পৃথা কখন আসবে <br /> অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়

পৃথা কখন আসবে
অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়

এই উপন্যাসের প্রায় পুরোটাই লেখা এমজেএন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পুরুষ শল্য বিভাগের বিছানায় বসে বা বালিশে হেলান দিয়ে আধ শোওয়া হয়ে। ট্রামাডল ইনজেকশন নেওয়ার পর ব্যথা একটু কমলে এবং ফের যন্ত্রণা শুরু হওয়ার মাঝখানের সময়গুলোতে এই উপন্যাসের বাক্য এবং যতিচিহ্নগুলো লেখা। কখনও মাঝরাতে উঠেও নিশ্চুপ হাসপাতালে বসে ভোর অবধি টানা লিখে গেছি। যখনই যন্ত্রণা শুরু হত ওঁরা ইনজেকশন দিয়ে কমানোর চেষ্টা করতেন, যাতে নিশ্চিন্তে লিখতে পারি। হাসপাতালে শুয়েই ডায়রি এবং নোট রাখার শাদা কাগজগুলোতে উপন্যাসটা গুছিয়ে আনার পর ‘অন রিকোয়েস্ট’-এ ডিসচার্জ নিয়ে ঘরে এসে এতে সংযোজন, পরিমার্জন ও ঘষামাজা সেরে ফেলি। কোনও অসুখ নয়, কোনও যন্ত্রণা নয়, আর কিচ্ছু নয়, মাথা থেকে গোড়ালি পর্যন্ত এ উপন্যাস শুধু প্রেমের উপন্যাস।

পৃথা কখন আসবে প্রথম পর্ব— প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এখানে

পৃথা কখন আসবে দ্বিতীয় পর্ব- দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এখানে

পৃথা কখন আসবে তৃতীয় পর্ব– তৃতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এখানে

দোকানের ভেতরে বাঁ দিকে একটা ক্লিপ বোর্ডে বেশ কিছু উদ্ধৃতি, কথা কাগজ দিয়ে সাঁটা। তার মধ্যে একটিতে লেখা, ‘ডোন্ট গেজ, প্লিজ আস্ক।’ এও আরেক বিভ্রান্ত করার মতো কথা। প্রশ্ন আমি কাকে করব? কে উত্তর দেবে? আমি কান কোথায় পাতব? সে কি আমার বুকের ভেতরের ক্রিস্টাল ডোরে নয়? প্রত্যক্ষ না অনুমান, কোন অভিজ্ঞতা আমাকে অনন্তের পথে নিয়ে যাবে, যে পথে পৃথা আসবে, যে পথে অভিজ্ঞতা নয়, বসে আছে অভিজ্ঞান। পৃথা কখন আসবে। এই প্রশ্ন আমি কাকে করব? কে উত্তর দেবে?
ভেতরে কয়েকটি শেলফে কিছু কাটুম কুটুম রাখা। দরজায় দেখলাম দোকানটির নাম লেখা— ‘শিল্পায়ন’। সঙ্গে ইমেল আইডি এবং জয়ন্ত বলে একজনের নামও লেখা। দোকানের ভেতরে মেঝেয় বসে আছেন এক ভদ্রলোক। তাঁর গালে অনেকটা কালো দাড়ি। দেখে মনে হয় বয়স ৫০-এর আশেপাশে। তিনি একটি চিমটে দিয়ে একটি পথকুকুরের কান এবং গায়ের লোম পরিষ্কার করছেন। কুকুরটি পরম নিশ্চিন্তে চোখ বুজে শুয়ে আছে মেঝেতে। ভদ্রলোক একমনে তাঁর কাজ করে যাচ্ছেন। জিজ্ঞেস করে জানলাম তাঁর নাম প্রসূন মজুমদার। জয়ন্ত আরেকজন। তাঁরা এই দোকানটি চালান। বললেন, ‘এটা একটা ওপেন স্পেস। যার ইচ্ছে হয় আসে। ওই হোয়াইট বোর্ডে ছবি আঁকে বা কিছু লেখে। ওই ছবিটা অসমাপ্ত ছবি। যিনি এঁকেছেন তিনি সম্পূর্ণ করে যাননি। পরে হয়ত কখনও এসে বাকিটা আঁকবেন। বা অন্য কেউও সেটা সম্পূর্ণ করতে পারে। না করলে এভাবেই থাকবে।’ এদের দোকানে দেখলাম, বাইরে সাইনবোর্ডে লেখা আছে, এদের আপডেট ডেইলি নিউজ পেপারের এজেন্সি নেওয়া আছে। আমি একটা সেদিনের আপডেট ডেইলি কিনলাম ৫ টাকা দিয়ে। আমি কোথায় থাকি, কী করি জানতে চাইলেন ভদ্রলোক। শেল্টার ফর আর্বান হোমলেসে আমার থাকা, সর্বস্বান্ত অবস্থা, শারীরিক অবস্থা, বাড়ি এবং স্থায়ী ঠিকানা না থাকা এবং এসবের সঙ্গে আপডেট ডেইলিতে আমার একদা কাজ করার কথা শুনে ভদ্রলোক সপ্রশ্ন সন্দেহে ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘আপডেট ডেইলিতে ছিলেন?’ কারণ আমার বাকি তথ্যগুলো যেগুলো আমাকে একজন ভিখিরি বলে সাব্যস্ত করে, সেগুলোর সঙ্গে আমার এই তথ্যটি অনেকটা বৈপরীত্যমূলক। আমি ভদ্রলোককে বললাম, আমার এই অসুস্থতা আমাকে আপনাদের সভ্য সমাজ থেকে আইসোলেটেড হওয়ার বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। আমরা তো চাইলেও বনে, জঙ্গলে, পাহাড়ের গুহায় গিয়ে থাকতে পারি না। সমাজ, সংসার, পরিবার, বন্ধুবান্ধব, কর্তব্য, দায়িত্ব, সামাজিকতা— এগুলো পায়ে শেকল পরিয়ে রাখে। আমার অসুস্থতা এসব শেকল কেটে দিয়েছে।
যাদের এজেন্সি ওদের নেওয়া, যে সংবাদপত্রের— তারা যে চোর, আপনারা যে চোরের এজেন্সি নিয়ে রেখেছেন সেটা আর ভদ্রলোককে বললাম না। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ’১৯ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি অবধি আমি আপডেট ডেইলি-র প্রধান কার্যালয় শিলিগুড়িতে নিউজ ডেস্কে সাব-এডিটর হিসেবে চাকরি করেছি। এই দু’ বছরে আমি ওদের সায়েন্স পেজের পাতাগুলো টানা সম্পাদনা করেছি— যে পাতায় বেশিরভাগ লেখাই থাকত আমার নিজের লেখা। কিছু লেখা লিখতেন পত্রিকার তৎকালীন অ্যাসোসিয়েট এডিটর রোশন যোশি, যিনি ২০২০ সালের জুলাই মাসে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় প্রয়াত হন। ইউডি, মানে আপডেট ডেইলি আমাকে ওদের সায়েন্স পেজ সম্পাদনা করার জন্য টাকা দিত। লেখাগুলোর জন্য কিন্তু এক পয়সাও দেয়নি। অথচ লেখার জন্য টাকা দেওয়া সংবাদপত্রের নিয়ম। বিনে পয়সাতেই যদি লিখব তাহলে বেঁচে থাক আমার লিটল ম্যাগাজিন। টাকার কুমির প্রতিষ্ঠানের কাগজে ফ্রি-তে কেন লিখব? লেখক স্বপন গুহনিয়োগী আমাকে নিজে বলেছিলেন একবার, ‘না ভাই, ইউডি-তে লিখব না। ওরা টাকা দেয় না।’ ওই দু’ বছরে কবে, কোন তারিখে, কী কী শিরোনামে, কত শব্দের কটি লেখা ইউডি-র ওই সায়েন্স পেজে বেরিয়েছে— তার সম্পূর্ণ তালিকা করা খাতা আমি জমা দিয়েছিলাম পত্রিকার তৎকালীন জেনারেল ম্যানেজার প্রবাল চ্যাটার্জির কাছে। না, লেখার জন্য আমি আমার প্রাপ্য টাকা পাইনি। এরপরে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ওরা আমাকে স্যাক করে। ইমেলে পাঠানো চিঠিতে বলে, আন-অথরাইজড লিভের জন্য আমাকে বরখাস্ত করা হল। অথচ আমার নিয়োগপত্রে ‘টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনস’-এ লেখা ছিল, পত্রিকা দপ্তর যদি আমাকে টারমিনেট করে তাহলে তার আগে তারা আমাকে শোকজ চিঠি পাঠাবে। আমাকে যথাযথ কারণ দর্শাতে হবে। যদি তা সন্তোষজনক না হয়, তাহলে ১৫ দিনের নোটিসে পত্রিকা আমাকে টারমিনেট করতে পারে। কিন্তু নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে, বকেয়া টাকা না মিটিয়ে তারা একটা চিঠি পাঠিয়ে টারমিনেট করে। এরপর ঠিক সাত মাস বাদে ’২০ সালের অগাস্ট মাসে তারা আমাকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। এবারে পোস্টিং হয় মালদায়, ইংরেজবাজার শহরে। এই পর্যায়ে আমি ২০২০ সালের অগাস্ট থেকে ২০২১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি অবধি, সাড়ে ন’ মাস চাকরি করি। শিলিগুড়িতে কাজ করার সময়, যেহেতু ওখান থেকে পত্রিকার মূল পাতাগুলো হয়, সেখানে বিজ্ঞানের পাতা ছাড়াও বিশেষ ক্রোড়পত্রের পাতা, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক খবর এবং পাতা, জেলার খবর এবং পাতা, পোস্ট এডিটোরিয়ালের লেখা এবং সেই পাতা এবং এর সঙ্গে নানাজনের সাক্ষাৎকার নেওয়া ও নানারকমের লেখার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম। মালদায় গিয়ে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়লাম শুধু গৌড়বঙ্গে। কিন্তু মালদা খুব হ্যাপেনিং জায়গা। খবরের জায়গা থেকে বলছি। এই সময়ে মালদায় আমি নিউজ ডেস্কের কাজ ছাড়াও বেশ কিছু কপিও করেছি, যার মধ্যে কয়েকটা এক্সক্লুসিভও ছিল। এই কপিগুলোর জন্য এক টাকাও কিন্তু ওরা দেয়নি। ’২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ’২১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি অবধি, এই সাড়ে আট মাসে আমি ওদের অনলাইন নিউজ বুলেটিনের কাজও করে গেছি— যে কাজ শুরু হয়ে যেত ভোর থেকে। আর চলত রাত পর্যন্ত। মোবাইলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঘরে বসে, রাস্তায় চলতে চলতে, বাজার করতে করতে, এমনকী বিয়ে করতে যাবার সময়েও অনলাইন বুলেটিনের কাজ চালিয়ে গেছি। কিন্তু ইউডি আমাকে এই সাড়ে আট মাস অনলাইন কাজের জন্য আট আনা পয়সাও পারিশ্রমিক দেয়নি। পুরোটাই ফ্রি সার্ভিস।
‘শিল্পায়ন’ থেকে ৭ অগাস্ট, ২০২২-এর আপডেট ডেইলি কিনে জানলাম, ধনকর উপরাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হয়ে গেছেন। মমতার মন্ত্রীসভার দু’ নম্বর মুখ, রাজ্যের টপ মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি করে ক’দিন আগে প্রেসিডেন্সি জেলে ঢুকে গেছে। দীর্ঘদিন সংবাদপত্র না পড়ার সুফল আমি এভাবেই উপভোগ করলাম। খবরের কাগজ পড়ে কী হয়? কাগজওয়ালাদের বড়লোক করা হয় শুধু। মার্গারেট থ্যাচার, ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, যদি কাগজওয়ালারা ভুয়ো খবর ছাপে, আমি তা উপেক্ষা করি। আর যদি সত্য খবর ছাপে, তাহলে তা আমি আগে থেকেই জানি। তাহলে কাগজটা পড়ব কেন? ইউডি দেখলাম ‘ন্যায় চাই’—এই ক্যাপশনে গলা ফাটিয়ে শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষক বদলিতে দুর্নীতি নিয়ে অন্তর্তদন্তমূলক খবর ছাপতে শুরু করেছে ধারাবাহিকভাবে। যারা চোর মন্ত্রীর খবর ছাপছে, তারা নিজেরাই তো চোর। সেই যে ঋত্বিককুমার ঘটক ‘যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো’তে কবে বলেছিলেন, ‘আমরা সবাই হয় চোর, নয় তো বিভ্রান্ত।’

এরপর ২০২১ সালের মে মাসের মাঝখানে আমি হুট করে একদিন ওদের চাকরি ছেড়ে দিই। ঠিক দেড় বছর আগে ’১৯ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ওরা আমাকে হঠাৎ করে টারমিনেট করেছিল। অনেকটা সেভাবেই আমি হঠাৎ করে ওদের চাকরি ছেড়ে দিলাম। যেদিন আমি ওদের চাকরি ছাড়ি তার আগের দিনও আমার বাইলাইনে কয়েক কলামজুড়ে কপি বেরিয়েছে। ঠিক যেভাবে আমাকে তাড়ানোর আগে ওরা আমাকে কিছু বুঝতে দেয়নি, একইরকমভাবে ওদের তাড়ানোর আগেও আমি ওদের বুঝতে দিইনি। এই মধুর প্রতিশোধটা নেওয়ার জন্য আমাকে ঠান্ডা মাথায় দেড় বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ওদের হাউজে ফিরে গিয়ে সাড়ে ন’ মাস টানা কাজ করতে হয়েছে। ইলেকশন কভার করতে হয়েছে। একের পর এক দায়িত্ব নিয়ে এবং সাফল্যের সঙ্গে টিম ওয়ার্ক করে ওদের বিশ্বাস এবং আস্থা যখন অর্জন করে ফেলেছি— ঠিক তখন এক সকালে আমার রেজিগনেশন লেটার পাঠালাম। জানি, এতে ওদের কিছুই আসে যায় না। ওরা কোটিপতি পত্রিকা। টাকাপয়সার কোনও লেখাজোখা নেই। কিন্তু ওই যে সুমনের গান— ‘হাতির সামনে পিঁপড়ের দল/হেরে যাবি তবু হামলাই বল।’
বেলা ১১টা নাগাদ আমার এমআরসিপি পরীক্ষা হল। এমআরসিপি-র কেবিনের ভেতর ঢুকে গেলে মনে হয় বিরাট এক শাদা ডিমের খোলসের ভেতর ঢুকে গেছি। আমার চোখের ওপর সেই ডিমের খোলস উপবৃত্তাকারে আমাকে ঘিরে রেখেছে চারপাশে। এই পরীক্ষায় প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে বিকট শব্দে মাথা ধরে যায়। একমনে কিছু চিন্তা করার জন্যে ডিমের খোলসের ভেতর ঢুকে যাওয়ার চেয়ে ভালো কিছু হয় না। এমআরসিপি-র কেবিনে ঢুকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার চারপাশ থেকে সমস্ত জগৎ মিলিয়ে গেল, থেকে গেল শুধু পৃথার চোখ দুটো— যে চোখ আমার দিকে তাকালে মনে হয় আমিই ফুটে উঠেছি তার চোখে। আমার মধ্যে সবসময় একধরনের স্থগিতভাব কাজ করে। জলের তলায় বিশেষ ফুসফুস নিয়ে ডুবে থাকা এক মানুষ যেন আমি। শক্ত শ্যাওলা পা পেঁচিয়ে রাখে প্রতিক্ষণে। প্রণয়প্রস্তাবের আগে যেমন হয়। স্বপ্নের ভেতর থেকে ঘুম ভেঙে যাওয়ার প্রাক্ মুহূর্তে যেমন হয়। যেন না ভাঙে ঘুম। স্বপ্ন বা ইচ্ছে পূরণের যন্ত্রণা যেকোনও ব্যর্থতার চেয়ে দ্বিগুণ। আমি পৃথার চোখের দিকে তাকাই কারণ সে চোখ আমার আমির দিকে তাকায়। এবং সরাসরি তাকায় দিনের আলোর মতো সহজ করে। আমি কথা বলে ওঠার আগেই আমার সেই মুহূর্তের অনুভূতিকে টলমল করতে দেখি তার চোখের তারায়, যেখানে দরিয়ার দিশা থমকে আছে। যেভাবে আয়নার সামনে দাঁড়ানো মানুষ আয়নার ফ্রেমের মধ্যে থাকা সবটুকু আয়নাকে সমর্পণ করে নিজের শরীর ও তার অবয়ব, আমিও তেমনি আমাকে সমর্পণ করেছি পৃথার দু’ চোখের ভেতর। অন্যরা সবাই কথা বলবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, তাকাবে আড়ে আড়ে। পৃথা তাকাবে সোজা। একদম তির এসে ঢুকবে হৃদযন্ত্রে, যেখানে একমাত্র ঈশ্বরের বৈধ অনুপ্রবেশ। অন্যেরা বলবে, ‘আপনি আগে ভর্তি ছিলেন না?’ কেউ বলবে, ‘কোথায় যেন দেখেছি। চেনা মনে হচ্ছে।’ কেউ বলবে, ‘আমাকে চিনতে পারছেন?’ এসব তারাই বলবে যারা স্বরলিপিতে সোজা আঘাত হানতে পারে না। পৃথা এরকম ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলার মেয়েই নয়। সে কথা বলবে মারোয়া রাগের মতো মীড়হীন। সে আমাকে হাসপাতালের সামনে গাড়ি থেকে নামতে দেখেই সরাসরি প্রশ্ন করবে, ‘আবার?’ আমি চিনতে পেরেছি কি পারিনি সেসবের পরোয়াই সে করবে না।
এমআরসিপি-র কেবিনের ভেতর শুয়ে আমি ভাবছি পৃথার চোখ দুটোর কথা। কী বলা যায় এই চোখকে? পাখির নীড়ের মতো? না, সেরকম নয়। পৃথার চোখ এক ইডিওগ্রাম— আ রিটন সিম্বল দ্যাট স্ট্যান্ডস নট ফর আ ওয়ার্ড অর সাউন্ড বাট ফর দ্য থিং ইটসেলফ ডায়রেক্টলি। যেন এক লিখিত বর্ণচিত্র। উদাসীনতার এই সময়ে ইতিহাসের গা ঘষটে যাওয়া আমাদের জিভ যখন কাশির ওষুধ চেটে নিতে শিখে ফেলেছে— তখন পৃথার চোখ থেকে আসা আলোক বিন্দু ফাঁসির দড়িটার ফাঁক গলে আরও বহুদূর আলোর কণাদের বিকিরণ করে যাচ্ছে, যাচ্ছে। আমরা সবাই নশ্বর। কিন্তু ওই আলো থেকে যায়। ঘুরতে থাকে আমাদের চারপাশে। অন্ধকার, নিঃসঙ্গ সুড়ঙ্গের পাশে শুয়ে থাকে সেই আলো। এরকম একটা কথা শোনা যায় যে, একমাত্র স্বপ্নেই আমরা নিজেদের দেখতে পাই। আয়নায় কিন্তু দেখতে পাই না। কারণ আয়নায় যেটা দেখি সেটা আমার ইমেজ। কথাটা কে বলেছিলেন জানি না। যিনিই বলে থাকুন, তিনি ঠিক কথা বলেননি। দোষ তাঁর নয়। কারণ তিনি পৃথার চোখ দেখেননি। দেখলে জানতেন, শুধু স্বপ্নে নয়, এ পৃথিবীতে পৃথার চোখের দিকে তাকালেও নিজেকে দেখা যায়। শুধু নিজেকে নয়, নিজের ভেতরটাও দেখা যায় সেই চোখে।
কিছুক্ষণ পরই এমআরআই প্লেট নিয়ে হাসপাতালে আমার বেডে ফিরে এলাম। এমআরসিপি সেন্টারে রিসেপশনের চেয়ারে পরের দিকে একটি মেয়ে এসে বসেছিল। কাগজপত্রের কাজ, রুগিদের নাম ধরে ডাকা— সে-ই করছিল। শিশু, সুন্দরী নারী, পশুপাখি এবং রাস্তাঘাট, গ্রামগঞ্জ ও হাটবাজারের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ধুলোমাখা মানুষদের আমি একটু খুঁটিয়েই লক্ষ করি।
মেয়েটি এদিন পরে এসেছে হালকা হলদেটে সবুজ রঙের চুড়িদার। দু’ পায়ে রুপোলি নূপুর। কানে রুপোলি দুল। ঝুমকো নয়। মাথার পেছনে রুপোলি একটা ক্লিপ একরাশ কালো চুলকে আলগা করে ধরে রেখেছে। মেয়েটি এই অল্প সময়ে বেশ ক’বার হাসল। না হাসলে কথা বলার সময়ে সে একটু কাঠ কাঠ ধরনের। অল্প আড়ষ্ট। হাসলে সেই আড়ষ্টতা আলগা হয়ে যায়। বোধহয় অফিসে কাজের মধ্যে আছে বলে একটু কনশাস। কিন্তু হাসার সময়ে সে এই কনশাসনেসের কথা ভুলে যায় কিছুক্ষণের জন্য। হাসলে তার উজ্জ্বল দাঁতগুলো দেখা যায়। দেখা যায় দু’ পাশের সুন্দর গজদন্ত। হাত এবং পায়ের আঙুলের নখে তার উজ্জ্বল নীল রঙের নেলপালিশ। চোখে তার গোল বড় চশমা। মাঝেমাঝেই ডান হাতের তর্জনী দিয়ে তাকে দুই ভুরুর মাঝখানে নাকের ডগায় চশমা চেপে ধরতে দেখা গেল। এটা হয়ত মেয়েটির মুদ্রাদোষ। অথবা হতে পারে এই চশমা সে নতুন পরছে। এখনও এতে অভ্যস্থ হতে পারেনি। কিংবা নিজের ব্যক্তিত্ব উপস্থাপনের জন্যেও সে এরকমটা করে থাকতে পারে, যাতে তার চরিত্রে ও চেহারায় একটা সিরিয়াসভাব আসে। মনে হয়, এই মেয়েটির মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থায় একটি শিশুসুলভ ছেলেমানুষ বাস করে। মেয়েটি চায়, অফিসে সেই ছেলেমানুষি বেরিয়ে না আসুক। সে চায়, লোকে তাকে সিরিয়াসলি নিক।
হাসপাতালে প্রতিদিন একবার সকালের দিকে মাইকে ঘোষণা হয়, ‘বাচ্চাদের ওয়ার্ড থেকে বলছি। যাদের যাদের নাম বলব, তারা বাচ্চা নিয়ে এস। ছুটি আছে।’ এই বলে বাচ্চাগুলোর নাম বলতে থাকে। ইসমাইল হোসেন, সাদিক রহমান, মোনালি বিশ্বাস, দেবাযানী পাল, অভিজিৎ দত্ত, পরমজিৎ দাস, রাজু শেখ, রহমত আলি, রুমা সাহা, শুভজিৎ রায়। একেকদিন একেক জনের নাম। যিনি ঘোষণা করেন সেই সিস্টারের গলাও একদম একটা বাচ্চা মেয়ের মতো আদুরে আর মিষ্টি। বাচ্চাদের ওয়ার্ডে যাঁরা কাজ করেন, দীর্ঘদিন সেখানে কাজ করতে করতে, শিশুদের সঙ্গে মিশতে মিশতে তাঁদের মধ্যেও কি কিছুটা শিশুভাব চলে আসে? শিশুরা যেমন চারপাশ থেকে নানা জিনিস অতি দ্রুত তাদের মধ্যে নিয়ে নেয়, তেমনি অত্যন্ত নিঃশব্দে তারা তাদের ভেতরে থাকা বিশুদ্ধ পরাগরেণু ছড়িয়ে দেয় চারপাশে। যারা তাদের সঙ্গে মেশে, তাদের হাতে তারা তুলে দেয় এই অপার ঐশ্বর্য। যারা সেটা একবার নিয়ে নেয়, তাদের আর শিশুত্ব থেকে মুক্তি নেই। তাদের আর কিছুতেই বড় হওয়া চলে না।
একদিকে বড়রা ছোট হয়ে যাচ্ছে। আরেকদিকে ছোটরা চোখে চশমা এঁটে বড় হতে চাইছে। কী সব ম্যাজিক চলছে চারপাশে। কত আশ্চর্য জিনিস চারপাশে। দুপুরে এবং রাতে হাসপাতালে খাবার দেন এক মহিলা, যাঁর ছেলের নাম পাখা, তিনি মনে করেন আমি তাঁর ছেলের বন্ধু। অথচ আমি পাখাকে চিনি না। তিনি এসে আমার কাছে পাখার গল্প করেন। হয়ত ঘরে গিয়ে পাখার কাছে করেন আমার গল্প। তিনি আমাকে তাঁর ছেলের বন্ধু ভেবে প্রতিদিন মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। খেয়েছি কিনা জিজ্ঞেস করেন। শরীর কেমন আছে খোঁজ নেন। স্নেহ করে ভালোবেসে দুটো কথা বলেন। তিনি বিশ্বাস করেন আমি তাঁর ছেলে পাখার বন্ধু। আমার একটা বিছানা পরে বেড নম্বর এক্সট্রা ফোরের সেই প্রবীরকুমার দত্ত, যাঁর বাড়ি জিরানপুরে, তিনি তাঁর ভাঙা পা খুলে ব্যাগে ভরে রাখেন বলে বিশ্বাস করেন। আই রুমে আসা এক নতুন রুগি, তাঁর লুঙ্গির সঙ্গে আমার নতুন লুঙ্গির হুবহু মিল দেখে আশ্চর্য হয়ে যান। এসবের মধ্যে ট্রলি বে-র ভেতরে একটা বেড়াল দুটো ছানার জন্ম দিয়েছে। মা বেড়াল গম্ভীর হয়ে বসে এ-পাশে ও-পাশে লেজ নাড়তে থাকে। আর ছানা দুটো সামনের দু’ পায়ের ছোট্ট থাবা দিয়ে মায়ের নড়তে থাকা লেজটা ধরার ক্লান্তিহীন চেষ্টা করে যায়। কিন্তু কিছুতেই পারে না। তারা ডানদিকে ঝাঁপালে লেজ চলে যায় বাঁ দিকে। তারা বাঁ দিকে ঝাঁপালে লেজ ডানদিকে ঘুরে যায়। কী গণ্ডগোল! মা বেড়াল কিন্তু সামনের দিকে মুখ করে চোখ বুজে গম্ভীর হয়ে বসে আছে। পেছনের এই খেলা সে দেখতে পাচ্ছে না। অথবা সে-ই হয়ত একমাত্র প্রাণি যে এই খেলার একমাত্র নিয়ন্ত্রক এবং অন্তর্যামীসুলভ পরম দর্শক।
মা বেড়ালের খেলা এই একটাই। চুপ করে চোখ বুজে গম্ভীর হয়ে বসে ডানদিকে বাঁ-দিকে লেজ নাড়তে থাকা। আর তার ছানা দুটো সেই লেজ ধরার জন্য জান লড়িয়ে দেবে। কিন্তু ধরতে পারবে না। মা বেড়ালের আদরের ধরনও একটাই। ছানা দুটো তার কাছে এলেই সে চোখ বুজে জিভ দিয়ে চেটে চেটে ভিজিয়ে দেবে একেবারে। ছানা দুটোর খেলার কোনও শেষ নেই। আমার চটির ভেতরে তারা প্রায়ই ঢুকে পড়ে। ছোট ছোট দাঁতে রাবারের স্ট্র্যাপ কামড়ে ধরে থাকে। আরশোলাকে চিৎ করে দূর থেকে তাকে থাবা দিয়ে নাড়তে থাকে। কাছে গিয়ে মুখে নেওয়ার সাহস কিন্তু নেই। কোনওভাবে আরশোলাটা এই চিৎ দশা থেকে মুক্তি পেয়ে সোজা হতে পারলেই এই শিক্ষানবিশ বেড়াল ছানার হাত থেকে ছুটে দৌড়ে পালাতে যায়। বেশি দূর পারে না। ছানা আবার তাকে ধরে ফেলে চিৎ করে দেয়। আরশোলা শূন্যে ঠ্যাং তুলে নড়তে থাকে। হয়ত বলে, বেড়াল, হয় তুই আমাকে খা। নইলে ছেড়ে দে। এভাবে চিৎ করে শুইয়ে রাখিস না। মাঝেমাঝে ছানাদের চলে আর্মি ট্রেনিং। ট্রলি বে-র বাইরে প্রায় ১০-১২-ফুটের উঁচু গ্রিল। ছানারা সেই গ্রিল বেয়ে পাঁই পাঁই করে উঠে যায় ওপরে। তারপর আর নামতে পারে না। ওপর থেকে ঘাড় বেঁকিয়ে নীচে তাকাতে থাকে। কোনওমতে গ্রিলের দু’ চারটে ধাপ বেয়ে নামতেই একেবারে নীচে ধপাস করে পড়ে। আবার উঠতে থাকে সামনের দু’ পায়ে গ্রিল বেয়ে।
ক’দিন ধরে দেখছি ওই মাদি বেড়ালের বর, মানে ছানা দুটোর বাবাও এখন ওদের সঙ্গে থাকতে শুরু করেছে। তিনি একেবারে স্পোর্টসম্যান। সে প্রথমে নিজের পিঠটা ধনুকের মতো বাঁকাবে। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়বে একটা ছানার ওপর। তার ঘাড় কামড়ে চেপে ধরবে। ছানাটা চিঁ চিঁ করতে থাকবে। এই সময় মা বেড়াল রাগি মুখে তাকিয়ে থাকবে পুরুষ বেড়ালটির দিকে। এবারে ছানা আর পুরুষ বেড়াল দুজন দুজনকে পা দিয়ে জড়িয়ে মেঝের ওপর গড়াগড়ি খেতে শুরু করবে। কখনও ট্রলি বে-তে রাখা বেলচার ওপরে শুয়ে থাকবে পুরুষ বেড়াল। কখনও ছানা দুটোর মতো মাদি বেড়ালের স্তন চেটে চেটে সেও আদর করবে আদর্শ প্রেমিক পুরুষের মতো। পুরুষ বেড়ালটির পাক খাওয়া দেখলে মনে হবে সে যেন এক ছৌ নাচের শিল্পী। ধনুকের মতো গোটা শরীর বাঁকিয়ে এমন করবে যেন একটা একলা ফার্স্ট ব্র্যাকেট। তারপর ওইভাবেই মেঝের ওপর কাৎ হয়ে শুয়ে ঘুরতে শুরু করবে, ঠিক যেভাবে ছৌ শিল্পীরা দু’ পায়ে লাফিয়ে উঠে পাক খেয়ে ঘোরে।
আমার অপারেশন নিয়ে ডাক্তারদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে সেটা বুঝতে পারছি। অন্যান্য মেডিকেল কলেজে যেভাবে ডাক্তাররা রুগিদের মনিটর করেন, এখানে সেটা সম্ভবত এখনও পুরোপুরি চালু হয়নি। এই হাসপাতাল খুব বেশিদিন হয়নি মেডিকেল কলেজ হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। অন্যান্য মেডিকেল কলেজে, সাধারণ হাসপাতালের কথা কিন্তু বলছি না, মেডিকেল কলেজগুলোতে ডাক্তারদের ইউনিট ভিত্তিক রুগির চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয়ের দায়িত্ব নেওয়া হয়। ধরা যাক, মেডিকেল কলেজে সার্জারি বিভাগে পাঁচটি ইউনিট আছে। প্রতি ইউনিটে বেশ কয়েকজন ডাক্তার আছেন। প্রতি ইউনিটের আছে একজন, দুজন সিনিয়র চিকিৎসক, যাঁরা প্রফেসর পর্যায়ে পড়েন। ধরা যাক, আমি সেই মেডিকেল কলেজে পুরুষ সার্জিক্যাল বিভাগে ভর্তি হলাম। এমার্জেন্সিতে ভর্তির সময় আমাকে দেখলেন ইউনিট ফোর-এর চিকিৎসকরা। আমি ওই মেডিকেল কলেজে এই ইউনিটের চিকিৎসকদের অধীনেই চিকিৎসা নেব। অন্য ইউনিটের ডাক্তারবাবুরা সকাল-বিকেল রাউন্ডে এসে আমার সামনে দিয়ে চলে গিয়ে অন্য রুগিকে দেখে যাবেন— কিন্তু আমাকে দেখবেন না। আমি তাঁদের ইউনিটের অধীনে নই।
কিন্তু এই মেডিকেল কলেজে সব ইউনিটের ডাক্তারই আমাকে দেখছেন। আজ ইউনিট ফোর আমাকে দেখলে, কাল দেখছে ইউনিট টু। স্কুল জীবনে একই ক্লাসের বিভিন্ন সেকশনের মধ্যে একটা রেষারেষি যেমন ছিল, একটা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ। কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেমন থাকে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, লবি— মেডিকেল কলেজে ডাক্তারদের ইউনিটগুলোর মধ্যেও সেটা দেখা যায়। কিন্তু স্কুল জীবনে আমাদের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটে না বলে সেখানকার রেষারেষি একটু চোখে পড়ার মতো। মিনমিনে বদমায়েশি একটু বেশিই সেখানে। আর রাজনৈতিক দলের নেতাগুলো বেশিরভাগই যাকে বলে ‘আংগুঠা ছাপ’, তাই তাদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব অনেক ন্যাংটোভাবে প্রকাশ্য। নোংরামি, দুর্নীতি, খেয়োখেয়ি, কূটনীতি সেখানে অনেক বেশি। কিন্তু অনেক লেখাপড়া করা ডাক্তাররা উচ্চশিক্ষিত। তাঁদের মধ্যে এই দ্বন্দ্বের স্রোত তাই খুব সূক্ষ্ম। আপাতভাবে চোখেই পড়ে না।
দুদিন আগে সন্ধেবেলা যে দুজন ডাক্তার আমাকে দেখতে এলেন, তাঁদের মধ্যে একজন লেডি ডাক্তার। দেখলাম তাঁরা দুজনেই আমার অপারেশন প্ল্যানিংয়ের ব্যাপারে কিছু জানেন না। আমি বলার পরে লেডি ডাক্তার প্রেসক্রিপশনের পাতা উলটে দেখলেন। এবং তখন বিষয়টি জানলেন। যে ইউনিটের ডাক্তারবাবুরা আমার ওটি প্ল্যান করছেন, এঁরাও সেই ইউনিটের ডাক্তার হলে এমনটা হত না। এঁরাও জানত ওটি প্ল্যানের কথা।
সেদিনই, এর ঘণ্টাখানেক বাদে ওই দুই ডাক্তার অন্য একজন সিনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে আমার বেডের সামনে দিয়ে চলে গেলেন। যেতে যেতে ওই লেডি ডাক্তার সিনিয়রকে বলছেন শুনলাম, ‘প্ল্যান ফর ওটি’। সিনিয়র বললেন, ‘এলপিজে?’ মহিলা ডাক্তার বললেন, ‘হ্যাঁ, এলপিজে।’ এবার সিনিয়র জিজ্ঞেস করলেন, একটু ব্যঙ্গের সুরে, ‘কে করবে?’ মহিলা ডাক্তার বললেন, ‘জানি না’।
‘কে করবে?’ সিনিয়র ডাক্তারের এই প্রশ্ন করার ধরনের মধ্যে, প্রশ্নের সুরে, চোখের ভুরু তোলায় এমন একটা জিনিস ছিল, যাতে বোঝা যাচ্ছিল সিনিয়র ডাক্তার বলতে চাইছেন, ‘এখানে কে আছে যে এই অপারেশন করবে, এই সেট-আপের মধ্যে?’
এলপিজে হল আমার খুব সম্ভবত হতে যাওয়া অপারেশনটির টেকনিক্যাল নাম। সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ সিনেমা যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের নিশ্চয়ই মনে থাকবে সেই দৃশ্যটা— যেখানে আসল ডাক্তার হাজরা ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় এক পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘আপনি টেলিপ্যাথির নাম শুনেছেন?’ এর উত্তরে সেই অফিসার বলছেন, ‘টেলিপ্যাথি? নো টেলিপ্যাথি। টেলিফোন ইয়েস। টেলিপ্রিন্টার ইয়েস। টেলিগ্রাম ইয়েস। টেলিগ্রাফ ইয়েস। বাট নো টেলিপ্যাথি।’ আমারও তেমনি বলতে হয়, এলপিজে? নো এলপিজে। এলপিজি ইয়েস। লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস—এলপিজি ইয়েস। বাট নো এলপিজে। হোয়াট ইজ এলপিজে? আমি জানি না।
সন্ধেবেলা এলেন আরেকজন ডাক্তার। ইনি হলেন সেই ডাক্তার যাঁকে আমি দিন কয়েক আগে বলেছিলাম ট্রামাডলের সঙ্গে পিসিএম অল্টারনেট করে চালাতে। আমার কথা শুনে যিনি চোখের তারায় হেসেছিলেন অল্প এবং পিসিএম দেওয়ার কথা লিখে দিয়েছিলেন প্রেসক্রিপশনে। সন্ধেয় তিনি এসে আমার সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট দেখতে চাইলেন। রিপোর্ট দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যথা আছে কিনা। ব্যথা কমেছে এটা জানানোর পাশাপাশি আমি তাঁকে জানালাম এদিন এমআরসিপি টেস্ট হয়েছে। রিপোর্ট ক’দিন পরে দেবে। ডাক্তার বললেন, ‘ব্যথা যখন কমেছে তাহলে আপনাকে ডিসচার্জ করে দিচ্ছি।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘তাহলে প্ল্যান ফর ওটি ক্যানসেল?’
‘প্ল্যান ফর ওটি? ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন।
‘হ্যাঁ, আপনার হাতের প্রেসক্রিপশনে দেখুন। সেরকমই তো লেখা আছে।’ আমি বললাম।
প্রেসক্রিপশন দেখে ডাক্তার বললেন, ‘ঠিক আছে। তাহলে থাকুন।’ এই বলে তিনি পুলিশ সেলের রুগিদের দেখতে এগিয়ে গেলেন। তাঁদের দেখে যখন তিনি আমার বেডের সামনে দিয়ে আবার নার্স রুমের দিকে যাচ্ছেন, তখন আমি তাঁকে ডাকলাম। বললাম, ‘একটু কথা বলা যাবে?’
‘হ্যাঁ, বলুন।’
‘দেখুন’, আমি বললাম, ‘আমি মেডিকেল সায়েন্সের স্টুডেন্ট নই। এলপিজে কী আমি জানি না। আপনাদের একজন ডাক্তার বলছেন হায়দরাবাদ গিয়ে স্টেন্ট নিতে। কেউ বলছেন ইআরসিপি করাতে। একজন বলছেন ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়ে ওষুধের ওপর থাকতে। আর ব্যথা হলে হাসপাতালে চলে আসতে। একজন বলছেন পিজিতে এসজিএলডি-তে যেতে। আপনি এখন ছুটির কথা বলছেন। দুদিন আগে আমাকে আরেকজন ডাক্তার অপারেশনের জন্যে মানসিক প্রস্তুতি নিতে বলে গেছেন। আপনাদের কথাবার্তায় আমি কনফিউজড। একজন ডাক্তার হিসেবে আপনি কী বলেন? আপনার সাজেশন কী? আমার কী করা উচিত?’
আমার প্রশ্নের উত্তরে সুপুরুষ চেহারার দীর্ঘদেহী সেই যুবা চিকিৎসক বললেন, ‘দেখুন, একেকজন ডাক্তার একেকটা প্রোটোকলে চিকিৎসা করেন। যিনি আপনার অপারেশনের জন্য প্ল্যান করেছেন, তিনি কিছু একটা ভেবে করেছেন। আমি চাইছি আপনাকে ছুটি দিতে। এর বাইরে আমার কোনও পার্সোনাল ওপিনিয়ন নেই।’
এ তো আচ্ছা গ্যাঁড়াকলে পড়া গেল। ‘বেশ’, আমি বললাম। ‘আপনি তাহলে বাকি চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে আপনাদের সর্বসম্মত একটা অ্যাডভাইস এনে আমাকে দিন। হোয়াট ইজ টু বি ডান? কী করতে হবে? কোনও একজন চিকিৎসক বা একটা ইউনিটের মত নয়। যেহেতু একাধিক ইউনিটের চিকিৎসক আমাকে দেখেছেন, আমি তাই তাঁদের সর্বসম্মত মতামতটাই জানতে চাই।’
সুপুরুষ চেহারার দীর্ঘদেহী যুবা চিকিৎসক বললেন, ‘আগামী কাল সন্ধেয় রাউন্ডে এসে আপনাকে এটা বলব। আমি সিনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলছি। আপনি কিন্তু মনে করাবেন আমাকে।’
সেই রাতটা ছিল রবিবারের রাত। রাতে একের পর এক দুর্ঘটনাগ্রস্ত রুগির লাইন লেগেই রইল। এটা আগের রবিবারেও লক্ষ করেছি। শ্রাবণ মাসে শিবভক্তদের একটা হিড়িক পড়ে। রবিবার রাতে তারা যাত্রা শুরু করে। সোমবার ভোরে কোনও শিবমন্দির, কাছেপিঠে যেমন বাণেশ্বর, সেখানে জল ঢালে। অনেকেই নেশাগ্রস্ত থাকে রাতভর যাত্রার সময়। আর অ্যাক্সিডেন্টগুলো তখনই হয়। গেরুয়া গেঞ্জি আর গেরুয়া বারমুডা পরা একের পর এক ভক্তেরা মন্দিরের বদলে হাসপাতালে আসতে থাকে। আমার পরের যে বিছানা দুটো খালি ছিল, সেখানেও নতুন মানুষ এল। এঁরা অবশ্য ভক্তের দলের লোক নন। প্রথমে রাত ৯টা নাগাদ বেড নম্বর এক্সট্রা ফোরে এলেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক। রাজারহাটে বাড়ি। রাস্তা পেরুতে গিয়ে বাইক মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। বেড নম্বর এক্সট্রা থ্রিতে অনেকটা রাতের দিকে এলেন আরেক মাঝবয়েসি তরুণ। পেটে যন্ত্রণা নিয়ে ভর্তি হলেন তিনি। এঁর বাড়ি চকচকা নীলকুঠিতে। পেশায় গাড়িচালক।
সিটি স্ক্যানের ঘরের সামনে থেকে বারান্দাটা পুলিশ সেল, আই রুম, এক্সট্রা বেড, ট্রলি রাখার জায়গা— এগুলোকে সঙ্গে নিয়ে সোজা হেঁটে এসেছে নার্স রুমের কাছে। সেখান থেকে একেবারে ডানদিকে ঘুরে আবার চলে গেছে সোজা। এবারে তার সঙ্গে চলেছে পুরুষ সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের ঘর আর ওদিকের বারান্দার বেডগুলো। এই পুরো রাস্তায় দু’ জায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে। যদি ক্যাপিটাল রোমান লেটারে ‘L’ বর্ণটিকে ভাবা যায়— তাহলে তার উল্লম্ব রেখা এবং আনুভূমিক রেখার কৌণিক বিন্দুতে আমাদের নার্স রুম। আনুভূমিক রেখার ডানদিকের শেষ মাথায় সিটি স্ক্যানের ঘর। ওখানে আছে রাশিয়া। আর উল্লম্ব রেখাটি ধরে সোজা হাঁটতে শুরু করলে বাঁ হাতে পড়বে পুরুষ সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের ঘরগুলো। কৌণিক বিন্দুতে একটি সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে, যার মুখ উল্লম্ব রেখার দিকে। আনুভূমিক রেখার মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে দ্বিতীয় সিসিটিভি ক্যামেরা— এর মুখ সিটি স্ক্যানের ঘরের দিকে। এই ক্যামেরা পুলিশ সেলের অংশটি পুরোটা কভার করছে। কিন্তু এই ক্যামেরার পেছনেই রয়েছে এক্সট্রা বেড ৪, ৩ এবং ২। এক্সট্রা বেড ৪ থেকে নার্স রুমের দরজা অবধি জায়গাটি সিসিটিভি ক্যামেরার নজরদারিতে নেই। অর্থাৎ আমি সার্ভেইলেন্সের বাইরে বসে এই লেখা লিখছি।
সিসিটিভি ক্যামেরার নজরদারির কথা উঠলে অত্যন্ত চমৎকার একটা ঘটনা আমার মনে পড়ে। আমরা যখন আপডেট ডেইলিতে জয়েন করি তখন আমাদের নিউজ রুমে ক্যামেরার নজরদারি ছিল না। হঠাৎ একদিন দেখি নিউজ রুমে ক্যামেরা বসানোর কাজ চলছে। অ্যাসোসিয়েট এডিটর রোশন যোশি, যাঁকে সবাই ‘স্যার’ বললেও আমি বলতাম ‘রোশনদা’, তিনি বললেন, ‘বুঝলি রে, ভালোই হল’।
‘কী ভালো হল?’
‘এই যে এবার থেকে হাসতে হাসতে শুয়োরের বাচ্চা বলা যাবে।’ রোশনদা বললেন।
কথাটা ঠিকমতো ধরতে পারিনি প্রথমে।
রোশনদাই বোঝালেন, বললেন, ‘বুঝলি না? সিসিটিভি ক্যামেরায় শুধু ভিডিওটা থাকে। অডিও নেই। তাই হাসতে হাসতে শুয়োরের বাচ্চা বললে কেউ ধরতে পারবে না। সবাই দেখবে আমার হাসিমুখ।’ তারপর একটু থেমে বললেন, ‘এর কারণটা কী জানিস?’
কীসের কারণ? সেটাও ব্যাখ্যা করলেন তিনিই।
বললেন, ‘এই সিসিটিভি ফুটেজে শুধু ভিসুয়াল থাকে। অডিও থাকে না। তার কারণ হল, কর্তৃপক্ষ জানে তারা বধির। আমাদের কোনও কথা কোনওদিনই তাদের কানে যাবে না। তাই তারা এতে অডিও সিস্টেমটা শুরু থেকেই রাখেনি। খরচ বেঁচে গেছে। আবার এমনও হতে পারে, কর্তৃপক্ষ হয়ত ভাবে আমরা সবাই বোবা। আমাদের আলজিভ কাটা। সেজন্যে তারা শুধু শুধু অডিও রাখার ঝামেলাই করতে যায়নি। ঠিকই করেছে। বোবা লোকের সামনে অডিও রেখে কী হবে। আবার তৃতীয় একটা সম্ভাবনাও রয়েছে। সেটা হল, হয়ত এই দুটোই সত্যি। কর্তৃপক্ষও বধির এবং আমরাও বোবা।’

শেষমেশ যখন সিসিটিভি ক্যামেরা বসল আমাদের নিউজ রুমে, তখন দেখা গেল একটা বড়সড় গোলমাল হয়ে গেছে ক্যামেরা বসানোয়। পুরো নিউজ রুম, স্পোর্টস সেকশন, নিউজ ইনচার্জের টেবল, সাব এডিটরদের সবক’টা ডেস্ক, অ্যাসোসিয়েট এডিটরের ডেস্ক, ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর এমনকী প্রুফ সেকশনও এতে কভার করছে। শুধু সাব এডিটরদের একটা রো-তে পাশাপাশি পরপর তিনটে ডেস্ক কী এক অদ্ভুত কারণে ক্যামেরায় আসছে না। সেই তিনটে ডেস্কের একটাতে বসতাম আমি। আমার ডানদিকে পরপর আরও দুজন। আমরা তিনজন গোটা নিউজ রুমে ক্যামেরার সমস্ত নজরদারির বাইরে। কী আশ্চর্য। সেটাই হল কথা। বাসরঘরে কোন ফাঁক দিয়ে যে কালকেউটে ঢুকবে, প্রতিষ্ঠান এখনও তা জানতে পারেনি।
কর্তৃপক্ষ কী ভাবে, প্রতিষ্ঠান কী জানে, আমি জানতে আগ্রহী নই। হাসপাতালে আমার বিছানার উলটো দিকে যে বেড়ালটা দুটো ছানার জন্ম দিয়েছে কদিন আগে— সেই বেড়ালটা সারাদিন গম্ভীর হয়ে চোখ বুজে বসে কী ভাবে, কী চিন্তা করে; কিংবা আমার বেহালার বাক্সে যে ছোট্ট সোনালি মাকড়সাটা কোনওভাবে ঢুকে পড়েছে, সে ওই বাক্সের লাল ভেলভেটের ওপরে সারাটা দিন-রাত বসে বসে কী ভাবে— ওদের চিন্তাজগৎ, ওদের ভাবনা জানতে আমি আগ্রহী। আমি জানতে আগ্রহী, পৃথা কখন আসবে। ক’দিন পর থেকে পৃথার সঙ্গে আর দেখা হবে না। অথবা হয়ত চিরদিন হবে। পৃথা কে? সে কি সেই মেয়েটা যাকে আমি হাসপাতালে মেল সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে নার্সের পোশাকে দেখেছি? নাকি সে অন্য কেউ, যাকে আমি আমার ভেতরে তৈরি করেছি। আমিই জন্ম দিয়েছি।

পরদিন সন্ধেবেলা সিনিয়র ডাক্তার এলেন। সঙ্গে সেই সুপুরুষ চেহারার দীর্ঘদেহী যুবা ডাক্তার। সব রিপোর্ট দেখে, আমার কেস হিস্ট্রি শুনে তিনি এখন অপারেশন না করার পক্ষেই মত দিলেন। ক্যালসিফিকেশনটা মেইন প্যাংক্রিয়াটিক ডাক্টে নেই। এর মাপও তুলনায় ছোট, চার এমএম। তিনি বললেন, ‘সাত এমএম পর্যন্ত আমরা নর্মাল বলি। অ্যাবনর্মাল হয় সাত এমএম-এর ওপরে হলে। তখন এলপিজে সার্জারির কথা ভাবা যেতে পারে। এখন ওষুধের ওপরেই থাকুন। ফ্যাটলেস ডায়েট করবেন। অল্প করে খাবেন। ক্রেয়ন চলুক তিন বেলা করে। তারপরেও ব্যথা হবে না তা নয়। মাঝেমাঝেই হবে। তখন হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। এটা টাইম টেকিং ব্যাপার। এখন অপারেশনে যাবেন না।’

যেদিন হাসপাতাল থেকে আমার ডিসচার্জ হবে, তার আগের রাতে পৃথার নাইট শিফট পড়ল। রাতে একইভাবে ট্রলি নিয়ে এলেন ইনজেকশন দিতে। আমার কারও সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছিল না। আমি শুধু চুপ করে বসে থাকতে চাইছিলাম। এই প্রথম তিনি এলেন মুখে মাস্ক না পরে। সন্ধের পর থেকে রাতের পুরো সময়টা মাস্ক নিলেন না মুখে। হয়ত শেষবার তাঁর মুখটা আমার ভেতরে, গভীরে ভালো করে গেঁথে দেওয়ার জন্যেই তিনি মুখের আবরণ সরিয়ে নিলেন। আমি তাকিয়েছিলাম গ্রিলের বাইরে। একটু আগে অল্প বৃষ্টি হয়ে গেছে। ভেজা ভেজা হাওয়ার গন্ধের মধ্যে বাইরে একটা অল্প উঁচু খুঁটির ওপরে বসেছিল একটা কাঠঠোকরা পাখি। আমি তাকিয়েছিলাম সেই অপূর্ব সুন্দর পাখিটার দিকে। তার গায়ে উজ্জ্বল নীল রঙের পালক। এই রাতে তাকে মনে হচ্ছে এক রাতঠোকরা পাখি। অথবা কোনও নীলপরী। রূপকথার অজানা জগৎ থেকে উঠে এসে বসেছে এই হাসপাতালের পাশে। তিনি এসে ইনজেকশন দিলেন।
আমি বললাম, ‘আপনার তো রিলিজ অর্ডার এল না। আমার এসে গেল।’
‘বাঃ!’ আমার ধমনীতে ইনজেকশন পুশ করতে করতে তিনি বললেন, ‘কবে?’
‘কাল সকালে’, আমি বললাম।
‘এর পরের বার যদি ভর্তি হও, তখন আর আমার সঙ্গে দেখা হবে না।’ তিনি বললেন।
আমাকে বলা পৃথার সমস্ত কথারই একটা ডুয়েল মিনিং রয়েছে বলে আমার মনে হয়। অথবা এমনও হতে পারে, পৃথার বলা কথার ইকোটাকে অনুসরণ করে আমার মস্তিষ্কের ভেতরে চলাচল করা পৃথা। তারপর সে ওই কথার অন্য আরেকটা অর্থ আমার সামনে এনে ফেলে। আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। কোন অর্থটাকে গ্রহণ করব, বুঝতে পারি না। আমার মস্তিষ্কের ভেতরে চলাচল করা পৃথার অস্তিত্বের খবরই জানে না বাইরের পৃথা। ঠিক যেমন সে জানে না তার কথার ইকোকে অনুসরণ করে আমার মস্তিষ্কে কোন অর্থের জন্ম হচ্ছে। অথবা সে সবটাই জানে। আমিই আস্ত একটা গাধার মতো এসব উলটোপালটা ভেবে মনে করছি পৃথা আসলে দুটো। একজন রয়েছে বাইরের জগতে, আরেকজন আমার মাথার ভেতরে। বাস্তবে হয়ত তা নয়। পৃথা হয়ত সত্যিই ডুয়েল মিনিং করে আমার সঙ্গে কথা বলছে। আর আমি সেটাকে আমার মস্তিষ্কসঞ্জাত ভেবে উজবুকের মতো কাজ করছি। আমাদের জীবনে জেগে থাকা সময়ের ঘটনাবলী আর আমাদের স্বপ্নের ঘটনাবলী যেমন আমাদের জীবন-প্রবাহের সঙ্গে সমান্তরাল রেখায় চলে; দু-রকমের দুটো পৃথা এবং তাদের দু-রকম অর্থবহ কথাগুলোও আমার সঙ্গে সঙ্গে সেইভাবে চলেছে। পৃথা কি এসব জানে? যদিও পরে আমার মনে হয়েছে, এসব কিছুই নয়। চারিদিকে এত শুকনো আর রোবট মানুষের রোবট কথার তোড়, এত ফালতু শব্দের ঝনঝনানি, সেখানে পৃথাকে দেখতে পাওয়া এবং তার কথা শুনতে পাওয়া মরুদ্যানের মতো শান্তিদায়ক। বিঠোফেনের সিম্ফনি আর নিখিল ব্যানার্জির সেতারের সঙ্গেই তার তুলনা চলতে পারে, এই জ্যান্ত নরকে যা একমাত্র স্বর্গীয়।
‘যদি নয়। ভর্তি তো হবই।’ আমি বললাম। তিনি কিছুই বললেন না। এগিয়ে গেলেন ট্রলি টেনে।
ট্রলি নিয়ে ফেরার পথে আমি তাঁকে হাতের ইশারায় একটু কাছে ডাকলাম। তিনি এগিয়ে এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে, আমার দিকে তাঁর সেই আগ্রহ ও উদ্বেগভরা চোখের দৃষ্টি।
আমি বললাম, ‘আমার একটা বেড পরে, এক্সট্রা ফোরের বাড়ির যে ছেলেটি আছে, সে ড্রিংক করে এসেছে। আজেবাজে কথাবার্তা বলছে। এই গন্ধেও আমার খুব সমস্যা হয়। আপনি একটু দেখবেন কী করা যায়?’
তিনি বললেন, ‘সে এখন এখানে আছে?’
‘না’, আমি বললাম, ‘আপনাকে আসতে দেখে সরে গেছে।’
‘এলে আমাকে বোলো।’ তিনি বললেন।
একটু পরে নার্স রুমের দরজার সামনে থেকে পৃথা আমাকে হাতের ইশারা করে জানতে চাইলেন ছেলেটি এসেছে কিনা। আমি হাতের ইশারা করেই বললাম, এখনও আসেনি। এরও কিছুক্ষণ পরে ছেলেটি এলে আমি নার্স রুমের সামনে গেলাম। পৃথা তখন ফোনে কথা বলছিলেন। আমি আস্তে করে তাঁকে বললাম, এসেছে। পৃথা আমার দিকে তাকালেন। একটুও কিন্তু বিরক্তিভরা তাকানো নয়। সে তাকানো দেখে মায়া জন্মায় মানুষের মনে। সে তাকানো দেখে এই পৃথিবীতে আরও অনেকদিন থেকে যেতে ইচ্ছে হয়। পৃথা কিন্তু বাইরে বেরিয়ে এলেন না। নার্স রুম থেকেই পুলিশ সেলের পুলিশকে ফোন করে বিষয়টি জানালেন। একটু পরেই সেখান থেকে পুলিশ এসে ছেলেটিকে বাইরে বের করে দিল।
কিন্তু এসব তো কেজো কথা। আমাদের সমস্ত কথার আড়ালেই থেকে যায় আরও অনেক কথা, যা আমরা কখনও বলে উঠতে পারি না। সেরকম কিছু কিছু কথোপকথন হয় কণ্ঠস্বর ব্যবহার না করেই। সেরকম কিছু কিছু কথোপকথন হয় চুপ করে। তিনি অন্যদের ইনজেকশন দিতে দিতে ট্রলি নিয়ে নার্স রুমে ঢুকে যাওয়ার পরও আমাদের কথোপকথন চলতেই থাকল। সেভাবেই। কণ্ঠস্বর ব্যবহার না করে। চুপ করে। অনেক রাত পর্যন্ত।
আমি বললাম, ‘আপনার খারাপ লাগছে না?’
‘খারাপ? কেন?’ তিনি বললেন। আমার মতোই একইভাবে কণ্ঠস্বর ব্যবহার না করে।
‘এই যে আজকের পর থেকে আমাকে আর দেখতে পাবেন না। এই ক’দিন ডে অফগুলোতে মনে হয়নি কাল গিয়ে যদি মানুষটাকে দেখতে না পাই?’
তিনি কিছুই বললেন না। চুপ করে থাকলেন।
‘এমারজেন্সির ডাক্তার’, আমি বললাম, ‘আমাকে মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি হওয়ার জন্য লিখেছিলেন। আমি তাঁকে ম্যানিপুলেট করে সেটাকে কেটে সার্জিক্যাল ওয়ার্ড করাই।’
‘কেন? আমাকে দেখতে পাবে বলে?’
‘কারণ’ আমি বললাম, ‘মেডিসিন দিয়ে আপনার দর্শনলাভ হবে না। আপনাকে দেখতে হলে সার্জারির ছুরি, কাঁচির কাটাছেঁড়া দিয়ে, যন্ত্রণা মাড়িয়ে মাড়িয়ে যেতে হবে। শুধু জল দিয়ে গিলে খাওয়া ওষুধের রক্তপাতহীন নিশ্চিন্ত পথে আপনাকে পাওয়া যাবে না। অ্যানাস্থেশিস্ট এসে অজ্ঞান করবেন— তারপর সেই চেতনহীন চৈতন্যে আপনার দেখা মিলবে— যেখানে আকাশ দেখে বোঝা যাবে না ঊষাকাল না গোধূলিবেলা। নাক দিয়ে টিউব ঢুকবে। ভেতরের সবকিছু বাইরে বেরিয়ে আসবে আপনার সামনে। কিন্তু আমি চাইলে বাইরে থেকে কিছু আমার ভেতরে নিতে পারব না। এক ফোঁটা জলও নয়। নিলে, তা আমার ভেতরে পৌঁছুবে না। বেরিয়ে আসবে নাক দিয়ে ঢোকা টিউবের পথ ধরে। আপনি সব লুঠ করে নিয়ে চলে যাবেন আর আমি তছনছ ও খালি এবং ফাঁকা হয়ে পড়ে থাকব একটা শূন্য বয়ামের মতো।’
কথা ঘোরানোর জন্য আমি বললাম, ‘এই যে ঘন ঘন ডিউটি আওয়ার বদলে বদলে যায়, শিফট পালটে যায়, বডি ক্লক গোলমাল করে না? আমি জানি, আপনি হয়ত বলবেন, প্রথম প্রথম অসুবিধে হত। এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। কিন্তু আমি আপনার কাছে একটু গোছানো উত্তর আশা করছি।’
‘নিজেকেই তো এখনও গোছাতে পারলাম না’, তিনি বললেন, ‘তোমার প্রশ্নের উত্তর আমি কীভাবে গোছাব বলো। তোমার তো তবু একটা কারণের মতো কারণ আছে। আমার কী কারণ বলো তো?’
‘ইউনিফর্ম পরে থাকতে হয় কতক্ষণ। সুন্দর সুন্দর জামাকাপড়গুলো পরা হয় না। খারাপ লাগে না?’
‘জামাকাপড় ছাড়াও যে পৃথিবীতে অনেক সুন্দর জিনিস রয়েছে, তা কি তোমার জানা নেই?’
‘কীরকম সুন্দর?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘তোমার সঙ্গে এই যে কথা বলছি, এরকম।’
সাহস করে বললাম, ‘আমার একটা নতুন লেখায় আমি আপনাকে লিখছি।’
‘তুমি আমাকে নিয়ে লিখছ? না, তুমি তা পারো না। এটা আন-এথিক্যাল।’
‘আমি আপনাকে নিয়ে কিছু লিখিনি। আমি আপনাকে রচনা করেছি। আই অ্যাম নট রাইটিং অ্যাবাউট ইউ। আই রোট ইউ।’
‘কেন?’
‘বিকজ ইউ আর লাইক নোবডি—’
‘নোবডি?’
‘ইয়েস। ইউ আর লাইক নোবডি সিন্স—’
‘সিন্স হোয়াট?’
‘সিন্স আই লাভ ইউ।’
অনেকক্ষণ পরে বললাম, ‘অসুখের, যন্ত্রণার দিনগুলোকে এত সুন্দর, এত কাঙ্ক্ষিত করে তুলেছিলেন আপনি— এর আগে আমি জানতামই না অসুখ এত সুন্দর।’
‘তাই তুমি হাসপাতালের দিনগুলোকে অমরত্ব দিলে?’
‘দিলাম। আমরা দুজনে মিলে অমর করে দিলাম এই দিনগুলোকে।’
‘তোমার খারাপ লাগছে? আর দেখা হবে না বলে?’ পৃথা বললেন।
‘থা খোয়াবসে খয়ালকো তুঝসে মুয়ামলা, যব আঁখ খুল গই, না জিয়াঁ থা না সুদ থা।’
‘এর মানে কী?’
‘গালিবের কবিতা। মানে বলা মুশকিল।’ আমি বললাম।
‘তাও শুনি, কী মানে।’
‘তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়েছিল স্বপ্নের ভেতর। তাই যখন চোখ মেললাম, তখন না রইল কোনও লাভ— না কোনও লোকসান।’
‘এই হল পুরুষ জাত’, পৃথা বললেন, ‘ভাঙবে তবু মচকাবে না। এদিকে বুক ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু তবু মুখে বলবে আমার লাভ হল না ঠিকই, কিন্তু লোকসানও হল না।’
‘নিজের ভাগ্য দেখে আসলে আমি নিজেই জ্বলে যাচ্ছি ঈর্ষার আগুনে।’ আমি বললাম।
‘কেন?’
‘আমি যে কখনও নিজেকে দেখিনি। আপনি তাকালেন বলে আমার নিজেকে দেখা হল, আপনার চোখে।’

শেষ রাতটা আমরা বলতে গেলে একসঙ্গেই কাটালাম। পাশাপাশি ঘরে। আমার বিছানার পাশেই দরজার ওপারে, দেওয়ালের ওপাশে নার্স রুম। সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের পাশে যে গেটটা সারাক্ষণই বন্ধ থাকে, সেখানে চা নিয়ে বসে হরি। খুব সকাল সকাল, সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আমি ওই গেটটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। হরি তখন সবেমাত্র দোকান শুরু করছে। একটা একটা করে কোলগেট টুথপেস্টের ছোট প্যাকেট সাজিয়ে রাখছে হাসপাতালের সিঁড়িতে। তার পাশে টুথব্রাশ। তার পাশে চিরুনি। তার পাশে কাপড় কাচার ডিটারজেন্ট পাউডার। পাম্প স্টোভে কেটলিতে চায়ের জল গরম করছে। লম্বা একটা প্লাস্টিকের বয়াম থেকে তাতে চিনি ঢালল। একজন একটা জলের বোতল কিনে ১০০ টাকার নোট দিল। পরে খুচরো হলে বাকি টাকা নেবে বলল। চিনি দেওয়া চায়ের জল গরম হলে সেটা একটা সসপ্যানে ঢেলে আবার স্টোভে চাপাল হরি। তারপর ঝিরিঝিরি করে আদা কুচি করতে শুরু করল। আদা কুচি হয়ে গেলে হাতের আঙুলে লেগে থাকা আদার কুচিগুলোও ঝেরে দিল পাত্রে। চা তৈরি হওয়ার পর, আর এক-এক করে হাতের কাজগুলো সেরে তারপর সেই ১০০ টাকাটায় হাত দিল হরি। টাকাটা তুলে প্রথমে সেটাকে পুরো মেলে ধরে একবার দেখল। তারপর স্টোভের আগুনে আর স্টোভের গায়ে একবার ছুঁইয়ে প্রণাম করে সেটাকে বাক্সে ভরল। একজন রুগি দাঁড়িয়ে ছিল গেটের সামনে। তার হাতে স্যালাইনের বোতল। হরি জিজ্ঞেস করল, তোমার কী চাই? কিছু না লাগলে যাও বেডে যাও। লোকটা চলে গেল তার বিছানার দিকে।

সকাল ছ’টায় ইনজেকশনের ট্রলি নিয়ে তিনি এলেন আরেকজন সিস্টারের সঙ্গে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘ব্যথা আছে গো?’ আমি শুধু বললাম, ‘না’। এ-ই আমাদের শেষ কথা। আমার শেষ বাক্য, ‘না’। তিনি ট্রলি নিয়ে গেলেন পরের রুগিদের কাছে। আমি যেন পুরো বোবা হয়ে গেছিলাম। ভেতরে কথার সমুদ্র উঠছে। কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারলাম না। আমার জিভ ভারী হয়ে গেল। আমি আড়ষ্ট হয়ে গেলাম। যে কাঠকে ঠোকরায় কাঠঠোকরা, সেই কাঠের মতো নিশ্চল। নিশ্চুপ। স্থির। শান্ত। আমি ভাবছিলাম, পৃথাকে আমার কী বলা উচিত? কিছু কি বলা উচিত? এখন এটুকু বয়সে এসে বুঝতে পারি, আমি যাকে ভেবেছি, সে অন্য কেউ। অন্য কোনও জগতে তার বাস। সে আমার মাথার ভেতরে তৈরি হওয়া একটা আইডিয়া, যাকে আমি পৃথার নাম দিয়েছি। পৃথা এবং পৃথা সম্পর্কে আমার ভেতরে জন্ম নেওয়া আইডিয়া— দুটো কি এক? কী লাভ আমার আইডিয়ার ভূত তার মাথার ভেতর ঢুকিয়ে! এক রোগে একজন পাগল হচ্ছি হই। দুজনে পাগল হওয়ার কী দরকার। বিজ্ঞান বলে, বস্তুর কখনও ধ্বংস হয় না। রূপান্তর হয়। পাণ্ডুলিপি পোড়ালে ছাই। পাণ্ডুলিপি কি ধ্বংস হল? হল না। ছাইতে রূপান্তরিত হল। সম্পর্কও বোধহয় তাই। ধ্বংস হয় না। তার রূপান্তর হয় শুধু। একটা সম্পর্কের ভেতর ঢুকে থাকে আরও অনেকগুলো সম্পর্ক। সব সম্পর্কের নাম দেওয়া যায় না যদিও। নামহীন এই চলায়, কে জানে, আমরা হয়ত কোনওদিন আমাদের চমৎকার বন্ধুও হয়ে উঠব। অথবা, অন্য কিছু। নামহীন সময়ই সেসব জানে। আমাদের সম্পর্ককে অতিক্রম করে চলে গিয়েও সেদিন আমরা হয়ত এর একদা অস্তিত্বকে অস্বীকার করব না। স্বপ্ন তো স্মৃতিরই একটা অংশ। আর তারও বাস্তবতা আছে, যে বাস্তবতা জীবনের থেকে আলাদা। কিন্তু তার শেকড় থাকে জীবনে। জীবনের বাস্তবতার মতো স্বপ্নের বাস্তবতাও আমরা স্বীকার করে নিয়েছি। কল্পনা দিয়েও সত্য প্রকাশ সম্ভব। কারণ বাস্তবের চেয়ে সত্য অনেক বড়। জীবনের বাস্তবতাকে বুঝতে কল্পনা ও স্বপ্নের অতটা প্রয়োজন হয়ত নেই। ঠিকই। কিন্তু জীবনের সত্যের কাছে পৌঁছুতে হলে, স্বপ্ন আর কল্পনা, এই দুটি মেয়ের হাত আমাদের ধরতেই হবে।
পুলিশ সেলে দুজন রুগিকে ইনজেকশন দিলেন তিনি। ফের ট্রলি ঘুরিয়ে আমার সামনে দিয়ে ঢুকে গেলেন নার্স রুমে। যেতে যেতে সঙ্গের সিস্টারকে বললেন, ‘আমি যাব।’ সিস্টার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায়?’ পৃথা বললেন, ‘হরির কাছে।’ ‘কে হরি?’ সিস্টারের ধৈর্যহীন গলায় প্রশ্ন। পৃথা বললেন, ‘ওই যে গেটের সামনে চা নিয়ে বসে।’ পৃথা কি এই কথাটা আমাকেই বললেন না? আমার মনে হল, আমাকেই বললেন, ‘আমি যাচ্ছি গেটের সামনে হরির চায়ের দোকানে। ওখানে তুমি এস।’
আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন তিনি হরির চায়ের দোকানে যাবেন আমার বিছানার সামনে দিয়ে। তিনি এলেন। আমার সামনে দিয়ে হরির দোকানে গেলেন। আমি গেলাম না। আমার শরীরের নীচ দিয়ে যেন শেকড় গজিয়ে গেছে। আমি উঠতে পারলাম না। পৃথা, আপনি এসে আমাকে হাত ধরে টেনে তুলুন। বলুন, ‘বসে আছ কেন? চলো আমার সঙ্গে।’ একটু পরে তিনি দু’ হাতে দু’ গ্লাস চা, একটা লাল চা, একটা দুধ চা নিয়ে আবার আমার সামনে দিয়েই নার্স রুমে ঢুকলেন। আমি তাঁকে ডেকে কথাও বললাম না। ওয়ার্ডের বারান্দার কোণে আবারও তাঁর সঙ্গে আমার মুখোমুখি দেখা হল। আমি তখন বাথরুম থেকে ফিরছি। আর তিনি নার্স রুম থেকে বেরিয়ে সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের ঘরে ঢুকছেন। আমি তাঁর মুখের দিকেই তাকাতে পারলাম না।
সকাল ৮টার কিছু আগে আবার তাঁকে দেখলাম। আমি তখন বিছানায় বসে আছি, নার্স রুমের দরজার দিকে মুখ করে। বেড়ালগুলো প্রতিদিনের মতো এদিনও খেলে যাচ্ছে। অন্য দিন আমি কত মন দিয়ে ওদের খেলাধুলো দেখি। এদিন কিছুই ভালো লাগছে না। অল্প বৃষ্টিতে গরম হাওয়া কমে গেছে অনেক। বৃষ্টি হলেই আমি বাইরে তাকাই। এদিন আমি কিছুই দেখলাম না। আমি শুধু তাঁর দিকে তাকিয়েছিলাম। তিনি ওই দরজা দিয়ে বেরিয়েই আমার দিকে একবার চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। আমি চমকে উঠলাম। এ আমি কী দেখছি! যেদিন এই হাসপাতালে ঢুকি, সেই রাত ৮টার দিকে, আমাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আবার?’ তখন তিনি যে পোশাকে ছিলেন, গাঢ় সবুজ রঙের চুড়িদার— এদিনও তিনি ঠিক সেই পোশাকে। আমার আসার সময় যেভাবে ছিলেন, আমার যাওয়ার সময়েও ঠিক একইভাবে দেখা দিলেন। একই পোশাকে। নার্স রুমের কোণের জায়গাটায় বেড নম্বর এক্সট্রা ওয়ান। সেই পেশেন্টের চেস্ট বেল্ট কেটে দিলেন। সকাল ঠিক ৮টায় তিনি বাড়ি ফিরছেন। আমি একইভাবে বিছানায় বসে। সেই গাঢ় সবুজ চুড়িদার পরে আমার সামনে দিয়েই তিনি গেলেন। যেতে যেতে আমার কাছাকাছি এসে যেন অন্য কিছু একটা বলতে গিয়ে সেটা বলতে না পেরে বেড়ালগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘সারাক্ষণ তিড়িং বিড়িং তিড়িং বিড়িং। আর কোনও কাজ নেই।’ বাক্য দুটো কেমন যেন অমনোযোগে বলে ফেললেন। নয় কি? এভাবে তো তিনি কথা বলেন না। যে কথাটা ভীষণভাবে বলার ছিল সেটা মুখ ফুটে বলতে না পেরে আমরা যখন অন্য কিছু একটা আলগাভাবে বলে ফেলি, এ যেন সেইভাবে বলা। আমরা কেউই কারুর চোখের দিকে তাকাতে পারলাম না। কেউ কাউকে কিছু বলতেও পারলাম না। আমাদের সমস্ত কথাই বাকি থেকে গেল। আমি তাঁর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। লম্বা টানা বারান্দা ধরে তিনি হেঁটে গেলেন। এবং আশ্চর্যের সীমা না রেখে কিছুক্ষণ পরে ছুটতে ছুটতে ফিরে এলেন। আমি দেখতে পাচ্ছি পৃথা আমার দিকে ছুটে আসছেন। আমার কাছাকাছি এসে ওভাবেই প্রায় ছুটতে ছুটতে বললেন, ‘দেখেছ, ঘরের চাবি ফেলে গেছি।’ আমাকে কি আরেকবার সুযোগ দিলেন তিনি? নাকি তিনিও আজ অমনোযোগী? ঘরের চাবি ফেলে যাওয়া কি তাঁর মন খারাপের ভুল?

একটু বেলার দিকে, ১০টা নাগাদ হাসপাতাল থেকে যখন বেরিয়ে আসছি, এমারজেন্সির সেই গেটের সামনেটায় এসে দাঁড়িয়েছি। অল্প ঝিরিঝিরি বৃষ্টি তখন। এমারজেন্সির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে একটা নেপালি মেয়ে। নার্সের পোশাক পরা। সঙ্গে ছাতা নেই। বারবার বাইরে হাত মেলে সে বুঝে নিতে চাইছে বৃষ্টিটা কত ঘন। কিছুক্ষণ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকার পর সে হঠাৎ ঝপাং করে লাফ দিল নীচে। জল ছিটে লাগল তার শাদা জামায়। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে মেয়েটা এক পা এক পা করে বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে গেল আউটডোরের দিকে। তার সঙ্গে ছাতা নেই। যারা লোহার মানুষ তারাই শুধু বৃষ্টিতে ছাতা নিয়ে বের হয়। কারণ লোহায় জল পড়লে মরচে ধরে। রক্তমাংসের মানুষ বৃষ্টি আর চাঁদের আলোই গায়ে মাখতে জানে। মেয়েটা বৃষ্টির মধ্যে হালকা গলায় একটা নেপালি গান গাইতে গাইতে যাচ্ছে, ‘ফুলকো আখামা ফুলোই সনসারা, কারাকো আখামা কারাই সনসারা।’

(সমাপ্ত)

লেখাটি যদি ভালো লাগে, আবহমানে নিজের ইচ্ছেমতো ফোন পের মাধ্যমে
অবদান রাখতে পারেন, এই কিউ আর কোড স্ক্যান করে। ফোন পে করুন 9051781537
অথবা স্ক্যান করুন পেমেন্টের লিংক

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
410 Gone

410 Gone


openresty