরু করে দিয়েছে। ছদ্ম বেশে তারা নগরে ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করছে।
মহারাজ আপনি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। আর কাল বিলম্ব না করে যত শীঘ্র সম্ভব এই স্থান পরিত্যাগ করা হোক। আমি পঞ্জিকা দেখে জানিয়ে দিচ্ছি কবে কোন সময়ে গমন শুভ।
ঠিকই বলেছেন ঠাকুর। আলাউদ্দিনের থাবা কতদূর বিস্তৃত আমরা কিছুই অনুধাবন করতে পারছি না।
আমাদের অতি সত্বর গুছিয়ে নিতে হবে।
আট
অজানা পথে পাড়ি
সেদিন মহারাজা জগৎদেব তার প্রিয়তমা মহিষী মহারানি সুদেষ্ণা এবং রাজকন্যাকে নিয়ে হাতির পিঠে সওয়ার হলেন। রূপোর হাওদায় বসলেন রানি শিশু কন্যাকে নিতে। রাজার হাতি এগিয়ে চলল দ্রুত পায়ে।
রাজকন্যা তখন সবে মাত্র দশ মাস বয়েস। নরম কম্বলের ভিতরে জড়িয়ে ধরে হাতির পিঠে বসানো হাওদায় বসে চোখের জল মুছলেন। সামনে এবং পিছনে আরো দুটি পালকি হাতির পিঠে চাপানো হল। তাতে জগৎদেবের মাতা, মাতামহী ছাড়াও পরিবারের আরো দুইজন সম্ভ্রান্ত মহিলা ছিলেন। তাদের ভিতরে একজন হলেন মহারাজের শ্মশ্রুমাতা এবং মাতৃশ্বসা। মহারাজের হাতি ঠিক এদের পিছনে। হাতির পিঠে ছাড়াও মল্লরাজার নিকট সম্পর্কের মানুষেরা কেউ আসছেন অশ্বের পিঠে চেপে কেউ বা আসছেন বৃষ শকটে চেপে। তাদের পাহারা দিয়ে আনছেন আরো কিছু সেনা। সব মিলিয়ে দীর্ঘ এক যাত্রা। সামনে সেনা, পিছনে সেনা। মাঝে সাধারণ প্রজাবর্গ। সেনাদেরকে বলা আছে কোথায় কখন তাদের থামতে হবে। এদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেনাপতি মহাবল্লভ।
মহামন্ত্রী তার পিছনে পিছনে ঘোড়ায় চেপে যাচ্ছেন। সামনে চলেছেন তার পরিবার বর্গ। সেনাপতি, আমাত্য বর্গ আর সকল রাজ প্রতিনিধিগণ চলেছে পিছন পিছন। তার পিছনে অসংখ্য সেনা, প্রজা সকল। এ যেন হাজার হাজার মানুষের মিছিল চলেছে। অশ্ব, উট, অশ্বেতর এবং হাতির পিঠে চাপিয়ে রাজা রাজ পরিবারের মানুষেরা জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। তাদের সঙ্গে ছিল কয়েকশ রাজপুত। ছিলেন অসংখ্য প্রজা বর্গ এবং অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষ। অভিজাত পুরুষেরা ঘোড়ার পিঠে চড়ে এলেন। অনেক পথ। মহিলাদের জন্যে বৃষ এবং গো শকটের ব্যবস্থা করা হল। দশটি বৃষ সেই শকট টানত এতো বড়ো বড়ো শকট। প্রায় মাস খানেক সময় লাগবে মান্ডু থেকে জঙ্গল মহল পর্যন্ত আসতে। পথ তো নেহাত কম নয়। মানুষ ছাড়াও প্রচুর জিনিস পত্র চাপিয়ে নেওয়া হল। আদতে এগুলি হল মালবাহী শকট। সারা রাত ধরে চলত এই শকটগুলি। দিনে প্রচন্ড রোদের কারণে বৃষ খুব বেশী পথ চলতে পারতো না। এদিকে সূর্যাস্তের পর পরেই নগরীর মূল প্রবেশ দ্বার বন্ধ করে দেওয়াই ছিল রীতি। যাতে বাইরের কেউ নগরীতে ঢুকে অসামাজিক কাজ কর্ম না করতে পারে। জগৎদেব সে ব্যাপারে চিন্তিত ছিলেন। অনুগামীরা সকলে এ ব্যাপারে ওয়কিবহাল ছিল তাই তারা সূর্যাস্তের আগেই নগরীর ভিতরে প্রবেশ করে একটা জায়গা দেখে সেখানেই খানাপিনার ব্যবস্থা করত। রাজার অনুচরেরা আশপাশ ঘুরে ঘুরে খোঁজ খবর নিত। তারপরে আবার পথ চলা শুরু হত।
সকলে এক সঙ্গেই চলেছেন। বিশ্রামের দরকার হলে সকলে একই সঙ্গে থামছেন।
জগৎদেব জানিয়ে দিয়েছেন একজন প্রজাও যেন পিছিয়ে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। একেবারে সবার সামনে রাজার সিপাহী সান্ত্রী চলেছেন পিছনে রক্ষীগণ। মাঝে রাজা এবং অন্যান্য লোকেরা। সেই সময়ে পথ ছিল বন্ধুর এবং খুবই জঙ্গলাকীর্ণ। অমসৃণ পথ কখনো জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কখনো বা নদী তীর বরাবর চলে গেছে। কখনো পাহাড়ি পথ অতিক্রম করতে হলো। দীর্ঘ ক্লান্তি শেষে প্রায় কয়েকশ মাইল পথ পেরিয়ে তবে তারা এই জায়গায় এসে পৌঁছাল। পথে কত রকমের অভিজ্ঞতা হল, কত জনপদ, শস্যক্ষেত্র, মাঠ-প্রান্তরভূমি, গচারণ ক্ষেত্র, জল- জঙ্গল নদীনালার উপর দিয়ে তারা এলেন। কত বিচিত্র জন্তু জানোয়ারের সম্মুখীন হলেন, কত ধরণের মানুষ দেখলেন পথে। একই দেশ অথচ বিচিত্র জাতির বাস। ভিন্ন তাদের আহার, বেশ বাস, যাপন প্রণালী আর রুচিবোধ। এক এক রাজ্যের মানুষের বাড়িঘর এক এক ধরণের।
এতোসব পেরিয়ে মল্লরাজ নতুন জায়গায় এলেন।
সুবর্ণরেখার তীরে শান্ত ছায়াচ্ছন্ন এক আম্রকাননে এসে তারা উপস্থিত হলেন। তখন গ্রীষ্মকাল। এত মাইল পথ প্রখর দাবদাহে অতিক্রম করায় তারা সকলেই বড় ক্লান্ত। নদী দেখতে পেয়ে সকলেই দারুণ উচ্চ্বসিত হলেন। তার উপরে এই চ্যূত বনে এসে তারা হস্তি, অশ্ব এবং বৃষ শকট থেকে নেমে বৃক্ষের ছায়ায় এসে বসলেন। সবুজ পাতায় ছাওয়া আম বাগানে তখন মধুর বাতাস বইছে। গাছে গাছে পাখিদের সুমিষ্ট কুজন আর নদীর শীতল বাতাস তাদের মনে প্রশান্তি এনে দিল। সত্যি মনোরম পরিবেশ। কেউ কেউ তো ক্লান্তিতে গাছের ছায়াতলে প্রথমে বসলেন। অচিরেই নিদ্রামগ্ন হলেন। কেউ স্নানে গেলেন। বাকীরা পায়চারি করে জায়গাটা দেখতে লাগলেন।
পাচকেরা রান্নার সরঞ্জাম বের করে রান্নার তোড়জোর শুরু করে দিল। নদীর তীরেই পাথরের উনুন বানিয়ে তার উপরে কড়াই বসিয়ে দিল বৃদ্ধ পাচক শিউশরণ। সঙ্গে আছে জনা দশেক সহকারী। কেউ কেউ কাটারি, কুড়াল নিয়ে নদী তীরবর্তী শাল সেগুনের জঙ্গল থেকে শুষ্ক কাষ্ঠ আহরণ করতে চলে গেল। জল আর জ্বালানি রন্ধনের জন্যে এই দুটি জিনিস খুবই প্রয়োজন।
নদীর জল আর জঙ্গলের পর্যাপ্ত কাঠ সাহায্য করল রন্ধনের কাজে। পথে তেমন খাওয়া হয়নি। কাল রাতে যা খেয়েছে সবই হজম হয়ে গেছে। সকলের কাছে শুকনো খাবার দাবার ছিল, তাই দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করল। গাছে গাছে সুপক্ক আম ধরে আছে। দেবতার উপহার বলে মনে করল এই ফলগুলোকে। তারা গাছ উঠে পাকা আম পেড়ে নিজেদের ভিতরে ভাগ করে খেল। সৌদাস ছিল তাদের দলে। সে খুব ভালো গছে চড়তে জানত। সে একেবারে মগ ডালে উঠে বেশ কিছু আম পেরে তার গামছায় বেঁধে সোজা রানিমাতার সম্মুখে হাজির হল।
চিত্রলেখাকে কোলে নিয়ে রানিমাতা সেই সময়ে গাছের ডালে বসা একটা পাখিকে দেখাচ্ছেন। লেজ ঝোলা একটা পাখি, বড়ই সুমিষ্ট তার ডাক। কন্যা আঙ্গুল দিয়ে দেখাল পাখিটাকে। সুদেষ্ণা মেয়ের কপালে দীর্ঘ চুম্বন দিলেন। সৌদাস রানিমাতার সম্মুখে ফলগুলো এনে রাখল।
বাহ, খুব সুন্দর তো, তুমি পেরে আনলে?
হ্যাঁ, রানি মা।
সৌদাস মৃদু হেসে ঘাড় নাড়ল।
দাসী কেতকি ফলগুলো ঝুরিতে তুলে নিতে নিতে বলল, কেটে দেবো?
নাহ, পড়ে। মহারাজ আসুন, তিনি দেখলে সন্তুষ্ট হবেন।
মহারাজ জগৎদেব সেই অবসরে মহামন্ত্রীর সঙ্গে শলা পরামর্শ করতে লাগলেন। আশপাশ ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। মন্ত্রীকে বললেন, জায়গাটা মন্দ নয়। এখানে বসতি স্থাপন করলে কেমন হয়?
মন্ত্রী, কোটাল, অমাত্য, রাজ পুরোহিত সকলেই সেই সময়ে উপস্থিত ছিলেন। তারা সকলে এক মত হলেন, সত্যি মনোরম এই স্থান। বসবাসের পক্ষে উপযোগী। এক দিনে বহমান সুবর্ণরেখা মানুষের দৈনন্দিন জলের চাহিদা মেটাবে, অন্যদিকে জঙ্গল, পাহাড় দিয়ে তিনদিক ঘেরা সুতরাং চট করে ভিন রাজ্যের কেউ সহসা আক্রমণ করতে পারবে না। জায়গাটা অত্যন্ত নিরাপদ বলে মনে হল। নদীতে বড়ো বড়ো পাথর খন্ড যত্র তত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এই পাথরখন্ড বাস গৃহ, পথ নির্মানে সাহায্য করবে। কয়েকজন গুপ্তচর ঘুরে এসে মহারাজকে জানাল, জঙ্গল পেরোলেই আদিবাসী গ্রাম। বহু মানুষের বাস। সুতরাং এদের সহায়তায় নিত্য প্রয়োজনীয় অনেক কাজ করা যাবে। লোক বলের অভাব হবে না। উপরন্তু তারা এ অঞ্চলের সমস্ত খবরাখবর দিতে পারবে।
রাজা জগৎ দেব এই স্থানেই নতুন রাজধানী স্থাপন করবেন মনস্থির করলেন। সুবর্ণরেখার তীরবর্তী স্থান বড়ই মনোরম। তখন হেমন্ত কাল। স্নিগ্ধ বাতাস বইছিল। নদীতে খুব বেশী জল ছিল না। বড়ো বড়ো পাথর খন্ড নদীর বুকে জেগে ছিল দেখে মনে হচ্ছিল হাতি তার ছানা পোনা সহ জল কেলি করতে নদীতে নেমেছে। এই ভুল করল রাজার একজন রক্ষী। আসার পথে হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে পড়ল। তখন সন্ধ্যা হবো হবো করছে। শরতের বিকেল দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। টুপ করে সূর্যদেব লুকিয়ে পড়লেন আর আকাশ থেকে নেমে এলো ঝুল কালি অন্ধকার। সেই সময়ে রাজা এবং তার সঙ্গীসাথী প্রজাবর্গ সকলে সুবর্ণরেখার তীরে এসে পৌঁছাল। আধো আলো আধো অন্ধকারের ভিতরে নদীর ভিতরে জেগে থাকা পাথর খন্ডগুলোকে মনে করেছে হাতির পাল। এর আগে মহারাজ জগৎ সিং এর কয়েকজন সেনা এসেছিল এই স্থানে। তারা এসে রাজার কাছে জায়গাটির বর্ণনা দিয়েছিল। সেই লোকগুলো একবার হাতির মুখে পড়েছিল। দলমা পাহাড় থেকে নেমে এসেছিল হাতির পাল। প্রতিদিন সুবর্ণরেখায় হাতিরা দলবেঁধে আসে জল খেতে। সেই গল্প শুনে তার মনে হয়েছিল ওগুলো বুঝি হাতি। সে ছিল ভয়ানক বোকা আর ভোলেভালা প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু তাকে কোনো দায়িত্ব দিলে সে সেই দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠা ভরে পালন করার চেষ্টা করত।
জগৎ সিং এর লোকেরা কিছু স্থানীয় মানুষের সংগে ইচ্ছা করেই পরিচয় করে নিল। যে স্থানে থাকবে সেই স্থান সম্পর্কে জানতে গেলে স্থানীয় মানুষের শরণাপণ্ণ হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই। এই লোকেদের ভিতরে এক জনের কানে সোনার মাকড়ি পরা। তার নাম পাঁচ কড়ি। পাঁচ কড়ি জন্মানোর আগে তার চার চারটে ভাই হয়ে মারা যায়। তারপরে ও যখন জন্মাল তখন ধাত্রীমাতা বল্লেন একে বিক্রী করে দিতে। না হলে কিছুতেই বাঁচানো যাবে না। জন্মের সময়ে পাঁচ কড়ির ওজন ছিল খুবই কম। হাত পা গুলো লিকলিকে। অপুষ্ট শরীরের গঠন। চোখ দুটো তখন ঠিক মতো ফোটেনি। ইঁদূরের বাচ্চার মতো চিঁ চিঁ করে ডাকছে। কোলে তুলতেও ভয় করতো এতোটাই ক্ষুদ্র ছিল। তুলোর ভিতরে করে রেখে দেওয়া হয়েছিল। প্রদীপের সলতে দিয়ে আলতো করে চোখের উপরে বুলিয়ে দিতেন ধাত্রী মাতা। যাতে তাড়াতাড়ি তার চোখ ফোটে। এমন সন্তানকে পরের হাতে তুলে না দিয়ে উপায় ছিল না। এবারেও যদি না বাঁচে। তাকে একজন প্রতিবেশী পাঁচটা কড়ি দিয়ে কিনে নেয়। সেই থেকে তার নাম পাঁচ কড়ি সংক্ষেপে পাঁচু। সেই প্রতিবেশী পাঁচুর জীবন সুরক্ষার জন্যে পঞ্চানন তলায় মানত করে এলেন এবং তার নামে বাম কানে একটা সোনার মাকড়ি পরিয়ে দিলেন। খুঁত ছেলের দিকে কারো নজর পড়বে না।
তাই সকলে তাকে কর্ণ সুবর্ণ নামেই চেনে। কেউ কেউ পাঁচু নামে ডাকে। বড় হলে সে রাজার দরবারে চাকরি পেল। অনুচর বৃত্তির কাজ। বুদ্ধির প্রখরতা খুব বেশি না থাকলেও তার ভিতরে, মানুষের সগে মেশার একটা সহজাত প্রবৃত্তি ছিল। আর সে খুব সহজেই মিশে যেতে পারত সকলের সঙ্গে। এই গুণের জন্যেই সে রাজার প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিল।
জগৎ সিং এর দলের একজন সেদিন হঠাৎ চীৎকার করে উঠল, দাঁড়াও, আর এক পাও এগিও না।
কেন?
বিপদ!
সে দলটাকে পথ দেখিয়ে আনছিল। তার কথায় কয়েকজন রক্ষী এগিয়ে এলেন। পিছনে ছিলেন একজন সেনাপতি। কোমরে অসি গোঁজা।
প্রধান সেনাপতি এগিয়ে এলেন তরবারী হাতে। বললেন, কী বিপদ?
কথা বলতে ভুলে গেছে এতোটাই ভয় পেয়েছে কর্ণসুবর্ণ। হাতের ইঙ্গিতে দেখালো, ওই দেখুন।
কী?
দেখতে পাচ্ছেন না হাতির পাল। জঙ্গলের পাগলা হাতি, বুনোরা একবার তারা করলে আর কারো রক্ষে নেই।
ওহ এই কথা, চল ব্যাটা আজ তোকে ওই হাতির পালের সামনেই ছেড়ে দেবো।
ওরে বাবা গো মরে যাবো গো এবারটি ছেড়ে দেন, আমি মরে যাবো।
কর্ণসুবর্ণ এলোপাতাড়ি হাত পা ছুঁড়তে লাগল। এমনিতে সে সাহসী কিন্তু বুনো হাতির এমন সব ভয়ংকর গল্প সে এ যাবৎ শুনে আসছে যে এখন রীতিমতো ঘাবড়ে গেছে।
সেনাপতি বল্লেন, যে মরার আগেই মরে যাবো বলে চেঁচায় তার মরে যাওয়াই ভালো। এই তুমি রাজার অনুচর! যার এতো ভয় সে কী করে এতো সব মস্ত মস্ত কাজ করে?
সে তো বুদ্ধি দিয়ে করি গো।
আর এখন সেই বুদ্ধি কাজে লাগছে না?
দামালদের কে না ভয় পায় বলেন ?
দাঁড়া আজ তোর ভয় পাওয়া ঘুচিয়ে দিচ্ছি।
এই বলে সেই সেনাপতি পাঁচুকে পাজাকোলা করে নিয়ে গেল এবং নদীর জলে কিছুটা নেমে তাকেও নামিয়ে দিল।
বলল, নে, এইখানে এই হাতির পালের সঙ্গে জল খা।
পাঁচু ভয়ে চীৎকার করে উথল। মরে গেলাম গো, আমাকে হাতিতে মেরে ফেলল গো-
সেনাপতি বললেন, দাঁড়া তোকে দেখাচ্ছি মজা।
পাঁচু ভালো করে লক্ষ্য করতেই বুঝতে পারল এতক্ষণ যাদের সে হাতি বলে ভুল করেছিল সেগুলো সব কালো কালো বিশাল আকারের পাথর খন্ড। নদীর বুকে ছড়িয়ে আছে এমন অসংখ্য পাথর। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে যেন হাতির পাল জলে শরীর ডুবিয়ে আছে।
ঠিক সেই মুহূর্তে বাতাস কাঁপিয়ে বৃংহন ধ্বনি শোনা গেল। পাঁচু বলল, সাবধান, শুনতে পাচ্ছ সকলে এ কিন্তু সত্যি হাতির চীৎকার। হাতির পাল দল বেঁধে এ নদীতে প্রতিদিন জল খেতে আসে গো। আমি মিথ্যে কিছু বলিনি।
পাঁচুর কথায় সকলে শংকিত হয়ে পড়ল। তারা দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করে নিরাপদ জায়গার খোঁজ করতে লাগল। একেবারে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল ভয়ে।
সেনাপতি চীৎকার করে অন্য সেনাদের নির্দেশ দিলেন, বল্লেন, ভয় নেই আমাদের কাছে মশাল আছে, তুরি, ভেরির শব্দে হাতি বাবাজীরা পালাতে বাধ্য। সকলকে শান্ত হতে বলুন। আমরা বর্তমানে যে স্থানে আছি তার চারিদিকে কড়া পাহারাদারেরা আছে। তারাই সব কিছু লক্ষ্য করছে।