
পঙ্কজ চক্রবর্তী-র কবিতাগুচ্ছ
প্রতিবিম্ব
এই যে মানুষের সামনে অথবা পিছনে মানুষের দল, উদ্দেশ্যবিহীন, কীভাবে চলেছে – এইসব ভাবতে ভাবতে তুমি এসে পড়েছ বটতলায়। মানতের ঢিলের নীচে বসে আছ চুপচাপ। যেকোনো সন্ধ্যায় তুমি ভাগ্যবান হলে দেখা যাবে পাঠকের লুকোনো ডানার অতিকায় ছায়া। ভাঙা আয়নায় গলে পড়া রতিক্রিয়া- অভিধান লুকিয়ে রেখেছে এতকাল। বিষণ্ণ হত্যাকারী ফিরে আসে অকুস্থলে, যেন স্মৃতিবিজড়িত এক সূর্যাস্তে ভ্রমণ।
তার খুব কাছে বসে তুমি লিখে ফেল যাবতীয় সুষম অক্ষর – ভেঙে দাও বিপুল সন্দেহ
বংশলতিকা
তোমার মৃত্তিকাপ্রেম উপসর্গ লুকিয়ে রেখেছে। ভাঙা লণ্ঠনের আয়ু তার পাশে দেখা দেয় চোখের অন্তিম ব্যবহার। কিছুদূর গিয়েছিলে তুমি। একটি উনিশ বছর পাশে ছিল – বিপক্ষে মতামত ছিল বহুদূর। সামান্য অপেক্ষা তুমি রিক্সাচালকের বন্ধু। অতিরিক্ত পয়সার বিনিময়ে তোমার হলুদ দাঁত দেখা গেল ঘোষণাসমেত।
এইসব উদাসীন দুপুরে সব গলিপথ পাকা রাস্তার দিকে খুলে দেয় বিবাহিত স্তন। যেন বা নদীর গর্ভ ফুঁড়ে এখনই উঠে আসবে হারিয়ে যাওয়া মানুষের থালা বাটি… অভিশপ্ত গন্ধর্বপুরুষ
পানসি
অদৃশ্য সুতোয় দেখি নৌকা রয়েছে নদী নেই। জল আছে মাইলখানেক দূরে বাসনকোসন সমেত। ঐ জল ঈষৎ কালো, মেঘহীন দাম্পত্যের মতো। পচা ডোবায় কুলুঙ্গি ডুবেছে যেন কার। শুকনো পাতার উপর স্কুলছুট বালকের বউ বউ খেলা। সূর্যাস্তে মাঠের ওপারে সে দেখেছে সোনার নৌকা চড়ে ফিরে যাচ্ছে মইদুলের মা গয়না ফেলতে ফেলতে সায়রের জলে।
এই দৃশ্য প্রতারিত। বাসনকোসনের গায়ে মনগড়া রূপোর মতো এক বিভ্রম গত শতাব্দীর।
কুলদেবতা
প্রতিটি অস্পষ্টতার ডানা দেখতে পাই আজকাল। আমার বয়সী এক মেঘে লুকোনো মলিন হাতপাখা। এখানে নদী নেই। মাঝে মাঝে মরা খাতে উঠে আসে অষ্টধাতুর দেবদেবী। কুলদেবতার পেতলের সিংহাসন।
সেদিন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এক কিশোরী বলে গেল রূপকথার আঁশটে গন্ধে তার দম বন্ধ হয়ে আসে। তারপর দেখি সে কোথাও নেই। শুধু কাদামাটির উপর কুলদেবতার মনিবের ছায়া হেঁটে যায়।
পরশু রাতের ঘটনা তবু দুশো বছর আমার মাথার উপর হাতপাখার মতো সে অনিচ্ছুক দুলেই চলেছে।
জিঘাংসা
মনে মনে জড়িয়ে যাচ্ছে হত্যাবাসনা এই ঘুলঘুলি প্রিয় মাঝরাতে। কার মুখ? কোন অতলস্পর্শ? সম্পর্কের সুতো এবার নামাও। ঘরে ঘরে লোকালয়ে অদৃশ্য কুয়োতলা। হলুদ খামারের পাশে ক্লান্ত রেলস্টেশন। দূর থেকে দেখা যায় গুমটির গাছে প্রিয় লাল শাড়ি। এক টুকরো গামছার গায়ে প্রতিবেশী বিড়ালের ছায়া।দুপাশে রেললাইন, ছোটো ছোটো গাছের আড়ালে জংশনের হাওয়া।কেউ জানেনা তবু হত্যা হয়। কেউ দেখেনি তবু পুকুরের কচুরিপানায় দুজন মানুষের অভিশাপ রাত হয়ে ফোটে।
হত্যাকারী হাত মুছে নেমে যায় সূর্যাস্তের দিকে
অপেরা
চলেছে যাত্রার দল পায়ে হেঁটে, বাঁশবন পেরিয়ে – পুরোনো পুকুরের ধারে সরোজিনী বালিকা বিদ্যালয়। হেডমাস্টার আগেভাগেই খুলে দিয়েছেন দোতলার ঘর। চাবি আছে দপ্তরীর কাছে (পাশেই বাড়ি)। কলতলায় চোখেমুখে জল দিতে দিতে মনে পড়ে কয়েক পুরুষ আগে এই ঘর পরিত্যাক্ত নীলকুঠি ছিল। কোনো এক রক্ষিতার গর্ভে তার মায়ের জন্ম। ভালোবাসার ছায়ায় বসে আছে পঞ্চায়েত প্রধানের ছেলে। দু-একটি অস্ফূট কথায় একটি চরিত্র যাত্রার আসর পেরিয়ে নেমে যায় পুকুরের দিকে।
জলের অনেক নীচে শোনা যায় ঘুমপাড়ানি এক সুর।