
দর্শনের পর্যটন
সুমন গুণ
রবীন্দ্রনাথের নাটক যে ‘আইডিয়া’র পরিবহনেই বেশি দক্ষ, টমসন সাহেবের এই কথার পক্ষে-বিপক্ষে কম আলোচনা হয়নি। কথাটির মধ্যে রবীন্দ্রনাটকের একটি বিশেষ প্রবণতার স্বীকৃতি আছে, এটা কিন্তু না মেনে উপায় নেই। শম্ভু মিত্র সহ আরও অনেক কুশলী রূপকারের প্রতিভা রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি আপাত-নিরীহ নাটকের মঞ্চ-সম্ভাবনাকে আমাদের কাছে মেলে দিয়েছে, কিন্তু তাতে করে রবীন্দ্রনাটকে ভাবের সঞ্চার সম্পর্কে টমসন-এর মন্তব্যের গুরুত্ব কিছু খাটো হয় না। যে-কোনও নাটকেই একটি বিশেষ বক্তব্যের প্রতি ঝোঁক থাকে, নানা ঘটনা আর চরিত্রের টানাপোড়েন সেই ঝোঁকটিকে ক্রমশ স্পষ্টতর করে তোলে। কিছু নাটকে এই ঝোঁকটি-ই অন্য সব ছাপিয়ে বড়ো হয়ে ওঠে, এই ঝোঁকের পরিপ্রেক্ষিতেই ঘটনা আর চরিত্রের দাবি মেটানো হয়। কিছু নাটকে আবার ঘটনার প্রকাশ্য ঘনঘটার গুরুত্ব থাকে বেশি, একের-পর-এক ঘটনার দাপটে দর্শককে সচকিত করে তোলাই এই ধরনের নাটকের লক্ষ্য। চরিত্রের বৈচিত্র্যময় উচাটনও কোনও কোনও নাটককে আলাদাভাবে লক্ষণীয় করে।
রবীন্দ্রনাথের নাটক, মুখ্যত, ভেতরের দিকে বেড়ে উঠতে চায়। এই অভ্যন্তরীণ উচ্চাশার চাপেই কথা বলে তাঁর নাটকের চরিত্রেরা, নাটকের ঘটনার দিকবিদিক-ও এই টানেই ঠিক হয়ে যায়। এমনিতে যে রবীন্দ্রনাথের নাটকে ঘটনার উচ্চারণ কম, তা কিন্তু নয়। হত্যা থেকে আত্মহত্যা, বিদ্রোহ থেকে বিলাপ, এমনকি থালায় সাজানো নরমুণ্ড, রক্তস্রোত — সব কিছুর শোভাযাত্রা তাঁর নাটকে আছে, কোনও কোনও নাটকে একাধিকবার আছে। কিন্তু সব-ই একটি নির্দিষ্ট তন্ময়তার কাছে সমর্পিত, একটা নাছোড় টান সব ঘটনা আর কুশীলবদের ভেতর থেকে টেনে রেখেছে।
‘রাজা ও রানী’ নাটকেও এটা ঘটেছে। একটি তুচ্ছ ঐতিহাসিক ঘটনার আবহে নির্দিষ্ট একটি ‘আইডিয়া’কে বিন্যস্ত করতে চাওয়া হয়েছে এখানে। খুব নতুন আইডিয়া কিছু নয়, রবীন্দ্রনাথের নানা নাটকে এই বিশেষ দর্শনটি নানাভাবে বোঝানো হয়েছে। ‘রাজা’, ‘বিসর্জন’ ‘মালিনী’ নাটকে, ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে ‘রাজা ও রানী’ নাটকের ‘আইডিয়া’র সহমর্মী উচ্চারণ আছে।
জলন্ধররাজ বিক্রমদেব তাঁর রানী সুমিত্রাকে বাইরের সব কর্তব্যের টান উপেক্ষা করে পেতে চেয়েছিলেন। সুমিত্রা রাজাকে সচেতন করার লক্ষ্যে তাঁকে ছেড়ে চলে গেলেন, রাজাও এই বিচ্ছেদের প্রতিক্রিয়ায় নিজের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হলেন।
এটা নাটকের একটা পর্ব। পরের পর্বে আছে কুমার আর ইলার আখ্যান, আর সেই সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে রাজার চূড়ান্ত আত্ম-উন্মোচন।
প্রথম পর্বে রাজা ছিলেন সুমিত্রার প্রেমে উদ্বেল, কিন্তু তাঁকে বাইরের দিকে চোখ ফেরাতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন সুমিত্রা :
শোন প্রিয়তম,
আমার সকলি তুমি, তুমি মহারাজ,
তুমি স্বামী — আমি শুধু অনুগত ছায়া,
তার বেশি নই; আমারে দিয়ো না লাজ,
আমারে বেসোনা ভাল রাজশ্রীর চেয়ে!
শেষ লাইনটি এই নাটকের মর্ম ধরে রেখেছে। এই কথাটিরই আরেকটু ব্যক্তিগত সম্প্রসারণ ঘটে সুমিত্রার-ই উচ্চারণে :
তোমরা পুরুষ, দৃঢ তরুর মতন
আপনি অটল রবে আপনার পরে
স্বতন্ত্র উন্নত ; …
তোমরা রহিবে কিছু স্নেহময়, কিছু
উদাসীন ; কিছু মুক্ত, কিছু বা জড়িত,
সহস্র পাখির গৃহ, পান্থের বিশ্রাম,
তপ্ত ধরণীর ছায়া, মেঘের বান্ধব,
ঝটিকার প্রতিদ্বন্দ্বী লতার আশ্রয়।
কিন্তু এমনভাবে বলেও রাজাকে উদ্দীপ্ত করতে না পেরে সুমিত্রা বাধ্য হয়ে ছেড়ে চলে গেলেন তাঁকে, আর তারপরেই রাজা ফিরে পেলেন নিজেকে। তিনি বুঝতে পারলেন, সর্বস্ব দিয়েও সুমিত্রাকে তিনি নিজের করে পাননি। যে-কাতরতাময় উপলব্ধির উচ্চারণ পাই এরপর তাঁর, তা আসলে এই নাটকের গন্তব্যের দিকে আমাদের মুখ ফেরায় :
অন্তর্যামী দেব,
তুমি জান জীবনের সব অপরাধ
তারে ভালোবাসা ; পুণ্য গেলো, স্বর্গ গেলো!
রাজ্য যায়, অবশেষে সেও চলে গেলো!
তবে দাও, ফিরে দাও ক্ষাত্রধর্ম মোর ;
রাজধর্ম ফিরে দাও ; পুরুষ হৃদয়
মুক্ত করে দাও এই বিশ্বরঙ্গ মাঝে!
কোথা কর্মক্ষেত্র! কোথা জনস্রোত! কোথা
জীবনে মরণ! কোথা সেই মানবের
অবিশ্রান্ত সুখ দুঃখ, বিপদ সম্পদ,
তরঙ্গ উচ্ছ্বাস! …
যে-রাজধর্ম ফিরে পেতে চাইছেন তিনি, কর্মক্ষেত্রের যে-উচ্ছ্বাস তাঁর কামনা, সেদিকে তাঁকে ফেরানোর ইশারা দিয়েই শেষ হয় এই নাটকের প্রথম পর্ব। কিন্তু নাটকটির বৈশিষ্ট্য হলো, রাজাকে এই দিকে সঙ্গে সঙ্গে ফিরিয়ে দেওয়া হলো না। জটিলতার আরও একটা পরত বিছিয়ে রাখা হলো। রাজা আঘাত পেয়ে জেগে উঠলেন বটে, কিন্তু বিপরীত এক উগ্রতা তাঁকে পেয়ে বসলো। রাজ্যের অত্যাচারী দস্যুদের তিনি দমন করলেন, আবার, যুদ্ধের নেশা তাঁকে এতটাই গ্রাস করলো যে, তিনি ঘোষণা করলেন :
সন্ধি নহে — যুদ্ধ চাই আমি ! রক্তে রক্তে
মিলনের স্রোত — অস্ত্রে অস্ত্রে সংগীতের
ধ্বনি
তাঁকে এতটা উন্মত্ত কেন করে তোলা হলো, ভাবা দরকার। আমার মনে হয়, নাটকে সুমিত্রার মধ্যে প্রেমের, মানবতার আদর্শকে নানাদিক থেকে সফল করে তোলার তাগিদেই রাজাকে প্রায় শেষ পর্যন্ত উগ্র করে রাখা হয়েছে। রাজা প্রথমে সুমিত্রার কাছে আঘাত পেয়ে নিজের দিকে ফিরতে চাইলেন, বাইরের পথ দিয়ে। কিন্তু ভেতরের দিকে ঢোকার আগেই রণরক্তের টান তাঁকে গ্রাস করে নিল। তিনি সেই যে বাইরের ঘোরে পড়ে গেলেন, আর থামতে পারলেন না। এমনকি রানীর আহ্বানও তাঁকে টলাতে পারলো না। রানীর প্রতি যে-একমুখী প্রেম তাঁকে একসময় কাবু করে রেখেছিল, তার-ই উলটো উগ্রতায় তিনি যুদ্ধ-রাজ্যজয়-হিংস্রতার আস্ফালনে মেতে উঠলেন।
এই বিপর্যয় থেকে তাঁকে ফেরার পথ দেখালেন ইলা। যদিও, ইলা-কুমারের অতিরিক্ত কাহিনিটি এই নাটকে যে অবধারিত ছিল, তা মনে হয় না। তবে, রাজাকে ঘুরপথে ফেরানোর জন্যই বাধ্য হয়ে ইলাকে আনতে হয়েছে বলেই আমার ধারণা। ইলাকে পেতে চেয়েছেন বিক্রমদেব, কিন্তু তখন ইলার নম্র প্রত্যাখ্যান তাঁকে বিচলিত করেছে, তাঁর হারানো ভালোবাসার দিগন্তের দিকে মুখ ফেরাতে বাধ্য করেছে । ইলা জানিয়েছেন :
পিতা মোর দিয়াছেন সঁপি তব হাতে,
আপনারে ভিক্ষা চাহি আমি। ফিরাইয়া
দাও মরে। কত ধন, রক্ত, রাজ্য, দেশ
আছে তব, ফেলে রেখে যাও মোরে এই
ভূমিতলে ; তোমার অভাব কিছু নাই।
…
কোথা নিয়ে যাবে? রেখে যাও তার তরে
যে আমারে ফেলে রেখে গেছে।
কার তরে? কে সেই রাজাধিরাজ ? কুমার? বিক্রমদেব অনেক চেষ্টা করলেন কুমারের দিক থেকে ইলার মন ফেরাতে। পারলেন না। আর এই ব্যর্থতার, এই পরাজয়ের আঘাতে জেগে উঠল তাঁর পুরনো প্রেমের স্মৃতি। তিনি টের পেলেন, যে-প্রেম সংসারের দিক থেকে মন টেনে এনে শুধু গুটিয়ে রাখতে চায় সবসময়, যে-প্রেমে আত্মসংবরণ নেই, আছে সংহার, তিনি এতদিন তার-ই বশে ছিলেন। জগতের আনন্দযজ্ঞে ইলার প্রেমের স্বরূপ চিনতে পারলেন তিনি। বুঝতে পারলেন :
প্রেমস্বর্গচ্যুত আমি, তোমাদের দেখে
ধন্য হই!
…
আমি কোন সুখে ফিরি
দেশ-দেশান্তরে, স্কন্ধে বহি জয়ধ্বজা,
অন্তরেতে অভিশপ্ত হিংসাতপ্ত প্রাণ!
কোথা আছে কোন স্নিগ্ধ হৃদয়ের মাঝে
প্রস্ফূটিত শুভপ্রেম শিশির শীতল
ধুয়ে দাও প্রেমময়ি, পুণ্য অশ্রুজলে
এ মলিন হস্ত মোর, রক্ত কলুষিত।
এটাই এই নাটকের ‘আইডিয়া’। ‘পুণ্য অশ্রুজলে’র মায়ায় যে-আইডিয়াকে পল্লবিত করা হয়েছে এই নাটকে। শেষ পর্যন্ত সুমিত্রাকে আর ফিরে পাননি বিক্রমদেব, শুধু সুমিত্রা নয়, ইলা-কুমার সহ নাটকের সব তাৎপর্যপূর্ণ চরিত্রই নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে রাজাকে সচেতন করে দিয়ে গেছে। সুমিত্রা মারা যাবার পরে তাঁর আর্তি :
দেবি, যোগ্য নহে আমি তোমার প্রেমের,
তাই ব’লে মার্জনাও করিলে না? রেখে
গেলে চির-অপরাধী করে? ইহজন্ম
নিত্য অশ্রুজলে লইতাম ভিক্ষা মাগি
ক্ষমা তব ; তাহারো দিলেনা অবকাশ
‘চির-অপরাধী’ হয়ে থাকার যন্ত্রণা বিক্রমদেবকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। এই যন্ত্রণার আভাতেই মুক্তি ঘটেছে তাঁর, প্রেমের ব্যক্তিসর্বস্বতা থেকে উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি, আর তারপরে টের পেয়েছেন নিজের ‘শাণিত ক্রূর বক্র’ রূপ, যার একটি প্রতিমূর্তি তিনি দেখতে পেয়েছেন রেবতীর মধ্যে। বুঝতে পেরেছেন :
এ হিংসা আমার
চোর নহ, ক্রূর নহে, নহে ছদ্মবেশী।
প্রচণ্ড প্রেমের মত প্রবল এ জ্বালা
অভ্রভেদী সর্বগ্রাসী উদ্দাম উন্মাদ দুর্নিবার।
এই ‘হিংসা’, ‘প্রচণ্ড প্রেমের’ এই জ্বালার স্বরূপ তিনি চিনতে পারলেন সুমিত্রার আত্মদানের পরে। তাঁর এই উপলব্ধির ‘আইডিয়া’ই ‘রাজা ও রানী’ নাটকে নানা বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনার পরম্পরার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।