
আষাঢ়ে গল্পের দেশ
অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
শীতকাল। ভোরের বৃষ্টিতে পথঘাট ছেয়ে আছে। ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাওয়া পথে আর কোথাও কেউ নেই। জানালার কাচে মরা আলো, দুই হাতে নিয়মের শিকল। চোখে মেঘ জমছে। আষাঢ়ে গল্পের দেশে নতুন শিশু জন্মেছে।
গোলাপি ফুলছাপ কাপড়ে মুড়ে দেওয়া হল তার শরীর। হলুদ আলোর বাক্সে দেওয়া হল কৃত্রিম প্রাণবায়ু। শিশুটি একবার চোখ বোজে, একবার চোখ খোলে, বন্ধ হাত খুলে একবার ডাকে, বদ্ধ শরীরে ফের ঘুমিয়ে পড়ে। এইবার যুদ্ধ শুরু হবে।
আষাঢ়ে গল্পের দেশে আইন কানুন সর্বনেশে। একটি যুদ্ধের ভিতর সে জন্মেছে। নবতম লড়াইয়ের জন্ম দেবে সে। তার আগে দেশ নিশ্চিত করেছে, তার প্রশ্ন করার দরজা বন্ধ করবে।
মাঝরাতে কেঁদে ওঠে শিশু। ঘনবুড়ি ঠোঁটে হাত চাপা দেয়। ঠোঁটের লালিমা থেঁতলে ওঠে ঘনবুড়ির মরা চামড়া ঘেরা হাতে। নিন্দের ভয় ঢুকে যায় শিশুর শরীরে। হাতে ছাঁচ নিয়ে বসে আছে পরিবার, বসে আছে দেশ। শিশুটির ঘরে কুমোরটুলির অন্ধকার।
ঘরের ভিতর থেকে ঘোলাটে পথ এগিয়ে গেছে মাঠের দিকে। মাঠের ভিতর সবুজ ক্রমে সাদা হয়ে আসছে। ঘর বাড়ি ভাঙা ইট বালি ভরে দিচ্ছে মাঠের শরীরে। সেখানে একটি অলীক আবাসন আকাশের দিকে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে পড়ছে। নিয়ম।
ফাঁকফোঁকর না রাখাই নিয়ম। কাঠখোদাই করা চৌকুনি মানুষেরা আরও একা করে দেবে শিশুটিকে। সে জানবে না পাশের শিশুটিকে। সে চিনবে না কাছের বন্ধুটিকে। দহলা পণ্ডিত তাকে শেখাবে বিকেলবেলার আলো মাখা পাপ। সে জানবে পৃথিবী বন্ধুহীন।
নিজস্ব ভাষার স্বাধীনতা গড়ে উঠবে না তার। সে জানবে ভাষা আদতে একটি যন্ত্র। সেই যন্ত্রের একধারে থাকে গোপন অক্ষরের সুড়ঙ্গ। আরেক দিকে থাকে সম্পদের সংকীর্ণ পথ। সেই যন্ত্রের ব্যবহারে যে যত পটু সে তত বিত্তশালী। দিনের শেষে সকলে তাসের মানুষ। সকলেই এক ভাষায় কথা বলবে। নিজস্ব ভাষা কী, জানবে না এই শিশু। নিয়ম।
প্রথমে শিশুটির ভিতর থেকে তার ভাষাকে মেরে ফেলা হবে। অচলায়তনের বাধ্যতামূলক আইনে সে চাল শিখবে। চলন রুদ্ধ হবে। নির্বাসনের ভিতর জন্ম নেওয়া শিশু সকারণ বন্দিদশাকে নিরাপদ ভেবে নেবে।
তারপরে শুরু হবে অদ্ভুত দৌড়। ছুতোরের তৈরি কাঠের শরীরে, ঠকাঠক শব্দে একঘেয়ে ছন্দে সে উঠবে, বসবে, ছুটবে, পিছবে, পিছবে, পিছবে… নতুনকে ভয় পেতে শিখবে।
আষাঢ়ে গল্পের দেশে সম্পাদক এসে নিয়ন্ত্রণ করে দিয়ে যাবে কৃষ্টি। হাজার বছরের হাজার গিরে দিয়ে তৈরি শুচিতা বোধের বিরুদ্ধাচরণ না করবার সম্পাদনাকে শিশুটি সাহিত্য বলে জানবে। জীর্ণ ছন্দের বেসুরকে সঙ্গীত হিসেবে জানবে। রাষ্ট্রের তৈরি করে দেওয়া বাক্সে মাথায় বেড়ে উঠবে সে। আদ্যপান্ত অনুগত ভৃত্য হবার দৌড়ে নিয়ম মানবে সে।
আষাঢ়ে গল্পের দেশে একদিন শিশুটি অনুগ্রহের অনর্থ বুঝে যাবে। অর্থ খুঁজবে না। চলবে নিয়ম মতে। তার প্রতিটি পদক্ষেপ, তার ঘুম, তার ভাবনার ধূসর পাথুরে জগত, তার আলো ও অন্ধকার নিয়ন্ত্রিত হবে আষাঢ়ে গল্পের নিয়মে। সে জানবে তার জীবন একটি অনুগ্রহের দান, তার বেঁচে থাকা আদতে বিরাট রাজশক্তির অনুগ্রহ মাত্র।
নিয়মের ভিতর বেনিয়মের ছিদ্র কি সে খুঁজবে না? অবশ্যই খুঁজবে। কিন্তু বেনিয়মকে নিয়ম বলেই জানবে। বেনিয়মের নিয়ম মানতে নিজেকে বিক্রি করবে। নিজেকে বিক্রি করতে করতে রাজার আরও অনুগত হয়ে উঠবে। তারপর, একদিন আষাঢ়ে গল্পের দেশে হঠাৎ বাতিল হয়ে যাবে সে। ঘর্মাক্ত মুখে কিংকর্তব্যবিমুঢ় সে চেয়ে দেখবে সকল নিয়ম ও বেনিয়মের ভিতরে দাঁড়িয়েও সে পথে বসেছে। আরও কোথাও কোনও আঁচড় লাগেনি। সমস্ত নিয়মের শুচিতা বজায় রেখেও সে পথে বসে আছে। নিজেকে যোগ্য যোগ্য যোগ্য বলে চিৎকার করতে প্রাণ চাইছে। আষাঢ়ে গল্পের যোগ্যতার দাঁড়িপাল্লায় নিজেকে বসিয়ে রেখেও কেবল নিজস্ব কাঠের পায়ের ঠকঠকানি ছাড়া আর কোনও চিৎকার কানে বাজবে না তার।
তবুও…শিশুটির ভাবনার ভিতর কোনও এক অতলে ঘুমিয়ে আছে প্রাণ। পাথর ফাটিয়ে জল বেরিয়ে আসবার মতো একদিন, হয়ত একদিন সে রাজপুত্র ও সদাগরের দেখা পাবে। জীবনের অনন্ত সাগরপাড়ে হঠাৎ দেখা পাওয়ার ভিতর সে অনন্ত নিয়মের ফিরিস্তি শুনিয়ে যাবে। একটি দমকা হাওয়া হয়ত তাকে ভাবতে শেখাবে। শেখাবে ইচ্ছে। ইচ্ছে… ইচ্ছের জোর, ইচ্ছের দৌড়। আর জীর্ণ নিয়মের সাজ পড়বে খসে। দহলা পণ্ডিতদের তৈরি করে দেওয়া খোলস যাবে ঘুচে। একদিন ক্রুদ্ধ হবে সে। একদিন শাসনের কূটনীতি ভেঙে ক্রুদ্ধ হবে সে। যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার বাইরে আসল লড়াই চিনে নেবে। আসল লড়াইয়ের ভিতর রাষ্ট্রের তৈরি করে দেওয়া শুচিতার লড়াইয়ের অসত্যতা চিনতে শিখবে। সকল মিথে শুচিতার ভান ছেড়ে দিয়ে আদতে অশুচি হতে শিখবে। চাঞ্চল্য আসবে, চাঞ্চল্যের সম্ভোগে সে যন্ত্র হতে ভুলে যাবে। দুর্গমের আশায় ছুটবে। যে পথ ফুরোয় না, সেই পথে যাবে, অজানাকে ভয় পাবে না, নতুন ভালবাসবে।
একদিন আষাঢ়ে গল্পের দেশে ক্রোধ ও হাসিকে চিনে নিতে নিতে বিদ্রোহের ভাষা চিনবে শিশুটি। চিনবে খোলস পরিয়ে রাখার কূটনীতিটি। একদিন ভাতে মারার ভয় উপেক্ষা করতে শিখে যাবে এই শিশু। নির্বাসনের ভিতর থেকে খুঁজে নেবে স্বাধীনতা।
কিন্তু আষাঢ়ে গল্পের দেশে সত্যিই কি বিদ্রোহ আসবে? যেখানে হঠাৎ একটি তাসের প্রজন্ম ফের মানুষ হতে চাইবে? প্রয়োজনের বেড়ার ভাষা ভুলে গিয়ে পথের ভাষা শিখবে? মানুষ থেকে তাস হয়ে ওঠা সহজ। তাস থেকে কি মানুষ হওয়া ততই সহজ? আমরা সবাই তাসের প্রজন্ম তৈরি করেছি। রাষ্ট্র আমাদের তৈরি করেছে তাস। মানুষ হতে গিয়ে যদি মানুষ হতে না শিখি?
যেদিন বিদ্রোহের হাওয়া উঠবে সাগরপাড়ের থেকে সেদিন যদি সাজ খসে না পড়ে? এই শিশুটি পাথর ফাটিয়ে মানুষ হবে না দলে থাকতে মানুষের মুখোশ পরে নেবে?
এ এক অন্য অঙ্কিতা। প্রকরণ, বিষয়, তীব্রতা সমস্তই নতুন। আর এ এক অন্য রূপকথা। যা বহিরঙ্গে অপরিচিত হলেও অন্তরঙ্গে চিরচেনা এক অবদমনের ও বিদ্রোহের আবহমান কাহিনি।