মৃন্ময় চক্রবর্তীর গুচ্ছ কবিতা

মৃন্ময় চক্রবর্তীর গুচ্ছ কবিতা

ভাসান

নিমগাছে ডেকে ডেকে উড়ে গেছে
চাঁদ সদাগর।
বোধনের ভাঙা ঘট ছেঁড়া মালা
দেবীর সিঁদুর
ভাঙা তির কালকেতু, লুকিয়েছে
সোনার হরিণ
জীবন-মরাই দাঁতে ছিঁড়ে দেয়
লোহার ইঁদুর।
খিদের সামনে যত স্তোক, পুঁথি
সীসের কড়াই
বেহুলা খুঁজছে জাঁতি, কে করেছে
কার কাছে ঋণ?
নদীর নাগিনী দাঁত, চাঁপাইনগরী
খাই খাই
শ্মশানের জ্যোৎস্নায় দু’পা মেলে
থাকে শুয়োরানি
লখাইয়ের শব টেনে নিয়ে চলে
খুনের নহর
মাথার উপরে জিভ চিরকাল
চ্যাঙমুড়িকানী….
নিমগাছে ডেকে ডেকে উড়ে গেছে
চাঁদ সদাগর।

সাধক

জনার্দন পাত্রের তালপাতার ফুটো চাল বেয়ে দেবতা নামে চিরকাল
রুপোর চাকতির মতো ঝলমলে দেবতা।
কখনো তার মুখ গোপালের মতো গোলগাল,
কখনো শুধু আকাশে ঝুলে থাকে তৃতীয়ার হাসি।
জনার্দন নারকেলকাঠের তক্তায় শুয়ে শুয়ে
হাতজোড় করে প্রণাম করে, ঘুমোতে যাবার আগে।

একদিন সকালবেলায় সে মরে যাবার পর
এঁদো বিছানায় জেগে উঠে দেখল,
কোথাও দেবতা নেই, পাড়া-প্রতিবেশী নেই
শুধু চারটে বুড়ো কাক এসেছে তাকে নিয়ে যাবে বলে।
তারপর সে চারবেহারার পিঠে চেপে শ্মশানের দিকে যাচ্ছে আর যাচ্ছে,
হঠাৎ কাকেরা তাকে বাবলাতলার ভাগাড়ে নামিয়ে বলল,
এখানেই শুয়ে থাক হে, শ্মশানের খরচ তো ঢের
শকুনেরা এখন স্বর্গ সামলাতে গেছে
তোমার ছিটেফোঁটা হাড়মাস মাটিই খাক, পিঁপড়েরও খানিকটা বুদ্ধি হোক!

এই বলে তারা উড়ে চলে গেল।

খোলামকুচির ঘর

পদ্ম কাঁকড়া হয়ে ফুটে আছে পুকুরের পাড়ে চিরকাল।
মাটি খেয়ে মাতাল নিতাই তাকে মেরেছিল বলে
সেই যে পুকুরের কাছে গিয়েছিল একদিন…

খোলামকুচির দাগ ছড়িয়ে রয়েছে এইখানে
যদিও এখন পাথরের বিরাট জ্যামিতি, চাইনিজ ধাবা।
প্রত্নখনকেরা সজল কলসির গলা খুঁজে পাবে
পেয়ে যাবে আয়না, সিঁদুর, জলছাপ শাড়ি
মনসার থান আর সাঁঝের পিদিম।

কৃকলাস,স্বপ্ন

সনাতন ধাড়া মরা আমকাঠের গুঁড়ির উপর উঠে ঘাড় নাড়ল টক টক টক,
এখন তার রঙ কাঠের মতো ধূসর।
কবেকার এক গাছের ফসিল পড়ে আছে এইখানে
তার পাশে তারই তস্য নাতির নাতি বিশাল গাছটা বন সাজিয়ে আকাশ ছুঁয়েছে।
একটা চিল উড়ছিল খুব কাছাকাছি,
সনাতন মাথাটা সূর্যের দিকে তুলতেই তার ঘাড়ের কাঁটাগুলো হয়ে উঠল ধারালো, রাঙা হয়ে উঠল চোখের চারপাশ, চোয়াল উঠল ফুলে;
না, কোনো বীরত্বে নয়, ধূর্ততায় নয়, নেহাতই টিকে থাকার নিঃসঙ্গ ব্যস্ততায়।
তারপর সে তার লেজ টান করে গুঁড়ির খাঁজে খাঁজে মিশে গেল।
গোটা দুই কাঠ পিঁপড়ে পাশ দিয়ে চলে গেল নিঃশব্দে ,
তার চোখে দূরের কুয়াশা :

কতদিন আগে এখানে ছিল মাঠ, ছিল গ্রাম
গ্রামে ছিল মানুষ একদল, উনুন ছিল একান্নের,
চন্ডীতলায় হুঁকোর আসর, শেতলার থানে মনসার ভাসান, কথকতা।

শকুনের মাঠ থেকে চাঁদ পেড়ে আনার খোয়াবে তারা
কাঁধে কাঁধে চড়ে হাঁক পেড়েছিল আকাশের গায়ে : সামাল হো!
তারপর কখন আশ্বিনের ঝড়ে ভেঙে গেল চন্ডীতলা,
গ্রাম ঢেকে গেল পিরামিডে।

সনাতন এখন পাথরের মতো স্থির।
সূর্যের বিপুল আঁধার ছিটকে এসে
ঢেকে দিয়েছে তার কৃকলাস চোখ।

পাখিটার আশ্চর্য তর্জনী

ছায়ার ফাঁকে ফাঁকে মাটিতে গড়িয়ে আছে রোদ
শুকনো পাতার খঞ্জনি বাজাচ্ছে হাওয়া
লুকোনো ফনায় ফুঁসে উঠছে বাতুল নিসর্গ
মাঠের গভীরে চিতা জ্বলছে নিরন্তর
শিশির পড়েছে ঘাসে কতটুকু?
সত্যের দোকান, আলোকবর্ষ মেঠো পথ
সেখান থেকে টিমটিমে কুপির কথা কানে আসছে না।

এখানে সুন্দরের মতো ফুল, কুৎসিতের মতো কাঁটা
বাঘের মতো ঘোড়া, ধানের মতো ঘাস
পাখিটার আশ্চর্য তর্জনী স্থির হয়ে আছে অনন্তের ডালে
আমাকে কিছু না জানিয়ে, না গেয়ে কোনো বোধগম্য গান।

মঙ্গলাপুঁথি

মঙ্গলার স্বামী গ্রামে ফিরে এলো
ডানায় প্রখর ক্লান্তি, ঠোঁটে তেষ্টার দাগ।
খই-মুড়ি নেই কারোর উঠোনে
ঘরে ঘরে রেশনের চাল
আগুনের পয়সা অচল।
সে এখন মাথার চাঁদি খুলে
চুবিয়েছে অমৃতের বিষে।

প্রিয়ব্রতের রথ

ভূষণ্ডি উড়ে এসে বসল নিম ডালে,
একটা পালক ফেলে বলল :
প্রিয়ব্রতের রথ গেছে ডুবে
আকাশে এখন সূর্য একটাই!

জীবন জোনাকির মতো ফাজিল
আর নিয়মগুলো সাতরঙা, কালো।

ধৃত আঙুলেরা জাগে?

স্বৈরাচারীর চোখ মেপে দেয় কথা দিনকাল
খনার ছিন্ন জিভ নিয়ে যাবে রাজকোতোয়াল
বটের শিয়রে হাওয়া কেঁপে ওঠে সবুজ বাউল!
অন্ধরাষ্ট্র-ধৃত আঙুলেরা গেছে ভেঙেচুরে
পুণ্যশ্লোকের পদ ফিকে-নীল ঘন রোদ্দুরে
পাপের আকাশজুড়ে ঘনঘোর রাজার নিশান!

তবুও কোথাও কেউ কেঁপে ওঠে, ডেকে ওঠে নাকি?
বুলবুলি ধান খেয়ে রেখে যায় ক্ষমতার ফাঁকি
ভাঙা আঙুলেরা জাগে, তর্জনী তুলে কথা বলে?

চিরজাগরুক লাশ

আহত চাঁদের থেকে চুঁইয়ে নেমেছে ক্ষত লোহার আকাশ
কাঠের রক্ত ফেটে ছিটকে উঠেছে লাল শ্মশান তারায়
নদীও ভাঙছে কালো নাগিনীর মতো বহু কালের আটন
অন্ধকারের সভা, একা একা বেহুলার গান বেজে যায়
মারণ উচাটন মারন উচাটন মারন উচাটন…

ধ্রুবপদে ভেসে চলে লখীন্দরের চিরজাগরুক লাশ।

ফেলনা কাঁথার মতো চাঁদ

সারারাত টিনের চালে কেউ কথা বলে
সারারাত আমগাছ বেয়ে কেউ ওঠে আর নামে
চোখে ঘুম নেই বলে একা একা জল গান গায়
এভাবে চাইনি বলে, এ জীবন আমাকে চেয়েছে এভাবেই
সারারাত কেউ ওঠে আর নামে, সারারাত
ফেলনা কাঁথার মতো চাঁদ পড়ে থাকে এমন অজলে।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (6)
  • comment-avatar
    শতানীক রায় 4 years

    খুবই ভালো লাগল কবিতাগুলো। অনেক ইন্টারটেকস্টচুয়ালিটি আপনার লেখাকে ইউনিক। আর নানা চিত্র। কত কিছুর ভেতর অন্বেষণ। কবিতার মধ্যে কবিতারাশি।

    • comment-avatar
      Mrinmoy 4 years

      আপনাকে ভালোবাসাটুকুই দিতে পারি, শতানীক

  • comment-avatar
    Chayan Bhowmick 4 years

    দারুণ লিখেছ মৃণ্ময়। বহুদিন আগে এক দুবার লিখেছিলাম আবহমান পত্রিকায়, খুবই ভালো পত্রিকা।

  • comment-avatar
    Sudip Chattopadhyay 4 years

    খুব ভালো লাগলো লেখাগুলি

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes