অজিত সিং বনাম অজিত সিং অষ্টাদশ পর্ব
তৃষ্ণা বসাক
অজিত সিং প্রথমে ছিল বঙ্গলক্ষ্মী চানাচুর, তারপর এল আজাদ হিন্দ চানাচুর, তারপর একের পর এক বিপ্লব চানাচুর, সর্বহারা চানাচুর, উন্নততর সর্বহারা চানাচুর, এখন চলছে বিশ্ববাংলা। এখানেই কি ভাবছেন গল্প ফুরিয়ে গেল? এবার আসছে একে ফিফটি সিক্স চানাচুর। নাম যাই হোক, সোল এজেন্ট আমি।’ ‘বেওয়ারিশ’ গল্পের চানাচুরওলা এবার ঢুকে পড়েছে বাংলার শিল্পক্ষেত্র থেকে শিক্ষাজগতের ক্ষমতার অলিন্দে।খুন, যৌনতা, প্রতিশোধ, নিয়তিবাদের রুদ্ধশ্বাস সুড়ঙ্গে সে টের পাচ্ছে- -বহুদিন লাশের ওপর বসে বারবার হিক্কা তুলেছি আমরা -বহুদিন মর্গের ভেতরে শুয়ে চাঁদের মুখাগ্নি করেছি আমরা -অন্ধ মেয়ের মউচাক থেকে স্বপ্নগুলো উড়ে চলে গেছে (জহর সেনমজুমদার) এই সবের মধ্যে বাংলার কি কোন মুখ আছে আদৌ? থাকলে কি একটাই মুখ? না অনেক মুখ, সময়ের বিচিত্র রঙে চোবানো? বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙ্গাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’-এ । সব কথনই রাজনৈতিক, সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক, ঝাঁকুনি লাগতে পারে। প্রকাশিত হল উপন্যাসের অষ্টাদশ পর্ব।
১৮
হারিয়ে যাওয়ার পর মানুষ কোথায় যায়? এ নিয়ে একসময় অনেক ভাবত সুমন। সেই সময় তার বুকের ক্ষতটা কাঁচা ছিল, একটু নাড়া পেলেই রক্ত ঝরত।ঝরত, আর থামতে চাইত না। অথচ এমনটা হবার কথা ছিল না। সুমন যে নিজের সীমানা বুঝত না এমন নয়। খুব ভালো করেই বুঝত আর নিজেকে খুব শক্ত করেই তার মধ্যে ধরে রেখেছিল। নিজের নতুন চাকরি, স্টাডি সার্কল, নতুন পত্রিকার স্বপ্ন, কফি হাউসের আড্ডা, অদিতি- সব মিলিয়ে নিজের একটা জগত। তখন তো ও সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করেছিল। কনিষ্ঠ কেরানী। বাম আমলের রমরমা। ক্যাচ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকাটা অসম্ভব জানত সবাই।এদিকে আলিমুদ্দিন ওদিকে লোকাল কমিটি বা এল সি- মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ফেলেছিল। ক্যাচ বা জ্যাক বা মামা না থাকলে যে কোথাও কিছু হয় না, এটাই সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। সুমনের মনে হয় সেটাই সর্বনাশের শুরু। মানুষের স্বপ্ন, বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাওয়াটা। সোজা রাস্তায় সৎভাবে কিছু পাওয়া যায়, এই বিশ্বাস চুরমার হয়ে যাওয়াটা, এর থেকে বড় ক্ষতি আর হয় না। এটা বিশেষ করে ছোটদের একেবারে ধসিয়ে দিয়ে যায়। তারা যদি একবার জেনে যায় ভালোভাবে পড়াশোনা করার কোন দাম নেই, সৎ চেষ্টার কোন দাম নেই, শুধু কারো ছত্রছায়ায় থাকতে হবে, বাবা কাকা মামা চাচা ধরে উঠতে হবে, স্কুল কলেজে ভর্তি থেকে বাড়িভাড়া, মায়ের শ্রাদ্ধ থেকে চাকরি কোন কিছুই এমনি এমনি সোজা রাস্তায় হবে না, তাহলে তো কয়েক প্রজন্মে চারিয়ে যায় সেই উদ্যমহীনতা, একটা জাতের মেরুদণ্ড বলে আর কিছু থাকে না, তার গৌরবের চিহ্নগুলোকেও সে আর গৌরব বলে চিনতে পারে না।
সুমনের সময় আলিমুদ্দিন স্ট্রিট ছিল সর্বনিয়ন্তা। আরও স্পেসিফিকালি বললে অমূল্যবাবু। একটা গল্প শুনেছিল একবার। উত্তরবঙ্গের কোন কলেজের প্রিন্সিপাল একবার অমূল্য বাবুর কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, অমর্ত্য সেন তো বছরে একবার শান্তিনিকেতনে আসেনই, সেইসময় ওঁকে যদি একটা স্মারক বক্তৃতা দেবার অনুরোধ করা যায়। একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের মুখ থেকে মূল্যবান বক্তব্য শোনার সুযোগ পাবে ছেলেমেয়েরা। অমূল্যবাবু নাকি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ অমর্ত্য সেন পণ্ডিত মানুষ, বলেনও ভালো, কিন্তু আমাদের পার্টিতে ওঁর থেকে অনেক বড় বড় পণ্ডিত আছেন, তাঁদের কাউকে দিয়ে বলিয়ে দেব।’ ঘটনাটা একজন প্রত্যক্ষদর্শীর মুখ থেকে শোনা, যা মিথ্যে হবার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। বাম আমলে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি নিয়োগ এইভাবেই হত। পার্টির লোক কিনা, কতটা অনুগত, সেটাই ছিল প্রধান বিচার্য। মার্ক্সবাদ মানে মুক্ত চিন্তা, এই ধারণাটা ভুল প্রমাণ করেছিলেন বাঙালি বামপন্থীরা, মূলত সিপিএমরা, তাঁদের মতো মৌলবাদী দল কমই হয়, যাঁরা নিজেদের মতের বাইরে যা কিছু দেখেছেন, ভয় পেয়েছেন। পৃথিবী সামনের দিকে এগোলে, তাঁরা হেঁটেছেন পেছন দিকে। যে কারণে কম্পিউটার ঢুকতে এত সময় লেগেছে এই বঙ্গে।তাঁদের ছেঁড়া চটিতে পা গলিয়ে যারা ক্ষমতায় এল, তাদের দেখা গেল অত ছুঁতমার্গ নেই। পার্টির আনুগত্যের থেকেও বেশি গুরুত্ব পায় কে কত টাকা আনতে পারবে। কত দ্রুত টাকা তুলে নিতে পারবে। সামনে পালিশ লাগানোর কাজটা যে কারণে খানিক বেশিই হল আগের আমলের চেয়ে। আগের আমলে তো ঘরে আগুন লাগলেও উত্তরের জানলা কিছুতেই খোলা যাবে না, অনেকটা ব্যাদে যা লেখা আছে, তার বাইরে কিছু করা মানেই গুনাহ। মজা হচ্ছে বেদ মানে দাস ক্যাপিটাল কিংবা রেড বুক কজনই বা পড়ে দেখেছে? প্রথম দশটা বছরের পর তো বেনো জল ঢুকতে শুরু করেছিল হুড়মুড় করে।কিন্তু ওপরতলায় বসে যাঁরা সিদ্ধান্ত নিতেন, তাঁরা যে এসব বোঝেননি, শুধু তাই নয়, বাস্তবের দাবী মেনে পরিবহন ব্যবস্থা, অফিস কাছারি, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিকীকরণ করার কথাও ভাবেননি। তাঁরা শুধু তত্ত্ব কপচে গেছেন। এই ব্যাপারে মনুপন্থী আর বাঙালি বামপন্থীদের মধ্যে বিশেষ তফাত নেই।
পরিবর্তন পরিবর্তন শোর মাচিয়ে যারা এল তারা আবার উল্টো। তাদের কোন বাদের বালাই নয়। সব ‘বাদ’ই বাদ। তারা বোঝে মাল্লু। পিছুটান বলতে তাই কিছুই নেই। তাড়াও বেশি। লুটে নাও, দুদিন বই তো নয়, কার যে কখন সন্ধে হয়! কদ্দিন গদি থাকে কে বলতে পারে! অচিরেই দেখা গেল চওড়া রাস্তাঘাট, ঝকঝকে অফিস, অসহ্য সব মূর্তি দিয়ে সাজানো পার্ক। দেখা গেল এরা বামপন্থীদের মতো মতাদর্শ নিয়ে কোন দোলাচলে ভোগে না, নিন্দুকেরা বলে এদের কোন মতাদর্শেরই বালাই নেই। তাই প্রথম থেকেই এদের ঘোড়ায় জিন দেওয়া। আগেকার মতো আঠেরো মাসে বছর নয়। টাকা দেওয়া নেওয়াটাকে এরা একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেল।
একবার বাংলা অকাদেমির এক কর্মী বলেছিল সুমনকে, বুঝলে ভাই, আগে আগে লেখক শিল্পীদের ডাকার সময় দেখা হত, তারা ওদের জাতের কিনা, অর্থাৎ সিপিএম কিনা, আর এখন এরা একটা বাজার করে দিয়েছে। খোলা বাজার, তাই খেলাটা বাজারের নিয়মেই হবে। যে বাজার দখল করতে পারবে, সে উঠবে।
সুমনের ভাগ্য ভালো বলতে হবে, আলিমুদ্দিনের প্রসাদ ছাড়াই সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছিল। কেবল ভালো রেজাল্ট সম্বল করে। সবাই অবাক হয়ে বলেছিল ছাঁকনি দিয়ে এক আধটা গলে যায় ওরকম।তাতে কিছু প্রমাণ হয় না। অর্থাৎ সিস্টেমটার যে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুন ধরে গেছে এই নিয়ে কারো কোন সন্দেহ ছিল না। সন্দেহ যেমন ছিল না, তেমনি তাপ উত্তাপও ছিল না। নইলে যারা বিরোধীও নয়, নিরপেক্ষ বলে নিজেদের, তাদের দিক থেকেও প্রতিবাদ হল না কেন? আসলে সবাই ভয় পেতে শুরু করেছিল। অন্যদিকে দৃশ্য শ্রাব্য মাধ্যমের উত্থান এইসব ভীতু মানুষদের একটা উষ্ণ গৃহ কোটর দিয়েছিল। হাজারটা চ্যানেলে এরা নিজেদের ডুবিয়ে রাখতে পেরেছিল। সবচেয়ে বড় নেশা ছিল ক্রিকেটের। খেলা আর খেলা ছিল না, হয়ে উঠেছিল দেশপ্রেমের প্রতীক। এই নেশা, বাকি সব অপ্রাপ্তি, অভাব অভিযোগকে ভুলিয়ে দিচ্ছিল। পাড়ায় পাড়ায় পুরনো হতশ্রী শহিদ বেদিগুলোকে ঢেকে দিয়েছিল বিশ্বজয়ী ক্রিকেটারদের ছবি। দুনিয়ায় হাতে গোনা কয়েকটা দেশ যে খেলা খেলে, তাকেই বিশ্ব বানিয়ে নিজেদের আন্তর্জাতিক ভেবে শ্লাঘা অনুভব করত লোকে। মাথার ওপর কারো স্নেহের হাত ছিল না বলে সুমনের একটু ঘ্যাম ছিল। কাউকে তোয়াক্কা করত না সে। হাজার বললেও কোন সংগঠনের মেম্বার হতে চায়নি, কিন্তু এক সিনিয়র দাদা বলল, এদের চটিয়ে চাকরি করতে পারবে না তুমি। অন্তত বছরের চাঁদাটা দিয়ে যাও। তেতো মুখ করে সেটাই করত সে। টিফিন ব্রেকে যখন সবাই এদিক ওদিক যেত, কিংবা গেট মিটিং-এ গলা ফাটাত, তখন সে চুপচাপ বসে বই পড়ত। সেইরকম একদিন বই পড়ছে, হঠাৎ কার যেন ছায়া পড়ল তার হাতের খোলা বইয়ের পাতায়। সে মুখ তুলে দেখল অচেনা এক অপরূপা নারী তার সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে বলছেন ‘দেখতে পারি, কী বই?’
ঘরে দু চারজন লোক যারা ছিল, ব্যানার্জিদা, স্বপন, শোভনবাবু- সুমন টের পেল তাদের মধ্যে একটা শশব্যস্ত ভাব। ইনি কে?
ওদের সন্ত্রস্ত চোখের ভাষা পড়ে নয়, আগন্তুক স্রেফ একজন মহিলা বলেই সুমন উঠে পড়ে বইটা এগিয়ে দিল, সলঝেতসিনের ‘ক্যান্সার ওয়ার্ড’। ভুরু কুঁচকে গেল মহিলার। তবে তা ক্ষণিকের জন্যে। পরমুহূর্তেই তাঁর মুখে ফিরে এল ভুবনভোলানো হাসি।
‘আপনি দেখছি খুব পড়ুয়া ছেলে। মাঝে মাঝে আমাদের ইস্তাহারগুলোও পড়ুন। আর আজ তিনটেয় একটা গেট মিটিং আছে। আসবেন কিন্তু’
সুমনের মাথা গরম হয়ে গেল।এ তো সামন্ততন্ত্র! সে কি এঁর খাস তালুকের প্রজা নাকি? জোর করে মিটিং-এ নিয়ে যাবেন? তার ইচ্ছে না থাকলেও যেতে হবে?
সে শুখনো গলায় বলল ‘মাপ করবেন। আমাকে একটা রিপোর্ট আজই তৈরি করে জমা দিতে হবে। তাছাড়া মিটিং মিছিলে আমি স্বচ্ছন্দ নই’
ঘরে যেন বোমা পড়ল। ব্যানার্জিদা হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন বুঝতে পারল সুমন। সেই মহিলা, তখনো তাঁর নাম জানে না, তিনিও স্থির চোখে ওকে দেখছিলেন। তারপর ওর দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে বললেন ‘আমি ডাকলেও আসবেন না?’
ঝুঁকে আসার জন্য শাড়ির আঁচল নেমে গিয়ে বিপজ্জনক বিভাজিকা দেখতে পেল সুমন। কী একটা বিদেশি পারফিউমের গন্ধ ওকে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরল। আর সবচেয়ে বড় কথা, কী যেন ছিল ওঁর গলায়, এমন মাদক কণ্ঠস্বর আর শোনেনি সুমন।
‘আমি ডাকলেও আসবেন না?’
সমস্ত শরীর ঝনঝন করে উঠল তার। সে তবু কঠিন গলায় বলল ‘সরি। আমি আসতে পারব না’
মহিলা ওর কাঁধ ছুঁয়ে বললেন ‘আমি জানি আপনি আসবেন। আজ না হলে কাল’
বলেই দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। ওঁর চৌকো সর্ষে ক্ষেতের মতো পিঠ ঘর পেরিয়ে লম্বা করিডর দিয়ে একসময় সুদূরে মিলিয়ে গেল। সুমনের মনে হল করিডরের দু পাশের দেওয়ালের কুৎসিত পোস্টারগুলো যেন লজ্জায় মুখ ঢেকেছে এঁকে দেখে। কে ইনি?
ব্যানার্জিদা প্রথমে মুখ খুললেন ‘করেছ কি বস? শতরূপা ব্যানার্জিকে চটিয়ে দিলে সবে জয়েন করেই? একেবারে সাপের লেজে পা দিলে যে’
স্বপন এসে বলল ‘কী যে করেন? বলতেই পারতেন যাব। একবার মুখ দেখিয়ে চলে এলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হত? আপনার আবার বেশি বেশি!’
সুমনের শরীর তখনো একটু একটু কাঁপছিল। ইনি শতরূপা ব্যানার্জি? এঁকে সে মুখের ওপর না করল? গ্রেট!
না, পরে নাম এবং নামের পেছনের জ্যোতির্বলয় জানার পরেও কোনদিন গেট মিটিং- এ যায় নি সুমন, শতরূপা ব্যানার্জির ডাকে।এ ছাড়াও একটা মিছিল বার করতেন উনি, যাকে সবাই ঠেস মেরে বলত শতরূপার স্কোয়াড। ওঁর পেছনে লাইন দেওয়ার জন্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। লিফটেও তাই। কে শতরূপার পেছনে দাঁড়াবে? সুমন দূর থেকে দেখেছে। কিন্তু পেছনে দাঁড়াতে চায়নি। ওর ঘেন্না হত ছেলেগুলোর হ্যাংলামি দেখলে। প্রতিটা গেট মিটিং, মিছিলের দিন ডিপার্টমেন্টে আসতেন শতরূপা, সবাইকে একসঙ্গে বলে গেলেও, সুমনের কাছে এসে দাঁড়াতেন একবার, ওকে বলতেন আলাদা করে, ‘এবার আসবেন নিশ্চয়’
শেষ যেদিন এসেছিলেন সেদিন বলেছিলেন ‘আসবেন তো? আমি কিন্তু অপেক্ষা করব’ সেদিন আক্ষরিক অর্থেই কেঁপে গেছিল সুমন। শতরূপা ব্যানার্জি অপেক্ষা করবেন তার মতো এক কনিষ্ঠ কেরানির জন্যে? কেন? সেইসময় সে অদিতির সঙ্গে প্রেম করছে। ছুটির পর অদিতি ওর জন্যে কফি হাউসের নিচে অপেক্ষা করে, কখনো ওরা হেঁটে চলে এলোমেলো। অদিতি ব্যারাকপুর যাবে। ওকে তুলে দিয়ে আসে শিয়ালদার ট্রেনে, তারপর ও ডানলপের বাস ধরে। এইরকম অতি তুচ্ছ তুচ্ছ জিনিস খুঁটে আনন্দ, সেখানে শতরূপা ব্যানার্জি তো বিরাট ব্যাপার। সুদূরের বলাকা। কত মন্ত্রী সান্ত্রীর সঙ্গে ওর ওঠাবসা, শোয়া, রেজিস্ট্রার অব্দি ওঁর অনুগত। উইকএন্ড ওঁর সঙ্গে কে কাটাবে, তা নিয়ে প্রায় ডুয়েল লড়া হয়। সেখানে সুমন! হাঃ। কিন্তু অপেক্ষা করবেন! এই কথায় কেমন টলে গিয়েছিল সুমন। সে বলে ফেলেছিল, ‘আমরা একটা পত্রিকা বার করি। বিনির্মাণ। আজ কফি হাউসে উদ্বোধন। আপনি আসবেন? তাহলে ছুটির পর নিয়ে যাব আপনাকে।’
শতরূপা ওকে অবাক করে দিয়েবলেছিলেন ‘যাব’। সেই সন্ধেটা এক আশ্চর্য সন্ধে। কফি হাউসের সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামার সময় কেবলই শরীর ছুঁয়ে যাওয়া, ফেরার রাস্তায় ওঁর গাড়িতে জোর করে তুলে নিলেন, সিঁথিতে নাকি কী কাজ আছে, নামিয়ে দিয়েছিলেন ওর বাড়ির মোড়েই, নামার সময় হাতটা ছুঁয়ে বলেছিলেন, ‘তোমাকে খুব ভালো লাগল আমার। খুব ক্লান্ত আমি। একদিন সারাদিনের জন্যে কোথাও যাব, কেমন? আচ্ছা কাল আমি জয়েন করছি জানো তো? হিস্ট্রিতে লেকচারার হয়ে? ব্যস্ত থাকব। পরশু বসব কোথাও’
সেটাই শেষ কথা। শেষ দেখাও। পরের দিন সকালে উঠে সুমনের শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছিল, জ্বর এসেছে, গা হাত পা ব্যথা। বাথরুমে যেতে গিয়ে শরীরটা টলে গেল। সেদিন সুমন ঠিক করল একটা সি এল নিয়ে নেবে। শুয়ে শুয়ে বই পড়তে পড়তে একটা আবছা সুগন্ধ কোথা থেকে আসছিল যেন। কফি হাউসের সিঁড়িতে ওঠার সময় সুমনের কনুই ছুঁয়ে গেছিল শতরূপার ডান স্তন।ঝনঝন করে উঠেছিল সারা শরীর। গাড়িতেও কত কাছাকাছি বসে ছিল তারা। নামার সময় হাত ছুঁয়েছিলেন শতরূপা। জ্বরের তন্দ্রাচ্ছন্নতার মধ্যে সেই স্পর্শ, কথার টুকরো টাকরা ফিরে ফিরে আসছিল। সন্ধেয় ওর জ্বর ছেড়ে গেছিল। সারাদিন সেভাবে কিছু খেতে ইচ্ছে করেনি। মা এসে বলেছিল ‘কিছু খাবি? আলু মরিচ করে দিই?’
কিছু কিছু খাবার থাকে, যা নিছক খাওয়ার জন্যে খাওয়া নয়, যার সঙ্গে মানুষের স্মৃতি আর সত্ত্বা জড়িয়ে থাকে। আলু মরিচও তাই।আশৈশব যত জ্বরের স্মৃতি, ছায়া ছায়া ঘর, বিছানায় অয়েল ক্লথ পেতে মাথা ধুয়ে দেওয়া, তপ্ত কপালে মার স্নিগ্ধ শীতল হাত, আর জ্বর ছাড়ার পর বিস্বাদ মুখে প্রথম স্বাদের বিস্ফোরণ – এই সব কিছুই আলু মরিচ, একটা জীবন্ত শুশ্রূষার মতো। সে মাকে বলল ‘সব কিছু আগের মতো আছে, তাই না মা?’ মা বেশ অবাক আর রুষ্ট হয়ে বলেছিল ‘কী যে বলিস তুই? তুই বদলে গেছিস বলে মাও কি বদলে যাবে?’ মা কি ইঙ্গিত করেছিল অদিতির সঙ্গে ওর সম্পর্কের পর সুমন বদলে গেছে, মাকে সময় দিচ্ছে না আগের মতো? একটু বিষণ্ণতা ছেয়ে ফেলেছিল তাকে। তাদের দুজনের সংসারে সে বেরিয়ে গেলে মা খুব একা হয়ে যায়, সেও তো ফেরে কত রাতে, অফিসের পরেও আড্ডা, একটা স্টাডি সার্কেল চালু করেছে, নতুন একটা লিটল ম্যাগাজিন বার করার প্ল্যান হচ্ছে, তাছাড়া অদিতি আছে, এইসব করে ফিরতে ফিরতে দশটা বেজে যায় প্রায়ই, আজ জ্বর বলেই সারাদিন বাড়িতে। তার মনে হল জ্বর হল বলেই মা কিছুটা পেল তাকে, নাহ, এবার অদিতির সঙ্গে সম্পর্কটায় একটা শিলমোহর লাগাতে হবে্, যদিও অদিতিও বাড়ি বসে থাকবে না, কিন্তু ও মার সঙ্গে সখ্য তৈরি করে নেবে ঠিক, মার এত একা লাগবে না, কিন্তু, কিন্তু এইসব ভাবনার মধ্যেই একটা চিনচিনে মনখারাপ, কালকের মৃদু সুগন্ধের মতো ওকে ঘিরে ফেলছিল। ও চমকে ভেবেছিল, এ তো অসম্ভব। স্বপ্নেও যা কামনা করা যায় না, সেই কামনা কেন করছে ওর মন? জ্বরক্লান্ত শরীর নিতে পারছিল না এই লড়াই। ও চোখ বুজে পড়ে ছিল। এমন সময় মা পরোটা আর ঘিয়ের গন্ধে ভরপুর আলু মরিচ নিয়ে এসে দাঁড়াল। গন্ধেই ওর জিভের বিস্বাদ কেটে যাচ্ছিল। ওর মগজের কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়ছিল সেই স্বাদ, ওর আচ্ছন্নতা কেটে যাচ্ছিল। উঠে বসে প্লেটটা হাতে নিতে নিতে ওর মনে হল সারাদিন বিশ্ব সংসারের কোন খবরই ও নেয়নি, নিতে ইচ্ছেই করেনি। মা চলে যাচ্ছিল ঘর থেকে। সন্ধে দেবে হয়তো। ও বলল ‘মা টিভিটা চালিয়ে দিয়ে যাও তো’। তখন সবে খবর শুরু হচ্ছে ডিডি বাংলায়। হেড লাইনের পরেও বিশেষ বিশেষ খবর, আর সেখানে কী শুনল সে? ওর গলায় আলুর টুকরো আটকে গেছে মনে হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসিস্টেন্ট কন্ট্রোলার অব একজামিনেশন আজ সকাল থেকে নিখোঁজ। তিনি আজ ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন, তার পর থেকে তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁর মা থানায় অভিযোগ করেছেন মেয়েকে পাওয়া যাচ্ছে না। শতরূপা ব্যানার্জি ইতিহাসের কৃতী ছাত্রী, তাঁর বয়স ৩৫, নিখোঁজ হবার সময় পরনে ছিল বেগুনি সুতির শাড়ি।। চমকে ওঠে সুমন। এ তো কালকের শাড়িটা। স্পষ্ট মনে আছে তার। শতরূপা তো এক শাড়ি পরপর দুদিন পরেন না।ওঁর পোশাক, সাজ, স্টাইল স্টেটমেন্ট নিয়ে রীতিমতো চর্চা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনেক গুঞ্জন কানে এলেও ওঁকে দেখলে সেসব মনে থাকে না কারো। কেমন যেন দেবী প্রতিমার মতো চেহারা, সেইরকম ব্যক্তিত্ব, অসুর নিধনের জন্যে জন্মেছেন। শতরূপা কালকের শাড়ি আজ পড়েছেন, তাও লেকচারার পোস্টে জয়েনিং-র বিশেষ দিনে। এর মধ্যে কোথাও একটা বিরাট গণ্ডগোল আছে। ‘আমি খুব ক্লান্ত সুমন’, বলেছিলেন কাল। তাহলে কি….