
পর্ণশবরীর কথকতা ৫
প্রাপ্তি চক্রবর্তী
এক-দুদিন কিছু না লিখলে ভাবনাগুলো মাথায় বিচিত্র এক বিনুনি বুনতে থাকে। নতুনের সঙ্গে পুরাতন, ভালো আর কম ভালোর নানান রঙ থেকে থেকে আনমনা করে আমায়। আগের মতো দেরাজ খুলে খাতা-কলম নামিয়ে এনে লিখতে শুরু করি এবং ফের বিনুনি গাঁথতে বসি। এসব দিনে আমার বহুযুগ আগে ফেলে আসা যাপনের ইতিকথা জানতে সাধ হয়।
ভাবি, কী লিখব আমি এসব যাপন-কথা! ভোরের প্রথম সূর্য আর শীতল বাতাস কত দ্রুত রূপ বদলাতে থাকে তা একইভাবে অবাক করে প্রতি রোজ। একটা তাকিয়ার পরে আরেকখানি তাকিয়া চাপিয়ে জানালার পাশটিতে অল্প একটু জায়গা করে নেওয়া গেছে। এখান থেকে এক টুকরো আকাশের সঙ্গে চেনা-শোনা হয়। খুব সকালে উঠলে এখনো দোয়েল আর কোকিলের ডাক শোনা যায় এখানে, বেলা বাড়লে অবশ্যি অন্য কথা। এখনো নীচের বস্তি ফাগুয়ার মত্ততায় মাতাল এবং অবশ হয়ে পড়ে রয়েছে। সুদীর্ঘকাল হল দোল আর বসন্তের নয়, মত্ততার পরব হয়েছে।
আপাতত মুহূর্তে বাঁচার পণ নিয়ে স্থির হয়ে বসলে নিশ্চুপ সকালটিতে পায়ের আঙুলের ফাঁকে রোদ্দুর আর বাতাস লুকোচুরি খেলতে শুরু করে। আর আমি ভাবি মায়ের বিবাহের তোরঙ্গখানির কথা। বহুবছর হল তার স্থান হয়েছে অপাংক্তেয়র দলে, আমার মনে সরে না যদিও বা। ভাবি, দিদার আমলের মতো আমার কল্পনার একফালি বাসাটিতে তোরঙ্গে রাখব পছন্দসই কাপড়গুলি। নরম সুতি সর্বক্ষণের পছন্দ হলেও উৎসব-পার্বণের জন্য এক-আধখানি একরঙা সিল্ক কিংবা খুব স্বল্প সোনালি জরির সরুপেড়ে বেনারসী থাকাও প্রয়োজন, সাধারণের জীবনে অল্প একটুখানি উজ্জ্বল স্বপ্নের মতো..।
মায়ের কাছে শুনেছি দিদার বিবাহের তোরঙ্গখানি ভরা ছিল অপূর্ব সব ব্যাঙ্গালোর সিল্ক আর তসরে। রান্নাঘরে নানান ফরমায়েশি কারবার সেরে সেসব নেড়েচেড়ে দেখা ছাড়া আর কিছু সম্ভব হয়নি তাঁর। লালপেড়ে নরম তাঁতের শাড়ি অল্পদিনে কালোপেড়ে সাদাশাড়ির নিদান দিয়ে রূপ বদল করলে। তোরঙ্গের কিছু শাড়ি দুই মেয়ের প্রয়োজনে লাগা ছাড়া ভাঁজে-ভাঁজে নিয়ম মতো কেটে গেছিলো সেসব। শাড়ির দোষ নয়, অবকাশের অভাবের ফল সেসব অপব্যয়। তোরঙ্গে দীর্ঘকাল একভাবে থাকলে ভাঁজে ভাঁজে কেটে যাওয়ার ভয় থাকে, তাই নরম রোদ্দুরে সেসবের ভাঁজ বদল করে মেলে দেওয়া দরকার। নিয়মের রদবদল না হলে ভেতরে ভেতরে কখন যেন সুতোগুলি আলগা হতে থাকে, বোঝা যায় না। সময় বিশেষে এলোমেলো করে দেওয়াও যে যত্নের এক রূপ একথা জীবনের নানান অভিজ্ঞতা থেকে বুঝি।
লিখতে লিখতে ভাবি, এসবে কার প্রয়োজন? এই প্রাচীন তোরঙ্গের প্রতি মায়া, না-দেখা ব্যাঙ্গালোর শাড়িগুলির নকশার ঘূর্ণন আর ফুল-পাতায় সময়ে সময়ে নিজেকে সঁপে দেওয়ার নেশা আমার একলার। এককথা লিখতে লিখতে অন্য কথার ভাবনারা আসে, একটা সুদীর্ঘ বিনুনির মতো কথামালা বোনা হয়ে চলে মনে মনে, কাজে-অকাজে, আরামে-বিরামের নি:শ্বাসে।
এতেই আমার শান্তি, এতেই মুক্তি।