
রবীন্দ্রনাথ মানেই মনখারাপ
বেবী সাউ
— তুমি কেন এমন…!
— মানে?
— এত দুঃখবিলাস জীবনের জন্য ভালো নয়…
— আমি আসলে তা নই…
— কিন্তু তুমি সহজ নও…
আমি যখন বুঝলাম, এই যে উদাস হয়ে বসে থাকা, পথের দিকে তাকিয়ে থাকা, ফেলে আসা মুহূর্তের কাছে ফিরে যাওয়া বারবার কিংবা শুধু শুধুই একটি সকাল বা একটি আবছা বিকেলের দিকে নিঃসঙ্গ যাত্রা— এসবই আমার স্বভাব হয়ে দাঁড়াচ্ছে, আর তখনই বুঝলাম যা হওয়ার হয়ে গেছে। একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা, অত্যধিক যা কিছু আড়ম্বরপূর্ণ সেই সব যাপন আজকাল আমাকে এক বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলে দেয়। আমি দেখি, একেকটি ঘটনা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে উঠছে সাপের মতো। ঘটনা আমরাই ঘটাই আর তারপর ঘটনা আমাদের জড়িয়ে রাখে চিরটা কাল। মুক্ত হয়ে চেয়ে গেয়ে উঠি “আমার মুক্তি আলোয় আলোয়…”। আবার তখনই গাঢ় হয় মনখারাপ। মুক্তি মানে উদাসীনতা? ছেড়ে যাওয়া। বিরহ। তবে মুক্ত হতে পারছি কই? বরং ছাড়তে গিয়ে জড়িয়ে ফেলা আরও বেশি করে। আরও বেশি করে যেন জীবনের দিকে ফিরে দেখা।
তখন বুঝি, এর জন্য দায়ি আসলেই রবীন্দ্রনাথ! আমাকে সুখের উদযাপন শিখিয়েছেন দুখের মধ্য দিয়ে। আমাকে কান্নার সুর বুঝিয়েছেন হাসির তরঙ্গের ভেতর যেতে যেতে। তিনি আমার আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন— লোভ, লালসা, ক্ষুদ্র চাওয়া পাওয়ার হিসেব নিকেশগুলি। অবশ্য তার বদলে দিয়েছেন বিশ্বের অন্তরাত্মায় বিলীন হয়ে যাওয়ার মন্ত্র। কিন্তু তাতে দুঃখ তো কমে না? আমি তো নেইলপালিশের রং নিয়ে বান্ধবীদের মতো খুশিতে উছল হতে পারি না! কেন আমি পারি না, পার্থিব সম্পদের হিসেব নিয়ে বসতে।
আমি যখন ‘মানবিক’ ‘অমানবিক’ শব্দগুলো বুঝে উঠতে অপারগ…তখন আমাদের দেশের সীমান্তে সাইরেন বাজচ্ছে। মানুষের রক্তে উল্লসিত হয়ে উঠছে মানুষ। মানুষের গন্ধ পেয়ে মানুষ আজ যখন শ্বাপদের আচরণ করছে, আমি চুপচাপ আকাশের দিকে তাকাই। যুদ্ধ বিমানগুলোর গতিবেগ মাপি! কফিন বহণকারীদের দিকে তাকাই আর কান্নায় ভেঙে পড়ি। সবাই যখন মিডিয়ার মিথ্যে প্ররোচনায় পা দিয়ে দেশপ্রেমের আগুনে টগবগ করে ফুটছে, আমি দেখি মৃত্যু আসলে বিচ্ছেদ! ভাবছি, রবীন্দ্রনাথ ঠিক কেন দুঃখ পেতেন! কেন তিনি মেনে নিতে পারতেন না এই মেকি দেশপ্রেমের মহড়াকে!
আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার কথাগুলোকে মিথ্যে প্রমাণ করার জন্য তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমাকে নারী ভেবে অপমান করবে। ছিঁড়ে খুবলে খাবে তবুও সত্যকে মানবে না। একটা দুর্বল জাতির মিথ্যে আস্ফালন ছাড়া আর কী থাকতে পারে! ঠিক যেমনটা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের সময়েও।
বাবা বলতেন , মানিয়ে নেওয়াই মধ্যেই পৃথিবীর যাবতীয় সমৃদ্ধি। সেই বাবা যখন সিনিয়র সিটিজেন, পেনশনের লাইনে মানিয়ে নিতে নিতে হঠাৎ ছুটে আসা দু’চারটে “যৌবনের দূত”দের মধুধারা ; বাসের লাইনে টাইট জিন্স এর “চোখের মাথা খেয়েছেন” — দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরের মানুষ গড়া কারিগরের চোখে কি তখন আগুন জ্বলেনি কিংবা জলস্রোত! ভোর ভেঙে জেগে ওঠার মধ্যে যতটুকু যুদ্ধ থাকে তারচেয়ে খানিক বেশী সূর্য ভেঙে ঘরে ফেরার কারণ। হাঁটু ভর্তি ধূলো ,সাইকেলে পিছলে ওঠা রোদ নিয়ে প্রত্যেক দিন সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরতেন বাবা। কাঁসার ঘটিতে জল তুলে ধরতেন আমাদের মা। কপালের লাল টিপে জ্বলজ্বল করত সূর্যের প্রতিচ্ছবি। আমাদের তখন নামতার বই ,আমাদের তখন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সহজপাঠ। শিউলির তলা ভরে থাকত সাদা ফুলে। এই দু’মুঠো উঠোন জুড়ে ছুটে বেড়াত শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়। বাবার দরাজ গলায় দেবী আহ্বানের সুর। মা তো রবীন্দ্র সঙ্গীত। খুন্তির শব্দে বেজে উঠছে “হারিয়ে যাওয়ার মানা … “। জ্যোৎস্নার আলোকে হারিয়ে যাওয়া তারাদের খোঁজে বাবার তর্জনীর সঙ্গে চোখ বুলাতাম নীলের খাঁজে। নীল তখন শূন্যতা নয়, নীল মানে একমুঠো আকাশ —বিরাট ছাদ , আদিগন্ত আকাশ। নীল মানে পুকুরপাড়ের ঝিঁঝিঁ , পাতিলেবুর গন্ধ, ভরপুর আলোমাখা জ্যোৎস্নার গল্প। এই ছিল আমাদের কাঠা দুই বাড়ির কবিতা। আমাদের আধুনিক জীবনযাত্রা। আমার আর বোনের পুরানো পোষাক পাল্টে ফেলা এরপর। বারবার। বহুবার। আর তখনই মনে হল “হারিয়ে গেছি আমি…”!
তাঁর শব্দে, তাঁর সুরে আমি আমার না বলা কথাগুলো খুঁজে পাই। খুঁজে পাই এক সহজ জীবনধারাকে। আমার অস্ফুট আকুলতা যেন ওঁরই লেখা কোনো চিঠির এক অব্যক্ত অনুচ্ছেদ।
এরকম ভাবতে ভাবতে আমি রাতের খাবার খেতে বসি। খেয়ে উঠে দেখি, চতুর্থীর চাঁদ উঠেছে নীল আকাশে। পাশে একটা ছোট্ট নক্ষত্র। চাঁদের চারপাশে এক অর্ধবৃত্ত আলো—গতকাল বৃষ্টি হয়েছে, মে মাসের গরম নেই আজ। বরং এক সুন্দর স্নিগ্ধ হাওয়া বইছে। আমি ব্যালকনির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। দেখলাম, নিচে নিমগাছের পাতাগুলো হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে। দূরে শিরীষ ফুলের গন্ধ এসে ভরিয়ে দিচ্ছে ব্যালকনি। রাধাকৃষ্ণ বাজছে দূরে—নাম সংকীর্তন।
আমার মনের ভিতর কেমন যেন দুমড়ে-মুচড়ে উঠল হঠাৎই। বুকের মধ্যে দোলা পাকানো কান্না। সোঁদা মাটির গন্ধ। জোছনা রাত। কুরচি ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। পুকুরের জলে ছলছল করছে জোছনার শরীর। বৈশাখের কীর্তন শুরু হয়েছে। কানাইকাকু গাইছেন—“রাধা… আ আ আ…” আর সেই সুর বৈশাখের হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে দূরে, আরও দূরে—গ্রাম পেরিয়ে, মাঠ ছাড়িয়ে।
মাঠ ছাড়িয়ে, পথ ভেঙে, এরকম একটা জোছনা মাখা রাতে কানাইকাকু যেন নিজেই কুরচি ফুলের গন্ধ হয়ে গেলেন। উবে গেলেন। আজ এই বৈশাখের চতুর্থী চাঁদ আমাকে মনে করিয়ে দিল—“আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে”। আমি জানি না, সেই বনে কী গাছ আছে, কী রকমের নীরবতা বা ভয়! আমি শুধু এই ব্যালকনির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এই চাঁদ, এই হিমেল হাওয়া, এই আবেশমুগ্ধ অবস্থানকে পালটে ফেললাম কান্নায়। হু হু করে ভেঙে পড়লাম, “আমার এ ঘর যতন করে/ ধুতে হবে, মুছতে হবে মোরে”।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান শুনতে শুনতে মনে হয় আমি এক দুঃখময় জগতের প্রান্তদেশে দাঁড়িয়ে আছি। এই দুঃখ বিষাদ নিয়ে আসে, অবসাদ নয়। এই বিষাদ আবার নিয়ে আসে এক আনন্দ। এই আনন্দ উপলব্ধির আনন্দ, এই আনন্দ ক্ষুদ্রতা থেকে নিজেকে মুক্ত করার আনন্দ। ছিন্নপত্রের একটি চিঠিতে কবি লিখছেন, “কর্মক্লিষ্ট সন্দেহপীড়িত বিয়োগশোককাতর সংসারের ভিতরকার যে চিরস্থায়ী সুগভীর দুঃখটি, ভৈরবী রাগিণীতে সেইটিকে একেবারে বিগলিত করে বের করে নিয়ে আসে। মানুষে মানুষে সম্পর্কের মধ্যে যে-একটি নিত্যশোক নিত্যভয় নিত্য মিনতির ভাব আছে, আমাদের হৃদয় উদ্ঘাটন করে ভৈরবী সেই কান্নাকাটি মুক্ত করে দেয়–আমাদের বেদনার সঙ্গে জগত ব্যাপী বেদনার সম্পর্ক স্থাপন করে দেয়। সত্যিই তো আমাদের কিছুই স্থায়ী নয়, কিন্তু প্রকৃতি কী এক অদ্ভুত মন্ত্রবলে সেই কথাটিই আমাদের সর্বদা ভুলিয়ে রেখেছে-সেইজন্যেই আমরা উৎসাহের সহিত সংসারের কাজ করতে পারি। ভৈরবীতে সেই চিরসত্য সেই মৃত্যুবেদনা প্রকাশ হয়ে পড়ে; আমাদের এই কথা বলে দেয় যে, আমরা যা-কিছু জানি তার কিছুই থাকবে না এবং যা চিরকাল থাকবে তার আমরা কিছুই জানি নে।“
এসব চোখ আমাদের কে দিল, রবীন্দ্রনাথ?
ভাবি। কথাগুলো আসলে তাই। সকালের কাছে আমি বিকেল চেয়ে বসি। বিকেল এলে মনে পড়ে গোধূলি। গ্রামে এলে শহরের জন্য মনখারাপ। শহরে ফিরে যাওয়া মানে, মনে পড়ে যায় গ্রাম, মাঠ এমনকি সেই সোনালিফুলের গাছটির কথাও। পরে জেনেছিলাম সোনালিফুল নয়, এটা অমলতাসের গাছ। আর এই জানাটুকুর মধ্যেও তখন সেই দুঃখ! বেশ তো ছিল! কিন্তু “তোমায় নতুন করেই পাব বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ”। আমার বন্ধুর ” তুই যেন কেমন…” শব্দ ক’টিকে আমার কেমন যেন ঘাতক ঘাতক লাগে। আসলেই কী তাই! কিন্তু কেন? তখনই বুঝি এরজন্য দায়ি আসলে রবীন্দ্রনাথ। তিনি আমার শিশু বয়েস থেকে যে চেতনা, যে বিবেক এবং বিবেচনা জাগিয়ে তুলেছেন সেখান থেকে আর মুক্তি নেই! সমস্ত কিছুর মধ্যে যে একটা সুচারু দুঃখ হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছে, তাঁর প্রতিটি কবিতায়, গানে, গল্প উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি আমার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন সেই বীজ!
তিনি মনের গভীরতম অনুভূতিগুলোর স্রষ্টা। তাঁর কবিতা, গান, গল্প, চিঠি—এগুলো যেন আমার দুঃখ, মনখারাপ, বিরহ, এমনকি মৃত্যুর মতো জটিল ভাবনাগুলোকে একটা অদ্ভুত সুন্দরভাবে তুলে এনেছেন। তাই তিনি আমার!
রবীন্দ্রনাথ না থাকলে আমরা হয়তো দুঃখকে এত গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারতাম?
মনখারাপকে এত সুন্দর করে চিনতে পারতাম, বিরহ বা মৃত্যুকে এত শান্তভাবে গ্রহণ করতে শিখতাম?
কীভাবেই বা ব্যাখ্যা করতাম ‘অভিমান’ শব্দটিকে? তিনি মনের ভেতর দুঃখ জাগানিয়া, ঘুম ভাঙানিয়া এক শিল্পী। তাঁর সৃষ্টি আমার নিজের জীবনের কথা বলে, আমার হারানোর বেদনা, আমার একাকীত্ব, আমার গোপন আকাঙ্ক্ষাগুলোকে ধরে ফেলে।
শুধু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বলে, আমি কখনো কঠিন হতে পারি নি! আমি আমার বিবেককে বিসর্জন দিয়ে লোভের পেছনে ছুটি নি। আমার এক প্রিয় বান্ধবী যখন অনেক অনেক কথা বলে যাচ্ছিল আমার পেছনে, অনেক অনেক কষ্ট, কান্না, অপমান সেসব কথার পরতে পরতে। আমার দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছিল একেকটি তীব্র তীক্ষ্ণ অপমানের ফলা— তখনও আমি চুপ ছিলাম। কিছু না ভেবেই চোখের জলে ভিজে ওঠা একেকটি মুহূর্তের দিকে তাকিয়ে, একেকটি সন্ধেকে আরও অন্ধকারে ঢেকে দিয়ে গুনগুন করে উঠেছিলাম, ” সুখে যে রয়েছে, সুখে সে থাকুক…”।
আর আমি? আমি কী তবে সুখে নেই? এত দুঃখের কারণ আসে কোথা থেকে? কোথা থেকে ভেসে আসে “প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন, তবু প্রাণ কেন কাঁদে রে…” আর ভাবি, “এই দুঃখ আমাকে শিখিয়েছে যে জীবনের সবকিছু ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু তার মধ্যেও একটা চিরন্তন সত্য আছে যা আমাদের বাঁচিয়ে রাখে।” বুঝি, তিনি যেমন চিনতে শিখিয়েছেন দুঃখগুলিকে, বুঝতে শিখিয়েছেন অন্তরের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলিকে তেমনি দুঃখে অপমানে অবিচল থাকার মন্ত্রও তো তিনি দিয়েছেন আমাকে।
কিছুদিন ধরেই আমার সেই বন্ধুর কথাগুলো আমার মাথায় ঘুরছিল। জীবনে তো তেমন কোনও অভাববোধ নেই। কেননা, আমি কখনও তেমনভাবে চাইতেও শিখি নি। চাওয়ার যেখানে বালাই নেই সেখানে পাওয়া না পাওয়ার তুলনাটাও বড় আপেক্ষিক হয়ে দাঁড়ায়। আমি শুধু শান্ত একটা রুম, হালকা আলো, সাদা সুতির বিছানা আর বড়জোর কোনও সুগন্ধি ফুল চেয়েছি আমার নিজস্ব ঘরে। আর এটা জোগাড়ও হয়ে গেছে। যখন আমার একার কোনও রুম ছিল না এবং আমাকে আমার বোনের সঙ্গে একটা বিছানায় ঘুমাতে হত তখনও না হয় একটা কারণ ছিল। বোন আজকাল আর আমার সঙ্গে ঘুমাতে চায় না কিছুতেই। তার কারণও আমি অবশ্য। স্বপ্নের ঘোরে বোনকে প্রেমিক ভেবে যদি চিৎকার উঠে বলি, “তুমি এখানে?”… ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু এখন গোটা আস্ত একটা রুম আমার কব্জাগত হয়েও দুঃখ কাটে না কিছুতেই।
কেন? খানিক আগে বৃষ্টি হয়েছে খুব। কালবৈশাখী। চারপাশের আবর্জনা ধুয়ে মুছে পৃথিবী বড় শান্ত সৌম্য রূপ ধারণ করে আছে। ঠান্ডা বাতাসে ভরে উঠেছে চারপাশটি। দেখি, একটা বিরাট চাঁদ ফুটে উঠেছে ব্যালকনির বারান্দায়। আর তখনই আমার কাছে এসে দাঁড়াল এক আবছায়া ক্ষণ। আমার মামাদাদুর মৃত্যু। মনে হল, ওই তো! ওওওই তো! ঠিক আরেকটি জোছনা রাতে হেঁটে যাওয়া মৃত্যুর মতো। বনের শান্ত হাওয়ার মতো। কান্নার মতো। অভিমানের মতো! কেন? আমি কী এর উল্টোটাকে গ্রহণ করতে পারতাম না? এই সুন্দর চাঁদনী রাতের মজা! ঠান্ডা সুশীতল বাতাসের ভেতর ভাসতে ভাসতে প্রেমিকের সঙ্গে দু’চারটে কথা? কিন্তু তখন যে আমার মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে “প্রকৃতির এই বিশালতার মধ্যে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি, কিন্তু তবু মনে হয় আমি তাঁকে পুরোপুরি পাইনি।”
কে? কে? কে সেই? যে আমার ভেতর ছড়িয়ে দিয়েছে এত এত মনখারাপ? কান্না? দুঃখের অনুবাদ? তখনই দেখি দাঁড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। বুঝি, বাঙালি কেন এখনো কেন লুঙ্গি ডান্স করতে পারে না! কেন ডিজে ডান্সের সঙ্গে মেলাতে পারে না নিজস্ব রুচিবোধকে! কিংবা অত্যধিক আনন্দের ভেতরেও কেন সে গম্ভীর এক আশ্চর্য মনকেমনের মধ্যে ডুবে যায় অকারণেই! এখনো এই অস্থির সময়ে, ফ্যাসিবাদের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে একটা জাতি যে এখনো নিরপেক্ষভাবে কিছুটা হলেও শুভবুদ্ধির বিচার করতে পারে সেখানেও কিন্তু রবীন্দ্রনাথ!
আর তখনই আমি আবিস্কার করি, রোজকার জীবনের সত্যকে খুঁজতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথই দায়ি আমাদের এই দুঃখবোধের। এই দুঃখের প্রকাশ হয়ত মানবিক, বিবেকের! জানি। মানিও। কিন্তু এই জীবনের সূক্ষ্ম থেকে অতি সূক্ষ্ম দুঃখকে জানা, অনুভব করা, ভাবা কিংবা তার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে একটা জীবনকে দুঃখের পরতে মুড়ে ফেলা— রবীন্দ্রনাথ যদি নাই শেখাতেন, কী এমন ক্ষতি হত?
আর না শেখালে আমরা অনুভব করতে পারতাম এই আশ্চর্য দুনিয়াকে? বোধহয় না…
একেকবার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ না এলে আমাদের পরবর্তীকালের সাহিত্যে, বাংলা কবিতায় যে দুঃখবোধ, আত্মচেতনাবোধ কোনোটাই এত প্রবলভাবে আসত না। জীবনানন্দের ওই অতিচেতনার দিকে যাত্রাও আসলে সেই দুঃখবোধেরই একটা অংশ।
রবীন্দ্রনাথ মানেই যেন এক দীর্ঘশ্বাস—রোদের মতন দীর্ঘ, বাতাসের মতো ছুঁয়ে যাওয়া, অথচ ধরা যায় না।
তার আরেকটি গান আমার খুব মনে পড়ে। অভিমানে ভরে উঠে বলি, কেন বলে গেলেন না? কী হতো একটু বলে গেলে! আরেকটু অপেক্ষা, আরেকটু! মনের ভেতর থেকে একটা কান্না দুমড়ে-মুচড়ে ওঠে। কান্নার ভেতর কান্না। মনের ভিতর খেলা করে মান, অভিমান, অভিযোগ। উথাল-পাথাল মনখারাপ। তখন এই বসন্ত হাওয়া, ফুলের গন্ধ, নারিকেল গাছের সারি দিয়ে ভেসে আসা হিমমাখা রোদ—সব কেমন যেন এক মুহূর্তে ভ্রান্ত হয়ে যায়। তুমি, তুমি আর তুমি—সব যেন বেকার! অপাংক্তেয়! শুধু তোমার ‘বলে না যাওয়া’, ‘না বলে চলে যাওয়া’ টুকুই এই মহাবিশ্বের মনখারাপের মূল কারণ। সেখানে আমিও ভারী, ভরাট—সুখের কারণে নয়, দুঃখের কারণে।
“সে চলে গেল, বলে গেল না—সে কোথায় গেল, ফিরে এল না।”— এই যে না বলে চলে যাওয়া, এই যে অনন্ত অপেক্ষার হাহাকার, এর ভাষা আমাকে কে দিল? রবীন্দ্রনাথ! না হলে আমি কি বুঝতাম, এই অদ্ভুত ক্ষতের মধ্যেও কীভাবে সৌন্দর্য বাস করে! কীভাবে ব্যথার মধ্যেও একটা নির্জন শ্রদ্ধা থাকে, একটা স্থির নীরবতা! কীভাবে কান্না কবিতা হয়ে ওঠে!
এর জন্য দায়ি রবীন্দ্রনাথ—সারাটা জীবন শুধু দুঃখগুলোকে চিনিয়ে দিয়ে গেলেন তিনি। কান্না, আত্মদহন, মনের ভিতর মান-অভিমান, কষ্ট, বিরহ দিয়ে ভরে দিলেন মনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত!
রবীন্দ্রনাথ মানেই আসলে বিশুদ্ধ মনখারাপ!