
আমি শুধু লিখতে চেয়েছিলাম
বেবী সাউ
আমি শুধু লিখতে চেয়েছিলাম
সরাসরি নয় যদিও প্রথমে—
তীক্ষ্ণ তীব্র বিষের ফলা
তীরের ধারালো চোখ
হিংসা এবং নারীত্বের কলঙ্ক দিয়ে
ওরা আমাকে লিখতে বারণ করেছিল
ওরা বলেছিল:
স্বীকার এবং স্বীকৃতি
শিকার এবং শিকারী
আমরাই ঠিক করি।
তুমি বহিরাগত…
চুপ করো…মেনে নাও কঠিন বশ্যতা…
ওরা বসিয়েছিল খাপ পঞ্চায়েত
প্রতিটি কাজের ওপর
প্রতিটি কথার ওপর দাগিয়ে দিতে চেয়েছিল সুইট পয়জন
নিজেকে ঈশ্বর ভাবতে ভাবতে
যখন তারা নিয়ন্ত্রণ করত
ভাষা এবং সভ্যতা…
যখন প্রতিটি মানুষকে ওরা
বাধ্য করেছিল
ভয়ংকর রকমের অত্যাচারের পুজো করতে
ওদের হ্যাঁ-তে হ্যাঁ
এবং না-তে না মেলানো জনগণ
আচম্বিত হয়ে বিচার করত সাহিত্য
এবং সংস্কৃতির ধারা
আর তখনই বুনোটিয়া ভেবে
আমার শরীর থেকে
একে একে খুলে ফেলতে লাগল
সবুজ পালক
ঠিক তখনই আমাকে কলঙ্কের মোড়কে মুড়ে
বস্তা বন্দী লাশের মতো
ফেলে দিতে চেয়েছিল ওরা
শিল্পের কালো নর্দমায়
কন্ঠকে ওরা ধিক্কারে ভরিয়ে
আমার প্রতিটি লেখা,
শব্দ এবং অক্ষরকে
ওরা অপবিত্র আখ্যা দিয়ে
হো হো অট্টহাস্যে
সাজাত একেকটি মঞ্চ এবং সভা
লম্বা আঙুল তুলে
কর্কশ ধ্বনির সঙ্গে
বিষাক্ত নিশ্বাস মিশিয়ে
দেখাত:
মেয়ে মানেই তো মনোরঞ্জনকারী,
কবিতা লেখার মতো মেধা বা বুদ্ধি কোথায়!
ওরা আমার নারীত্বের ওপর
আমার একাকিত্ব যাপনের ওপর
পরতের পর পরত ঢেলে দিয়েছে
আলকাতরার চাঁই
প্রতিনিয়ত জ্যান্ত লাশে পরিণত
করতে করতে
থুতু এবং মল মূত্রে ভরিয়ে দিয়েছে
আমার যাপিত একেকটি পৃষ্ঠা
ওরা মানুষের ইনবক্সে ঢুকে
সভা এবং সমিতিতে
সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টে
এবং আড়ালে
এবং আড়ালে…
এবং সামনে গদগদ ভাবের মুখোশ এঁটে
কুৎসা এবং কলঙ্কের মোড়ক উন্মোচন
করতে করতে
চুমুক দিয়েছে চা-য়ে
কবিতা পাঠের উৎসবগুলোতে
অন্য কথা ছিল না
ওদের অন্য বিষয় ছিল না আলোচনার
কর্মহীন এবং বেকারত্বের সমস্যা ভুলে
তারা পড়ে থাকত
লিঙ্গভেদ এবং নারী-ভাগ্যনির্ধারণের কাছে!
আমার লিখিত প্রতিটি কবিতা ওদের মিথ্যে মনে হত
আমার লিখিত প্রতিটি আখ্যানে
ওরা ঝুলিয়ে দিত প্রশ্নচিহ্ন
এবং প্রবন্ধগুলোর ওপর
চাপিয়ে দিত রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা
আমার কল্পনার জগৎ,
ভাবনার ভেতর ঢুকে
বাঘনখ দিয়ে
ক্ষত বিক্ষত করে
উল্লাস ধ্বনি দিয়ে ভরাতে চাইত
শহরের রাজপথ…
আঁচড়ে কামড়ে বারবার
ব্যর্থ হয়ে যেতে যেতেও থামেনি ওরা
ক্ষুধার্ত এবং লোভাতুর চোখে
আমার রূপের রহস্য বুঝতে চেয়েছে
ঘৃণ্য মন নিয়ে এঁকে ফেলতে চেয়েছে
কোনো যৌন রোগের চিহ্ন
শুধু নারী বলে
কিংবা নারী হয়ে কিছু লিখতে চেয়েছি বলে
লম্বা কালো হাতে
সাঁড়াশির মতো
চিপে দিতে চেয়েছে ওরা
আমি বারবার ক্ষমা করেছি ওদের
আমি বারবার কুকুর এবং হাতির প্রসঙ্গ তুলে
লোককথাগুলোর মধ্য থেকে
জেন গল্পগুলো থেকে
এবং পিতামহীর সংস্কার বুঝে
ওদের উপেক্ষা করে গেছি শুধু
শুধু হাজারো মৃত্যুর গন্ধ সরিয়ে
মৃত লাশের চক্ষু সরিয়ে
কপালের ভাঁজ সরিয়ে
ভবিষ্যতের দিকে রেখে যেতে চেয়েছি
আমার লেখা কয়েকটি সামান্য আয়াত
ওরা আমার নাম নিয়ে খিল্লি করেছে
আমার গ্রাম্য স্বভাব
আমার মেক আপহীন মুখ
আমার শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট
উষ্কখুষ্ক চুল
এবং
পিতৃপরিচয় নিয়ে বসিয়েছে
কুৎসার বিচারসভা
ওরা আমার নারীত্বের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে
লোভ এবং লালসার দৃষ্টি
আমি শুধু লিখতে চেয়েছিলাম
আমি শুধু আমার কথাগুলোর জন্য সমমনস্ক পাঠক চেয়েছিলাম
না বলতে পারা কথাগুলোর জন্য অক্ষম অক্ষরের দ্বারস্থ হয়েছিলাম
আমি শুধু নিজের দমবন্ধ মৃত্যু থেকে
বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলাম
শব্দ এবং ধ্বনির সাহায্যে…
সমাজের দেওয়া উপেক্ষার পাহাড় ভেঙে
কিছু হাহাকার পৌঁছে দিতে চেয়েছিলাম
আমার নিভৃতের কাছে
তারা ভয় পেয়েছিল?
তারা আমাকে আটকাতে চেয়েছিল?
তারা শুধু ঈর্ষার বশে ঈর্ষান্বিত ছিল?
আর সেই গোপন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে
নিজেদের চেহারা না দেখে
তারা দৃষ্টি দিয়ে ধ্বংস করতে চাইত আমাকে
তারা তাদের কর্কশ শব্দ দিয়ে মেরে ফেলতে চাইত আমাকে
তারা তাদের জন্মজন্মান্তরের অসফলতা নিয়ে
কষ্ট, আক্রোশ এবং ক্রোধ নিয়ে
বিচার করতে চাইছিল আমাকে
যাদের আমি কখনো না কখনো
মহান নাগরিক ভেবে বসেছিলাম
আমি তাদের আত্মীয় ভেবে
শুভাকাঙ্ক্ষী ভেবে
বলে ফেলেছিলাম লেখার রহস্য
আর তারা
গুপ্ত ঘাতকের মতো
হাজারো কাজের মধ্য থেকেও
বেছে নিত জীবন হত্যার কৌশল
আমি যখন দেশের কথা বললাম
আমি যখন পরিচয়ের কথা বললাম
যখন চাইলাম নদী এবং সম্পদের কথা বলতে
ইতিহাস, ভৌগোলিক দূরত্বের কথা জানাতে
পিতামহীদের যুগ যুগান্তের অশ্রুপাত
এবং আমার নারীত্বের কথা বলতে
এবং আমি যখন লিখতে চাইলাম
এবং আমি যখন শুধু লিখতেই চাইছিলাম…
ওরা আমাকে মঞ্চের লোভ দেখাল
লোভ দেখাল পত্র এবং পত্রিকার
এবং বশ্যতার স্বীকারের
দানাপানি এবং ক্ষুধার লোভ
সিঁড়ি এবং পিছলে যাওয়ার ভয়
আর দেখাল কলঙ্ক দিয়ে
হত্যা করা হয়েছে কীভাবে আমার পূর্বজ লেখকদের!
পেতল এবং টিনের
ওপর খোদিত হল আমার নাম
ওরা ছাপার অক্ষরে দেখাল আমার নাম
ওরা বিষের বোতলে নাম আঁটতে আঁটতে
আড়চোখে তাকাল ছেঁড়া ডানার দিকে
এবং আমার লেখা বন্ধ করতে
আমাকে হুমকি দিতে দিতে
ওরা হয়ে উঠেছিল
একেকটি হিংস্র পশুর মতো
আয়নায় কোনো প্রতিবিম্ব ছিল না যাদের
আমি শুধু ততক্ষণে
শান্ত, স্থির
সামান্য কালির বিনিময়ে
লিখে ফেলতে পেরেছিলাম নিজেকে…
স্পর্শ করতে পারলাম । এই কবিতা ঐতিহাসিক এবং একই সঙ্গে সমসাময়িক ও প্রাসঙ্গিক ।
আন্তরিক ধন্যবাদ আপনাকে