
রক্তকরবী ও রবীন্দ্রনাথ
ধীমান ব্রহ্মচারী
সিস্টেমের বিরুদ্ধে অবস্থানের কথা বলতে আমরা যখন হিংস্র হয়ে পড়ি, নিজের অবস্থান – ইতিহাস ঐতিহ্য এবং সবচেয়ে বড় কথা আবহমান নিজস্ব সংস্কৃতি প্রত্যাহার করি, তখনই আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে লেখা একটি নাটক নাম রক্তকরবী, এই নাটকেই একটা সিস্টেমের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার কত সহজ ভাষা বা সহজ প্রশ্ন করেছেন রক্তকরবীর রবীন্দ্রনাথ। বারবার এই নাটক আমাদের সীমাহীন চিন্তা – ভাবনা ও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। আসলে জীবনের স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততা, প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা, জীবনের সাধারণ ঘটনা, এমনকি ছোট ছোট চাওয়া-পাওয়াগুলোর মধ্যেই বেঁচে থাকার আসল রসদ। কিন্তু যখন এইসব কিছুর বাইরে গিয়ে আমরা বৃহত্তর সভ্যতাকে মাথায় রেখে, শুধু অট্টালিকা প্রাসাদ ঝাঁ চকচকে এলিট ক্লাসের মত আজকের সভ্যতায় বেঁচে থাকি – তখন কেন জানিনা বারবার মনে হয় শান্ত শীতল স্নিগ্ধ যে বাতাবরণে ঘেরা এই ব্রহ্ম, এই পৃথিবী আর প্রকৃতি, সেখানে সর্বদাই নাগরিক সভ্যতার হাতছানি কোথাও যেন আমাদের সাধারণ বেঁচে থাকাকে বারবার কণ্ঠ রোধ করে। করে আমাদের কুক্ষিগত। প্রবাসী পত্রিকায় ১৯২৪ এ প্রকাশিত হলেও, রক্তকরবী নাটক গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায় ১৯২৬ এ। এদিকে আজ রবীন্দ্র জন্মের ১৬৪ তম বার্ষিকী। রক্তকরবীর ১০০ বছরের যাত্রা নেহাতই কম নয়। একশো বছরের সভ্যতা থেকে সংস্কৃতি, ভাষা থেকে ভাব, রাজনীতি থেকে অর্থনীতির সব কিছুরই বিরাট পরিবর্তন হয়ে গেছে কালের নিয়মেই। অথচ রক্তকরবী থেকে গেছে কালের পর কাল ধরে। একশো বছরের রক্তকরবীর উজ্জ্বলতা এতটুকুও ম্লান হয়ে যায়নি। যন্ত্রসভ্যতার আস্ফালন আমাদের মনুষ্যত্বের অনুষঙ্গগুলোকে কোথাও যেন শিথিল করে দিয়েছে। আমরা প্রত্যেকেই সেই যক্ষপুরীতেই ঢুকে পড়ছি, দিনের পর দিন, ক্রমাগত আর প্রতিনিয়ত। দিন থেকে রাত অর্থ উপার্জনের পেছনে ছুটছি আমরা, ছুটছে মহাকাল। প্রতিনিয়ত ইঁদুর দৌড় আমাদের চিন্তায় মেদ জমিয়ে দিয়েছে আমাদেরই অজান্তে। সকালের সূর্যের আলো, শীতের ঘাসের ওপর জলবিন্দু, প্রখর রৌদ্রে চাষা যখন কাদা মাটি জলে মাঠের ধান বুনছে, সূর্যাস্তের সময় অন্ধকার করে নেমে আসছে সন্ধ্যের আকাশে – এসব কিছু উপেক্ষা করে আমরা ধনসঞ্চয়ের জন্য সর্বদাই ছুটছি যন্ত্রের মত এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। জীবনের এই সুদীর্ঘকাল প্রবাহ পথেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের মুক্তির পথ দেখিয়েছেন যেন। রক্তকরবীর আমরা প্রত্যেকেই সেই বিশু পাগল। আর আমাদের প্রত্যেকের প্রণয়ী হয়ে থেকে যাবে নন্দিনী।
পাশ্চাত্য সভ্যতার বিশেষত যান্ত্রিক সভ্যতার বিরুদ্ধে আমাদের প্রাচ্য সভ্যতার যে নৈতিক সংস্কৃতি ও সাধারণ জীবন যাপন, সেখানে আজকের দ্বি-বিংশ শতাব্দীতে আমাদের যন্ত্র সভ্যতার আস্ফালন কোথাও যেন আমাদেরকেই শ্বাসরোধ করে নাটকের ওই যক্ষপুরীর বা পাতালপুরীর অন্ধকার ঘরে নিয়ে যায়। আসলে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর রক্তকরবী নাটককে কোন দিনই কোন বস্তু সীমা বা তথ্যের মধ্যে নির্দিষ্ট করা যায় না। রবীন্দ্রনাথের নাটক বৈচিত্র্যের সম্ভারে পরিপূর্ণ। ‘রক্তকরবী’ এমনই বৈচিত্র্য প্রধান নাটক। বাংলা নাটকের জগতে এই নাটকটি অন্যমাত্রা এনে দিয়েছে। ‘রক্তকরবী’ নাটকে আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামের কথা প্রাধান্য পেয়েছে। সমাজে যেমন পেশাগত দিক থেকে নানা শ্রেণির মানুষ থাকে এখানেও রাজা আছে, প্রজা হিসেবে সর্দার, মোড়ল, গোঁসাই, অধ্যাপক, পালোয়ান, খোদাইকর, খননকারী শ্রমিক শ্রেণির মানুষ আছে। কিন্তু দুটি শ্রেণির মানুষ এখানে এসেছে। যন্ত্র সভ্যতার পক্ষ হিসেবে যক্ষপুরীর রাজা, সর্দার, মোড়ল, গোঁসাই, অধ্যাপক ও শ্রমজীবী মানুষ হিসেবে রঞ্জন, নন্দিনী, কিশোর, বিশুপাগল, ফাগুলাল এসেছে। এরা প্রত্যেকেই যক্ষপুরীতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে খননকার্যের সঙ্গে যুক্ত। রাজার নির্দেশে তাদের বাঁচা ও মরা, কোনো মুক্ত চিন্তার প্রকাশ এখানে নেই। এককথায় যন্ত্র যেমন নিজের কাজ করে যায় তেমনভাবেই রাজা, সর্দার ও মোড়লের নির্দেশের শৃঙ্খলে এখানকার মানুষ কাজ করে যায়। তাদের সতর্কতার জন্যই কেউ কাজ ছাড়া অন্য ভাবনায় ভাবিত হতে পারে না। “এই রাজ্যের যাঁরা সর্দার তাঁরা যোগ্য লোক এবং যাকে বলে বহুদর্শী। রাজার তাঁরা অন্তরঙ্গ পার্ষদ। তাঁদের সতর্ক ব্যবস্থাগুণে খোদাইকরদের কাজের মধ্যে ফাঁক পড়তে পায় না এবং যক্ষপুরীর নিরন্তর উন্নতি হতে থাকে। এখানকার মোড়লরা একসময়ে খোদাইকর ছিল, নিজগুণে তাদের পদবৃদ্ধি এবং উপাধিলাভ ঘটেছে।” নাটকটির প্রেক্ষাপট সম্পর্কে নাট্যকার নিজেই বলেছেন “ঘটনাস্থানটির প্রকৃত নাম কী সে-সম্বন্ধে ভৌগোলিকদের মতভেদ থাকা সম্ভব। কিন্তু সকলেই জানেন এর ডাকনাম যক্ষপুরী। পণ্ডিতরা বলেন, পৌরাণিক যক্ষপুরীতে ধনদেবতা কুবেরের স্বর্ণসিংহাসন। কিন্তু এ নাটকটি একেবারেই পৌরাণিক কালের নয়, একে রূপকও বলা যায় না। যে জায়গাটার কথা হচ্ছে সেখানে মাটির নীচে যক্ষের ধন পোঁতা আছে। তাই সন্ধান পেয়ে পাতালে সুড়ঙ্গ-খোদাই চলছে, এইজন্যেই লোকে আদর করে একে যক্ষপুরী নাম দিয়েছে। এই নাটকে এখানকার সুড়ঙ্গ খোদাইকরদের সঙ্গে যথাকালে আমাদের পরিচয় হবে।”
সীমা থেকে অসীম, আবার ভাব থেকে পরাভাব। জীব থেকে জগত, গভীর অন্ধকার থেকে আলোর পথে পেরিয়ে আসা এক কাহিনি যেন এই নাটক। এই নাটক যেমন অসংখ্য চরিত্রের মধ্যে নিজের স্বতঃস্ফূর্ত কামনা বাসনা এবং যেকোনো সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রতি জনগণ বা সাধারণ মানুষের যে আবেদন, যে চাহিদা (অর্থাৎ ইংরেজি প্রতিশব্দ করলে যে শব্দ দুটি ব্যবহার করা হয় Appeal এবং Demand ), এটা পূরণের জন্য সর্বদাই রাষ্ট্রশক্তির ওপর পরনির্ভরশীল থাকা অথবা দাসত্ববৃত্তি করে চলা। এই জীবনকেই রবীন্দ্রনাথ কোন কোনভাবেই মানতে পারেননি। প্রকৃতির উন্মুক্তায় ছোট্ট এই জীবনকে তিনি বস্তু সীমার বাইরে কল্পনা করেছেন বার বার।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক ছিল বন্ধনমুক্তিকামীদের জন্য আশার সময়। ১৯২৬-এ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ৪১তম অধিবেশন হচ্ছে অসমের গুয়াহাটিতে। সেখানে মহাত্মা গান্ধী, মতিলাল নেহরু, বল্লভভাই পটেল প্রমুখরা ব্রিটিশ পণ্য বয়কটের ডাক দিয়ে সর্বসাধারণকে উদ্দীপ্ত করছেন। এর কিছু আগে প্রাদেশিক কাউন্সিলে স্বরাজ পার্টি নির্বাচনে জিতেছে। অথচ রক্তকরবী-র একশো বছরে, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের দিকে তাকালে বোঝা যায়, সমাজের নানা স্তরে নানা গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, খাদ্য আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন, নকশালবাড়ি আন্দোলন, এবং এরই পাশাপাশি প্রবলভাবে এলিট শ্রেণির রমরমা ব্যবসা, পুঁজিবাদীর একচ্ছত্র আধিপত্য – তখন সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে নিচু তলার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। বার বার প্রকৃতির ও সমাজের খামখেয়ালিপনা তাঁদের ওপর যেন গোলা বর্ষণ করেছে। আমাদের রবীন্দ্রনাথ যেন এরই বিপরীতে দাঁড়িয়ে থেকেছেন।
কত স্বাভাবিক এক চাওয়া পাওয়া কি কত সাধারন মানুষের কথা বলার ভাষায় তিনি বলেছেন। যা আমরা বলতে পারি না, তা তিনি কিশোর আর সেই যক্ষপুরীর আলো নন্দিনীকে দিয়ে বলা করিয়ে নিয়েছেন। নাটকের শুরুতেই সংলাপ একটু তুলে আনি —
কিশোর। নন্দিনী, নন্দিনী, নন্দিনী!
নন্দিনী। আমাকে এত করে ডাকিস কেন, কিশোর। আমি কি শুনতে পাই নে।
কিশোর। শুনতে পাস জানি, কিন্তু আমার যে ডাকতে ভালো লাগে। আর ফুল চাই তোমার? তা হলে আনতে যাই।
নন্দিনী। যা যা, এখনি কাজে ফিরে যা, দেরি করিস নে।
কিশোর।সমস্তদিন তো কেবল সোনার তাল খুঁড়ে আনি, তার মধ্যে একটু সময় চুরি করে তোর জন্যে ফুল খুঁজে আনতে পারলে বেঁচে যাই।
এই যে কত সাধারনভাবে একই অপরের চাওয়া-পাওয়ার কথা, এই চাওয়া পাওয়াই তো আমাদের চাওয়া পাওয়া। সাধারণ মানুষদের মুখের ভাষায় এই নাটকের প্রাণ। অন্ধকার যক্ষপুরীতে সব সময় শুধু শাসন চলে, চলে অত্যাচার, চলে চাবুকের মার। আমরাও আজকের এই ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদী সভ্যতায় সেভাবেই শ্রমের চাবুক খেতে খেতে অর্থ উপার্জন করছি বিরাট এক যক্ষপুরীর অন্ধকার পাতালপুরীতে। তাই আমাদের অর্থ উপেক্ষা ফুল তুলতে যাবার সময় হয়ে ওঠেনা। মৃত্যুকে পরাভূত করা জীবনের শক্তি প্রাণীর প্রেমের জয়। প্রকৃতির সৌন্দর্য, নদীর প্রবাহমানতা, সমুদ্রের আস্ফালন, পাহাড়ের মৌনতা, পাখির কলতান, উদ্ভিদ জগতের প্রাণের বিস্তৃতি- এই সবকিছুই আমরা ক্রমশ উপেক্ষা করছি সভ্যতার জাঁতাকলে। যে মাটি চোষে চাষা আমাদের মুখের অন্ন জুগিয়ে চলে আজীবন। সেই চাষায় পায়না শ্রমের মূল্য। তাই সহজ-সরল জীবনকে বোঝার তাগিদই রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বড় প্রেরণা। তার জন্যই এই নাটকের প্রযোজনা নিয়ে তিনি ছিলেন ব্যাকুল। রক্তকরবীর প্রথম সংস্করণের প্রস্তাবনা দেখলেই তা সহজে বোঝা যায়। তাই তিনি অভিভাষণে বলতে পারেন – ‘ আজ আপনাদের বারবাড়ি সভায় আমার “নন্দিনীর” পালা অভিনয়। প্রায় কখনো ডাক পড়ে না, এবার কৌতুহল হয়েছে। ভয় হচ্ছে পালাসাঙ্গ হলে ভিখ মিলবে না, কুত্তা লেলিয়ে দেবেন। তারা পালাটিকে ছিড়ে কুটিকুটি করার চেষ্টা করবে। এক ভরসা, কোথাও কোথাও দন্তস্ফুট করতে পারবে না।
‘আপনারা প্রবীণ। চশমা বাগিয়ে পালাটার ভিতর থেকে একটা গূঢ় অর্থ খুঁটিয়ে বের করবার চেষ্টা করবেন। আমার নিবেদন, যেটা গূঢ় তাকে প্রকাশ্য করলেই তার সার্থকতা চলে যায়।’
যাইহোক মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ, আজকের সময়ে যে কতটা প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে তা সম্প্রতি নানা বিষয়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেই খুব সহজেই বোঝা যায়। যা কিছু সহজ যা কিছু সরল তা সহজে পথ ধরে গ্রহণ করতে আমাদের কোথাও যেন বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমরা সর্বদাই চাকচিক্যের আড়ালে অতি সাধারণ স্বতঃস্ফূর্ত মানব সত্তাকেই লুকিয়ে রাখি বারবার। আর শতাব্দী পেরিয়েও একটি আয়না আমাদের সামনে রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরেন যে আয়নাটির নাম রক্তকরবী।