
বঙ্কিমচন্দ্র – বন্দেমাতরম এবং একটি প্রবহমান বিতর্ক
ধীমান ব্রহ্মচারী
উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরোধা সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’, যেখানে ‘বন্দেমাতরম’ গানটি অন্তর্ভুক্ত হয়। এখন এই ‘বন্দেমাতরম’ গানটির সূতিকাঘর বা রচনার স্থান অথবা সোজা কথায় গানটি কোন স্থানে বসে লেখা হয়েছিল? — এই নিয়ে বাঙালি পণ্ডিতদের মতবিরোধের অন্ত নেই। যুক্তি, প্রমাণ ও নানা ধরনের স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন। একটি প্রশ্ন এবং যাকে ঘিরে দীর্ঘ শতাব্দী ধরে চলে আসছে এক অদ্ভুত বিকৃত ইতিহাসের ধারা। যেখানে প্রায় ধরে নেওয়া হয় হুগলি জেলার সদর শহর চুঁচুড়ার জোড়াঘাট সংলগ্ন একটি বাড়ি যা বর্তমানে ‘বঙ্কিম ভবন’ বা ‘ বন্দেমাতরম ভবন ‘ নামে পরিচিত, ইতিহাস আশ্রিত সেই বাড়িটিতেই বঙ্কিমচন্দ্র বেশ কিছুকাল কাটিয়েছেন এবং এই বাড়ির অন্দরে বসেই তিনি ‘বন্দেমাতরম’ গানটি রচনা করেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই ভবনে থাকাকালীন বঙ্কিমচন্দ্র যদি গানটি লিখে থাকেন তাহলে এর উপযুক্ত প্রমাণ কী? দ্বিতীয়ত, ঠিক কোন সময়ে এই গানটি তিনি রচনা করেন ?– এবার এই দুটি বিষয়কে মাথায় রেখে যদি আমরা দু’চারটে ঘটনা ও কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্যকে ভিত্তি করে কিছু প্রশ্ন রাখি তাহলেই উপযুক্ত ও সঠিক সিদ্ধান্ত আমরা গ্রহণ করতে পারব।
প্রথমত, বর্তমান নৈহাটির কাঁঠালপাড়া অর্থাৎ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মভিটে। এবং হুগলি নদীর পশ্চিম পাড়ে প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো শহর চুঁচুড়া। এই দুই শহরেরই অলিন্দে বঙ্কিমচন্দ্রের যোগাযোগ, কাঁঠালপাড়ায় বেড়ে ওঠা ও তারসাথে সাহিত্যকর্ম এবং ব্যক্তিগত জীবনে চাকরির স্থান হিসেবে এই চুঁচুড়া শহরও উল্লেখযোগ্য। একটি তথ্যে পাওয়া যায় তিনি ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ২০ মার্চ হুগলিতে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিযুক্ত হন। তখন তিনি তাঁর কাঁঠালপাড়ার বাড়ির দক্ষিণে মুক্তারপুর খাল দিয়ে নৌকায় করে হুগলি নদী পার হয়ে এপারে চুঁচুড়ায় নিয়মিত যাতায়াত করতেন। (বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়ি – গৌতম সরকার / বঙ্কিমভবন ও গবেষণাকেন্দ্র) এবং এরই সঙ্গে উল্লেখিত ওই ঘরে বসেই তিনি “বন্দেমাতরম” সংগীত এবং “কৃষ্ণকান্তের উইল ” উপন্যাস ইত্যাদি রচনা এবং বঙ্গদর্শন পত্রিকার তৃতীয় ও চতুর্থ বছরের সম্পাদনার কাজ সম্পন্ন করেন। (অন্য এক বঙ্কিমচন্দ্র – গোপাল চন্দ্র রায় | দেজ) পাশাপাশি বঙ্কিমচন্দ্রের সার্ভিস রেকর্ড থেকে জানা যায় তিনি প্রায়শই শারীরিক অসুস্থতা জনিত কারণে বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে টানা এক মাস থেকে আট মাস পর্যন্ত ছুটি নিয়েছেন। অবশ্যই এই সমস্ত ছুটিগুলোতে তিনি তাঁর কাঁঠালপাড়ার বাড়িতে ফিরে লেখার কাজে মগ্ন হয়ে যেতেন। যদিও হুগলিতে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিযুক্ত হবার প্রথম বেশ কিছুদিন তিনি কাঁঠালপাড়া থেকেই যাতায়াত করতেন। এই প্রসঙ্গে শচীশচন্দ্র বলেছেন – বঙ্কিমচন্দ্র সপরিবারে চুঁচুড়ায় বাস করতে থাকেন ১৮৭৬ এর এপ্রিল-মে মাস থেকে। অন্যদিকে “সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা’য় ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস বলছেন – ” ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে বঙ্কিমচন্দ্র কাঁঠালপাড়ার বাস উঠাইয়া চুঁচুড়ায় একটি বাড়ী ভাড়া করিয়া সপরিবারে উঠিয়া গেলেন(ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস, ‘সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা’, বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ, ১ম সংস্করণ মাঘ ১৩৪৯, ৪র্থ সংস্করণ ১৩৬১, পৃ. ৯৫) । কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের মেজদাদা সঞ্জীবচন্দ্রের পুত্র জ্যোতিশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে লেখা একটা ডাইরিতে দেখা যাচ্ছে যে ওই বছর ১০ এপ্রিল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বঙ্কিমচন্দ্র কাঁঠালপাড়ার বাড়িতেই রয়েছেন। এমনকি সেদিনের দিনলিপিতে জ্যোতিশচন্দ্র লিখছেন – “This day 3rd uncle came to me & confessed that he did wrong to take the musical instrument from me & asked me over & over what I want to have from him in lieu of the instrument.”(কৃষ্ণজীবন ভট্টাচার্য সম্পাদিত জ্যোতিশচন্দ্রের ডায়েরি, দ্র. বঙ্গদর্শন-১১, বঙ্কিম-ভবন গবেষণা কেন্দ্র, পৃ. ২৪৪।) জ্যোতিশচন্দ্র বঙ্কিমচন্দ্রের হারমোনিয়াম নিয়ে প্রতিদিন রেওয়াজ করতেন। একদিন সেই রেওয়াজে অমনোযোগী লক্ষ্য করে বঙ্কিমচন্দ্র জ্যোতিশচন্দ্রের ওপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন এবং হারমোনিয়ামটা ভেঙে দেন। আর এই ঘটনায় সমস্ত দায় তিনি জ্যোতিশচন্দ্রের ওপর চাপান। যদিও পড়ে তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং জ্যোতিশচন্দ্রকে নানাভাবে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেন। ১০ এপ্রিলের দিনলিপিতে তাই জ্যোতিশচন্দ্র লিখছেন- ওই দিন বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর কাছে এসে স্বীকার করেন হারমোনিয়াম ভাঙার ব্যাপারে তিনি ভুল ছিলেন। এরপর ওই ডাইরিতে কাঁঠালপাড়ার বাড়িতে বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে জ্যোতিশচন্দ্রের সাক্ষাতের আর কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। আবার ২২ এবং ২৩ শে মে এর দিনলিপিতে দেখা যাচ্ছে জ্যোতিশচন্দ্র বঙ্গদর্শনের কাজে চুঁচুড়া যাচ্ছেন বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে। ২২মে তে তিনি লিখছেন – “went to Chinsurah & inexpected Bangadarshan office.” পরের দিনও তিনি একই কাজে চুঁচুড়া যান। সেদিনের দিনলিপিতে লেখেন- “went to chinsurah in the morning & released corrected three of four proff of Darshana.”(কৃষ্ণজীবন ভট্টাচার্য সম্পাদিত জ্যোতিশচন্দ্রের ডায়েরি, দ্র. বঙ্গদর্শন-১১, বঙ্কিম-ভবন গবেষণা কেন্দ্র, পৃ. ২৪৪।) এর থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় ১৮৭৯-র ১০ এপ্রিলের পর এবং ২২ মে-র আগে কোনো এক দিন বঙ্কিমচন্দ্র কাঁঠালপাড়ার বাড়ি ছেড়ে সপরিবারে চুঁচুড়া জোড়াঘাটের ভাড়াবাড়িতে উঠে যান। তাহলে দেখা গেল বঙ্কিমচন্দ্র ঠিক কোন সময়টায় ঐতিহাসিক শহর চুঁচুড়ার জোরাঘাট সংলগ্ন বাড়িটিতে বসবাস করতে শুরু করলেন।
দ্বিতীয়ত, বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম গানটির রচনাকাল! অর্থাৎ কোন সময়ে গানটি তিনি লিখেছিলেন। দশকের পর দশক ধরে বিভিন্ন গবেষণা, তথ্য অনুসন্ধান, নানান ধরনের পত্র পত্রিকা এবং স্মৃতিচারণা থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। প্রথমেই ঋষি অরবিন্দের একটি প্রসঙ্গ এখানে তুলে আনি – ” শ্রীঅরবিন্দের একটি লেখা থেকেও প্রমাণিত হয় বন্দেমাতরম্ ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে রচিত হয়েছিল। – ‘It was thirty two years ago that Bankim wrote his great song and few listened; but in a sudden moment of awakening from long delusions the people of Bengal looked round for the truth and in a fated moment somebody song Bandemataram.’ (‘Sri Aurobindo Birth Centenary Edition, Vol. 17, Rishi Bankimchandra.’)- লেখাটি ১৯০৭-এর লেখা। যেখান থেকে ৩২ বছর বাদ দিলে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দ হয়। বন্দেমাতরম সংগীত প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাসে। আর আনন্দমঠ এর প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১২৮৯ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ইংরেজি ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দ। কিন্তু এর আগে উপন্যাসটি প্রথমে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ পেয়েছিল বঙ্গদর্শন মাসিক পত্রে। উপন্যাসের প্রথম কিস্তিতেই গানটির মুদ্রিত হয়েছিল পত্রিকায় ১২৮৭ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যায়, ৫৫৫-৫৬ পৃষ্ঠায়। এর ঠিক বছর পাঁচেক আগে অর্থাৎ ১২৮১-৮২ বঙ্গাব্দের বন্দেমাতরম সঙ্গীতটি স্বতন্ত্রভাবে রচিত হয়েছিল এবং যখন বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদর্শন পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। আর ১২৮২ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাস পর্যন্ত বঙ্কিমচন্দ্রই বঙ্গদর্শন পত্রিকা সম্পাদনা করেন।(প্রবন্ধ পঞ্চাশৎ / বিষয় বঙ্কিমচন্দ্র – অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য)। অর্থাৎ সহজেই আমরা এই গানের সাল নির্ণয় করতে পারি। Bengali Library Catalogue অনুযায়ী বঙ্গদর্শন পত্রিকার ১২৮৭ চৈত্র সংখ্যা প্রকাশিত হয় (১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুলাই)। কিন্তু বঙ্গদর্শনে প্রকাশের অনেক আগেই যে বঙ্কিমচন্দ্র বন্দেমাতরম সংগীতটি রচনা করেন স্মৃতিকথামূলক কিছু লেখা থেকে সেটা সহজেই প্রমাণিত হয়। যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের ছোট ভাই পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখছেন –
“কিঞ্চিৎ পরিণত বয়সে “আনন্দমঠ” লিখিলেন। “বন্দে মাতরম্” গীতটি উহার বহুদিন পূর্ব্বে রচিত হইয়াছিল।… বঙ্গদর্শনে মধ্যে মধ্যে দুই এক পাত matter কম পড়িলে পণ্ডিত মহাশয় আসিয়া সম্পাদককে জানাইতেন। তিনি তাহা ঐ দিনেই লিখিয়া দিতেন। ঐ সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রবন্ধের মধ্যে দুই একটি ‘লোক-রহস্যে’ প্রকাশিত হইয়াছে, কিন্তু অধিকাংশ প্রকাশিতহয় নাই। “বন্দেমাতরম্” গীতটি রচিত হইবার কিছু দিবস পরে পণ্ডিতমহাশয় আসিয়া জানাইলেন, প্রায় একপাত matter কম পড়িয়াছে। সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র বলিলেন, “আচ্ছা আজই পাবে।” একখানা কাগজ টেবিলে পড়িয়াছিল, পণ্ডিতমহাশয়ের উহার প্রতি নজর পড়িয়াছিল, বোধ হয় উহা পাঠও করিয়াছিলেন, কাগজখানিতে “বন্দেমাতরম্” গীতটি লেখা ছিল। পণ্ডিতমহাশয় বলিলেন, “বিলম্বে কাজ বন্ধ থাকিবে, এই যে গীতটি লেখা আছে,- উহা মন্দ নয় ত- ঐটা দিন না কেন।” সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র বিরক্ত হইয়া কাগজখানি টেবিলের দেরাজের ভিতর রাখিয়া বলিলেন, “উহা ভাল কি মন্দ এখন তুমি বুঝিতে পারবে না, কিছুকাল পরে উহা বুঝিবে- আমি তখন জীবিত না থাকিবারই সম্ভব, তুমি থাকিতে পার।” (পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, “বঙ্কিমচন্দ্রের বাল্যকথা”, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, ‘বঙ্কিম-প্রসঙ্গ’, মুখার্জি বোস এণ্ড কোং, ১৯২২, পৃ. ৫২-৫৩।) আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এ প্রসঙ্গে এখানে বলে রাখি – ” । “আমার দুর্গোৎসব” বঙ্গদর্শন-এ প্রকাশিত হয় কার্তিক ১২৮১ সংখ্যায়। পরের সংখ্যা, অর্থাৎ, অগ্রহায়ণ ১২৮১-র শেষ লেখা ‘প্রাপ্ত গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত সমালোচনা’ বিভাগে প্রকাশিত ঈশানচন্দ্র বসুর ‘চিত্তবিনোদ কাব্য’-এর আলোচনা। এই আলোচনার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ২৯টি চরণ। তাহলে পূর্ণচন্দ্র কি ওই স্থানটুকুর ‘matter কম’ পড়ার কথাই উল্লেখ করেছিলেন? কারণ সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র সম্মত হলে ২৮ চরণের বন্দে মাতরম্ গানের দ্বারা ওই স্থান পূরণ করা সম্ভব ছিল। বিষয়টি কেন এতদিন আলোচকদের চোখে পড়েনি, ভাবতে অবাক লাগে। শ্রদ্ধেয় জগদীশ ভট্টাচার্য(১)অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য-কৃত বঙ্গদর্শন-এর কালানুক্রমিক সূচি দেখেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ তিনি সম্ভবত মূল পত্রিকা দেখেননি। যেহেতু অমিত্রসূদনবাবুর সূচিতে পৃষ্ঠা সংখ্যার উল্লেখ নেই, তাই এই বিভ্রান্তি হয়ে থাকবে বোধ হয়। Bengal Library Catalogue অনুযায়ী অগ্রহায়ণ ১২৮১ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ৫ ডিসেম্বর ১৮৭৪। অন্যদিকে কার্তিক সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১২ অক্টোবর ১৮৭৪। আর সে-বছর দুর্গাপূজার সপ্তমী ছিল ১৮ অক্টোবর। “আমার দুর্গোৎসব” যে দুর্গাপূজার আগেই রচিত হয়েছিল সেকথা আমরা উল্লেখ করেছি। ফলে রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় অগ্রহায়ণ ১২৮১ সংখ্যার পাদপূরণের জন্য যদি বন্দেমাতরম্ গানটি চেয়ে থাকেন, তাহলে “আমার দুর্গোৎসব”-এর ছন্দোবদ্ধ বাণীরূপ বন্দেমাতরম্ গানটি বঙ্কিমচন্দ্র রচনা করেন ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসের শেষদিকে, ১৮ অক্টোবরের পর কোনো একদিন। আর পূর্বোল্লিখিত সুমনকুমার মিত্রের কল্পনা অনুসারে পূর্ণিমা রাতের সঙ্গে যদি বন্দেমাতরম্ গান রচনার কোনো সংযোগ থেকে থাকে, তবে সেটি ওইবছরের কোজাগরী পূর্ণিমার রাত-অর্থাৎ, ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ অক্টোবর।” (বন্দেমাতরম রচনাকাল ও রচনাক্ষেত্র – কিছু অনুক্ত তথ্য/ পার্থপ্রতিম চট্টোপাধ্যায়) ।
আবার একই রকম ভাবে দেখা যায় ১২৯২ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় ঠাকুরবাড়ির ‘ বালক ‘ পত্রিকায় বন্দেমাতরম গানের কিছুটা অংশ ও তার স্বরলিপি প্রকাশিত হয়। স্বরলিপি কর্ত্রী প্রতিভাসুন্দরী দেবী। বন্দেমাতরম গানের ভাব অবলম্বনে ‘বালক ‘ এর এ সংখ্যায় পূর্ণ পৃষ্ঠার একটি ছবিও মুদ্রিত হয়। ছবির নিচে লেখা ‘ বন্দেমাতরং ‘। স্বরলিপির ভূমিকায় লেখা,-‘ বঙ্কিমবাবুর রচিত বন্দেমাতরং নামক বিখ্যাত গানটির সমস্তটা দেওয়া গেল না, কারণ উক্ত গানের সুর অত্যন্ত কঠিন, সমস্তটা দিলে পাঠকের সহজে আয়ত্ত হইবে না। (প্রবন্ধ পঞ্চাশৎ / বিষয় বঙ্কিমচন্দ্র – অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য) – এবং এখানেই খুব সাধারণভাবে আমাদের প্রশ্ন বন্দেমাতরমকে বঙ্কিমচন্দ্রের রচিত বিখ্যাত গান বলে উল্লেখ করার ফলে আনন্দমঠ গ্রন্থটি প্রকাশের মাত্র তিন বছরের মধ্যেই বন্দেমাতারাম গানটি এতখানি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল যে ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত কাগজে সেই গান সচিত্র প্রকাশ হয়েছিল। অর্থাৎ এমনটা হতেই পারে বঙ্কিমচন্দ্রের এই গান আনন্দমঠে প্রকাশিত হবার আগেই লোকমুখে গীত হিসেবে দেশবাসীর কাছে অত্যন্ত প্রিয় হয়েছিল। কারণ দিনক্ষণ যদি একটু দেখা যায় তাহলে দেখা যাবে ১২৮৯ বৈশাখে (এপ্রিল,১৮৮২) অষ্টম এবং জ্যৈষ্ঠে (মে,১৮৮২) নবম অর্থাৎ অর্থাৎ শেষ কিস্তি ছাপা হয়। বঙ্গদর্শন উপন্যাস শেষ হবার সাত মাস পর ১৮৮২এর ১৫ ডিসেম্বর আনন্দমঠ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। বই প্রকাশের সাত মাস পর দ্বিতীয় সংস্করণ এবং দ্বিতীয় সংস্করণের তিন বছর পর তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। লেখক এর জীবনকালে মোট পাঁচটি সংস্করণ ছাপা হয়। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য দ্বিতীয় তৃতীয় ও পঞ্চম সংস্করণ ছাপা হয় এক হাজার করে। এবং চতুর্থ সংস্করণে ২০০০ কপি ছাপা হয়। তাহলে প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৮৮২ এর ১৫ ডিসেম্বর, এবং অনুমান করা যেতে পারে ১৮৮৩ সালের প্রথম দিকেই পাঠকের হাতে বই এসে পৌঁছায়। এবার যদি ধরে নেঅপয়া যায় বঙ্কিমচন্দ্রের বই এক এক এডিশনে সাধারণত ছাপা হত পাঁচশো বা হাজার কপি, এবং যদি ধরেও নেয়া যায় প্রথম সংস্করণ হাজার কপি ছাপা হয়েছিল তাহলে ১৮৮৩ থেকে ১৮৮৬ সালের ১৫ এপ্রিল অর্থাৎ দ্বিতীয় সংস্করণের প্রকাশকাল পর্যন্ত মোট ২ হাজার কপি আনন্দমঠ বাজারে বিক্রি হয়েছিল। ৪০ মাসে ২০০০ কপি মানে বছরে ৬০০ কপি বিক্রি। এ আদৌ কোন বিস্ময়কর জনপ্রিয় বিক্রি হিসাব নয়। আর যদি তাই হয় তা সত্ত্বেও এই আনন্দমঠ গ্রন্থের অন্তর্গত একটি গান ১৮৮৫ এর মে মাসের মধ্যে কেমন করে একটা গান বিখ্যাত হয়ে গেল? (প্রবন্ধ পঞ্চাশৎ / বিষয় বঙ্কিমচন্দ্র – অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য)
আলোচনা যতই হয়েছে ততই একটার পর একটা জট খুলেছে। শুধুমাত্র নৈহাটি কাঁঠালপাড়া অথবা চুঁচুড়া শহরকে কেন্দ্র করে এই বন্দেমাতরম গানটির সূতিকাগৃহ আলোচনায় আসেনি, এসেছে মুর্শিদাবাদের লালগোলা, আবার দক্ষিণের জয়নগর মজিলপুর – এই উক্ত স্থানকেও বন্দেমাতরম গানের প্রকৃত স্থান হিসেবে কেউ কেউ গণ্য করেছেন। যদিও এখন এই দুটি অঞ্চলকে আমার আলোচনায় রাখার প্রয়োজন বোধ করছি না। ফলে শুধুমাত্র চুঁচুড়া শহরের অবস্থানকে কেন্দ্র করেই গানটির প্রকৃত সূতিকাগৃহ খোঁজার কিছুটা চেষ্টা করছি। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের হুগলি চুঁচুড়ার ‘বন্দেমাতরম শতবার্ষিকী কমিটি’ ও ‘হুগলি চুঁচুড়া সাংস্কৃতিক সংঘ সংহতি’র উদ্যোগে চুঁচুড়া জোড়াঘাটে বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়িতে (এক সময় বঙ্কিমচন্দ্র যে বাড়িতে ভাড়া নিয়ে উঠেছিলেন) বন্দেমাতরম রচনার শতবর্ষ পালন করা হয়। এবং সেখানে একটি স্মারক গ্রন্থও প্রকাশ করা হয়। যেখানে মুদ্রিত অক্ষরে পরিষ্কারভাবে লেখা আছে – ” ‘ বন্দেমাতরম রচিত হয়েছিল ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে চুঁচুড়ায় বঙ্কিমচন্দ্রের জোড়াঘাটস্থিত বাসভবনে।’ সেই অনুযায়ী জোড়াঘাটের বাড়িটিকে ‘বন্দে মাতরম্ ভবন’ হিসাবে ঘোষণা করে একটি ফলকও লাগানো হয়। ওই বছরই ২৬ জুন চুঁচুড়া নিবাসী গোরাচাঁদ আঢ্য লিখলেন ‘বন্দে মাতরম্ : ‘একটি সঙ্গীতের জন্মকথা’ শীর্ষক ২২ পৃষ্ঠার একটি পুস্তিকা; যেখানে তিনি চুঁচুড়াতে বসেই যে বঙ্কিমচন্দ্র বন্দেমাতরম্ গানটি রচনা করেন, নানাভাবে সেকথা প্রমাণ করার চেষ্টা সত্ত্বেও নিজেই দুটি জায়গায় বন্দে মাতরম্ ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে রচিত বলে উল্লেখ করে ফেলেছেন। যথা- ১. “১৮৭৫ খৃষ্টাব্দে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র বন্দেমাতরম্ সঙ্গীত রচনা করেন- অভিজ্ঞ মহলে এ বিষয়ে মতভেদ নাই।” (পৃ. ৬); ২. ১৮৭৩ খৃষ্টাব্দে অক্ষয়বাবু দশমহাবিদ্যায় যে জয়ধ্বনির আহ্বান জানাইলেন-১৮৭৪ খৃষ্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র সেই আহ্বান জানাইলেন, দেবী দুর্গাকে ‘আমার দুর্গোৎসব’ প্রবন্ধে, ১৮৭৫ খৃষ্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র নীরবে তাহার সাড়া জাগাইলেন- ‘বন্দে মাতরম্’ কবিতায়…” (পৃ. ১০-১১) গোরাচাঁদ আঢ্য চুঁচুড়াতে বন্দেমাতরম রচনার স্বপক্ষে মূল যে তথ্যটি পরিবেশন করেছেন সেটি ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে চুঁচুড়ায় অনুষ্ঠিত বঙ্গীয়-সাহিত্য-সম্মিলনের পঞ্চম অধিবেশনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি হিসেবে বঙ্গদর্শন পত্রিকার অন্যতম লেখক ও বঙ্কিম-স্নেহধন্য সাহিত্যাচার্য অক্ষয়চন্দ্র সরকারের বক্তৃতার একটি অংশবিশেষ; যেখানে অক্ষয়চন্দ্র বলছেন- “আমাদের যখন পূর্ণ-যৌবন, চুঁচুড়া তখন সাহিত্যের আনন্দ-কানন। সাহিত্য-সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র তখন তাঁহার সুরধুনী-তীরস্থ বন্দে মাতরম্ সঙ্গীতের সূতিকা-গৃহে অধিষ্ঠিত। নিকটেই প্রগাঢ় পণ্ডিত পূজনীয় ভূদেব নামের সার্থককারী ভূদেববাবু প্রতিষ্ঠিত।” (পৃ. ১৬) সেইসঙ্গে তিনি নবপর্যায় বঙ্গদর্শন পত্রিকার ১৩১৯ বঙ্গাব্দের ভাদ্র সংখ্যায় প্রকাশিত অক্ষয়চন্দ্র সরকারের “বঙ্কিমচন্দ্র” শীর্ষক একটি রচনারও অংশবিশেষ উদ্ধৃত করেছেন- “বিষবৃক্ষের এবং আনন্দ-মঠের সূতিকা-সমাচার আমি কিছু জানি।… যখন আনন্দ-মঠ সূতিকাগারে তখন ক্ষেত্রনাথ মুখোপাধ্যায় এখানকার আর একজন ডেপুটি ছিলেন, বঙ্কিম বাবু ত একজন ছিলেন; উভয়ের পাশাপাশি বাসা। সন্ধ্যার পর তিনি আসেন, আমিও যাই। তিনি সুরজ্ঞ, বড় টেবিল হারমোনিয়ম্ লইয়া তিনি ‘বন্দেমাতরম্’ গানে মল্লারের সুর বসান। বঙ্কিম বাবুকে সুরের খাতিরে যৎসামান্য অদল বদল করিতে হয়।” (পৃ.১৬-১৭)
আনন্দমঠ বঙ্কিমচন্দ্র চুঁচুড়ায় বসে রচনা করেন এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কারণ ১৮৮০- র ১৫ জুলাই থেকে অভিনন্দন চন্দ্র সেনকে লেখা একটি পত্রের বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই সে কথা স্বীকার করেছেন।(নবীনচন্দ্র সেনের পত্রটির জন্য দ্র. ‘আমার জীবন’ ৩য় ভাগ, “রঙ্গমতী কাব্য”, সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত ‘নবীনচন্দ্র রচনাবলী’, বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ, ১ম সংস্করণ ১৩৬৬, পৃ.১৬২।) এদিকে রেকর্ড বুক থেকে জানা যাচ্ছে বঙ্কিমচন্দ্র ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে হুগলিতে ছিলেন ২০ মার্চ ১৮৭৬ থেকে ৫ জানুয়ারি ১৮৮১ পর্যন্ত। এবং প্রথম প্রথম তিনি কাঁঠালপাড়া(২) থেকে এই নিয়মিত যাতায়াত করতেন। তাহলে চুঁচুড়ায় থাকা শুরু করলেন কবে থেকে? – এই তথ্য যদিও পূর্বেই জ্যোতিশচন্দ্রের দিনলিপিতে বলেছি।
তৃতীয়ত, কাঁঠালপাড়ার বাড়ি থেকেই প্রথম বন্দেমাতরম সংগীতের পাণ্ডুলিপি পান। এই নিয়ে একটু বিস্তারিত কথা বলতেই হবে। এক – ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসের শেষ দিকে অর্থাৎ ১৮ অক্টোবরের পর কোনদিন বন্দেমাতরম গানটি রচনা করেন বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং। কিন্তু সার্ভিস রেকর্ড অনুযায়ী তো বঙ্কিমচন্দ্র মালদাতে কর্মরত এবং তিনি এই সময় কোন ছুটি নিচ্ছেন এমন প্রমাণও পাওয়া যায় না। তাহলে কিভাবে তিনি কাঁঠালপাড়া বাড়িতে বসে গানটি লিখলেন? সার্ভিস বুকে কোনো ছুটির উল্লেখ না থাকলেও, ওই বছরই দুর্গাপুজোর সময় বঙ্কিমচন্দ্র কাঠালপাড়ার বাড়িতেই উপস্থিত ছিলেন, যার সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে পাওয়া যায় পূর্ণচন্দ্রের লেখা, “কমলাকান্তের ‘এস এস বঁধু এস!’ ” শীর্ষক স্মৃতিকথাটিতে। পূর্ণচন্দ্র লিখছেন, “মহাষ্টমী পূজার রাতে কাঁটালপাড়ার বাড়িতে বঙ্কিমচন্দ্র রেনেটি ঘরানার কীর্তন গায়ক বলহরি দাসের কণ্ঠে ‘এসো এসো বঁধু এসো, আধ আঁচরে বসো’ গানটি শুনে মুগ্ধ হয়ে যান এবং কিছুদিন পর বঙ্গদর্শন পত্রিকার ফাল্গুন ১২৮১ সংখ্যায় এই গানকে কেন্দ্র করে লেখেন ‘কমলাকান্ত’ গ্রন্থের অন্তর্গত “একটি গীত” শীর্ষক রচনাটি। “আমার দুর্গোৎসব”-এর মতো “একটি গীত”-এও বঙ্কিমচন্দ্র কালস্রোতে নিমজ্জিত দেশজননীর কথাই বলেছেন, যদিও সেখানে কালস্রোত হয়েছে গঙ্গাস্রোেত। রচনার শেষবাক্যটি ছিল- “যদি গঙ্গার অতল-জলে না ডুবিলেন, তবে আমার সেই দেশলক্ষ্মী কোথায় গেলেন?” শুধু তাই নয় ১৮৭৪ এর দুর্গা পুজোর সময় বঙ্কিমচন্দ্র দেশ মাতৃকার ধ্যানে ভাবনায় মোহিত ছিলেন। ফলে মহাষ্টমীর রাতে বল হরিদাসের কন্ঠে কীর্তন শুনে বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যে লক্ষ্য করি, বন্দেমাতরম – এর মত মহাসংগীত রচনার যেন ব্রহ্মমুহূর্ত সেই ক্ষণ। এমনকি পূর্ণচন্দ্র ও ললিত চন্দ্র দুজনেই বলেছেন – পণ্ডিত রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গদর্শন ‘ এর পাদপূরণের জন্য সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে টেবিলের ওপর রাখা বন্দেমাতরম পাণ্ডুলিপি চেয়েছিলেন। ফলের পরিষ্কার, পাণ্ডুলিপিটি প্রথম দেখা গিয়েছিল কাঁঠালপাড়ায় বঙ্কিমচন্দ্র নির্মিত বৈঠকখানা বাড়িতে তাঁর লেখার ঘরে। এবং এরই সাথে কাঁঠালপাড়া বাড়ি দাবি করে যে বন্দেমাতরম এর সুতিকাগৃহ তাদের, কেননা বঙ্কিমচন্দ্রের ভাইপো মেজদাদা সঞ্জীবচন্দ্রের পৌত্র (জ্যোতিশচন্দ্রের পুত্র) শতঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রূপমঞ্চ পত্রিকার ১৩৫৪ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন ও চৈত্র বৈশাখ পরপর দুটো সংখ্যায়। সেখানে Documentary Film of Bankim Chandra’ নামে বঙ্কিমচন্দ্র, তাঁর পরিবার পরিজন ও কাঁঠালপাড়ার বাড়ি সম্পর্কের তথ্যচিত্র নির্মাণের জন্য বিজ্ঞাপন দেন; যেখানে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে ‘ বন্দেমাতরম ‘ সূতিকা ঘর বলে তিনি কাঁঠাল পাড়ার বাড়ির কোন একটি ঘরকে চিহ্নিত করছেন। (এবং অবশ্যই মনে রাখতে হবে এই শতঞ্জীবচন্দ্রই ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ঋষি বঙ্কিম গ্রন্থাগার ও সংগ্রহশালায় বঙ্কিমচন্দ্র ও চট্টোপাধ্যায় পরিবারের দলিল-দস্তাবেজ, চিঠিপত্র ও বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যবহৃত শাল- পাগড়ী শহ নানা সামগ্রী দান করেন। )
[(১)অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্য তাঁর বন্দেমাতরম শীর্ষক গ্রন্থে অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য বঙ্গদর্শনের যে কালানুক্রমিক সূচি পাওয়া যায়, তা দেখে সম্পূর্ণ মত প্রকাশ করেন যে চতুর্থ বচ্ছরে অর্থাৎ ১৮৭৬ এর কোন সংখ্যায় এক পৃষ্ঠার মতো স্থান পূরণের জন্য কোন লেখার প্রয়োজন হয়নি। অর্থাৎ ১৮৭৬ এর জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত স্থান পূরণের জন্য পণ্ডিতমশায়ের তাগিদে লেখা নেওয়ার কোন প্রশ্নই আসতে পারে না। ]
[(২)অন্যদিকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী “বঙ্কিমচন্দ্র কাঁটালপাড়ায়” শীর্ষক স্মৃতিকথায় লিখছেন- “বঙ্গদর্শন এক বৎসর বন্ধ থাকার পর ১২৮৪ সালে সঞ্জীববাবুর সম্পাদকতায় আবার বাহির হয়।… নূতন বঙ্গদর্শন বাহির হইবার প্রায় বছরখানেক পরে আমি লক্ষ্ণৌ যাত্রা করি এবং সেখানে এক বৎসর থাকি। আমি যেদিন যাই, সেইদিন সকালে বঙ্কিমবাবুর সহিত দেখা করিতে গিয়াছিলাম। বঙ্কিমবাবু তাড়াতাড়ি প্রেসে গিয়া ভিজা বাঁধান একখানি কৃষ্ণকান্তের উইল আমাকে দিলেন, বলিলেন, ‘রেলগাড়ীতে এইখানি পড়িও, ছাপাখানা হইতে এইখানা প্রথম বাহির হইল।’… লক্ষ্ণৌ হইতে ফিরিয়া আমি কাঁটালপাড়ায় গিয়া দেখি বঙ্কিমবাবু সেখানে নাই। শুনিলাম তিনি চুঁচুড়ায় বাসা করিয়াছেন। শিবের মন্দিরের পাশে সে ঘরগুলিতে চাবীবন্ধ। বাগানটি গতপ্রায়। সেই দিনই বৈকালে চুঁচুড়ায় গেলাম, দেখিলাম চুঁচুড়ার যোড়াঘাটের উপর দুইটি বাড়ী ভাড়া করিয়াছেন, একটিতে তাঁহার অন্দরমহল, আর একটিতে তিনি নিজে বসেন। যেটিতে তিনি বসেন, সেটি একতালা। বাড়ীটির একটি গেট আছে। যে ঘরটিতে তিনি বসেন, তাহা একটি বড় হল, গঙ্গার দিকে চারিটি জানালা। সে ঘরের পূর্ব্বের দেওয়ালটি গুটিকতক বড় বড় মোটা গোল থামের উপর, বর্ষাকালে তার নীচেও জল আসে। বঙ্কিমবাবু যেখানে বসিয়াছিলেন, সেদিন তার নীচে খুব জল ছিল। এক বৎসরের পর হঠাৎ আমাকে দেখিয়া তিনি খুব খুসী হইলেন। ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ প্রকাশিত হয় ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট কাঁটালপাড়ার ‘বঙ্গদর্শন যন্ত্রালয়’ থেকে। সুতরাং ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাস পর্যন্ত বঙ্কিমচন্দ্র যে কাঁটালপাড়ার বাড়িতেই থাকছেন শাস্ত্রীমশায়ের লেখা থেকে তা প্রমাণিত। আবার লক্ষ্ণৌ ক্যানিং কলেজে রাজকুমার সর্বাধিকারীর ‘একটিনি’ হিসেবে শাস্ত্রীমশায় ১ সেপ্টেম্বর ১৮৭৮ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর ১৮৭৯ পর্যন্ত পড়ান। তিনি নৈহাটি ফেরেন ১৮৭৯-র অক্টোবরে। এরপর তিনি কাঁটালপাড়ার বাড়িতে বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে জানতে পারেন তিনি চুঁচুড়ায় বাড়ি ভাড়া করে থাকছেন। ফলে শচীশচন্দ্রের ‘বঙ্কিমজীবনী’ কিংবা ‘সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা’য় উল্লেখিত ১৮৭৬ বা ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের কোনো সময় নয়, ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল-মে মাসেই যে বঙ্কিমচন্দ্র চুঁচুড়া জোড়াঘাটের বাড়িটি ভাড়া করেন তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।]