
অরূপ গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতাগুচ্ছ
নক্ষত্রের কবিতা
১
মহাকাশ জুড়ে নৈ:শব্দের কিছুই ছিল না
না বৈভব না অভিপ্রায় না কোন সত্যের উচ্চারণ-
তবু কোটি আলোকবর্ষ জুড়ে নক্ষত্রেরা জন্ম নেয়
আলো ফেলে ফেলে ছায়াপথে বেদনা ছড়ায়
এক বোধহীন জন্ম খুঁজে চলে মৃত্যু পথের নিশানা-
মানুষের কোনও প্রতিশ্রুতি ছিল, মানুষ তা ভাঙে প্রতিদিন,
ছড়ানো বিষাদ আমাদের রক্তে, স্নায়ুতে-শিরায়, অদ্ভুত বহে
শূন্যের বুক ছুঁয়ে কেউ প্রশ্ন করেছিল ভ্রুণের পরিচয়
(পাশপোর্ট এক জাল মানচিত্র, শতকে শতকে বদলায়)
নিরাকার আলো থেকে কিভাবে যে হিংস্রতা নামে
আর চোখের ভেতরে
আকাশ, নক্ষত্র, নদীকে দেখে
সৃষ্টি ও প্রলয়ের নীরব সঙ্গীত শুনে যাই,
(মহাকাশ কি মানুষকে চিনেছিল সঘন মৌনতায়?)
যা কিছু বপন করেছ এতকাল তা সত্য নয়, সত্যের মায়া
সত্য এক শুন্যতাজাত আলো, বিচলনহীন,
মৃত্যুর ছায়া
২
নক্ষত্রের আলো পড়ে সাইবেরিয়ায়
অথচ পাখিরা এই মাঘপূর্ণিমায়
তাদের ডানায়
হৃদয়ের আলো নিতে চলে আসে
ঘরের পাখিদের সাথে
তারা গান গায়, ঘর বাঁধে
স্মৃতি পড়ে থাকে দূরতর তুষার প্রান্তরে
নক্ষত্রপাখিরা সীমানা মুছে মুছে বাহিরকে ঘর, ঘরকে বাহির–
মানুষ পারেনা, নক্ষত্র ছোঁবার স্বপ্ন এক হিমশৈল-চূড়া।
৩
কৃষ্ণগহ্বরে মহাকাশের সমস্ত শিহরণ জমা আছে
সার সার শুয়ে থাকা নক্ষত্রের বায়বীয় কন্ঠস্বর
ঘুমন্ত আলোর দেহে জমা ধূলো শতাব্দী চেতনা
জন্মের পূর্বলেখ, বিস্মৃতি,
স্বপ্নের ছিঁড়ে ফেলা পাতা
শূন্যের স্তব্ধতাকে কে শব্দ পাঠায় রাতভর বহুকৌণিক
আগুনের মধ্যে থেকে উঠে এসেছে, আগুনেই চলে যাবে
অজ্ঞান অন্ধকারে সমাহিত আমি ও নক্ষত্র সময়রহিত
চেতনায় থেকে যাব, নক্ষত্র কি শোনাবে তার জন্মকথা?
মৃত্যুকে মনে রাখার মতো জাগরণ আজো ঘটেনি
বিস্মৃতির এযাবৎ মহাকাব্য
মহাকাশ যত্নে রেখে দেয়
ঘুম ও জাগরণ
যে পাথর শুয়ে আছে, তাকে জড়িয়ে অক্সিজেন-নল
বাতাস ভাসিয়ে দেয়,
নাসারন্ধ্রে দিন ও রাতের আহার–
অথচ সে নির্বিকার, বিমোহিত, ভগ্নপ্রায়, সাড়া-শব্দ বিহীন,
মাঝে একবার চোখ খুলেছিল শূন্যতার ভেতরে এক শূন্যতায়;
ঘুম নাকি জাগরণ ঠিক কোন দিকে পাশ ফিরল সে
কেবিনের বাইরে নিসর্গের ঝর্ণা, হাসির ভিতরে
বিষাদবধের কাব্যবীজ, বাতাসের নিগূঢ় শাসানি-
বাঁ হাতের আঙুল নড়ে, বল কি ডান দিকের জালে ঢুকবে
অবিশ্বাসী চোখ নড়ে ওঠে বারোদিন পর,
একটি অশান্ত পিঁপড়ে বুকের ওপর ঘুরেঘুরে খুঁজে চলেছে
হৃদয়ের স্থান ঠিক কোথায়
নড়ে ওঠে বাঁ পা— একটা বাউন্সার কান ঘেঁষে চলে যায়।
ক্ষত
ক্ষত কি অলিন্দে বাসা বাঁধা কোনো ফেরারি শরীর
অবিরত ঘসা খেতে খেতে দৃশ্যত নীল,
কমলা মেঘ ও রোদ্দুরের মনকষা নিয়ে থেকে গেছি
সয়ে যাওয়া সংলাপ থেকে বেরোনো
নি:শ্বাসের আয়ু সুরের মায়ায় এসে বিভ্রান্ত
ভুলে গেছি আকাশ থেকে আকাশ ভ্রমনে ক্ষতের যন্ত্রণা
নিরাময় পৃথিবী পড়ছিল প্রকীর্ণ সবুজে, মেঘপুঞ্জে, ধ্যানে
সহসা পাথর সরিয়ে ফস করে খুলে গেল—
অশ্রুমালিকা,
ক্ষত কি দেখাবে খুলে লুকানো গহ্বর কতটা গভীর
অনন্তের হিম
নির্মাণ করেছি, যা কিছু নির্ভার
যেমন ছায়াপথ, যেমন দর্পণ-
ওরাও ফেলে যায় পালক রোদ্দুরে
অশ্রু ও স্মৃতি রেখা, প্রাচীন কবেকার
মন কি বোঝা যায়, পথের অন্তিম
কি আছে করতলে পুষ্প ফোটাবার?
রক্ত পশ্চিমে নাবাল ধানক্ষেতে,
ঝরেছে
সারারাত অনন্তের হিম
এস্কোবার অথবা সনাতন
বুলেটঝাঁঝরা দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে সনাতন,
বুকের মাঝখানে ফাটে দ্রুম করতাল
বিষাক্ত খেলার মাঠ—
ফাঁকা
অন্ধকার নেমে আসে,
জাল কামড়ে থেঁতলে যাওয়া হাত, পাথর সমান ভারি,
ভূ-শয্যায় পতনের নিরর্থক দিন,
লক্ষ হীরা জ্বলে যায়
ওই আলোয় অন্ধ সনাতন,
জখম কলজেতে রক্ত গড়ায়
যেন রিল আটকে যাওয়া কবেকার শাদা কালো চলচ্চিত্র
উৎসবের রাত আর লাথি খাওয়া মানুষের কান্না নিয়ে
রঙীন পৃথিবীর দিকে হাঁ-জিভ তাকিয়ে আছে
নিষিদ্ধ কবিতা
রাস্তায় নামি, রাস্তাও দৃশ্য হয় বহুদূর
কাদায় মোচড়ানো, সাইকেল আটকে যায়—
ভবতোষবাবু নেমে শায়িত চপ্পল তুলে আনছেন
মাঝখানে কাঁটাঝোপ, টুসু-হাসনুহানা শোকাকুল
অন্ধকার হয়ে আসে, মেঘলা দিন শিস দিয়ে আরো মেঘলা
সাপেরা মেতেছে ঘন,
বঙ্কিম জোড়ে, শঙ্খ লাগা
টর্চের এলোমেলো আলো, পিঠ জুড়ে জোৎস্না নামায়
টর্চধারী তার জোড়া অন্ডকোষ কপালে তুলে চিত্রার্পিত
খোলস খুলতে খুলতে সর্পদেবী ও সর্পরাজ মানুষজন্মে ফিরছে
অ-শনাক্ত
মড়ক লাগা হিম জোৎস্না
কাতারে কাতারে,
ফেরার রাস্তা বন্ধ
মহিমাময় শোক উড়ছিল মেঠো পথে
পঞ্জরে গাঁথা
নির্গত হবার পর পেশাদার ভোজালি ঘৃণায় কিছুটা বিশ্রাম নেয়,
গুরুত্বহীন মানুষকে চেনে না— ফাঁসুড়ের হাত
জোড় করে সে শুধু তামিল করে,
অ-শনাক্ত দেহ
নির্বিকার পড়ে থাকে, পরিত্যক্ত মাজারে
পরিচয় চিহ্ন মেলাতে ভীড়, রক্তে বসা মাছি
ঘুরে ঘুরে দুর্গন্ধ ছড়ায়।
অনন্ত কলুষ
১
দূরত্ব থেকে দূরত্বে সরে যাচ্ছে সংঘ,
নতুন-বন্ধুতায় চুক্তিবদ্ধ সেয়ানার হাসি
নীলগেঞ্জি পরা একজন লোক খুঁজছে আরেকজন
নীলগেঞ্জি পরা লোক,
রক্তের বন্ধন ছিন্ন, মাটির মানুষগুলি
হারাতে হারাতে খাদের কিনারায়,
রাত্রি চেটে নেয় নক্ষত্রদল, মেঘ-নৌকা, শস্যের ঘ্রাণ
সম্পর্কগুলি আনুপূর্বিক,
ভেতরের ঘূণ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে
২
আমার সমস্ত ভাষা তাড়া খাওয়া হরিণী,
পাহাড়ের খাঁজে ঢুকে হাঁফাতে থাকে
ঝড়ে ও বিদ্যুতে ধুলো বালিয়াড়িতে
খসে পড়া এক একটা ছিন্ন সবুজ—
হাওয়ার মুখে মুখে ফেরে উপনিষদ;
আমি কি করবো,
জল তো গড়িয়ে চলেছে রোজ
ওডেসা স্টেপসে প্যারাম্বুলেটার ছেড়ে দেওয়া মায়ের চোখ,
গাজায় কফিনের অপেক্ষায় কিশোরের ফুটো হওয়া বুক—
সেনাদের করতালি থামছে না,
কথায় কথায় উলকি আগুন ছড়িয়ে
আমাদের হাতে ধরা শৈশব, ঘুড়ি ও লাটাই
তুঁষের আগুন থেকে ঘনিয়ে ওঠা ভয়
এক গভীর শূন্যতাজাত
আমাদের ঠোঁট চেপে ধরে, কন্ঠ চেপে ধরে–
নদীর কিনারা ছুঁয়ে, ঘাসপায়ে দমছুট
রক্তমাখা রুমাল চেপে ভাষা
অহরহ পার হচ্ছে অনন্ত কলুষ
মৃত্যু পরবর্তী
নি:স্ব ডালপালা, ঝুঁকে পড়া গাছ
মৃত্যু কামনা করে বেঁচে আছে, নির্বিরোধী—
শিকড় দুর্বল, চোখে কুয়াশার ঘোর
হাজার বছরের মাটি, কিছুটা পাথর
কুঠার উদ্যত, বজ্রের রোষ যতদূর
শুকনো পাতারা পোড়ে, কিছু ওড়ে
নৃত্যগীত যা কিছু প্রাচীন, কোন অর্বাচীন
ঘর্ঘর শব্দে সুরগুলি ছিঁড়ে ফেলেছিল
মাটির গহন থেকে আদিধ্বনি ওঠে,
এবার ফেরাও—
যা কিছু তুচ্ছ, ছুঁড়ে ফেলেছিলে বানরের ক্রোধে
কত-কতকাল ঝিনুক আত্মস্থ করেছে নোনা ঢেউ
মুক্তার জন্ম দিয়ে গেছে, শিকারী তা কেড়ে নেবে?
নি:স্বতার কোন ইতিহাস নেই, শূন্যতা গোপন করা ছাড়া।
দহন
আগুনের সামনে মাকে বসে থাকতে দেখি
আগুনকুণ্ডলী কি মাকে দেখে
হেড লাইট যেমন পথচারীকে?
মুখে লেগে থাকা সরের মতো বিষন্নতার ছায়া
আগুন দাউ দাউ- মা ভাবতে থাকে
সেই ভুলের কথা, চোখের পাতা পুড়তে থাকে
যেভাবে একদিন পুড়েছিল একথালা ভাতের আগুন-
কোনটা ফেরার রাস্তা, পুনর্জীবন, কোনটা ভুল?
দপ করে নিভে যায় কেরোসিন ডিবা
স্মৃতির ভেতর উনুনের আঁচ এখনো গনগনে,
মা চলে যাচ্ছে এক অশান্ত আগুনের সমুদ্রে
আমি থামাতে পারছি না।
শুভময়
বটফল ফেলে যায় সূর্যাস্তের শেষ কাঠবেড়ালি
কতটা সরব হলে কিছু অন্ধকার রুখে দেওয়া যেতো?
সমস্তই ক্ষয়, সময়ের ক্ষত, শুভময় বসে দেখে
ভেসে যাওয়া কত যে করুণা, নিহিত সাপের ফণা, নিশুতি পালক—
এক ভীড় রাত্রির হাওয়া অ-বিজ্ঞানে নিয়ে গেল
স্মৃতি
যেভাবে ভেঙেছে সংঘ,
পরাগচ্যুত প্রেম চোখ তুলে ঢেকে দেয় গুপ্ত চাদরে।