লজ্জাগৌরী:এক দেবীমূর্তির বিবর্তনের নিরিখে সভ্যতার ইতিহাস দেখা <br />     অর্ঘ্য দত্ত বক্‌সী

লজ্জাগৌরী:এক দেবীমূর্তির বিবর্তনের নিরিখে সভ্যতার ইতিহাস দেখা
অর্ঘ্য দত্ত বক্‌সী

একদা শিব পার্বতীকে একটি কম্বল দিয়ে তা সযত্নে রক্ষা করতে বলেন। পার্বতী তা যত্ন করে রেখে দেন। শিব তার সঙ্গে মজা করার জন্যই ইঁদুরের রূপে এসে সেই কম্বলে ছিদ্র করে দেন। পরে পার্বতী সেই কম্বলের অবস্থা দেখে চিন্তান্বিত হয়ে পরেন যে তিনি শিবকে কী উত্তর দেবেন! এমন সময় দেবীকে পরীক্ষা করবার মানসে শিব এক দরজির বেশ ধারণ করে দেবীর সম্মুখে উপস্থিত হন। পার্বতী তাকে দেখেই কম্বল সারিয়ে দিতে বলেন। দরজি তাতে সম্মত হয়, কিন্তু সে শর্ত রাখে যে, তার বিনিময়ে পার্বতীকে তার সঙ্গে সঙ্গম করতে হবে। দেবী প্রবল লজ্জা পেলেও, কম্বলের অবস্থা আর রুদ্রের সম্ভাব্য রোষের কথা ভেবে একেই সহজ সমাধান ভেবে দরজির শর্তে রাজি হয়ে যান। যখন দরজিরূপী শিব সঙ্গমরত অবস্থায় নিজ রূপে দেবীর কাছে প্রকটিত হন, তখন লজ্জায় দেবীর মাথা কাটা যায় এবং তার জায়গায় এক পদ্ম প্রস্ফুটিত হয়। সেই রূপই লজ্জা গৌরি। দেবীর ‘কামঘন’ রূপ।
কম্বলও (লজ্জা)বস্ত্র! এবং তাতে ছেদও লজ্জাউদ্‌গীরক।
প্রকৃতপক্ষে নারীশক্তির পূজা এইজন্য হয়নি যে, নারীর ইমেজ খুব মহান ছিল। বরং তার কারণ নারীর প্রজনন ক্ষমতা ও তার ফলে একটি গোষ্ঠীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি। মহামারী-যুদ্ধ-প্রতিকূল প্রকৃতি ইত্যাদি ক্রমাগত জনসংখ্যার ক্ষয় করেছে। তাকে পরিপূরণ করেছে নারীরা, যাদের সঙ্গে প্রকৃতির সংযোগ অবিচ্ছিন্ন। পুরুষ চাইলেই তার বীর্যপাত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আবার কামবাসনাও তার মধ্যে প্রবলতর। আবার সে নিউট্রাল হয়ে গিয়ে বলতে পারে— সচ্চিদানন্দ শিবোহম! কিন্তু একজন নারী তা পারে না, চাইলেও সে অত পরিমাণে স্বেচ্ছাধীন হতে পারে না। তার ঋতুস্রাব হবেই, তার কিশোরী দশায় সে বড় হতে না চাইলেও প্রথম ঋতুস্রাবের মাধ্যমে প্রকৃতি জানিয়ে দেবে যে সে এখন পূর্ণনারী! প্রকৃতির ঋতু পরিবর্তনের মতোই তারও হরমোনাল চেঞ্জ হবে প্রতিমাসে! তার মধ্যে প্রকৃতি যেন নিত্য বিরাজিতা। একবার গর্ভবতী হলে দশমাস তাকে শরীরের ভিতরের ঘটে চারা পালনের মতোই লালনপালন করতে হবে বংশের উত্তরাধিকার। এবং শ্রেণিবিভক্ত ব্যক্তিগত মালিকানা ও তার উত্তরাধিকারের সমাজ তাই নারীকে দেবীরূপে পুজো করে তার প্রজননশক্তির জন্য। শস্যও নারীসুলভ ও প্রকৃতির চিরকালীন রীতিতে উৎপাদিত হয়। এই ভাবে নারী-শস্য-মাটি-প্রকৃতি-যৌনতা একত্র হয়ে এক দেবীরূপে পূজিতা হন।
‘লজ্জাগৌরি’ নামটি অনেক পরে ব্যবহৃত হয় এবং বৈদিক সাহিত্যে তার উল্লেখ নেই। বরং বৈদিক সাহিত্যে তার নাম অদিতি উত্তানপাদ (উত্থিত পদ)।

দেবী দুর্গা বা পার্বতী বা উমা শৈবধর্মের সঙ্গে সংযুক্তা দেবী। শৈবনারী তার প্রজননক্ষমতা দীর্ঘ বয়স অবধি ধরে রাখতে পারেন। দুর্গা তার আইকনগ্রাফি অনুযায়ী খাদ্য-সংগ্রাহক শিকারী ও পশুপালনকারী অবস্থা থেকে মানুষের খাদ্য উৎপাদনকারী কৃষি সভ্যতায় উন্নীত হবার প্রতীক। মহিষকে হত্যা করা হচ্ছে। করছে সিংহ পুরুষ ও দশহস্তা কর্মনিপুণা নারী একত্রে। লক্ষ্মী-সরস্বতী ইত্যাদি বৈদিক দেবী তার থেকে নিচু অবস্থানে থাকছেন (কন্যারূপে)। শিবও তার পশুপতিরূপ ত্যাগ করে এখানে শুধুই দ্রষ্টা-যোগী হয়ে উঠছেন। দুর্গাপুজোর আগে নবরাত্রিতে পূজিতা হচ্ছেন দেবীর নয় রূপ। শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুষ্মাণ্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরি ও সিদ্ধিদাত্রী। সতী দেহত্যাগের পর হিমালয় কন্যা পার্বতীরূপে জন্মগ্রহণ করেন, তাই তিনি শৈলরাজের পুত্রী, ইত্যাদি পরে আলোচিত হবে। অষ্টমাতৃকা যেমন ব্রহ্মাণী, বৈষ্ণবী, মহেশ্বরী, ইন্দ্রাণী, কুমারী, বারাহি, নারসিংহী ইত্যাদি পুরুষ দেবতাদের নারীরূপ, এমনকি গুহ্যদ্বারের রক্ষাকারিণী দেবী গুহ্যেশ্বরীর কথাও পাওয়া যায় দেবী কব্চম স্তোত্রে। যাইহোক, লজ্জাগৌরি প্রসঙ্গে ফিরে এসে বলি যে, দুর্গার বিবিধ রূপ যেমন শাকম্ভরী (শাক-সব্জি), পৃথিবী/ভূমি (উর্বরতা শক্তি), রেনুকা (কুমারী মৃত্তিকা), কোটাভী কোট্টামাহিকা (নগ্না কুলদেবী-নিদ্রাদেবী), ইয়ালাম্মা (সকলের মাতা) ইত্যাদি লজ্জাগৌরিরূপেই পূজিতা। ভারতের সর্বত্র এই দেবী আদিকাল থেকে এখনও অবধি পূজিতা হন। রাজস্থান, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, উত্তর-পূর্ব ভারতে এই দেবীশক্তি কৃষকশ্রেণির আরাধ্যা। আদিতে সকল প্রজনন ক্ষমতা, যৌনতা, সন্তান উৎপাদন, শস্য উৎপাদন, কৃষি ও প্রাকৃতিক শক্তির উপাস্য ছিলেন দেবী অঙ্গিয়ারা মাতা (উত্তর প্যালিওলিথিক যুগ, মধ্যপ্রদেশ) যিনি আর কিছুই নন, এক ত্রিভুজাকার যোনিমূর্তি! জনপদ-মৌর্যযুগ অতিক্রম করে ৬০০ শতাব্দীতে লজ্জাগৌরি পুজো প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করে।
যাইহোক, আগে আমরা মানবসভ্যতার আদিতে সমগ্র পৃথিবীজুড়ে সভ্যতাগুলিতে এই মূর্তির সমতুল্য মূর্তিগুলিতে চলে যাই। ধীরে ধীরে দেবীর আইকনগ্রাফিক্যাল পাঠ সম্পূর্ণ করে আবার আমরা ভারত উপমহাদেশে তার মাহাত্ম্য, ঐতিহাসিকতা ইত্যাদি আলোচনায় ফিরে আসব।
প্রাগাধুনিক মানব সভ্যতায় আদিম প্রজাতির মানুষদের প্রকৃতিপূজা, বস্তুপূজা বা বস্তুতে নরত্বারোপ করে পূজা (পাথর, গাছ, ইত্যাদি), তন্ত্র-মন্ত্র-কালাজাদু পূজার আদিমতম আধার দেবী লজ্জাগৌরি যিনি সৌভাগ্য, প্রাচুর্যতা ও প্রজননক্ষমতার প্রতীক।
লজ্জাগৌরি—লজ্জাহীনা যৌনচারিণী
লজ্জাগৌরি—নাম-রূপহীনা নারীযৌনতা
লজ্জাগৌরি—এক আসন্ন প্রসবরতা মাতা!
তো এই সত্ত্বাটি তো আর স্বাভাবিকভাবেই কেবল ভারতেই পূজিতা হতে পারেন না। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর সিন্ধু সভ্যতার প্রাচীনতর মেসোপটেমিয়ান সভ্যতাতেও—নিওলিথিক যুগের সকল মাতৃতান্ত্রিক ধর্মাচরণের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিকভাবে পূজিতা এই প্রকৃতিদেবী!
তিনি উবু হয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছেন—সন্তান প্রসবকালীন দেহভঙ্গিমায়—হাত হাঁটুর উপর থেকে উপরে বিস্তৃত এবং হাতেও পদ্ম ধরে আছেন। বিবস্ত্রা, তবে মুক্তোজাতীয় নেকলেস, কটিবন্ধ, চুড়ি জাতীয় হস্ত অলংকার পরিহিতা—কোন কোন ক্ষেত্রে হস্ত দ্বারা আপন স্তন মর্দনরত অবস্থায়—ঘাড় থেকে মাথার বদলে উত্থিত পদ্মনাল ও পরিপূর্ণ প্রস্ফূটিত পদ্মটি কাঁধে ঈষৎ হেলানো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পেট সমতল, গর্ভিনী নন এবং যোনি বড় ও অত্যন্ত প্রকট। তার যৌনময়তাকে আরো স্পষ্টভাবে বোঝাতে শিল্পীরা তার ক্লাইটোরিস ও যোনিমুখ অত্যন্ত স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন, বহু প্রত্নবস্তুতে তার যোনির নিচে স্পষ্ট উত্থিত লিঙ্গ এবং অণ্ডকোষ আঁকা।
তার এই দেহভঙ্গিমাটি পরিপূর্ণরূপে পুরুষকে যৌনতায় আহ্বান করে আবার প্রসববেদনার মধ্যে নবজাতক ভূমিষ্ঠ হবার পূর্বমুহূর্তেরও প্রতীক এটি। পরবর্তীকালের ভিক্টোরিয়ান বা বলা ভালো পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ তার মাথাকে পদ্ম দিয়ে প্রতিস্থাপন করে যেন তাকে লজ্জিতা প্রতিপন্ন করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাকে পুরুষের যৌনফ্যান্টাসির ডানা মেলে দেওয়া আকাঙ্ক্ষিত নারীদেহে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে তার মুণ্ডটি অ্যানোনিমাস রাখা হয়েছে। এছাড়া লজ্জার সঙ্গে তার কোনো সংযোগ নেই। (বস্তুত তিন চার হাজার খ্রিঃ পূঃ তে বিশ্বের বেশির ভাগ মূর্তিতেই মুখসংযুক্ত, কিন্তু ভারতে নয়। গ্রিক-রোমান-মিশরীয় দেবীরা প্রত্যেকে অত্যন্ত যৌনাকর্ষক মূর্তিতেই পূজিতা, ভারত কিন্তু তার দেবীদের মূর্তি এমনভাবে গড়েছে যাতে কোনোভাবেই তা দেখে যৌনতার উদ্রেক না হয়। চতুর্হস্তা, দশহস্তা, মুণ্ডমালিনী—ভারত বীরাচারী মতে দেবীকে স্ত্রী-প্রেমিকা দৃষ্টিতে দেখতে কম স্বচ্ছন্দ। তাই ভারতের দেবীমূর্তিরা মাতৃরূপা—স্নিগ্ধা, উগ্র যৌনাকর্ষক নন।)
ফুটনোট- মুণ্ডহীনা দেবীর কথা ভারতীয় মিথেও পাওয়া যায়। সর্বাগ্রে মনে পড়ে ছিন্নমস্তার কথা। কালীর গলায় একান্ন মুণ্ড, একান্ন পীঠ (যদিও মাত্র ৪২টি স্থান) ৫১ বর্ণমালার প্রতীক। বর্ণ— রঙ, অক্ষর, , জাতি ইত্যাদি বহু অর্থব্যঞ্জনা ধারণ করে। ছাগমুণ্ড দক্ষ, হস্তীমুণ্ড গণেশ, বানরমুণ্ড হনুমান বা কুকুরমুণ্ড আনুবিস সর্বজনবিদিত। রাবণের দশমুখ, হাইড্রার দশমুণ্ড, সহস্রমুণ্ড গ্রিক দানব হেকাটনখিরাস, সেরাবেরাসের তিনমুণ্ড, ব্রহ্মার পাঁচমুণ্ড যার একটি আবার কেটে নেওয়া হয়। মুণ্ডহীনতা বা মনুষ্যমুণ্ডহীন দেবদেবীরা কেউ বোধবুদ্ধিহীন পাশব সত্ত্বার প্রতীক নন। তার পরিবর্তে প্রাচীনতর প্রকৃতিজ প্রজ্ঞার প্রতীক। এক পবিত্র ও অলৌকিক ক্ষমতার প্রতীক। এক আত্মসমর্পণের প্রতীক। পৃথিবীর অসংখ্য দেবদেবীর মুণ্ড মানুষের নয়। মানবচৈতন্য-পশুচৈতন্য-প্রকৃতিচৈতন্য আদিমতরকালে বিচ্ছিন্ন ছিল না। একাকার সত্ত্বা ছিল (যদিও বর্তমানে প্রচলিত মিথ থিওরি অনুযায়ী মিথমেকিং মানুষ বর্তমান মানুষের মতোই সমান বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন ছিল। প্রাচীন মানুষের কাছে মিথ বর্তমান মানুষের বিজ্ঞানের সমান কার্যকারিতা সম্পাদন করত)। জুমরফিজম বা পশুকথা সকল ধরনের রূপকথার মধ্যে ও সকল উদ্ভূত মিথের মধ্যে প্রাচীনতম, একথা সর্বজনগ্রাহ্য।
আবার লক্ষণীয় যে, পদ্ম পরবর্তীকালের দৈবিক পবিত্রতার শ্রেষ্ঠ প্রতীক। পদ্মাসনা গজগেলা লক্ষ্মী, পদ্মযোনি ব্রহ্মা এরা সকলেই কসমিক সৃষ্টির প্রতীক। বেদের শ্রীদেবী পরবর্তীকালে দুর্গা-লক্ষ্মী-সরস্বতী ইত্যাদি দেবীতে বিভক্ত হন। এই শ্রী এর সঙ্গেও পদ্মের প্রবল সংযোগ। সহস্রার ও কুণ্ডলিনীর প্রতিটি চক্রকে আমরা পদ্ম দিয়ে প্রতিকায়িত করি। পদ্ম যেন একটি নারীগর্ভ—ফসল ও প্রজনন প্রাচুর্যের প্রতীক। সুতরাং পদ্মমস্তক অবশ্যই অত্যন্ত সদর্থক ইমেজারি)।
পৃথিবীর প্রথম সভ্যতা মেসোপটেমিয়ান (খ্রিঃপূঃ সাড়ে চার হাজার বছর)। সমগ্র মধ্য এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া, নীলনদের তীর, পার্সিয়া থেকে সিন্ধুসভ্যতার জনগোষ্ঠীর উপর এদের প্রভাব বিস্তর। মেসোপটেমিয়াতেও পূজিতা মহীয়সীমাতা লজ্জাগৌরিকে মাতৃতান্ত্রিক-প্রকৃতিপূজারী দেবী উপাসক সভ্যতাগুলির ‘আদিমতম দেবী’ হিসাবেও চিন্তা করা যায়। নিওলিথিক যুগারম্ভে ৬৫০০ খ্রিঃ পূর্বে দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার এল ওবেইদ গ্রামীন সভ্যতায় পাওয়া সরীসৃপ জাতীয় মুখবিশিষ্টা (গিরগিটি) উলঙ্গ, স্তনমর্দনকারিণী এবং যৌনস্থান স্পষ্ট করে চিহ্নিত করা পোড়ামাটির মূর্তিগুলিই পৃথিবীর প্রাচীনতম দেবীমূর্তি।

মেসোপটেমিয়ার পরবর্তীকালের দেবী ইনানা/ইসতার এনারই মার্জিত রূপ এবং ইনানা-দামুজ্জি উর্বরতা মিথে দেখা যায় যে দেবী কীপ্রকার উদগ্রযৌনতাময়ী নারীসত্ত্বা; পরবর্তীকালের পৃথিবীর সকল উর্বরতার দেবীরা এই ‘আদিমতম দেবীর’ই অবতারস্বরূপা। এবং সেই আদিদেবীর সরীসৃপমুখ এবার ইনানাকে পরিবেষ্টন করে অবস্থিত টিকটিকি, কাঁকড়াবিছে ইত্যাদিতে পর্যবসিত হয়েছে। মরুভূমির প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকতে সক্ষম কাঁকড়াবিছে সুমেরীয়দের কাছে সঙ্গমরত অবস্থার প্রতীক।

মেসোপটেমিয়ার মিথে পুরুষ পুরোহিতদেরদের মাধ্যমে এই দেবীকে সঙ্গমের জন্য বারবার আহ্বান করা হয়েছে। দেবী নিজের বর্ণনায় বলেছেন, ‘আমি এক বারবণিতা যে পুরুষ যৌনাঙ্গের সঙ্গে অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ। আমি পুরুষের অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। আবার আমিই এক নারীরও সর্বপ্রিয় সখী!” (নারী-পুরুষের যাবতীয় সেক্সফ্যান্টাসি যৌনাঙ্গের প্রতীকও তিনি)। ইনানা বা ইসতারের ‘বারবণিতা মন্দির’গুলির পূজারিনীরা নারী উর্বরতা-প্রকৃতি উর্বরতা সংক্রান্ত যাবতীয় পূজা আচার অনুষ্ঠান মিথের পালনকারিণী (দেবদাসী?)। শুঁড়িখানাগুলি থেকে মদ্যপ পুরুষদের প্রলুব্ধ করে নিয়ে যাওয়া (অর্থের বিনিময়ে কদাপি নয়) উচ্চপদমর্যাদা সম্পন্ন পবিত্র বারবণিতারা পরতেন মুক্তোর নেকলেস যা বীর্য রজের প্রতীক এবং আচার অনুষ্ঠান করার ক্ষমতাজ্ঞাপক সম্মানজনক পরিধানস্বরূপ (যেমন পৈতে বা রাজদণ্ড)। অর্থ বা জীবননির্বাহের জন্য নয়, কোনো পর্ণোগ্রাফিও নয়, জীবনের জন্য যৌনতার উৎসবকারিণী। নারীর প্রজনন ক্ষমতা ও পুরুষ-নারী সঙ্গমরত মূর্তিগুলিকে বলা হত ‘পবিত্র বিবাহ’ মূর্তি। যা আজ পর্ণোগ্রাফি চার হাজার খ্রিঃ পূর্বে তা ছিল ঐশ্বরিক ক্রিয়া, জীবনের জয়গান। সেইসব চিন্তা আজও প্রাচীন মন্দিরগুলিতে পবিত্র অলঙ্করণরূপে খোদিত আছে।

ব্যাবিলনে প্রাপ্ত সিলগুলিতে প্রেম ও যৌনতার দেবী ইনানার সহচরীদের পা ফাঁক করা লজ্জাগৌরি দেহভঙ্গিমায় যৌনতার জন্য পুরুষদের সরাসরি আহ্বান করতে দেখা যায়। অন্য একটি সিলে, এক নগ্না দাসী অন্য এক নগ্নাকে এক দীর্ঘ শ্মশ্রুধারীর সঙ্গে যৌনতার জন্য অনুমতি চাইছেন ইনানার সহচরী ‘লামাশতু’র কাছ থেকে। লামাশতু দেবী সিংহের মস্তক ও পক্ষীর ডানা বিশিষ্টা। এই সিলের কেন্দ্রে রয়েছেন বিশিষ্ট পেঁচকের মতো ডানা ও পদবিশিষ্টা এবং বিরাট ও প্রকট যোনিস্থান যুক্তা ইনানা দেবী যার দেহের নিম্নাংশ চলে গেছে পাতাল লোকে যেখানে কচ্ছপ, হরিণ, কীট ইত্যাদি পশুদেবতাদের অপূর্ব সমাহার।

কোনারকে তোলা এমনই শ্মশ্রুযুক্ত দুজন পুরুষের মূর্তি যারা ফোরসাম ও থ্রিসামে রত। আরও আশ্চর্যের যে তাদের কাউকেই পূর্বভারতীয়দের মতন দেখতে নয় (চৈনিক ও ইউরোপীয়)।

ফুটনোটঃ কোনো ইভলিউশন প্রসেসের তত্ত্ব নয়, পশুপূজার আদিবাসী ধর্মাচরণগুলিকে অঙ্গীভূত করে নিয়েই দশাবতারের ধারণা। ভারতীয় সনাতন ধর্ম অত্যন্ত আগ্রাসী! সে এলিমিনেশনে বিশ্বাস করে না। বিবিধের ও বৈচিত্র্যের মধ্যে মিলন করার রজ্জু তার ধর্ম। সনাতন ধর্ম সকল ধর্ম ও তাদের যাবতীয় অদ্ভুতগুলিকে স্বীকৃতি দেয় ও আত্মসাৎ করে নেয়। যে কোন ‘বাহন’ সেই আদিম জনগোষ্ঠীগুলির পশুপূজা ধর্মাচরণের প্রত্নচিহ্ন। বা তারও বেশি কিছু। সে যুগের মানুষ প্রাণীদের সঙ্গে নিবিড় যৌথ জীবন-যাপনের ফলে প্রাণীদের অভ্যাস-আচরণ-বৈশিষ্ট্য-শুভাশুভ গুণাবলীর খবর-তথ্য-তত্ত্ব আজকের অ্যানিম্যাল প্ল্যানেটের প্রাণীবিদদের থেকে সহস্রগুণে বেশি জানতেন-বুঝতেন। তার ভিত্তিতে মানব মনে তৈরি পশুদের মানস-ইমেজকে যে পরবর্তী মূর্তিসৃষ্টিকারীরা অত্যন্ত বৈজ্ঞানিকভাবে দেবদেবীদের মূল থিমের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই সংযুক্ত করেছিলেন তা বলাই বাহুল্য। তন্ত্র-অঘোর-শৈব বা সাগরসংগমে কপিলাশ্রমের সন্ন্যাসীরা যত প্রজাতির প্রাণীর উল্লেখ করেছেন (সামুদ্রিকও), বর্তমান বিজ্ঞান তত আবিষ্কার করতে পারেনি, তাদের ধারণা হয়তো সেই প্রজাতিগুলি বর্তমানে অবলুপ্ত। যাই হোক যতই হোক, পশুপতি শিব-এর মতো কনসেপ্ট অন্য মিথলজিতে বিরল।
এই ইনানার সহচরীদেবী ‘লামাশতু’ যার যৌন স্থানে কাঁড়াবিছে (সঙ্গমের প্রতীক), মস্তক সিংহের ও পক্ষীডানা সংযুক্তা, কুকুর ও শূকরের(প্রচুর সন্তান উৎপাদন ও অবাধ ইনসেস্টের জন্য পরিচিত, উর্বরতার প্রতীক) স্তন্যদাত্রী, এবং সর্পহস্তা (লিঙ্গের প্রতীক)। পরবর্তীকালে তিনি উপদেবতা-অপদেবতা-গ্রাম্য আঞ্চলিক দেবতায় (যেমন জ্বরাসুর) পরিণত হন; হয়ে যান ব্যাবিলনের অসুখের অপদেবী, গর্ভবতী মেয়েদের রোগ-দৌর্বল্যের জন্য দায়ী অপদেবী। আরো পরবর্তীকালে তিনিই ডাকিনী-হাকিনীসুলভ নারকীয় দেবীদের প্রতীক হন; পুতনা রাক্ষসীদের মতোই প্রজনন-প্রসব-নবজাতকের রোগ-ক্ষতি-মৃত্যু বিষয়ক অনিষ্টকারী অপদেবী রূপে বিবেচিতা হন। ইনানা যদি মহীয়সী মাতা হন ইনি তার ‘ছায়া’—দেবীর কালোদিক।

প্রকৃতিপূজা-উর্বরতার ধর্মবিশ্বাসে অভ্যস্ত মাতৃতান্ত্রিক-নদীমাতৃক সিন্ধু সভ্যতার বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলিতে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুগুলিতে লজ্জাগৌরির মতো দেহভঙ্গিমার একাধিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। শোভাযাত্রার সিলে এক নগ্না ও পা ছড়িয়ে বসা নারীর চিত্র পাওয়া যায় যাকে ঘিরে আছে মহিষ মস্তক ও ছাগমস্তক পেট-বড় গর্ভবতী দেবীরা (৩২০০খ্রিঃপূঃ)।

আরও পাওয়া যায় পারদ দিয়ে নির্মিত উজ্জ্বলচক্ষু ব্যাঙের সিল যার বিস্তৃত পায়ের দেহভঙ্গিমাও লজ্জাগৌরির মতো এবং তাকেও ঘিরে আছে কাঁকড়াবিছেরা। (আমরা এখানেই রূপকথাগুলিতে বর্ণিত ব্যাঙরাজপুত্র ও ব্যাঙরাজকন্যা বা সেইজাতীয় নারীর সঙ্গে সাদৃশ্য পাই এবং রূপকথায় সেই ব্যাঙ শেষপর্যন্ত সকল সমস্যার সমাধানকারী শক্তিরূপে নিজেকে প্রকাশ করে। ধর্ম ও মিথে ব্যাঙের উল্লেখ মিথগুলিকে প্রাচীন ও রূপকথাগুলিকে মহত্তর পর্যায়ে উন্নীত করে)।
অন্য একটি উত্তরকালের পরিণত হরপ্পা সিলে আমরা আপসাইড ডাউন এক নারীকে পা ছড়িয়ে বসে থাকতে দেখি ও তার যোনি থেকে একটি চারা গাছ বেরিয়ে এসেছে। আবার ওই সিলেরই উল্টোদিকে এক নারী তার মাথার চুল ছড়িয়ে হাত দিয়ে দুদিকে টানছেন এমন উদ্ভিদ প্রতীক দেখি যেমনকীনা মেসোপটেমিয়ার চিত্রেও দেখেছি। এই উন্নতি থেকে শস্য ও শাক-সবজির (১২০০ খ্রিঃপূ) মস্তকহীনা কৃষিদেবীরূপে লজ্জাগৌরির চরিত্রবদল পরিলক্ষিত হয়।

মৌর্যযুগেরও আগে ‘ষোড়শ জনপদ’কালের সময়ে আমরা পাচ্ছি পা ছড়ানো ও মাথার আলু থালু কেশে চন্দ্রশোভিত ও শিবজ অনুষঙ্গসমন্বিত নারীমূর্তিগুলি। চাঁদ সরাসরিভাবে নারীযৌনতার প্রতীক (তার ২৮ দিনের সাইকেল ও ঋতুস্রাব সমার্থক)। এই নারীসত্ত্বাগুলিই পরবর্তীতে ধ্যানী-যোগী শিবের প্রতীকের সঙ্গে একত্র হয়ে দুর্গা/গৌরি/পার্বতীর আদিরূপের জন্ম দেয়। দেবীর মনুষ্যমুণ্ড বিশিষ্ট একটি বিগ্রহের সঙ্গে খোদিত হতে দেখা যায় গণেশ, লিঙ্গ, ত্রিশূল ও ষণ্ড। এভাবেই শৈব ফার্টিলিটি কাল্টের সঙ্গে, শিবলিঙ্গের প্রতীকের সঙ্গে মিশে যান লজ্জাগৌরি। মৌর্যযুগের একটি অঙ্গুরীয়ের মধ্যেকার গর্তের ভিতরে বৃত্তাকারে মস্তকহীন পা ছড়ানো নারীমূর্তি অঙ্কিত দেখা যায়, যেখানে গর্তটি স্বয়ং যোনির প্রতীক। তবুও ১০০ খ্রিঃ পূর্বের আগে এই দেবীর পূর্ণাঙ্গ রূপটি সকল বৈশিষ্ট্য নিয়ে গঠিত হতে পারেনি। ৬০০ শতাব্দীর দাক্ষিণাত্যের শুঙ্গ রাজবংশের আমলেই লজ্জাগৌরির মহিমা চরমে ওঠে। নির্মিত হয় একাধিক মন্দির। তৎকালীন সময়ে বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের প্রাবল্যে ঐহিক ভোগবাসনা ত্যাগ ও চরম বৈরাগ্যময় পরিবেশে যখন বংশরক্ষা ও প্রজাউৎপাদন একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে তখন লজ্জাগৌরি যৌনতা ও কৃষির দেবীরূপে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন মূলত সাংসারিকদের কাছে।
আবার মধ্যযুগে দেবীর অধিকাংশ বিগ্রহের গর্ভবর্তী পেট দেখা যায়। আদিম যৌনতা ছেড়ে দেবী পরিপূর্ণরূপে মাতৃত্বের, সন্তান কামনায় আরাধ্যা দেবীতে পরিণত হন। পূর্বে হয়তো কটিদেশ ও পেট ক্ষীণ করে সুন্দরী মহিলাদের মতো যৌন আবেদনময় করাতেই চরিতার্থ হত শিল্পীর মানস ও সমাজের চাহিদা। আর পদ্মনাল বেয়ে পরিপূর্ণ ভরন্ত প্রস্ফুটিত পদ্ম কাঁধের দিকে হেলে পড়েছে, এই চিত্রকল্পে মেটানো হত তার মাতৃসত্ত্বা ও কৃষিদেবীসত্ত্বার চাহিদা। মাতৃসত্ত্বায় ক্রমান্বয়ে উত্তরণের ফলে সন্তান কামনায়, সন্তানের সুস্থতা কামনায় বিবাহিতা নারীদের উপাস্য হয়ে উঠলেন দেবী। সৃষ্টি হল পূজাপদ্ধতি, ব্রাহ্মণ্যমন্ত্র যা উচ্চারিত হত প্রসবকালীন অবস্থায় মা ও শিশুর সর্বতো মঙ্গলকামনায়। তার যোনিতে ও সিঁথিতে সিঁদুর মাখানো মূর্তি কামাখ্যায় আজও পূজিত হয় যা ঋতুস্রাবের প্রতীক। দেবীর সঙ্গে যুক্ত হন পুরুষ দেবতারা। অর্ধনারীশ্বর মূর্তিও আবিষ্কৃত হয়েছে যাও অতিপ্রাচীন মানতে হবে।

ব্রাহ্মণ্যবাদে আশ্রয় পাওয়া দেবী ক্রমে লক্ষ্মীপ্রতিমার সঙ্গে মিশে যান। বঙ্গে গৃহগুলিতে বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীপুজোর সন্ধ্যেতে অতিশুভ স্বস্তিকা চিহ্নরূপে ঘটে ও পটে পা ও হাত ছড়ানো এক মানবমূর্তি অঙ্কিত হয়, মনে করা হয় যে তা এই লজ্জাগৌরি দেবীরই নবতম চিহ্ন। যদিও পূর্বেকার মূর্তিতে দেবীকে তার যোনি স্পর্শ করে বেঁকে থাকতেও দেখা গেছে এবং যাকে বেষ্টন করে আছে কাঁকড়াবিছেরা, সেখানেও দেবীমূর্তি স্বস্তিকচিহ্নের মতোই দেখতে লেগেছে।
এইভাবে আদিমতম সভ্যতাগুলির রহস্যময় যৌনদেবী থেকে বর্তমান গৃহস্থালীর শুভত্বের স্বস্তিকাচিহ্নে উত্তরণের মাধ্যমে আমরা কি টাইমমেশিনে চড়ে সভ্যতার বিবর্তনকেই প্রত্যক্ষ করার চেষ্টা করি না? দ্বাদশ শতাব্দীর পর ভারতে নতুন করে কোথাও দেবী বিগ্রহ নির্মাণ করা হয়নি। পুরুষতন্ত্র তার বেসিক বর্বর ও উগ্র নারীদেহলোভকে বেশ ভালোভাবেই নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে সক্ষম হয়েছে।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes