স্রোত <br /> শেষ দুই পর্ব <br /> যশোধরা রায়চৌধুরী

স্রোত
শেষ দুই পর্ব
যশোধরা রায়চৌধুরী

২২

ফ্লো মানে স্রোত

মানসী ফোন হাতে করে দাঁড়িয়েছিল। নিজের স্টেশন ছাড়িয়ে তিনটে স্টেশন পর এই হরিপুর। লোক কম। বাসরাস্তাও দূরে। এই লাইনে কখনো আসেনা।

আচ্ছা, বাড়ি থেকে আরো দূরে চলে যাচ্ছে মানসী? অমিতকে ফোন করতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। মনে হচ্ছে কাজটা ঠিক হল না।

স্বপন বলেছিল আসবে। এল না তো?

মানসীকে ওর স্বামীর মুখ দূর থেকে হাতছানি দিচ্ছে। ছেলেটার মুখ আরো কাছে থেকে ডাকছে। এত ডাক, এত কাতর কাছে টানা, সব উপেক্ষা করে, কী করে দূরে চলে যাচ্ছে মানসী?

কাছে রেল পুলিশের লোক দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা জায়গা জুড়ে বালির বস্তা রেখে আড়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন খাকি উর্দিধারী। বিপদ বুঝলে, মানসীও তো ওদের কাছে সাহায্য নিতে পারত।

সে বিপদ এই বিপদ নয়। সে বিপদ দেশলাইয়ের আগুন অথবা ছোটখাটো একটা বান। কিন্তু বিপদ যখন সমুদ্রের ঢেউ হয়ে যায়, আগুনের গোলা হয়ে যায়, মাথা একেবারে গুলিয়ে যায়।

স্বপন বলেছিল মানসীর বরকে বলে দেবে। বলে দেবে বাড়ি বানানোর চক্করে, কিছু টাকা কম পড়ায়, মানসী গিয়েছিল ওদের গুদোমে। গুদোমের পেছনের ঘরটায় স্বপন মানসীকে নিয়েছিল, ঘেঁষের টাকা মেটাতে পারবে না বলেই দায়ে পড়ে মানসী তখন এই ভয়ানক ব্যাপারটা চেপে গেছিল।

তারপর থেকে ক্রমাগত টাকা নিয়ে গেছে স্বপন তার কাছে। কত টাকা যে দিয়ে গেছে শুধু বিধানের মুখ চেয়ে মানসী।

শেষদিন মানসী রেগে উঠেছে, আর পারেনি সহ্য করতে। বলে দিয়েছে, কিচ্ছু পাবে না আর। যা খুশি কর গে যাও। বলে দাও তোমার বিধানদাকে। কিচ্ছু এসে যায়না আমার। আর বেশি বাড়াবাড়ি করলে, পুলিশে খবর দেব আমি।

বলেই মনে হয়েছিল, ভীষণ ভুল করে ফেলল না ত?

ততক্ষণে স্বপনের গলা পালটে গেছে। সেই তেজ আর নেই। নরম হয়েছে। বলেছে, টাকা লাগবে না। তুমি শুধু একবার এসো। দেখা করব। আমার বউ মাগিটা খুব ঝাম করে রেখেছে। বাড়ি যাচ্ছি না অনেকদিন। হরিপুরের দিকে একটা ছোট ঘর নিয়েছি। আমাকে একটু লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। তার আমি কি করব? তেজ কমে এসেছে মানসীর। তবু চোপা করেছে। তোমার বদ স্বভাব, বউ জানতে পারলে এমনি এমনি ছেড়ে দেবে, না? বোঝ এখন।

ওইরকম বল না। তোমার ঠান্ডা আঁচলে একটু জায়গা হবে না গো? তোমাকে না দেখে ভাল থাকিনা আমি। সত্যি বলছি। এসো।

কষ্ট হয় মানসীর। খুব কষ্ট। চোখে জল আসে। ঠোঁট দাঁতে চেপে সে দাঁড়িয়ে আছে। স্বপন আসতে বলেছিল , না এসে পারেনি। এসে ভুল করল না তো।

এখনো পাপী মন তার। এত খারাপ ছেলে, এত মন্দ লোক স্বপন। তবু সে কেন যেন মনের ভেতর থেকে স্বপনকে ফেলে দিতে পারেনা। কেন যে পারেনা।

এখনো রাতে পেশেন্ট দেখতে দেখতে মনে পড়ে, একদিন স্বপন তাকে কীরকম হাত চেপে ধরেছিল। কতটা মরদের মত। গায়ে ঘাম আর বিড়ি মেশানো উগ্র গন্ধ। স্বপনের বুকটা ভাবে ও। কান্না পায়।

দুটো লোক এসে দাঁড়ায় তার দু পাশে।

অস্বস্তিতে, ভয়ে কাঁটা হয়ে দুদিকে তাকায়।

খুব আস্তে লোকদুটো তাকে বলে, চলো।

তারপর তারা চলতে থাকে।

অন্ধকারের দিকে। মানসী সিঁটিয়ে যেতে যেতে ভাবে, আচ্ছা স্বপন সত্যি আছে তো , যেখানে ও যাচ্ছে?

হয়ত নেই। হয়ত এই লোকদুটোকে স্বপন পাঠিয়েছে, ওকে গুম করে দেওয়ার জন্য। জানে না মানসী। জানতেও চায় না।

ফোনটা বার করে ও, ছেলেকে একবার ফোন করবে বলে।

হঠাৎ ফট করে পাশের ষন্ডা মত লোকটা হাত বাড়িয়ে ওর ফোন কেড়ে নেয়, এই খানকি, ফোনটা দে!

ফোনটা টেনে নিয়ে ছুঁড়ে পাশের জলায় ফেলে দেয়। কচুরিপানার মধ্যে আস্তে আস্তে ডুবতে থাকে ফোন।

ওহ, ওই ফোন কত কষ্টে নিজের টিউশনির টাকা জমিয়ে জমিয়ে ছেলে আমাকে কিনে দিয়েছিল গো!

অন্য লোকটা ওর কোমরে হাতের বেড় দেয়। বলে , ফোন দিয়ে কী করবি। এখন তুই অনেক দূরে যাবি। ওখানে মোবাইলের টাওয়ার নেই।

পুলিশটাকে ছাড়িয়ে অনেকটা চলে এসেছে মানসী এখন। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে। দেবে নাকি এক ছুট। এখনো দরকার পড়লে বাস ধরতে দৌড় লাগায়। ভিড়ের ভেতর চেঁচিয়ে রাস্তা করে নিতে পারে। অত সোজা?

মানসী উল্টোদিকে ফিরে ছুটতে শুরু করে আচমকা।

এ্যাই , এ্যাই , পালাল! দুটো স্যাঙাত, স্বপনের , ওর পেছনে আসতে থাকে।

মানসী জানে, কাঠের মত পুলিশখোকাটা দাঁড়িয়ে থাকবে, ওর জন্য একটা আঙুলও তুলবে না। মাথা নিচু করে ও পাশের লোহার বেড়াটার তলা দিয়ে গলে নিচে নেমে যেতে থাকে। নয়ান জুলিতে। দূরে একটা ছোট জটলা, আগুনের ধোঁয়া, চায়ের দোকান। একবার ওদিকে গেলে, আর ওকে পায় কে।

২৩

প্রথমা অটোতে উঠেছিল। একেবারে ধারের সিট তাই বাঁচোয়া। দুই মক্কেলের মাঝখানে আটকে গেলে সে এক যাতনা। ওর পাশে এক উশখুশে তরুণী, তার পাশে এক সুদর্শন পুরুষপুঙ্গব । নিজের জগতে দুজনেই ব্যস্ত। একজন মোবাইলে চোখ, আরেকজন গান শুনছে। কানে ইয়ারপড, মাথা আর পা সূক্ষ্মভাবে গানের সঙ্গে তাল দিচ্ছে। পায়ে দামি স্নিকার। ছেলেটা নিজের ভেতরে নিমগ্ন। এটাই এটাই আজকের প্রজন্ম।

সুনন্দনাও ছেলেটার পথ অনুসরণ করল। আশেপাশের মানুষ জনকে উপেক্ষা করার সহজ উপায় বেরিয়েছে এখন। কানে কানগুঁজি আটকে নেওয়া। কানগুঁজি শব্দটা স্বস্তিকা বলেছে। ওর বাড়ির বিশ্বস্ত আয়া কাম রাঁধুনি কাম সর্বকর্ম পটিয়সী মানসীর থেকে আসা শব্দ। খেটে খাওয়া মানুষের মুখের ভাষা নিয়ত বিবর্তিত হচ্ছে। একটা অদ্ভুত জীবন্ত ব্যাপার আছে শব্দগুলোতে। ইয়ারপডের বাংলা।

সুনন্দনার একটা ওয়াটস্যাপের ভয়েস শুনে নিচ্ছিল কাজে যাবার ফাঁকে প্রথমা। সুনন্দনা নিজের কথা ফাঁক ফোকরে এভাবে বলে রেখে দেয়। মা তার নিজের সময়ে শুনে নেবে । মামসু, আমার খুব মন খারাপ। বাড়ি যাব কবে জানিনা। বাড়ি মানে ত আমার এখন দুটো বাড়ি।

প্রথমার এমনিতেই মন ভাল ছিল না। সুনন্দনাকে ও ভয়েস করে না। অটোতে বসে ভয়েস করা যায়না। লেখে, আমিই তোর ওখানে আসব শিগগিরি। আমরা দুজনে মিলে তোর ওই শহরটায় ঘুরব। জুবিলি হিলস এ বিরিয়ানির দোকানের খোঁজ পেয়েছি একটা । সেখানে বিরিয়ানি খাব। আগে এদিকে একটু গুছিয়ে নিই সোনা। জানি তোদের সবাইকে অসুখী করেছি আমি। সবাইকে কষ্ট দিয়েছি। তবু আমি এই জীবনটা কাটিয়ে যেতে চাই। আমার আঁধার ভাল।

সুনন্দনার কাছে মেসেজ পৌঁছতেই ওটার দুটো টিক নীল হয়ে যায়। সিন হয়েছে। সুনন্দনা তার মানে জেগে আছে। ক্লাস না থাকলে সচরাচর ও এত সকালে ওঠে না। রাত তিনটে অব্দি মোবাইলে বা ল্যাপটপে থেকে তারপর ঘুমায়। মনে মনে মায়ের কর্তব্যবোধে হিসেব করে নেয় প্রথমা। আজ ওর সকালে ত ক্লাস নেই। তাহলে কি মন ভাল নেই বলে সারারাতই ঘুমায় নি মেয়ে? সকালের ঘুমভাঙা গলায় সুনন্দনা ওকে গানটা পাঠায়, নিজে গেয়ে , রেকর্ড করে। ভয়েস মেসেজে।

অটোতে বসেই, চোখ বন্ধ করে সুনন্দনা শোনে। ও আমার আঁধার ভাল। আলোরে যে লোপ করে খায় সেই কুয়াশা সর্বনেশে।

বিষাদে ডুবে যেতে যেতেও ভেসে ওঠে প্রথমা। ও জানে , এ পৃথিবীতে খুব বেশি সুখী মানুষ নেই। তবু সুখ আছে। মেয়েদের জীবন অদ্ভুতভাবে জটিল হয়েছে এই সময়ে এসে। তবু এভাবেই প্রতিটি দিন অন্ধকার ঠেলে যেতে হবে। এভাবেই নিজেকে বারংবার পথ খুঁজে বার করতে হবে। শুধু প্রথমাকে না, ব্রেকাপ থেকে ব্রেকাপে যেতে যেতে সুনন্দনাকে, বর বাচ্চা সামলে চাকরি সামলে নিজের জীবনকে একটা সফল জীবন করে তুলতে চেষ্টা করা স্বস্তিকাকে, তার বন্ধু অবনীকেও… একটা স্টপে অটো থামতে অটোওয়ালা ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের বাইরের প্রান্তে বসা ছেলেটাকে বলে, দাদা নেমে সামনে এস। দুবার বলতে হয়। কান থেকে গুঁজি খুলে ছেলেটা অবশেষে শুনতে পায়। দ্রুত নেমে ড্রাইভারের পাশের চিলতে মত সিটে পাছা ঠেকিয়ে বসে। একটি ফাটা রেক্সিনের ব্যাগ হাতে, গোলগাল বউ, সারাশরীরে পরিশ্রমের চিহ্ন, এসে ওঠে। মেয়েটিকে দেখে প্রথমার আবার মনে হয়, সে ত প্রিভিলেজড, অবনী বা স্বস্তিকাও প্রিভিলেজড। এই যে বউটি, গলার চেনে দুটো সেপ্টিপিন, বুকের খাঁজে ছোট্ট মানিব্যাগে খুচরো বার করে দিয়ে রাখছে অটোওয়ালাকে, অটো স্টপে থামতে না থামতে দৌড়তে হবে। প্রয়োজনে অটো চেপেছে, দেরি হয়ে গেছে কাজের জায়গায়। নইলে হেঁটেই মেরে দিত। মুখে উফ আফ , স্বগতোক্তি চলছেই বউটির। বাবা রে, এত্ত লেট করল ট্রেনটা। কুয়াশার জন্য সব ট্রেন লেট নাকি গা !নাকি বেছে বেছে আমারটাই । মরণ! আজ মালিক ত টাকা কেটে নেবেই , তাড়াতাড়ি চল্‌ রে ভাই। বালিগঞ্জ স্টেশনে নেমে লাইনের অটো নিয়েছে। এ ত প্রিভিলেজড নয়। সারাদিনের হাড় ভাঙা খাটুনি খেটে সন্ধেবেলা বাড়ি যাবে। আবার ট্রেনে চেপে ধিকির ধিকির করে ফিরে যাবে পিয়ালিতে…

সেইদিন স্বস্তিকা অবনী র কথা বলছিল। অবনীর বিয়ে ভাঙ্গার গল্প আর প্রথমার গল্পে ও বোধ হয় জোর করে মিল টানার চেষ্টা করছিল। তাতে অবাক হয়নি প্রথমা। ইন ফ্যাক্ট, আজকাল যে কোন মেয়ে, সে তার শ্রেণীচরিত্রের শিক্ষিত মেয়ে হোক বা গ্রাম মফস্বলের কলকাতার প্রাচীনপন্থী বাড়ির বৌমা, যে কারুর সঙ্গে তার জীবনের গল্প আদানপ্রদান করতে বসলেই এই ব্যাপার হয়। সবটা দেখা, জানা মনে হয়।

ও বুঝতে পারে, কারুর গল্পই আলাদা নয়।সব কাহিনি কোথায় যেন ঘুরে ঘুরে সেই এক। কোন তফাৎ নেই।

সেটাই অদ্ভুত। তাহলে গত পনেরো বা কুড়ি বছর ও বোকার মত বিভ্রান্ত হয়ে, একা একা ঝেলল কেন? ঝেলা- শব্দটা হিন্দি থেকে বাংলায় এসে ঢুকেছে। সহ্য করার অপর নাম ঝেলনা। এই যে কুড়ি বছর ধরে, “এসব আমারই প্রব্লেম, আমারই হচ্ছে” বলে মুখ গুঁজড়ে পড়ে সংসারের নানা অদ্ভুত ধাক্কা সহ্য করল, কারুর সঙ্গে শেয়ার করার সাহসটুকু পেলনা, এই নীরব অত্যাচারটাই কি তাহলে সমাজের কল? যন্ত্র? এই যন্ত্রে সবাই একা, সবাই ভাবে আমি তো একাই বেখাপ্পা, মানিয়ে নিতে পারছি না, এ আমারই লজ্জা। সবাই নিজের মত অ্যাডজাস্ট করে শুধু।

পথ খুঁজতে থাকে একা। কারণ কোন পথ বলে দেওয়া নেই। অন্ধকার সমুদ্রে একা একা মাতাল তরণী নিয়ে দুলতে দুলতে চলা , অনেক দূরে দুর্ভেদ্য দিকচক্রবালের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করা, পার আছে কোনদিকে?

আরো মজার কথা আছে।

পথ খোঁজা আর পথ পাওয়া , এইভাবে কুড়ি বছর কাটিয়ে তারপর বোঝা যায়, এক প্রজন্ম নিজের মত করে খুঁজে পেয়েছে পথ, কিন্তু তা অন্য প্রজন্মের কাজে আসছেই না আর। কারণ যতদিনে তুমি খেলার সব নিয়ম শিখে উঠবে, অল দ্য রুলস অফ দ্য গেম উইল বি চেঞ্জড। তোমার পরের প্রজন্মকে আবার নতুন করে সেই নতুন খেলার নতুন নিয়মগুলো শিখে উঠতে হবে!

প্রথমা যা পেরেছিল, নিজের যৌবনে যতটা আবিষ্কার করতে পেরেছিল এই সবুজ নীল গ্রহকে, শস্যশ্যামলা পৃথিবীকে, চোখের সব রং মরে আসতে আসতে সেই ফাইটিং স্পিরিট যখন প্রায় অপসৃয়মান, তখন সে দেখছে, তার মেয়ে সুনন্দনাও তো লড়ছে নিজের মত করে।

অন্তত প্রথমাদের জীবনে তো এইসব ছিল না। ফেসবুকে নিজেকে সিঙ্গল বা এনগেজড দেখানো, চুমু খাওয়ার ছবি সাঁটানো। এসব দিয়েও কত নতুন বঞ্চনা নতুন আঘাত তোইরি হচ্ছে, হয়ে উঠছে ক্রমাগত।

মানুষের, বিশেষ করে মানুষীর, দুঃখ পাবার কি আর শেষ নেই গা?

প্রাচীন মাসিপিশিদের মত, বালিগঞ্জ স্টেশনের থেকে দৌড়ে এসে ওঠা ঐ বৌটার মত, “গা” শব্দটা টান দিয়ে বলে প্রথমা মনে মনে। এটাই এখানে যেন কাজে আসে। এসে যায়।

এক প্রজন্মে সবকিছু পাল্টে গেল, কিন্তু লড়াই পাল্টালো না। আজও নির্ভয়া রেপড হয়। আজো মেয়েদের ধর্ষিত হলে শুনতে হয়, নিশ্চয় কিছু দোষ তারও ছিল। অবাধে ভিক্টিম ব্লেমিং চলে।

অথচ সেদিনই ইউটিউবে একটা ভিডিও পাঠাল সুনন্দনা ওকে। তাতে দেখল একটি তরুণী মেয়ে কমেডিয়ান, যাকে বলে স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান, কী স্মার্ট একটা মেয়ে, জড়তাহীন, সকলের সামনে বলে যাচ্ছে, পিরিয়ডস নিয়ে, স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে রসিকতা… নারীবিরোধী রসিকতা না। মেয়েদের রোজকার জীবনের অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতা নিয়ে। ব্রা কিনতে গিয়ে দোকানদার কীভাবে বুকের দিকে তাকিয়ে মাপ বলে দিচ্ছে ! কত খুচরো টাটকা অপমান। সব অভিনয় করে দেখাচ্ছে… আর কুটিপাটি খাচ্ছে জনগণ। জনগণ মানে নানা টেবিলে বসা মেয়েরা, তরুণেরা… তরুণ তরুণীরা সবাই কি এখন অনেক বেশি জেন্ডার কনশাস না? ওরা ত এল জি বি টি কিউ নিয়ে স্পষ্ট অবস্থান নেয়। সুনন্দনারা বিশাল বড় প্রাইডে হাঁটে, রামধনু রঙা পতাকা টাঙায় ঘরে, ওদের ক্যুইয়ার বন্ধুদের গ্রুপ আছে। ওরা নিজেদের সেক্সুয়ালিটিকে এক্সপ্লোর করে, আবিষ্কার করে, হেঁটেঘুরে পরখ করে দেখায় মেলায় কেনা পুতুলের মত… প্রেমিক প্রেমিকা, লেসবিয়ান গে, নানা চয়েস … ওরা কেউ কেউ নিজেদের চয়েস আলাদা করে বলে দেয়। আমরা প্যানসেক্সুয়াল। ওরা চুলে গোলাপি সবুজ নীল রং করে।

সুনন্দনা ওকে কত নতুন জিনিস দেখাল, শেখাল। নিজের মোবাইল ফোন, যা এখন স্মার্ট ফোন, সেটাতেই “ফ্লো” নামের অ্যাপ পর্যন্ত ডাউনলোড করে ফেলেছে মেয়ে। সবটা জানবে ওরা, জেনে ছাড়বে।

কবে পিরিয়ড শুরু, কবে ওভ্যুলেশন । তার মানে এটাও জানবে, কবে সেফ পিরিওড। পুরুষ সংসর্গ করার দিনক্ষণ নিজেরাই বিচার বিবেচনা করে ঠিক করবে তাহলে?

ওরা এগিয়ে যাচ্ছে তার মানে?

কিন্তু অবাধ যৌন সংসর্গ ব্যাপারটার পথ প্রশস্ত হওয়াটাকে এখনও প্রথমা ভাল ভাবতে পারে না কেন, নিজের শ্রেণীচরিত্র, নিজের বড় হয়ে ওঠার ডেটলে ধোওয়া-সাবানে কাচা ভিক্টোরিয় মূল্যবোধ থেকেই বোধ হয় পারেনা। ওর এটা তো মিলবে না পরের প্রজন্মের সঙ্গে। তবু মানিয়ে নিতে হবে। জেনে নিতে হবে । সময় এগুচ্ছে, প্রযুক্তিও। সুনন্দনা তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে।

একদা নিজেকে যে ভাল ভাবত, উচ্চস্তরের ভাবত, তাও আর ভাবে না প্রথমা। নিজেকেও খুব সাধারণ, আর সবার মত মনে হয়। প্রত্যাশিত চাওয়াপাওয়া ওর ও। অস্তিত্বের তলদেশ পর্যন্ত এই জন্য যেতে ইচ্ছে করে না আর। ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখা সুন্দরী নায়িকার জীবনের দ্বিধা দ্বন্দ্ব আগে নিজের জীবনেও ঘটতে দেখার চাপা বাসনা ছিল। সেই ইচ্ছেটুকুও অন্তর্হিত হয়েছে এখন। সেই যে ওদের কলেজ জীবনে এসেছিল শাবানা আজমি- স্মিতা পাতিল অভিনীত “অর্থ” ছবিটি। নিজের অজান্তে ও-ও ত শাবানার মত সাদা সালোয়ার কামিজ আর রঙিন বাঁধনির চুন্নি পরত। সেরকম ওর মূল্যবোধ, ওর “এগিয়ে থাকা” সেটাও আসলে প্রেডিক্টেবল ছিল। কোন বিস্ময়কর কিছু ছিল না প্রথমার জীবন । গতে বাঁধা। হয়ত আর পাঁচটা অন্য মেয়ের থেকে আলাদা, যারা তখনও বিয়ে করে সংসার করাকেই একমাত্র ধর্ম জ্ঞান করেছিল। সেইসব বান্ধবীরাই বেশি সুখী হয়েছিল আর প্রথমাই অসুখী? কে জানে রে বাবা! এখন এটাও গুলিয়ে গেছে।

নিজের মেয়ে কে দেখে চমকে যায় শুধু। ভাবে, এই তো ওরা নিজের হাতে টেনে নিয়েছে রাশ । জীবনের রাশ। তাহলে আর চাওয়ার রইল টা কী? তথ্য, ওয়েল ইনফর্মড হওয়া, এই দিয়েই তো হতে পারে উত্তরণ। সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ এক প্রজন্মে হয়ে গেল তবে গুগল আর ইউটিউব দিয়ে?

স্পষ্ট করে কথা ভাবা, কাজ করা, হৃদয় শুকানো। এই তো, এভাবেই মানুষের ক্রমমুক্তি হবে।
মানুষীর হবে না? মান্যবর শ্রী জীবনানন্দ? স্যার? হবে হবে। সব হবে।

আর কিছু না হোক, ফ্লো অ্যাপ দিয়ে নিজের জরায়ুকে ভাল করে জানা বোঝা নিয়ন্ত্রণ… এভাবেই মানুষীর ক্রমমুক্তি হবে।

অটো থামে। যাদবপুর। দিদি। দশ টাকা।

(সমাপ্ত)

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes