
ইন্দ্রনীল চক্রবর্তীর কবিতাগুচ্ছ
শব্দে শুরু হয়ে শব্দে শেষ হয়ে যাচ্ছি
সমস্ত কিছু ছাড়িয়ে দাড়িয়ে আছি-
এই বাস ট্রাম
এই দীঘির জল
এই উন্মাদ দুপুর, এই অর্থহীনতায়।
থেমে গেছে এক টুকরো জল- স্থল -মেঘ
কোনও কিছু ছুঁচ্ছে না আমায়
সমস্ত অভ্যুথানে।
শুধু শব্দে শুরু হয়ে শব্দে শেষ হয়ে যাচ্ছি।
পৃথিবীর সমস্ত প্রেম ছুঁয়ে ছুঁয়ে,
নিজের কাছে যে আরশি নগর
মায়া হয়ে সমস্ত বিকল্প কে হারিয়ে দিচ্ছে।
উচ্ছ্বাস বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রে,
দাড়িয়ে আছি স্রোতের মত বাস-ট্রামে
অর্থহীন আকাশে- নীরবতায়-
শব্দে শুরু হয়ে শব্দে শেষ হয়ে যাচ্ছি ।
কিছুই বলার ছিল না -জেনো এই পৃথিবী
কিছুই বলার ছিল না
কিছুই বলতে চায়নি।
যখনই বলতে বলেছ
থেমে গেছি বিপ্লবে।
মনে পরে গেছিল ক্লান্ত মুখ
সমস্ত চেতনা জুড়ে।
অপরাহ্ণে যেমন রাগ বাজে
শব্দরা তেমন ভেঙ্গে ভেঙ্গে
জোড়া লেগে গেছে হৃদ মাঝারে।
কিছুই বলতে চায়নি বা
কিছুই বলার ছিল না -জেনো এই পৃথিবী।
আমার সেই হলুদ সূর্য
জেলেকে জিজ্ঞেশ করি ,
তোমার জাল কি এতই বড়
যে ধরে দিতে পারবে আমার সেই হলুদ সূর্যকে?
গাছের পাতার থেকে বিকেল হতে হতে
সে পালিয়ে যাবে অচিন শহরে।
দীঘির জল কাগজের নৌকা ভাসায়
সাক্ষী রাখে হলুদ সূর্য, অনন্ত বিহ্বলে, পার্শ্ব চরিত্রে।
হাহাকার করি,
জেলেকে জিজ্ঞেশ করি,
ধরে দিতে পার আমার সেই হলুদ সূর্যকে?
কিছুই লাগেনি কবিতা লিখতে
সুর লাগেনি, গান লাগেনি,
না রাগরাগীণি,
ছবি লাগিনি, না মানুষ,
কবিতা এসে দাড়িয়েছিল সামনে।
নিথর অনন্ত মানুষ
যেমন সান্ধ্য ভাষায় কথা বলে, তেমনি
মিট মিট করে চেয়েছিল সে।
আর এক বুক স্রোত আর জলে
থৈ থৈ করছিল আমার ঘর।
স্থানাঙ্কহীন কবি
নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে
সে ভুলে গেছে সে কে ছিল।
অনেক খুঁজে খুঁজে সে পায়নি কিছুই, রানাঘাট লোকালে বা মফস্বলে।
বৃষ্টি ভেজা শব্দ শুনে সে মেঘের দেশে
স্থানাঙ্ক খোঁজে শুন্যতার ঘরে।
সমস্ত কিছু ভরে গেছে, মানুষে, কলমে, ফেলে দেওয়া প্যাকেটে।
কেউ কি জানে কি হবে
স্থানাঙ্ক হীন কবিদের?
সমস্ত প্রেম ছাপিয়ে -একটা প্রেম
সমস্ত প্রেম ছাপিয়ে -একটা প্রেম
এসে দাড়িয়েছে ঘরে।
তারপর থেকে খুঁজিনি কিছুই আমি,
তারাদের দেশে, অথ হৃদ কমলে ।
শুধু এক পৃথিবী লিখে গেছি আমি
সমস্ত প্রেম ছাপিয়ে একটি প্রেমের কথা।
কাল রাতে এক অদ্ভুত কবিতা লিখেছি
এক অদ্ভুত কবিতা লিখেছি-আমি
কাল রাতে, প্রকাশ্যে সূর্য লোকে নয়,
তীব্র জ্বরেও নয়, দংশনে ও নয়।
শোক ছিল না- পেঁয়াজ কেটে কেটে
চামড়া খুলে খুলে জল টেনে এনেছি আমি।
কবিতার থেকে কবিতায় মিশে গেছে সেই কবিতা।
কাল রাতে আশ্চর্য জনক এক অদ্ভুত কবিতা লিখেছি আমি।
ছাদের ওপারে কবিদের দেশ
ছাদের ওপারে কবিদের দেশ থাকে।
অপারহ্নের পাঁচিল থেকে দেখি
কবিরা কখনো চন্দ্রালোকে, কবিরা কখনো সূর্যলোকে।
সেই দেশ থেকে পাখি উড়ে
বসে যাচ্ছে তারে, ইথারে, পাঁচিলে।
অপারহ্নের পাঁচিলে দাড়িয়ে থাকি-
দেখি ছাদের ওপারে কবিদের দেশ।
মাঝে অজস্র পাথর কুচি
কবিতাদের মাঝে মাঝে
থেকে যায় অজস্র পাথর কুচি।
নিরাসক্ত কোলাজ তৈরী করে, সান্দ্র করে।
রাত ভোর হলে
মুছে যায় পৃথিবীর সমস্ত বায়বীয় ইতিহাস।
তোমার আমার অপরিসীম জাড্যে
প্রতিবিম্বিত হয় কোপাই নদীর তীরে।
ঘুম থেকে উঠলে কাঁদে
ঘুম থেকে উঠলে কাঁদে- পৃথিবী এসে গেল বলে।
সমস্ত ভোরের মত
সংকেত চিহ্নের মত
নিজের কাছে জানতে চাওয়া- হংস ধবনি।
এক রাশ সূর্যের মত বর্ণাঢ্য উৎসবে
একলা পাখি হয়ে কার্নিশ হয়ে উড়ে যায়
অলীক স্বপ্নগুলি।
ইষ্টিশনের কবি
ইষ্টিশনেরা কবিরা রোজ সাইকেল নিয়ে দাড়িয়ে থাকে
চরাচরের ট্রেনের জন্য।
সন্ধ্যা নেমে আসে মফস্বলে
তবু ট্রেন আসেনা।
আকাশ যাবতীয় আয়োজন করে
পূর্ণিমা আসে, অমাবস্যা আসে
তবু ট্রেন আসেনা।
ক্রিং ক্রিং শব্দ করে বাড়ি ফেরে
ইষ্টিশনের কবিরা।
অক্সিজেন শেষ হয়ে গেলে
অক্সিজেন শেষ হয়ে গেলে,
সমস্ত সভাঘর গুলো নতুন করে আর্তনাদ করে উঠবে,
সমস্ত মাইক দুমড়ে মুচড়ে কেঁদে উঠবে।
সমস্ত পরে থাকা ফুল গুলি
বলে উঠবে, “একটু বাতাস, একটু বাতাস।”
বাইরে তখন কালবৈশাখী বা ঈশান বিদ্যুৎ
অপেক্ষায় দ্রাবিত হবে আবৃত্তি।
ছড়িয়ে থাকে শব্দরা -উৎসবে
ভোরের ঘাসের চারিপাশে
ছড়িয়ে থাকে শব্দরা -উৎসবে।
উৎসব ক্লান্ত
একলা হতাহত যোগ সাদৃশ্য
কবি তারি মাঝে হেঁটে যায় বিবর্তনে।
যদি তুলে নেয় সে ছিটেফোঁটা নিটোল ঘরে-
ছড়িয়ে থাকে শব্দরা -উৎসবে।
কবিতার জন্য সবকিছু ছেড়ে
কবিতার জন্য সবকিছু ছেড়ে এসেছি-
এই কলেজ পাড়ায় আপাতত
মহাকাশচারী।
হেঁটে যেতে দেখেছি সমস্ত গলিকে
অন্ধকূপে কিম্বা তারাগোধূলি পথে।
চায়ে, কফি হাউসে, দোকানে , বইয়ের গন্ধে
সমস্ত নীহারিকাকে পুঞ্জীভূত হতে দেখেছি।
দেখেছি ধুমকেতুর মত উড়ে যেতে
বিছিন্ন কবিকে তারাজন্মে।
কী ছিলাম আর কী হয়েছি
কী ছিলাম আর কী হয়েছি, পৃথিবী
বলে বসল
এই নিসর্গ শব্দ প্রণালী।
জরায়ু থেকে যে ভাষা বেরিয়েছে আজ
তা কি কোনও দিনও ছিল।
জন্মেরও অনেক আগের থেকে
ও মৃত্যুর পরেও হয়তো
খুঁজতে গিয়ে এগিয়ে এসেছে
অদেখা রদ্দুর আর এই নিসর্গ শব্দ প্রণালী।
বলে বসেছে,
কী ছিলাম আর কী হয়েছি, পৃথিবী।
সমস্ত বিভেদ থেকে -ভাষা বিভেদে
নেতি নেতি করে
সমস্ত বিভেদ থেকে
ভাষা বিভেদে এসে দাঁড়িয়েছি।
আঁকড়ে ধরেছে, যেতে দেবে না বলে
অস্তিত্ব রক্ষায়-
এক বুক নদী জল আকাশ ধান,
ইট শহর বাড়ি,সমস্ত ভাষা হয়ে
নির্বাণ পথে।
অবিচল হয়ে মায়াকে চিনেছি
সমস্ত বিভেদ থেকে -ভাষা বিভেদে।
ভীষণ সুন্দর কবিতাগুলি। কবির একটি নিজস্ব স্বর সর্বত্র অনুরণিত হয়েছে।
অনেক ধন্যবাদ।