
উঁকিঝুঁকি, আয়না ও দু’চারটে দিন প্রথম পর্ব
কৃষ্ণালক্ষ্মী সেন
— মশাই! বলি, ও ম শা ই!
— অ্যাঁ
— এটা মঙ্গলকোট থানার কেতুগ্রাম তো!
— অ্যাঁ… হ্যাঁ… হ্যাঁ… কেতুগ্রাম। তা ক্যানে গো? এখানে কী করবে?
— আমি একটা নৌকা কিনব। তোমরা নৌকা তৈরি করো না!
— হেঁ হেঁ হেঁ… সে বানাই বটে, কিন্তু তুমি লৌকো লিয়ে কী করবে শুনি?
সামনের দিকে আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে বলি, জানেন মিস্ত্রিমশাই, বহুদিনের ইচ্ছে আমার, নিজের একটা বেশ নৌকা থাকবে। জোয়ারের সময় জল যখন জলের পিঠে চড়ে আহ্লাদে আটখানা হয়ে নাচন মাতন লাগায় আর ছলক ছলক ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে ঢেউগুলো পাড় ছুঁয়ে আবার জলে ফিরে যায়, তখন আমার ওই নৌকাখানা ছেড়ে দেব। আমি থাকব হাল ধরে। বুঝলেন, হাওয়া আর জলে একবার মিলমিশ হলে আর পিছনে দেখতে হবে না। ভাসতে ভাসতে… না, না, ওই ছোট ছোট ডিঙি নয়, মাঝারিসাঝারি গোছের নৌকাই লাগবে। আমার অনেকগুলো নিজস্ব নদী আছে তো, তাই নৌকা একটু জুতসই হলেই ভালো। এপাশে ওপাশে হেলে দুলে রাজার হাতির মতো নৌকো চললে…
‘মেয়ে, ও মেয়ে ওঠো, টামনা প্রায় এসে গেল তো!’
‘অ্যাঁ’, ধড়মড়িয়ে উঠতে গিয়ে লোহার কোনও একটা শক্ত পাতে আমার ডান হাঁটু ঠুকে গেল বেশ জোরে।
হাঁটুতে হাত বুলোতে বুলোতে একটু থিতু হয়ে বুঝলাম, এই দোল, এই দুলুনি নৌকোর নয়। না, আমি তো কোনও নৌকো ভাসাইনি জলে। সে অবশ্য আমার আর হয়ে ওঠে না। সংসারের ঘুরন-চরকিতে পাক খেতে খেতে আজ-কাল-পরশু, আজ-কাল-পরশু করে কেবল সকাল চলে যায়, দুপুর আসে, সূর্য ডোবে, রাত নামে। বাড়িতে রকমারি পদ রান্না হয়, ফর্দ মিলিয়ে দোকান বাজারের জিনিস ঢোকে, পাশের বাড়ির মিসেস ভান্ডারী গাড়ি বেচে দিয়ে চারচাকা কেনার গল্প করেন। কেবল আমার নৌকাখানাই জল ঠেলে জলে চলে না। আমি অজানার দিকে কিছুতেই জল-পথিক হতে পারি না হাওয়ায় হাওয়ায় আমার সেই তিরতির তিরতির করে কেঁপে কেঁপে ওঠা নৌকোর মতো।
ও তাই তো! আদতে আমার তো কোনও নৌকাই নেই। আমি কি তবে স্বপ্ন দেখছিলাম! স্বপ্ন! হবে স্বপ্ন। কিন্তু আমি কোথায় যেন একটা যাচ্ছি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাচ্ছি তো, মনে পড়েছে, পুরুলিয়া যাচ্ছি, হ্যাঁ, টামনাতে। কাল রাতে হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়লাম—চক্রধরপুর লোকাল, সাড়ে বারোটায়।
আমি কি তাহলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নাকি? কিন্তু ট্রেনে তো আমার সচরাচর ঘুম আসে না। বেশ মনে আছে, মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম পৌনে একটা নাগাদ। অন্ধকারের রাতে কত মানুষ আর কত মানুষের মুখ অনেক প্রসঙ্গ নিয়ে কেবলই ফিরে ফিরে আসছিল— সেসব মানুষ— যারা আছে, যারা নেই অথবা যারা থেকেও নেই। কোনও কোনও মুখ কী তীব্র হয়ে উঠেছিল রেললাইনের একটানা ইস্পাতীয় শব্দের মতো। তবে ভোরের দিকে হাওয়া আর রেলগাড়ির দুলুনিতে বোধহয় চোখের পাতায় চোখের পাতা নেমে এসেছিল। তারপর স্বপ্ন এলো… নদী এলো… স্বপ্নে সেই বুড়ো এলো — কেতুগ্রামের মিস্ত্রি, নৌকার পাটাতনে গায়ের জোরে পেরেক ঠোকে যে— ঠক ঠকাস ঠক ঠকাস ঠক ঠকাস।
স্বপ্নে কেমন করে যে নদী আসে! আমার সেই কিশোরীকালে মনকেমনবেলার দিনগুলোতে রোগা রোগা একটা নদী ছিল। তাতে জলের তালে তালে ছোট ছোট ঢেউ ভাঙত। হাওয়ার তোড়ে নৌকো দুলতে থাকলে ঘুম ঘুম পেত বেশ। কতবার আমাদের মাঝিকে দেখেছি নৌকো ছেড়ে দিয়ে ছইয়ের ভিতর চিৎ হয়ে শুয়ে মাথার তলায় দুই হাত ভরে দিয়ে চোখ বুজে গান ধরেছে। হাওয়ায় হাওয়ায় তখন যেন নদীর গন্ধ নাকে এসে লাগে। শরীর ঝিমঝিমোয়। জানি, আমি জানি—সবাই তো বেশ জানে নদীর একটা ছন্দ আছে—আমি কিন্তু জানি নদীর একটা গন্ধ আছে, মানুষের গায়ে যেমন থাকে।
ও মাঝি, একবার ওই গানটা গাও না!
নদীরে তোর জল ছুঁয়েছে কালোমানিক মাঝি
তারই সাথে পলাইতে কি হইবি সখি রাজি?
রাইবিনোদী নদীরে তুই পলাইতে কি রাজি?
তোর, জল ছুঁয়েছে জল ছুঁয়েছে কালোমানিক মাঝি
কী যে হয় আমার মাঝে মাঝে! এক ভাবনা থেকে সরতে সরতে কখন যে আর এক ভাবনায় গিয়ে পড়ি! মন কেবলই এদিকে ওদিকে দৌড় দেয়! সাবির কাকা ঠিক বলত — ‘মনের বড় তরপড়ানি গো, তরপড়ানি, নাগাড় নাগাড় ছুটে পালায়।’
নাহ্, এবার উঠতে হবে, বাইরের পৃথিবীর গায়ে সকালের রং ধরেছে।
পুরোপুরি ধাতস্থ হয়ে উপর থেকে নেমে দেখি নিচের বার্থে হাসিহাসি মুখ করে বসে আছেন হরিদেবপুরের মাসিমা। উনিই আমাকে তবে ডাকছিলেন! কাল রাতেই আলাপ। প্রথম পরিচয়েই ছোলার ডাল দিয়ে লুচি খাওয়াতে চেয়েছিলেন। মাসিমার মনে সম্ভবত ভ্রমণসুখের কারণে ওই মধ্যরাতেও খাস বাঙালির উৎসবময় অনুভূতি সক্রিয় ছিল, কিন্তু আমার ছিল না। খিদেও ছিল না। বাড়ি থেকে খেয়ে বেরিয়েছিলাম।
নীল নীল থোকা থোকা ভোরবেলাকার অন্ধকার সরে গিয়ে বাইরে এখন নরম হালকা আলো। এই আলোয় প্রকৃতির মায়াবিনী রূপে আরও মায়া ধরে। তাকে মনে হয় রূপকথার জিন পরী। বড় রহস্যময় লাগে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে তৈরি হওয়া আবছা প্রেক্ষাপট আর একটা রক্তবর্ণ সূর্য। একটা দৃশ্য পেরিয়ে আর একটা দৃশ্যের দিকে ছুটতে থাকে ট্রেন। গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে সরে যেতে থাকে মাঠ, আমবন, নদী, পৃথিবী—সব। সে কী শান্ত, নির্মল রূপ! সে রূপের বর্ণনা বৃথা শব্দের অপচয়। শব্দে তার সিকিভাগও ধরা যায় না।
ট্রেনের খোলা জানলা দিয়ে হু হু করে বসন্তের মেঠো হাওয়া ঢুকছে। হরিদেবপুরের মাসিমার মুখময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে কাঁচাপাকা চুল। তাঁর কপালে একটি টিপ, বড়, লাল রঙের।
— আপনিও কি টামনায় নামবেন?
— না, না, আমি তো কুনকি যাচ্ছি, ওখানেই আমার আদি শ্বশুরবাড়ি। ফাল্গুনী পূর্ণিমায় বড় করে পুজো হয়। তবে টামনা আমি গেছি। আমার ছোট জায়ের বাড়ি ওখানে।
—ও, সাবধানে যাবেন। আমি আসি। পরের স্টেশনই টামনা, নামতে হবে।
—তা তোমার কেউ থাকে বুঝি এখানে?
— না তো!
— তাহলে কি কাজে এসেছ?
—আমি পালিয়ে এসেছি।
দু চারটে বই নেওয়ায় কাঁধের ব্যাগটা একটু ভারি হয়েছে। এবং আমার কথা শুনে হরিদেবপুরের মাসিমার মুখটা খানিকটা হাঁ হয়েছে। সেটা দেখেই বলি, না মানে রোজদিনের একই কাজ, একই জীবন, হুড়োহুড়ি, ব্যস্ততা, শহরের ভিড় — সে সব ফেলে রেখে চলে এসেছি।
—ও, তাই বলো, ঘুরতে এসেছ।
ট্রেন টামনা স্টেশনে ঢুকছে।
—না, নিজেকে খুঁজতে এসেছি।
(ক্রমশ)
শুরুটা খুব সুন্দর,,,,একেবারে অন্যরকম,,,