
সত্তার সঙ্গে সম্পর্ক
কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং
অনুসৃজন — রিনি গঙ্গোপাধ্যায়
"পুরনো চৈনিক পাঠ্য যা এই ধরনের অভিজ্ঞতাকে ঘন করে, প্রায়শই বিড়াল ইঁদুরের গর্ত দেখছে - এই উপমা কে ব্যবহার করে। যেমন একটি পাঠ্য বলে অন্য কোন ভাবনাকে অনুপ্রবিষ্ট হতে দিও না , কিন্তু কারো মনোযোগ এতো তীক্ষ্ণ নয় – বা এতো নিষ্প্রভ নয়। সেখানে যথাযথ উপলব্ধির মাত্রা থাকে – ‘যদি প্রশিক্ষণ এইভাবে অভিজ্ঞতা লাভ করে... যে যত সময় যাবে ততো প্রভাবিত করবে... এবং যখন কারণটি ফলপ্রসূ হবে তখন পাকা তরমুজ যেমন নিজে থেকেই খসে যায়, যে কোনো ঘটনাই তাকে স্পর্শ করবে যা হঠাৎ করেই সত্তার চূড়ান্ত রূপে জেগে ওঠার কারণ হবে। এটা সেই মুহূর্ত যখন প্রশিক্ষণকারী গরম জল না ঠান্ডা জল পান করছে তা বুঝবে; সে তার সম্পর্কে সমস্তরকম দ্বিধা মুক্ত হবে এবং বাবার সঙ্গে শব্দজব্দ করতে বসে কেউ যেমন খুশি হয় সেইরকম দুর্দান্ত খুশি হবে।’ এইভাবে সাধারণ বহির্মুখী জীবনের মাঝখানে কেউ ধরে ফেলতে পারে উত্তেজক আভ্যন্তরীণ অ্যাডভেঞ্চার এবং যেহেতু এটি প্রত্যেক সত্তার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র তাই এটি অনুলিপি করা বা চুরি করা সম্ভব নয়।"
আজকাল বেশিরভাগ মানুষ, বিশেষত যারা বড় শহরে বসবাস করে তারা এক ভয়ানক শূন্যতায় ও একঘেয়েমিতে ভুগছে; যদি তারা তেমন কিছু প্রত্যাশা করে থাকে যা তাদের কাছে কোনদিন আসবেনা। চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন, খেলা বা রাজনৈতিক উত্তেজনা হয়তো তাদের কিছুক্ষণের জন্য বিনোদন দিতে পারে, কিন্তু তারপর আবার তাদের বিমুখ করে, মোহমুক্ত করে , ফলে তারা তাদের জীবনের কণ্টকভূমিতে ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
একমাত্র উত্তেজনাময় ঘটনা যা এখনো পর্যন্ত সার্থক তা হল আধুনিক মানুষের অন্তরস্থিত অবচেতন মানসিকতার রাজত্ব। মস্তিস্কের এই অস্পষ্টতার জন্য অনেকেই এখন যোগা করেন বা প্রাচ্যের অন্যান্য কিছু অভ্যাস করেন। কিন্তু এগুলো অকৃত্রিমভাবে কোন উত্তেজনা প্রদান করে না। এগুলি আসলে হিন্দু বা চীনাদের মধ্যে যা বহু বছর ধরে প্রচলিত তাকেই আবার অভ্যাস করতে বলে। একজন ব্যক্তির অন্তরসত্তার সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগ তৈরি করে না। যদিও এটা সত্যি যে এই প্রাচ্যপদ্ধতিগুলি মস্তিষ্ককে ঘনীভূত করে তার অভ্যন্তরীণ বিষয়ের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে যা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনে (সেই জন্যেই এই পদ্ধতি অন্তর্মুখীনতার বিশ্লেষণমূলক চিকিৎসায় প্রায় সমান একটি ভূমিকা পালন করে)। ইয়ুং একটি বিবর্তিত পদ্ধতির কথা বললেন ব্যক্তির অন্তরে পৌঁছানোর জন্য , তার মনের জীবন্ত রহস্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য , যা একা এবং অবলম্বনহীন। এই পদ্ধতি প্রচলিত জীর্ণ পদ্ধতির তুলনায় ঘোষিত ভাবে পৃথক ছিল।
সত্তার অভ্যন্তরীণ চলমান বাস্তবকে প্রতিনিয়ত মনোযোগ দেওয়া আসলে একই সঙ্গে দুটো ভিন্ন পৃথিবীতে দুটো আলাদা স্তরে থাকার মতো। একটি পৃথিবী আগের মতোই বাইরের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করবে, একই সঙ্গে আরেকটি পৃথিবী ইঙ্গিত ও চিহ্নের জন্য সতর্কতা পাঠাবে। এরা দুজনেই স্বপ্নে ও বাইরের ঘটনাবলীর মধ্যে থাকবে, ফলে যেদিকে জীবনের প্রবাহ চলেছে সেই দিকে তার অভিপ্রায়কে চিহ্নিত করতে থাকবে।
পুরনো চৈনিক পাঠ্য যা এই ধরনের অভিজ্ঞতাকে ঘন করে, প্রায়শই বিড়াল ইঁদুরের গর্ত দেখছে – এই উপমা কে ব্যবহার করে। যেমন একটি পাঠ্য বলে অন্য কোন ভাবনাকে অনুপ্রবিষ্ট হতে দিও না , কিন্তু কারো মনোযোগ এতো তীক্ষ্ণ নয় – বা এতো নিষ্প্রভ নয়। সেখানে যথাযথ উপলব্ধির মাত্রা থাকে – ‘যদি প্রশিক্ষণ এইভাবে অভিজ্ঞতা লাভ করে… যে যত সময় যাবে ততো প্রভাবিত করবে… এবং যখন কারণটি ফলপ্রসূ হবে তখন পাকা তরমুজ যেমন নিজে থেকেই খসে যায়, যে কোনো ঘটনাই তাকে স্পর্শ করবে যা হঠাৎ করেই সত্তার চূড়ান্ত রূপে জেগে ওঠার কারণ হবে। এটা সেই মুহূর্ত যখন প্রশিক্ষণকারী গরম জল না ঠান্ডা জল পান করছে তা বুঝবে; সে তার সম্পর্কে সমস্তরকম দ্বিধা মুক্ত হবে এবং বাবার সঙ্গে শব্দজব্দ করতে বসে কেউ যেমন খুশি হয় সেইরকম দুর্দান্ত খুশি হবে।’
এইভাবে সাধারণ বহির্মুখী জীবনের মাঝখানে কেউ ধরে ফেলতে পারে উত্তেজক আভ্যন্তরীণ অ্যাডভেঞ্চার এবং যেহেতু এটি প্রত্যেক সত্তার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র তাই এটি অনুলিপি করা বা চুরি করা সম্ভব নয়।
দুটি কারণে মানুষ তার সত্তার কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে; তার একটি হল কিছু সহজাত প্রবৃত্তি তাকে চালনা করে বা সংবেদনশীলতা তাকে একটি দিক নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে যা তার মনের ভারসাম্য কে নষ্ট করে। এটা পশুদের ক্ষেত্রেও হয়। যৌন উত্তেজনার সময় মানুষ খাদ্য ও নিরাপত্তা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভুলে যায়। এই একপাক্ষিকতা এবং তার ফলস্বরূপ ভারসাম্য না থাকা খুবই ভীত করে আদিবাসীদের; তারা একে বলে ‘সত্তার ক্ষতি’। আরও একটি কারণ যা আভ্যন্তরীণ ভারসাম্য কে নষ্ট করে তা হল প্রচুর দিবাস্বপ্ন দেখা, যা একটি গোপন উপায়ে সত্তার হীনমন্যতাকে ঘিরে থাকে। এবং একই সময়ে তা সত্তার সচেতনতা , একাগ্রতা ও ধারাবাহিকতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে।
দ্বিতীয় বাধাটি ঠিক এর বিপরীত। এটা মূলত ঘটে অহং সচেতনতার অতিরিক্ত একত্রীকরণের কারণে। যদিও সভ্য সমাজে ক্রিয়াকাণ্ড চালানোর জন্য একটি নিয়মানুবর্তী সচেতনতা জরুরি ( আমরা জানি এটা ঘটে যখন একজন রেলের সিগন্যাল-ম্যান দিবাস্বপ্নের কারণে তার কাজ থেকে বিচ্যুত হয়)। এর একটি গুরুতর অসুবিধার কারণ হল সত্তার কেন্দ্র থেকে যে প্ররোচনা ও বার্তা আসে তাতে বাধা তৈরি করার একটি প্রবণতা এর মধ্যে থাকে। এই কারণে সভ্য মানুষের অনেক স্বপ্ন পুনরুদ্ধার করে তার গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠার দ্বারা অবচেতন সত্তার দিকে সচেতন মনের সঠিক ভঙ্গিমাটি পাওয়া যেতে পারে।
সত্তার পৌরাণিক উপস্থাপনার মধ্যে ব্যক্তি পৃথিবীর চতুর্কোণকে আরো জোরের সঙ্গে আবিষ্কার করতে পারে। এবং বহু ছবির মধ্য দিয়ে সেই বিখ্যাত মানুষটি নিজেকে একটি গোলাকার কেন্দ্রে আবিষ্কার করতে পারে যে গোলকটি চারটি ভাগে বিভক্ত। ইয়ুং হিন্দু শব্দ ‘মণ্ডলা’ ব্যবহার করেছেন এই কাঠামোকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য; যা হলো মানুষের মনুষ্যত্বের নিউক্লিয়ার এটমিক চিহ্নায়িত উপস্থাপনা; যার সারমর্ম আমরা কিছুই জানিনা। এটা আকর্ষণীয় এই সূত্রে যে একজন নাস্কাপি শিকারী তার চিত্রাবলীতে একজন বিখ্যাত ব্যক্তিকে উপস্থাপন করেছেন মানুষ হিসেবে নয় , ‘মন্ডলা’ হিসেবে। কোথা থেকে এই নাস্কাপি অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রের অভিজ্ঞতা অর্জন করল সরাসরি যথার্থ ধর্মীয় আচার বা মতবাদ ছাড়া! অন্য সম্প্রদায়গুলি ব্যবহার করে ‘মণ্ডলা’ মোটিফটি যে অভ্যন্তর কেন্দ্রের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে তার পুনরুদ্ধারের জন্য। উদাহরণস্বরূপ নভো ভারতীয়রা বালির ওপর অঙ্কণের মধ্য দিয়ে ‘মণ্ডলা’ গঠনের চিত্র তৈরি করে একজন অসুস্থ মানুষকে ফিরিয়ে আনার জন্য, মহাজাগতিক জগতের সঙ্গে সাদৃশ্য স্থাপনের জন্য; যার ফলে ব্যক্তির স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার হয়।
প্রাচ্য সভ্যতায় একই ছবি ব্যবহৃত হয় আভ্যন্তরীণ সত্তাকে একীভূত করার জন্য অথবা একজনকে সক্ষম করার জন্য যাতে সে ডুবে যেতে পারে গভীর ধ্যানে। ‘মণ্ডলা’র চিন্তা আমাদের এক গভীর শান্তিতে নিমজ্জিত করে , এমন এক উপলব্ধির সঞ্চার হয় যে আমরা জীবনের অর্থ ও ক্রম আবার খুঁজে পাই। ‘মণ্ডলা’ আধুনিক মানুষের স্বপ্নে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত হয়, যারা কোনো ধর্মীয় ঐতিহ্য দ্বারা প্রভাবিত নয় এবং যারা এই সম্বন্ধে কিছুই জানেনা। সম্ভবত তার ইতিবাচক প্রভাব কিছু ক্ষেত্রে মহত্তর, কারণ জ্ঞান এবং ঐতিহ্য অনেক সময় স্বতঃস্ফূর্ত অভিজ্ঞতায় বাধা তৈরি করে অথবা তার অর্থ উপলব্ধিকে ঝাপসা করে। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝান যেতে পারে, স্বতঃস্ফূর্ত উৎপাদিত ‘মণ্ডলা’ সংঘটিত হয়েছে একজন ৬২ বছরের মহিলার স্বপ্নে তার জীবনের একটি নতুন পর্বের মতো যার পর থেকে সে সৃজনশীল হয়ে উঠেছিল।–
আমি একটি ভূদৃশ্য দেখছি মৃদু আলোয়। পটভূমিতে আমি দেখছি একটি পাহাড়ের চূড়া এখনো উপরের দিকে উঠছে। যে লাইন ধরে তা উদিত হচ্ছে সেট একটা চতুর্ভুজাকার চাকতি হয়ে যাচ্ছে এবং সোনার মত চকচক করছে। তার অগ্রভাগে আমি দেখছি কালচে লাঙলের মত পৃথিবী যা ফুটতে চলেছে। এবার হঠাৎ করে আমি উপলব্ধি করলাম একটি গোলটেবিল যার ওপর একটি ধূসর পাথরের স্ল্যাব দেওয়া। ঠিক সেই মূহুর্তে সেই চতুর্ভুজাকার চাকতি হঠাৎ করে এই টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে পড়ল। এটা পাহাড়টাকে ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু কেন এবং কেমন করে এটা ওর জায়গা পরিবর্তন করল আমি জানিনা।
ভূদৃশ্য স্বপ্নে (ঠিক যেমন শিল্পে) কখনো কখনো চিহ্নিত করে অবর্ণনীয় মনের অবস্থা। এই স্বপ্নে ভূদৃশ্যের মৃদু আলো ইঙ্গিত করে যে দিনের বেলার সচেতন নির্মলতা কমে গেছে। অভ্যন্তরীণ প্রকৃতি হয়তো এবার নিজেকে প্রকাশ করতে চলেছে তার নিজস্ব আলোয়। সুতরাং আমরা বলতে পারি চতুর্ভুজাকার চাকতি এবার দেখা যাবে দিগন্তে। এখনো পর্যন্ত সত্তার সংকেত, চাকতিটি বৃহৎ অর্থে স্বজ্ঞাত ধারণা স্বপ্নকারীর মস্তিষ্কের দিকচক্রবালে। কিন্তু এখন স্বপ্নে এটা তার অবস্থান পরিবর্তন করে এবং ভূদৃশ্যের কেন্দ্রে বা তার আত্মার কেন্দ্রে চলে আসে। একটি বীজ যা বহু আগে দেখা হয়েছে অঙ্কুরিত হতে শুরু করে। আগে অনেক সময় স্বপ্নকারী তার স্বপ্নে যত্নসহ মনোযোগী হয়েছিলেন; এখন সেই কাজ ফলবতী হয়েছে। এবার ওই সোনার চাকতি আচমকাই ডান দিকে সরে গেল , যেদিকের প্রতি আমরা সচেতন থাকি। অন্য অনেক কিছুর মধ্যে ডান দিক প্রায়শই মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে সচেতনতা বোঝায়, অভিযোজন বোঝায়; বাম দিক বলতে অপরিশোধিত গোলক, অবচেতনে অশুভের প্রতিক্রিয়া বোঝায়। তারপর শেষ পর্যন্ত সোনার চাকতি তার অপসারণ বন্ধ করে এবং বিশ্রাম নিতে আসে—উল্লেখযোগ্যভাবে—একটি গোল পাথরের টেবিলের ওপর এটা একটা স্থায়ী ভিত্তি পায়।
এই বইতে এনিয়েলা জাফে পরে লক্ষ্য করবেন গোলাকৃতি (‘মণ্ডলা’ মোটিফ) সাধারণত সংকেতয়িত করে প্রাকৃতিক সম্পূর্ণ্তাকে , যদিও চতুর্ভুজাকৃতি গঠন সচেতনতা উপলব্ধির প্রতিনিধিত্ব করে। এই স্বপ্নে চৌকো চাকতি ও গোলটেবিল মিলিত হয় , এবং এইভাবে কেন্দ্রের সচেতন উপলব্ধি আমাদের হাতে আসে। গোলটেবিল ঘটনাচক্রে সম্পূর্ণতার সুপরিচিত সংকেত এবং মাইথোলজিতে তার একটি ভূমিকা আছে। উদাহরণস্বরূপ , রাজা আর্থারের গোলটেবিল , যেটা নিজেই একটি ভাবমূর্তি , যা আমরা ‘লাস্ট সাপার’ ছবিতে পাই।
আসলে যখন একজন মানুষ সত্যিই তার অন্তর বিশ্বের কাছে পৌঁছতে চাইবে এবং নিজেকে জানতে চাইবে — তার বিষয়গত চিন্তা উপলব্ধির দ্বারা নয়, বরং তার স্বপ্ন ও কল্পনার মধ্য দিয়ে যে অভিব্যক্তি উঠে আসছে তার মাধ্যমে—শীঘ্র বা দেরিতে হলেও সত্তা উদিত হবে , অহং খুঁজে পাবে একটি আভ্যন্তরীণ শক্তি যা সমস্ত সম্ভাবনাকে পুনরায় নতুন করে তুলবে।
কিন্তু এর মধ্যে একটি বড় অসুবিধে আছে যা এখনো পর্যন্ত আমি পরোক্ষভাবে বলে এসেছি। তা হলো প্রতিটি ব্যক্তিত্বের অবচেতন – প্রতিচ্ছায়া, অণিমা, শত্রুভাব এবং সত্তা – দুটোরই আলো অন্ধকারের দিকে আছে। আমরা আগে দেখেছি প্রতিচ্ছায়া হয় ভিত্তি, নয় মন্দ বা অশুভ – এমন একটি সহজাত ক্রিয়া যা ব্যক্তির অতিক্রম করা উচিত। এটা হয়ত বৃদ্ধির দিকে প্ররোচনা যা ব্যক্তির অনুসরণ করা উচিত। ঠিক একইভাবে অণিমা ও শত্রুভাবের দুটি দিক আছে। তারা সারা জীবনের জন্য ব্যক্তিত্বকে উন্নত ও সৃজনশীলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে, অথবা তারা মানুষের মনকে প্রস্তরীভূত করে ফেলতে পারে যা শারীরিক মৃত্যু ডেকে আনে। এমনকি সত্তার অবচেতনের সমস্ত সংকেতের আছে দ্বিপদী প্রভাব, যেমনটা বলা হয়েছিল এস্কিমোদের একটি গল্পে যখন সেই ছোট মহিলাটি চাঁদের আত্মা থেকে নায়িকাকে বাঁচাতে চেয়েছিল, আসলে তাকে মাকড়সার রূপান্তরিত করার জন্য।
সত্তার অন্ধকার দিকটি খুবই বিপজ্জনক; কারণ মনস্তত্ত্বে সত্তার ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। এটা মানুষের নিজেকে বড় বা শক্তিশালী বলে ভাবার অবকাশ দেয়; অথবা বিভ্রান্তিকর রূপকথা তাকে অধিকার করে ফেলে। একজন মানুষ এই পরিস্থিতিতে ধারাবাহিক কাঠামোর বাইরে গিয়ে ভাবতে পারে সে সমাধান করেছে মহাজাগতিক ধাঁধা। তারপর মানুষের বাস্তবতা থেকে সে অনেক দূরে সরে যায়। এর একটা বিশ্বাসজনক লক্ষণ হলো ব্যক্তি তার মেজাজ হারিয়ে ফেলে, মানুষের সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলে।
এই জাগ্রত সত্তা মানুষের সচেতনতার পক্ষে বিপজ্জনক হয়। সত্তার এই দ্বিমুখী দিক দারুণভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে পৌরাণিক ইরাণীয় এক গল্পে; নাম ‘স্নানঘরের রহস্য’—
বিখ্যাত ও উদার রাজপুত্র হাতিম তাই তার রাজার কাছ থেকে নির্দেশ পেলেন রহস্যময় স্নানঘরের অনুসন্ধান করতে হবে। যখন সে অনুসন্ধানে প্রবেশ করল তখন সে জানল এই দুঃসাহসী কাজে যে গিয়েছে সে আর ফিরে আসেনি; কিন্তু তাকে জোর করে এই অনুসন্ধানে পাঠানো হচ্ছে। একটি গোলাকার ভবনে হাতিমকে একজন নাপিত গ্রহণ করল তার সঙ্গে একটি আয়না ছিল; সেই তাকে ওই স্নানঘরে নিয়ে যায়। কিন্তু যে মুহুর্তে রাজপুত্র জলে নামে সেই মুহূর্তে বজ্রবিদ্যুতের আওয়াজ হয় তারপর সব অন্ধকার হয়ে যায়। সেই নাপিত অদৃশ্য হয়ে যায় এবং জল ক্রমশ উঁচুতে উঠতে থাকে।
হাতিম নিদারুণভাবে সাঁতার দিতে থাকে; শেষ পর্যন্ত অট্টালিকার ওপরের গোলাকার গম্বুজে পৌঁছয়, যা এই স্নানঘরের শীর্ষ ছিল। সে ভেবেছিল সে এবার মরে যাবে কিন্তু সে হঠাৎ আঁকড়ে ধরে গম্বুজের কেন্দ্রীয় পাথরটি আবার একটি বজ্রবিদ্যুতের আওয়াজ হল এবং সমস্ত কিছু পরিবর্তন হয়ে গেল। হাতিম নিজেকে একটি মরুভূমির মধ্যে একা আবিষ্কার করল।
তারপর দীর্ঘ যন্ত্রণাময় পথ অতিক্রম করে এসে সে পৌঁছল একটি সুন্দর বাগানে যা একটি পাথরের মূর্তির মধ্যের গোলাকার অংশ ছিল। সেই মূর্তির কেন্দ্রে হাতিম দেখল একটি টিয়াপাখি খাঁচার মধ্যে রয়েছে; এবং সে বলে উঠল, হে নায়ক তুমি সম্ভবত এই স্নানঘর থেকে বেঁচে ফিরতে পারবে না; একদা গ্যেমার্ট (প্রথম মানব) পেয়েছিল একটি প্রকাণ্ড হীরে যার উজ্জলতা সূর্য – চাঁদের থেকেও বেশি। সেটিকে সে এমন জায়গায় লুকিয়ে রাখবে ভেবেছিলে যেখান থেকে কেউ খুঁজে পাবে না আর তারপর সে এই জাদু স্নানঘর বানিয়েছিল হীরেটিকে রক্ষা করার জন্য; তুমি যে টিয়া পাখি দেখছো তা হল আসলে এই জাদুর একটি অংশ; এর পায়ের কাছে একটি সোনার তীর-ধনুক আছে যা দিয়ে তুমি তিনবার একে হত্যা করার চেষ্টা করতে পারো। যদি তুমি তাকে হত্যা করতে পার তবে অভিশাপ কেটে যাবে। যদি না পার তবে তুমি অন্যদের মতো প্রস্তরীভূত হবে।
হাতিম প্রথমবার চেষ্টা করে পারল না; তার পা পর্যন্ত পাথরের হয়ে গেল; এবং সে দ্বিতীয়বারও পারল না; ফলে তার বুক পর্যন্ত প্রস্তরীভূত হয়ে গেল। তৃতীয়বার সে তার চোখ বন্ধ করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করল, ঈশ্বর তুমি মহান , এবং অন্ধের মতো তীর নিক্ষেপ করল। এবার সে টিয়া পাখিটিকে হত্যা করতে পারল; আবার বজ্রবিদ্যুৎ চমকালো, মেঘে আকাশ ছেয়ে গেল; তারপরে সব যখন প্রশমিত হল তখন সে ওই টিয়া পাখির জায়গায় একটি প্রকাণ্ড হীরে দেখতে পেল; এবং সব মূর্তিগুলো প্রাণ ফিরে পেল; সবাই হাতিমকে ধন্যবাদ জানাল তাদের মুক্তি দেওয়ার জন্য।
পাঠক নিশ্চয়ই চিনতে পারবে এই গল্পে সত্তার সংকেতকে — প্রথম মানব গ্যেমার্ট, গোল মণ্ডলাকৃতি ভবন, কেন্দ্রের পাথরটি এবং হীরেটি। কিন্তু এই হীরেটি বিপদ দিয়ে ঘেরা ছিল। পৈশাচিক টিয়াপাখিটি মন্দ আত্মার অনুকরণ; তাই একজন লক্ষ্যভেদ করতে না পারলে তাকে মানসিকভাবে প্রস্তরীভূত করে ফেলবে। আমি আগেই বলেছি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য পাখির মত অনুকরণ কে বাদ দেয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত দেশের মানুষ বাইরে থেকে চেষ্টা করে বিভিন্ন ধর্মীয় আচার ব্যবহার অনুকরণ করতে; যা তাদের ধর্মীয় শিক্ষকরা শিখিয়ে গিয়েছেন – যীশু, বুদ্ধ অথবা আর কোন ধর্মগুরু – আর তারপর তারা প্রস্তরীভূত হয়ে পড়ে। মহান আধ্যাত্মিক গুরুদের অনুসরণ করা মানে এই নয় যে তাদের আচার-আচরণ অনুকরণ করতে হবে যা ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের পরিপন্থী। এর মানে হল আমরা সততার সঙ্গে একাগ্রতার সঙ্গে ভক্তি করে আমাদের নিজেদের জীবন বাঁচাতে চেষ্টা করব।
সেই নাপিত ও তার সঙ্গে আয়নাটি যে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল সংকেতায়িত করে প্রতিবিম্বের পুরস্কার যখন হাতিমের এটি সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল। জলোচ্ছ্বাস প্রতিনিধিত্ব করে একজন মানুষ যখন তার অবচেতনে ডুব দেয় এবং হারিয়ে ফেলে তার নিজের আবেগকে। অবচেতনের সংকেত বোঝার জন্য ব্যক্তিকে অবশ্যই যত্নবান হতে হবে; তার ব্যক্তিত্বের বাইরে নয়, পাশে নয়, আবেগপূর্ণ ভাবে তার ব্যক্তিত্বের মধ্যে নিমজ্জিত হতে হবে। প্রকৃতপক্ষে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে আমাদের অহং স্বাভাবিক ভাবে কাজ করবে, যদি আমি খুব সাধারণ মানুষ হই আমার অসম্পূর্ণতার প্রতি সচেতনতায় আমি সংকেত গুলিকে গ্রহণ করতে পারি এবং অবচেতনে কিভাবে কাজ করে তা দেখতে পারি। কিন্তু কী করে একজন মানুষ এই টেনশন গ্রহণ করতে পারবে যে সে নিজেকে অনুভব করতে চাইছে পুরো বিশ্বের মধ্যে একজন হিসেবে আবার একই সঙ্গে সে মনে করছে সেই সবচেয়ে তুচ্ছ পার্থিব সৃষ্টি! যদি এক দিকে আমি অবজ্ঞা করে নিজেকে নিছক একটি পরিসংখ্যান শূন্য মনে করি এবং আমি মনে করব আমার জীবনের কোন মানে নেই এবং বাঁচার কোনো অর্থ নেই কিন্তু অন্যদিকে আমি যদি নিজেকে মহান কোন কিছুর অংশ মনে করে আমি নিজেকে কিভাবে মাটিতে নামিয়ে আনব? এটা খুব কঠিন প্রকৃতপক্ষে নিজের ভিতরেই বৈপরীত্য কে একটি সত্তায় নিয়ে আসা কারণ এরা একে অপরকে টেক্কা দিয়ে অন্যটিকে চূড়ান্ত করে তোলে।
গুরুত্বপূর্ণ কাজ। খুব ভালো লাগলো।
এখানে একটা খটকা লাগল। ‘হিন্দু বা চিনাদের…’ — হিন্দু একটা ধর্ম, চিনা কোনও ধর্ম নয়। বাকি লেখাটি ভালো লাগল।
এই খটকা আমারও লেগেছে। কিন্তু মূল টেক্সট এ এরকমই ছিল।
সমৃদ্ধ হলাম…প্রসঙ্গত,সম্পূর্ণ লেখাটি পড়ে এখানে “…হিন্দু বা চীনাদের…” সম্ভবত ধর্ম-অর্থে নয়,বরং জাতি-অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে বলেই মন হল পাঠক হিসেবে৷
সমৃদ্ধ হলাম…প্রসঙ্গত,সম্পূর্ণ লেখাটি পড়ে এখানে “…হিন্দু বা চীনাদের…” সম্ভবত ধর্ম-অর্থে নয়,বরং জাতি-অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে বলেই মনে হল পাঠক হিসেবে৷
খুবই গুরুত্বপূর্ণ লেখা। ভাল লাগছে।