
বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর কবিতাগুচ্ছ
জোনাকিদের বসত-বাড়ি
যেদিন জোনাকিরা মাঠের ধারে জড়ো হয়
একটা আবছা অবয়ব খোঁজে, মনে হয়
ওরা এ পৃথিবীর নয়…
মনে পড়ে একটা সবুজ আয়নার ভেতর রেখে আসা আমি
আর নদীর মতো তোমার সুদূর জোনাকি-শরীর
সেখানে ঘড়ির কাঁটার মতো আমার ভাসমান ঘুমন্ত শরীর
রক্তচন্দনের সুবাসিত ঘোর লেগে একটু একটু যেন দুলছে—
এ সুবাস পৃথিবীর নয়
তবু যে আবছা নদী-শরীর— জোনাকিদের বসত-বাড়ি
তার শিয়রে কিংবা পায়ে হাতড়ে বেড়াই অজানা জিয়ন-কাঠি
এ জিয়ন-কাঠি পৃথিবীর নয়
তার স্থান-বদল হয়তো অন্যকোন পৃথিবীর সাথে
আপনি কেমন আছেন
তোমার যে হাত হুবহু পরিণতি চেয়ে
অন্য একটা হাতের তালুতে পরিপাটি সংসার আঁকে;
সকালে বাজারের ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে, তারপর
সারা ঘরময় ছড়িয়ে দেয় ব্যস্ত টোস্টের নাদুস টিফিন-গন্ধ
আমি সে হাতের দুরত্বে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করি:
আপনি কেমন আছেন?
তোমার যে হাত, সঞ্চিত শিশিরে মুখ মুছে নিয়ে
সকাল জুড়ে ছড়িয়ে দেয় শিউলি-হাসির দ্রবীভূত রোদ…
যে হাত, একটা অশেষ পথে হেঁটে যাওয়ার দিগন্ত-ভাঙা ইচ্ছেকে দেখায়, এখনও—
আমি সে হাতের দূরত্বে দাঁড়িয়ে বলি:
আপনি কেমন আছেন!
সীতা
তুমি গণ্ডিহীনা হলে আজও রামায়ণ লেখা হয়
পল্টুদা’র চায়ের দোকানে সার্থক হয় আজ
নেতিয়ে পড়া এ পত্রিকার বড়দিন—
শব্দের এ বিষম আলোকসজ্জায়
সবাই গোপনে তোমাকেই খোঁজে
কোন জরুরী সংবাদের অছিলায়
দুঃখের তিলক
কখনও দুঃখের তিলক কাটিনি বলে
ভেবো না আমার দুঃখ নেই…
তবু ক্ষতচিহ্নের জ্যামিতি, বীজগণিত
নিদেনপক্ষে যোগ-বিয়োগ, গুন-ভাগও
তোমাকে শেখাবো না
নিসর্গভেদী যে গতি নিয়ে চাঁদ প্রদক্ষিণ করে যায়
মানুষের হৃদয়
আমি সেই কুলকুল জ্যোৎস্নার মাঠে
নিঃসঙ্গ এক তেঁতুল গাছের প্রাইভেট টিউটর
আয়না
আমার মতোই একটা মানুষ
রোজ আমাকে দেখে… আমার মতো চুল আঁচড়ায়
মুখের বলিরেখা দেখে
প্যারালাল ভুবন থেকে ডাকে: আয় না
কাছে আয়… আরও কাছে…আয়…
জলজ ভাটিয়ালি
এখন মানুষের সব কথা মনে রাখে কাগজ
সব লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে
সংসার, বাজার হয়ে ঈশ্বর অবধি
অথচ আমি আজও তোমাকে লিখতে গিয়ে দেখি
নিমগ্ন নৌকোর সমাধি-শরীরে মাছেদের রঙিন আনাগোনা
লোকজ গানের মতো তোমার মৃত শরীরে
কেমন যেন জলজ ভাটিয়ালি বয়
যুদ্ধ
যুদ্ধের খবরগুলো কামসূত্রের পোজের মতো
পড়শীরা সব নিন্দা ছেড়ে ফেলে
খবরের একই কাগজে ভাগাভাগি করে নেয়
বীভৎস লাশের আরো বিভঙ্গ খোঁজ।
যুদ্ধ ছাড়া মানুষেরা ঠিক সংগঠিত হতে জানে না
যুদ্ধই দেশপ্রেমের সার্থক পোজ