
মহম্মদ সামিম-এর কবিতাগুচ্ছ
কী তবে বিরলতম?
সবাই তারিখ নিয়ে ফিরে গেছে যে যার ঘরে
নথির জীর্ণ শরীরে ব্যর্থতার গল্প লিখে
আজ সারাদিন আমার মৃত্যু হয়েছে বহুবার
ক্লান্ত দু-চোখের ভিতর উড়ে এসে বসল
‘অভয়া’ নামের একটি শাদা পাখি
কলরবহীন নির্জন এজলাস,
চেয়ারে বিচারক নেই।
আমিও আপ্রাণ চেষ্টা করছি উড়ে যেতে
পারছি না
বুকের ভিতর গিঁথে আছে রাষ্ট্রের ফলা
সাদা কাগজের উপর সন্ধে নেমে এসেছে
শূন্য দু-হাত লাল হয়ে উঠল
যে লাল, সূর্যের যন্ত্রণায় ছিল
যে লাল, তোমার চোখ ফেটে নেমে এসেছিল
যে লাল, চিতার উপর অঝোর কেঁদেছিল তোমার পা ধরে
ক্ষমা চেয়েছিল সেই করুণ আগুন
সেই বাতাস, সেই আকাশ, সেই রাত্রের অন্ধকার
যেখানে তুমি একাকী চাঁদ হয়ে আলো দিতে চেয়েছিলে
একটি বিরল ছায়া পড়েছিল,
যে ছায়া আমাদের লজ্জা ঢেকে দিতে ব্যর্থ হয়েছিল
এজলাস হয়ে উঠল একটি কাচের পৃথিবী
একটি বিরল কান্নার ভিতর ডানা মেলে ধরলে তুমি
সেই অশ্রুর আলোয় আমরা সবাই পুড়ে গেলাম
পাখির নিঃশব্দ উড়ানের মায়াটুকু ছিল বিরল
তোমার চোখের ভিতর সূর্য নিভে
চুঁইয়ে পড়া লাল ভোরের বেদনাটুকু ছিল বিরলতম!
______________________
বেদনা বিধুর
একটা মলিন অন্ধকার কেঁদে চলেছে আজও
তার উপর কত চিৎকার ও রক্তপাত
ক্রমশ অবশ হতে হতে খড়কুটোর মতো
আঁকড়ে ধরে ধ্বস্ত সময়ের প্রাণ
বেঁচে উঠতে চায় একটা আলোর মায়াবী সিঁড়ি।
শূন্যের বিষণ্ণতা দু-চোখ ভরে নিকষ
নিজেকে আস্ত গিলে নেয়!
মুঠোর ভিতর ধরিত্রী, আমার জন্মদাত্রী
কিছুতেই দখলমুক্ত করতে পারছি না
চাঁদের উপর কালো মেঘের প্রলোভন।
ঢেকে দেয় দেহ, দেহের মাটি, আরও অতল আত্মা
তবু অপারগ, যত নখের আঁচড়, দাঁতের কামড়
অসহায়, দুঃখে রাগে আমি একাকী আঁধার
গড়িয়ে নামি দুর্নিবার লজ্জার ভোরে
কাজল-মেদুর রজনীর মৃত্যু হয়
দূরের আকাশে মাথা হেঁট করে সূর্য হেঁটে যায় গভীর বেদনায়।
—————————————
জ্বালানি
অন্ত নেই, আদি নেই, সর্বত্র জড়িয়ে আছে ছায়া
জানি না, কীভাবে মৃত্যু পর্যন্ত পৌঁছাব
ধিকিধিকি পুড়ে যায় সোনালী ক্ষেতের ফসল
খড়ের উপর মাটির স্নেহ, টানা ত্রিনয়ন
প্রসারিত বাহু থেকে একখণ্ড মেঘ ঝরাল বৃষ্টি
বিস্তীর্ণ ভূমির উপর অন্ধকার রাত্রির দেহ
কোন জাদুবলে ছিন্ন করেছ সম্পর্ক
অদূরে শ্মশান, শৃগালেরা দল বেঁধে ডাকে
ব্যথাভরা ব্যর্থ নদী, অনর্গল বয়ে যায়
রক্তমাখা চোখ থেকে জন্ম নেয় আগুন
মৃত্যুর মাঝে নাভির ভিতর শুধু জলের শব্দ
বিশ্বাসে জাগে আলো, ছাই ওড়ে, ধূসর যাত্রা
সারা শরীর থেকে খসে পড়ে অগ্নিপালক
জ্যোতিষ্ক আঙুল তোমার, জ্বালিয়ে দাও অহং।
—————————————
আগুনই তো ময়ূরের পেখম
এভাবে কেন পৃথিবীর পথে পদচিহ্ন সাজাও
ক্ষীণ হতে হতে সমস্ত প্রহর অন্ধ হয়ে যায়!
ক্রমশ পাল্টে যাচ্ছে সাবলীল হাওয়ার গতিপথ
দেখি স্খলন, আত্মত্যাগের মহিমা বলছ যাকে
সে আসলে পাথরের গায়ে পাথরের আঘাত
জ্বলতে জ্বলতে আগুনই তো ময়ূরের পেখম
নিজেকে মেলে ধরে রাজপথের অধিকারে
প্রতিটি মোমবাতি যেন অন্ধকারের অশ্রুদানা
চোখ থেকে ঝরে পড়ে এঁকে দেয় দগ্ধ সময়
জীবনের জলছবি, ছায়ার ভিতর এত সেলাই?
নিজের ভিতর কত ফাঁকি, পক্ষপাতের বাঁশি
এরপরও কেন তবে ধ্যানের ভ্রমে লেখো গান
এত আলো, মঞ্চভরা কোলাহল, সবই ব্যর্থ ছাই
এই শিখা, আত্মদহন শেষে ফিনিক্স হয়ে ওঠে।
__________________________
বলা বারণ
যে-কোনও মূল্যে ফিরে আসা আবশ্যিক
তোমার নাগাল অসাধ্য, সেরে ওঠা হল না
অন্ধ সে-চোখ তুলাদণ্ড হাতে শোক লেখে
বন্ধন খুলে উড়ে যায় ছাতিম ফুলের গ্রাম
তবু চূড়া-স্পর্শের আলোড়নে সমাহিত এই মুষ্টি
বিচার চলুক আবহমান, অতঃপর তারিখজন্ম
মহাশূন্যের অভিধানে কত ব্রহ্মপথ, পুষ্পনীড়
অভিঘাতে মুছে যায় বসুধার ঐশ্বর্য
মহাপৃথিবীর কাছে কী চাও বলো?
শিরা ফুঁড়ে শোণিত অপব্যয়, জমা হয় কবিতা
ধমনীর মৃণাল ভাসে, আঘাত ফিরে আসে
তৃণের পেলব মন সহাস্য সেলাই করে মর্মযন্ত্রণা।