ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ষষ্ঠ পর্ব
সন্দীপন চক্রবর্তীর জার্নাল
সংবাদপত্রের কল্যাণে আমরা অনেকেই হয়তো একজনের নাম জানি — নীলাঞ্জন হাজরা। নানারকম কাবাব ও তার ইতিহাস নিয়ে তাঁর লেখা সাম্প্রতিক একটি বই ‘কাবাব কিসসা’-র সূত্রেও হয়তো আমরা শুনেছি তাঁর নাম। কিন্তু আমরা ক’জন জানি উর্দু ভাষায় — বিশেষত কবিতায় — তাঁর গভীর প্রেম ও ব্যুৎপত্তির কথা? হয়তো অতি সম্প্রতি এই আবহমানের ‘ফয়েজ পরিক্রমা’ পড়ে আমরা তার খানিক আন্দাজ পাচ্ছি। কিন্তু আমরা ক’জন জানি পাকিস্তানের সাম্প্রতিক উর্দু কবিতায় উল্লেখযোগ্য কবিদের কথা? অথচ, আমরা — যারা কবিতা পড়তে ভালোবাসি — যদি আমাদের সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার মানচিত্রকে বুঝতে চাই, তাহলে আমাদের আশেপাশের রাজ্য ও দেশগুলোয় অন্যান্য ভাষায় কেমন কবিতা লেখা হচ্ছে, তা বুঝে নেওয়া খুবই জরুরি, এমনকি হয়তো বলা যায় আবশ্যক। কিন্তু জানবো কী করে? সেই ভাষা তো আমি জানি না! সেক্ষেত্রে আমাদের সবথেকে সুবিধা হয়, যদি সেই ভাষা থেকে সরাসরি কেউ অনুবাদ করেন বাংলায় এবং ইতিহাসগতভাবে খানিকটা ধরিয়ে দেন ওই কবিতার বৈশিষ্ট্যের সূত্র। ঠিক সেই কারণেই নীলাঞ্জন আমাদের ধন্যবাদার্হ। আধুনিক সময়ের এক উল্লেখযোগ্য পাকিস্তানি কবি অফজাল আহমেদ সৈয়েদ-এর ‘কেড়ে নেওয়া ইতিহাস’-এর উর্দু থেকে সরাসরি বাংলায় অনবদ্য একটি অনুবাদ করেছেন তিনি। এই অনুবাদ যে এত বিস্ফোরক উদ্বেগ নিয়ে ধরা দিতে পেরেছে বাংলায়, তার প্রধান কারণ নীলাঞ্জন নিজেও একজন কবি। এই বইয়ের শুরুতেই ‘অফজাল আহমেদ সৈয়েদ এবং পাকিস্তানের আজকের কবিতা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে তিনি ধরিয়ে দেন — গালিবের অনেক পরে আধুনিক পাকিস্তানি উর্দু সাহিত্যের ক্ষেত্রে সাদাত হাসান মান্টো থেকে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ হয়ে অফজাল আহমেদ সৈয়েদ পর্যন্ত যাত্রার পুরো ধারাটি। অফজাল আহমেদ সৈয়েদ-এর জন্ম ভারতের গাজিপুরে ১৯৪৬-এ। অর্থাৎ বয়সে আমাদের ষাটের শেষদিক বা সত্তরের শুরুর দিকের কবিদের সমসাময়িক হলেও তিনি বস্তুত আশির কবিদের আত্মীয়। তাঁর শৈশব ও যৌবনের অনেকটাই কেটেছে ঢাকায়। পরে তিনি করাচি চলে যান এবং বর্তমানে সেখানেই থাকেন। তাঁর কবিতা লেখা শুরু ১৯৭৬ সালে। প্রথম কবিতার বই ‘ছিনি হুয়ি তারিখ’ (কেড়ে নেওয়া ইতিহাস) প্রকাশিত হয় ১৯৮৪-তে। এই দ্বিভাষিক সংস্করণের সুবিধা হলো যে এতে উর্দু এবং বাংলা দুটোই দেওয়া আছে। অর্থাৎ আমরা শুধু পিছিয়ে যাবো পঁয়ত্রিশ বছর। পাকিস্তানের আজকের কবিদের একাংশ — নীলাঞ্জন দেখিয়েছেন যে — ‘এই ৮০-এর দশক থেকেই অত্যন্ত সচেতনভাবেই যেন নিজেদের কবিতাকে নিয়ে চলে গেলেন উর্দু কবিতার দারুণ সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের একেবারে বিপরীত মেরুতে। তার পরের ২০ বছর ধরে এই সব কবিরা নিজের-নিজের মতো করেই গড়ে পিটে নিয়েছেন এমন একটা কাব্যভাষা যার মধ্যে আছে এক অন্তর্নিহিত উদ্বেগ। যে-উদ্বেগ এইসব কবিকে কিছুতেই সমাজবিচ্ছিন্ন একান্তই নিজস্ব পরম উপলব্ধিতে নিবিষ্ট হওয়ার সুযোগ দেয়নি কোনোদিন। একইসঙ্গে আবার সংগঠিত রাজনীতিতে ক্রমাগত বিশ্বাস হারানো আজকের পাকিস্তানি কবি গভীরে ভীষণভাবেই একা। আর তাঁর সেই একাকিত্বের কবিতায় ক্রমাগত ছায়া ফেলছে টহলদার সৈন্যের ভারি বুটের শব্দ, অতর্কিত বিস্ফোরণের শব্দ কিংবা কাছাকাছি কোথা থেকে যেন ভেসে আসা ফায়ারিং-এর শব্দ। এ-রকমই অস্বস্তিকর, অপ্রত্যাশিত, ধারালো আজকের পাকিস্তানি কবিতা, অফজালের কবিতাও।
“আমি পাইনি এত অঢেল জীবন
সারিবদ্ধ প্রতিপক্ষ পার করে আমার কাছে পৌঁছেছে আমার নদী
চিরদিন এঁটো জলই পান করেছি আমি
বর্ষার নামে আমায় খালি রাখতে হয়েছে একটা ঋতু
আমার জন্যে যে রেখে গেছে উত্তরাধিকার-দলিল
বর্ষার জলে সে খালি পায়ে হাঁটেনি কোনও দিন…”