সুবর্ণরেখার তীরে ( দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ পর্ব) <br /> ছন্দা বিশ্বাস

সুবর্ণরেখার তীরে ( দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ পর্ব)
ছন্দা বিশ্বাস

দ্বাদশ পর্ব

কুড়ি

সখী – পথিক কথোপকথনঃ

রাজকন্যার এই ভাবাবেগের ঘটনার তিন -চার মাস আগে মেঘমালার সঙ্গে সোমদেবের দেখা হয়েছিল।

রাজবাড়ির ঘাট থেকে সামান্য কিছু দূরে আর একটি ঘাট আছে। সেখানে স্থানীয় আদিবাসী মানুষেরা স্নান করে, পূজা অর্চনা করে থাকে।

মেঘমালা বিকেলবেলা একদিন ঘুরতে ঘুরতে সেই জায়গায় উপস্থিত হল।

এখানে নদী বেশ চওড়া। উত্তর দিক থেকে একটি ছোটো নদী এসে মিলিত হয়েছে। এই মিলনস্থল খুবই পবিত্র বলে আদিবাসীদের কাছে গণ্য হয়। সেই মোহনার ধারে সামান্য উঁচুতে একটি দেবতার থান আছে। খুবই জাগ্রত স্থান। সেই উচ্চ ভূমির উপরে বসেছিল একজন যুবক। নদীর বৈকালিক শোভা দেখছিল মগ্ন হয়ে। সূবর্ণরেখায় পশ্চিম পাড়ে সেদিনের মত দিনমণি অস্তাচলে যাচ্ছেন। যাবার পথে সোনার আবীর ছড়াতে ছড়াতে চলেছেন। তার স্বর্ণ রেণু এসে পড়েছে নদীর জলে। নদীর পাশে বনভূমির মাথায় ম্লান আলোর পরশ মাখা। পাখিয়ার বাসায় ফিরছে। শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ।

মেঘমালা বুঝতে পারল এই সেই যুবক। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল।

যুবকটিকে মেঘমালা বলল, সেদিন হাতে যাওয়ার কথা ছিল, আমার যেতে দেরী হওয়ায় তুমি বোধ হয় চলে গিয়েছিলে। তাই না?

আমারই ভুল ছিল, আমি একটা বিশেষ কারণে সেদিন হাটে যেতে পারিনি।

ওহ, তা এক প্রকার ভালোই হল। আমি ভাবলাম তুমি আবার মনে কিছু করলে কিনা।

তা বলো, আজ এই জায়গায় আগমনের হেতু কি?

মেঘমালা সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞাস করল সে কোত্থেকে এসেছে?

যুবক জানাল মধ্যদেশে তার বাস।

এখানে আসার কারণ জানতে চাইলে সে জানাল, ব্যবসার কাজে সে এদিকে এসেছে।

এবারে সে উল্টে মেঘমালার পরিচয় জানতে চাইল।

মেঘমালা মৃদু হেসে বলল, সে রাজা জগৎদেবের রাজকন্যার সখী। রাজকন্যা তোমার নিজের আঁকা এক খানা ছবি দেখতে চাইল।

আমার ছবি? সে কী করে জানলে আমি ছবি আঁকি?

তোমার আঁকা ছবি আমার কাছে আছে।

তোমার কাছে আমার ছবি?

আমার কাছে ঠিক নয়, আমাদের রাজকন্যার কাছে।

রাজকন্যার কাছে আমার ছবি কীভাবে গেল?

ছবিটা পেয়েছি একজন খনি শ্রমিকের কাছে। সেই আমাকে দিয়েছে। আমার খুব পছন্দ হয়েছিল তাই আমি নিয়ে গেছি রাজকন্যাকে দেখানোর জন্যে।

আমার ছবি রাজকন্যাকে দেখিয়ে কী হবে?

আমার ছবিটা খুব ভালো লেগেছিল তাই ভাবলাম রাজকন্যাকে দেখাই। শিল্পী যদি রাজকন্যার জন্যে এমন একটা সুন্দর ছবি এঁকে দেয় শিল্পী তাই দেখানোর জন্যে নিয়ে গিয়েছিলাম।

তা তোমাদের রাজকন্যা সেই ছবি দেখে কিছু বলল?

মেঘমালা সত্যিটা না বলে বলল, রাজকন্যা জানতে চাইল এই ফটো যার তার সন্ধান পেলে তার সঙ্গে একটিবার দেখা করতে চায়।

যুবক মৃদু হেসে বলল, তোমাদের রাজকন্যার এমন খামখেয়ালি আচরণের হেতু কি?

আমি নিতান্ত একজন মুসাফির। দেশে দেশে ঘুরে দেশ দেখাই আমার কাজ। তার সঙ্গে কিছু ব্যবসাপাতি করি। না হলে নিজের জীবন ধারণের জন্যেও ত কিছু দরকার। কে আর আমায় নিত্য বসে খাওয়াবে?

আমার চালচুলো কিছু নেই। পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর সে সব দেখার জন্যে দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছি।

মেঘমালা বলল, আপনি কি প্রতিদিন এই সময়ে এখানে আসেন?

নাহ, কয়েক দিন হল আসছি। এই স্থান অতি মনোরম। বিশেষ করে বৈকালিক শোভা অতি উপভোগ্য। সেই কারণে কয়েকদিন হল আসছি।

আপনার হঠাৎ ছবি আঁকার বাসনা হল কীরকম?

যুবক এই প্রথম উচ্চ স্বরে হেসে উঠল। হঠাৎ নয় এতা আমার শখ বলতে পারো, নেশাও।

আচ্ছা, তোমার আমার ব্যাপারে এতো কৌতুহল কেন বলতো?

আমার নয়, রাজকন্যার।

রাজকন্যারও বা কেন এমন বেপরোয়া কৌতুহল?

সেটা বলতে পারি নে। হতে পারে সেও আপনার মতোই সুন্দরের পূজারী।

তা নাকি? তুমি তো দেখছি খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারো? তা তোমাদের রাজকন্যা কি খুব সুন্দরী?

সেটা তো আপনাকে দেখে বলতে হবে। সুন্দরের সংজ্ঞা এক এক জনের কাছে এক একে ভাবে ধরা দেয়।

বাহ, চমৎকার বললে তো কথাটা?

কিন্তু আমার মত একজন ভিন দেশী আগন্তুক কীভাবে রাজকন্যার সঙ্গে দেখা করতে পারে?

না সেটা সমীচীন হবে?

চাইলেই হতে পারে।

স্বয়ং রাজামশায় এ কথা জানতে পারলে আমার দন্ডাদেশ হতে পারে এমন স্পর্ধার জন্যে। আমি এমন কাজ করতে পারি না। তুমি তোমাদের রাজকন্যাকে বলো, এ তার খেয়ালী মনোভাব, হঠাৎ আবেগ। ছেলে মানুষী চপলতা। একে কিছুতেই প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত আমি নিতে পারি না।

আমাকে এখানে আরো বেশ কিছুদিন থাকতে হবে। তাই আমি চাই আমার কোনো কাজ যেন অন্যের চোখে অপরাধ বলে মনে না হয়।

মেঘমালা সেদিন ফিরে এলো ঠিকই কিন্তু রাজকন্যার সঙ্গে অন্য কথা বলল। বলল, সেই যুবকের সঙ্গে তার দেখা হল, অনেক কথা হল।

এটা সেটা বলতে গিয়ে বলেই ফেলল সে রাজকন্যার সখী।

তো যুবক বলল, তোমাদের রাজকন্যা কেমন দেখতে আমার খুব দেখতে ইচ্ছা করছে তাকে।

তাই বলেছে নাকি?

হ্যাঁ তো, নইলে আমি কি আর শুধু শুধু তোমায় বানিয়ে বলছি?

আসলে মেঘমালা বুঝতে পেরেছিল রাজকন্যার বর্তমান অবস্থা। যুবকের ছবিটা দেখা মাত্র তার ভিতরে অনুরাগ জন্মেছিল। সে যুবকের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ছে তাকে না দেখেই। মেঘমালা অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। রাজকন্যা যে কেন শিল্পীর সঙ্গে দেখা করতে চায় তার কারণ একটাই, যুবকের সম্মন্ধে খোঁজ খবর নেওয়া।

এর পর পরেই হঠাৎই মেঘমালাকে চলে যেতে হয়েছিল তার মাতুলালয়ে।

কারণ তার মাতুল ভগ্নির বিবাহ উপলক্ষ্যে পুরো পরিবার সেখানে যাচ্ছে। মাতুলালয়ে গিয়েই মেঘমালা জ্বরে পড়েছিল। এর ভিতরে অনেকদিন কেটে গেছে। রাজকন্যা তো ব্যাকুল সেই যুবকের জন্যে। আর সেই শিল্পী। কয়েক জনের কাছে খোঁজ নিয়েছে কিন্তু কেউই সেই শিল্পী খবর তাকে এনে দিতে পারেনি।

মেঘমালার কথার ভিতরে এমন কিছু ছিল যেটা যুবককে ভাবিয়ে তুলল।

যুবক এর পরে বিভিন্ন লোক মারফৎ রাজা জগৎদেব সম্মন্ধে নানা বিষয়ে খোঁজ নেওয়া শুরু করল। তবে খুবই সতর্ককতার সঙ্গে সে এই কাজ করতে লাগল। নতুন জায়গা, রাজ পরিবারের অন্দরমহল নিয়ে আলোচনা করাটা মোটের উপরে শুভ নয়। এক একজন এক এক ভাবে নিতে পারে। তার এই অহেতুক কৌতুহল রাজ পরিবারের পক্ষে মঙ্গলজনক নয় ভেবে তাকে সঠিক তথ্য নাও দিতে পারে। বাইরের শত্রু ভেবে তার কারাদন্ড হতে পারে। সোম তাই উপযুক্ত লোক খুঁজতে লাগল।

এইরকমই একটা দিনে তার দেখা হয়ে গেল এক জন খনি শ্রমিকের সঙ্গে। সে নানা জনের ছবি একে দেয় পয়সার বিনিময়ে। তো সেই খনি শ্রমিক যার নাম অপূর্ব সে সোমের কাছে এল তার একখানা ছবি এঁকে দেবার জন্যে।

সোম তার মুখ থেকে জানতে পারল রাজা জগৎদেবের কথা। রাজকন্যা চিত্রলেখার কথা। পরীর মতো স্বর্গের দেবীদের মতো দেখতে নাকি সে।

সোম অপূর্বকে সামনে বসিয়ে সেদিন ছবি আঁকতে লাগল।

ছবি আঁকা শেষ হলে সোম অপূর্বকে বলল, স্কেচ হয়েছে এবারে শেষ টান দিতে হবে। সেই অবসরে দুইজনে একটু গল্প করতে লাগল।

অপুর্ব বলল, তোমায় একদিন আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবো।

সোম বলল, সে তো খুবই ভালো কথা। তোমার মায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হবে। তোমার মাকে একবার চোখে দেখার ইচ্ছা রইল।

সে সম্ভাবনা শূন্য।

কেন?

কারণ তিনি আমার জন্মের তিন মাস বাদে মারা যান এক কঠিন অসুখে।

অপূর্বর শেষ কথাটা বলার সময়ে গলা কেঁপে উঠল।

সোম বুঝতে পেরে অপূর্বর কাঁধে সহানুভূতির হাত ছোঁয়াল। বলল, আমি দুঃখিত, না বুঝে তোমায় কষ্ট দিলাম।

না না তোমার আর দোষ কী বলো? সব দোষ আমার কপালের। জন্মের পর পরে যে শিশু তার মাকে হারায় সে যে কত দুখী সে কথা একমাত্র আমি আর আমার মতো যারা অভাগা তারাই বুঝতে পারে।

তোমাকে তখন কে প্রতিপালন করতেন? বাবা?

আমি মাতুলালয়ে বড়ো হয়েছিলাম। বাবা এরপরে বিবাগী হয়ে কোথায় যে চলে যান আজ পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ পাইনি।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। ভাই সোম, তুমি তো নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াও, কত মানুষের সঙ্গে তোমার আলাপ পরিচয় হয় যদি কখনো এমন মানুষের সন্ধান পাও আমায় জানিও।

তোমার বাবা কেমন আমি তো জানি না।

এই যে তোমায় দিয়ে ছবি আঁকলাম আমার বাবা যে বয়েসে নিরুদ্দেশ হয়েছে তখন এমনি দেখতে ছিলেন।

সে তো অনেক দিনের কথা।

হ্যাঁ, ঠিকই, এরপরে কেটে গেছে বাইশটা বছর। এখন কেমন দেখতে কে জানে।

সোম নিরুত্তর রইল। তারপরে আস্তে আস্তে বলল, হয়তো তোমার বাবা একদিন ঠিক ফিরে আসবেন। এরপরে সোমের সঙ্গে অপূর্বের গভীর সখ্যতা তৈরী হল। সোম অপূর্ব মারফৎ রাজ পরিবারের অনেক খবর নিতে লাগল। এমন অনেক কথা সে জানত যে কথা একান্তই গোপনীয় ছিল। অপূর্বকে জগৎদেবের পরিবারের সকলেই অত্যন্ত স্নেহ করত। সে মাতৃহারা অনাথ সেকথা জানতে পেরে রাজ মহিষী তাকে গভীর স্নেহ করতেন। ভালোবাসে দাস দাসীরাও।

সে গুণী এবং বিনয়ী ভদ্র স্বভাবের যুবক। রাজার অনুচরেরা তাকে বিশেষ খাতির করে, কারণ তাকে দিয়ে অনেক কাজ করে নিতেন তারা।

অপূর্ব একদিন মেঘমালাকে সোমদেবের কথা বলল। বলল, রাজার এমন একজন চিত্রকরের ভীষণ প্রয়োজন। সন্দেহজনক ব্যক্তির ছবি সে ছবি এঁকে দিতে পারবে যেমনটি বলবেন তারা। উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে এক নজর তাকিয়ে দেখে নিয়ে সে চটপট তার স্কেচ এঁকে দিতে পারে। এই ভাবে সে অন্তঃপুরে প্রবেশাধিকার পেতে পারে।

রাজকন্যার সখী মেঘমালার সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে সেটা জেনে সোমদেব আনন্দিত হল।

আনন্দিত হল যেদিন শুনল অপূর্বর বাগদত্তা হল মেঘমালা।

বন্ধুর বন্ধু সুতরাং সেও মেঘমালার বন্ধুত্ব দাবী করল। মেঘমালা মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে। আর প্রখর বুদ্ধিমতী। তাই সেও সোমদেবের বন্ধু হয়ে গেল অচিরেই।

সোমদেব মেঘমালা এবং অপূর্বর কাছ থেকে চিত্রলেখার সমস্ত খবরাখবর পেতে শুরু করল।

সেদিন ঝর্ণার ধারে দেখা করল মেঘমালা। একজন রক্ষীর পোশাক ধার করে পরে নিয়ে তবেই সে এসেছে।

সোমদেব প্রথমে তাকে চিনে উঠতে পারেনি। পরে তার গলার আওয়াজ শুনে সে বলল, পুরুষের বেশে তো তোমায় চমৎকার মানিয়েছে। বলো, কী সংবাদ নিয়ে এসেছ?

আপনি কী জানতে চান বলুন?

রাজকন্যার কী রূপ আচরণ লক্ষ্য করলে আমার ফটো দেখার পরে?কোনোরকম ভাবান্তর লক্ষ্য করেছ?

সখী তো আপনার চিত্র দর্শনের পরে আকুল পড়েছে আপনাকে সামনা সামনি দেখার জন্যে সে পাগল। আমিই তাকে কোনোমতে ঠেকিয়ে রেখেছি।

বলো কি? হঠাৎ আমার প্রতি তার এই অনুরাগের কারণ?

সেটা বলতে পারব না।

আমি জানি তার কাছে তুমি আমার সম্মন্ধে এমন কিছু কথা বলেছ যাতে তার অনুরক্তি ঘটেছ। ঠিক কিনা বলো?

আপনি শুধু সুদর্শনই নন অসাধারণ বুদ্ধিমান একজন মানুষ। মানুষের মন পড়তে পারেন।

সত্যি বলছ?

নয় তো কি? দেখুন না কেমন সুন্দর বলে দিলেন।

আমার তো তোমার সম্মন্ধেই এই ধারণা হয়েছে।

আমি? আমি আবার কী করলাম?

তুমিই তো এই সমস্ত কিছুর নিয়ন্তা। তুমি না থাকলে রাজকন্যার সঙ্গে আমার পরিচয় কে ঘটাতো?

কেন আপনার বন্ধুটি? সেই তো আপনাকে বলে অপূর্ব সুন্দর ছবি এঁকে রাজকন্যাকে আপনার প্রতি অনুরক্তি ঘটিয়েছে। চাক্ষুষ না দেখেই শুধুমাত্র ছবি দেখেই সে আপনার প্রেমে পড়ে গেছে।

বলছে এ তো সামান্য যুবক নয়, স্বয়ং মহাকালেশ্বর এসেছেন আমার পরীক্ষা নিতে।

তাই বলেছে বুঝি? আমি নিতান্ত একজন অতি সাধারণ মানুষ। তোমাদের রাজকন্যাকে কথাটা স্মরণ করিয়ে দিও।

হ্যাঁ। বলেছি। কিন্তু ও আপনার ফটো দেখে এমনি অনুমান করেছে সেটাই আপনাকে বললাম। বলেছে, তৃতীয় নয়ন কপালে এঁকে দিলেই তো ওমকারেশ্বর হয়ে যেত।

সখী মেঘমালার কথা শুনে সোমদেব হেসে উঠল।

হেসে উঠল নদীটাও। উদ্দাম ঢেউ ছুটে চলেছে।

ঠিক সেই মুহূর্ত্যে সুবর্ণরেখার একটা মস্ত বড়ো ঢেউ এসে পাড়ে ধাক্কা লেগে প্রতিহত হয়ে ফিরে গেল। বেশ কিছুটা জল উপচে উপরের দিকে ছলকে উঠে তাদের পায়ের কিছুটা অংশ ভিজিয়ে দিল।

সেই শব্দের সঙ্গে সোমদেবের হাসি মিশে গেল।

সূর্যদেব সেদিনের মতো সূবর্ণরেখার পশ্চিম পাড়ে অস্ত গেলেন নদীর বুক রাঙ্গিয়ে।

অপূর্ব এক মায়াবী সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো চারপাশে।

ত্রয়োদশ পর্ব

একুশ

প্রথম দেখাঃ

এর ভিতরে মেঘমালা একদিন জরুরী খবর পেয়ে মাতুলালয়ে গেল। মামাতো বোন কাজরীর বিয়ে। অতি শীঘ্র হওয়ায় সে রাজকন্যার কাছ থেকে জরুরি ছুটি নিয়ে চলে গিয়েছিল। খুব আনন্দেই বিবাহ সম্পন্ন হল। এর পরে ফেরার পালা।

সে সময়েই তার প্রবল জ্বর হল। এক টানা দেড় মাস সে শয্যাগত ছিল। কঠিন পীড়া তাকে বিছানা থেকে উঠতে দিল না। ভয়ানক দুর্বল। গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে গেছে। চেহারা ভেঙ্গে পড়েছে।

দীর্ঘদিন মেঘমালার অদর্শনে আকুল হয়েছে অপূর্ব। দাস দাসী মারফৎ সে সংবাদ নিয়েছে। শুনেছে সে মাতুলালয়ে গিয়েছে ভগ্নির বিবাহ উপলক্ষ্যে।

অপূর্বর মনে সুখ নেই। তার ব্যাকুল মন বলছে হয় সে কোনো অসুখে পড়েছে নয় তার বিবাহ হয়ে গেছে।

সে সময়ে ভগ্নি ভ্রাতার বিবাহ সময়ে তাদের কনিষ্ঠ ভগ্নিদের উপরে কারো নজর পড়িলে একই সঙ্গে বিবাহ হয়ে যেত।

অপূর্ব ভালোবাসার কাঙ্গাল। শিশুকাল থেকে সে মাতৃহারা। অন্যের কাছে প্রতিপালিত হওয়ায় যথার্থ্য ভালোবাসা সে পাইনি। মেঘমালার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে সে বুঝতে পেরে এই মেয়েই পারবে তাকে যাথাযথ ভালোবাসতে।

সে তার ভিতরে জননী এবং জায়ার ছবি দেখেছে। তার শিল্পী সত্তা বলেছে এই তার যোগ্য সহধর্মিনী হতে পারে।

প্রায় তিন মাস বাদে মেঘমালা সুস্থ হয়ে ফিরছে। পথে অনেক কষ্ট সহ্য করে সে পা রেখেছে নিজের গৃহে। প্রখর তাপ তীব্র দাবদাহে সে খুবই ক্লান্ত। তবু রাজকন্যার সঙ্গে সে দেখা করতে এসেছে। তার মনে আছে রাজকন্যার সঙ্গে সে সোম দেবের সাক্ষাৎ করিয়ে দেবে।

কিন্তু হঠাৎ তাকে যেতে হওয়ায় সে কাজটি সে করতে পারেনি। তার জন্যে সে অনেক বার রাজকন্যায় কাছে ক্ষমা চেয়েছে।

এই তিন মাস রাজকন্যার খাওয়া ঘুম ত্যাগ করেছে প্রায়। রাজ অন্তঃপুরে কারো মনে সুখ নেই রাজকন্যার এ হেন ভাবান্তরে। সে কারো কাছেই পরিষ্কার করে কিছুই খলে বলছে না। মাতা পিতা এমনকি অন্য সখীদের সঙ্গেও না।

সেদিন ভাদ্র পূর্ণিমা রাতে রাজকন্যা আর মেঘমালা বেরিয়ে পড়ল।

দুই জনের পরিধানে রক্ষীর বেশবাস। এক নজর দেখে কারো বোঝার উপায় নেই। মেঘমালা একটি অশ্ব জোগাড় করেছিল ইতিপূর্বে। পিছনে চিত্রলেখাকে বসিয়ে সে এগিয়ে চলে।

পথে একজন রক্ষী তাদের দেখে এগিয়ে কিছু বলতে এসেছল।

মেঘমালা অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে হাত নেড়ে জরুরি কাজ আছে এমন ভান করে তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সেক স্থান ত্যাগ করল।

রাজকন্যা ফিস ফিস করে বলল, সখী তুই কিন্তু সত্যি সত্যি দারুণ দায়িত্ব পালন করতে পারবি। আমি যদি কখনো সিংহাসনে বসার যোগ্যতা অর্জন করতে পারি তবে তোকে আমার মন্ত্রী বানাব। এমন বিচক্ষণ মানুষ তো আমার দরকার যে আমায় সঠিক পথ দেখাতে পারে।

দুই সখী বিভিন্ন রঙ্গ রসিকতা করতে করতে এক সময়ে ঘুর পথে সুবর্ণরেখার তীরে উপস্থিত হল।

ঘোড়াটিকে আগেই একটা জঙ্গলের ছাতিম গাছের তলে বেঁধে রেখে এসেছে। তার মুখ বাধা যাতে সে কোনোরকম শব্দ না করতে পারে।

সেদিন সোমদেব আগেই এসে উপস্থিত হয়েছল।

সে তাকিয়েছিল দূরের দিকে। জ্যোৎস্না প্লাবিত নদীটাকে দেখছিল।

চরাচর ভরে গেছে শাদা কাশফুলে। মনে হচ্ছে ধবল জ্যোৎস্না লুটিয়ে পড়েছে নদী চরে।

আকাশ পরিষ্কার। বেগবতী নদীটাকে আজ যেন অন্য রকম দেখাচ্ছে। নদীর বুকে জেগে ওঠা পাথরখন্ড গুলিকে অপূর্ব লাগছে। সুরধুনি উচ্চ সুর তুলে বয়ে চলেছে সুবর্ণরেখা।

এমন এক মায়াবী পরিবেশে দুইজন রক্ষী তার সামনে এসে দাঁড়াল।

তরবারী উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

সোম চমকে উঠল। তার হৃদস্পন্দন দ্রুততর হল। সে দুই পা এগিয়ে যেতে উদ্যত হয়ে আবার পিছিয়ে এলো।

তার এমত অবস্থা দেখে হঠাৎ একজন রক্ষী হেসে উঠল। খিল খিল হাসি চরাচর কম্পিত হল। নদীর জলে অভিঘাত লাগল সেই হাসির দমক এমনি।

সোম আগের চাইতে অধিক আশ্চর্যান্বিত হল।

ব্যাপারটা কী হল?

আজ তো রাজকন্যার এই জায়গায় আসার কথা ছিল। কিন্তু এ তো রাজকন্যার কন্ঠস্বর নয়। রাজকন্যা তো এমন ভাবে তার সঙ্গে রঙ্গ রসিকতা করতে পারেন না।

সোমদেব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।

আলো আঁধারী পরিবেশে সে দেখল সামনের রক্ষী তেমনি নিশ্চল ভাবে স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

স্বল্প আলোকে তার দিকে তাকাতেই সোমদেবের শরীর প্রকম্পিত হল।

কে এই রূপবান যুবক? জগৎদেবের কোনো পুত্র আছে কিনা সেটা তো জানত না সে। তবে কি,-

খুবই সামান্য সময়ে এতো সব ভাবান্তর ঘটে গেল সোমের ভিতরে।

সোম এবারে সমস্ত রকম সংকোচ ত্যাগ করে রক্ষীর দিকে নির্ভয়ে এগিয়ে গেল এবং জানতে চাইল কে তিনি? কী তার উদ্দেশ্য?

আবার সেই হাসি।

সুবর্ণরেখার উপর দিয়ে বয়ে গেল সেই হাসি শব্দ। বাতাস মথিত হল। সোমদেবের বিস্ময় আরো গাঢ় হল।

এবারে রক্ষী মাথার উপর থেকে পাগড়ি খুলে ফেলল।

এক ঢাল কালো কেশরাজী ঢেউ এর মতো ভেঙ্গে পড়ল পিঠের উপরে।

সে দিকে তাকাতেই সোমদেব মোহিত হয়ে গেল। সাক্ষাৎ জগৎ জননীর রূপে আজ চিত্রলেখা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

দুই জনে কেউই কোনো কথা বলতে পারল না।

এমন সময়ে কাউকে কিছু না বলে মেঘমালা সে স্থান থেকে দ্রুত প্রস্থান করল।

একান্তে তাদের কথা বলার সুযোগ করে দিল।

সে কিছুটা দূর থেকে তাদের উপরে লক্ষ্য রাখল। অনেক দায়িত্ব তার। নিশ্চিন্তে রাজকন্যাকে রাজ প্রাসাদে নিয়ে যেতে হবে। সে দূরে থেকে আশেপাশের পরিবেশ দেখতে লাগল। অন্ধকারের ভিতরে ঝর্ণার জলের শব্দ হচ্ছে। যেন কোনো সঙ্গীত ভেসে আসছে বাতাসে। এমনি মধুরস এই সুললিত ধ্বনি।

থেকে থেকে বেশ জোরে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। খুব দূরে কাদের যেন গলা শোনা যাচ্ছে।একদল মানুষের মিলিত কন্ঠধ্বনি। হতে পারে নদীর ওপারে যে শ্মশান আছে সেখানে কেউ দাহ কার্য করার জন্যে এসেছে।

মেঘমালা সোম এবং রাজকন্যা চিত্রলেখাকে লক্ষ্য করতে লাগল আশেপাশে কেউ যেন না আসে সেদিকে তার কড়া নজর।

দুইজনের বেশ কিছুটা সময় কথাবার্তা হল।

মেঘমালা সেই স্বল্প আলোতে লক্ষ্য করল দুইজন মাথা নেড়ে পরস্পরের কথাতে সম্মতি জানাচ্ছে।

বেশ কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। চিত্রলেখা মাথা নিচু করে আছে। এটাকে সুলক্ষণ বলে সে ধরে নিল। কেমন যেন আত্মনিবেদনের ভঙ্গী।

ভালোবাসার বহির্প্রকাশ তো এমনি হয়।

আস্তে আস্তে দুটি নারী পুরুষের মধ্যেকার দূরত্ব কমে আসতে লাগল।

স্বল্পালোকে মনে হলো ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে কথায় বুদ হয়ে আছে দুইজনে।

এদিকে রাত বাড়ছে। মেঘমালার দায়িত্ব সঠিক ভাবে রাজকন্যাকে নিয়ে যাওয়া।

পূর্ণীমার চাঁড একটু একটু করে গাছ পালার অর্গল ভেদ করে ক্রমশঃ উপরের দিকে উঠে আসছে। এখন চারিদিক ধবল জ্যোৎস্নায় প্লাবিত।

অনেক দূরের জিনিস স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

আর বুঝি এখানে থাকা ঠিক হবে না। রাজ অনুচরেরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। যদি তাদের নজরে পড়ে যায়।

সব দোষ এসে পড়বে মেঘমালার উপরে।

অতএব সে গলা খাকারি দিতে দিতে এগিয়ে এল।

এ এমন এক মুহূর্ত যেন দুজনের কেউই কাউকে ছাড়তে চাইছে না।

মেঘমালা বুঝতে পেরে বলল, আর একদিন সে আসবে রাজকন্যাকে নিয়ে।

এ কদিন একটু সামলে চলতে হবে। বাতাসের কান আছে, চোখ আছে।

কথাটা যেন সোমদেবকেই বলল।

সোমদেব আর চিত্রলেখা তখনো দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের থেকে চোখ সরাতে পারছে না। মেঘমালা মনে মনে বলল, চোখের আঠায় আটকে গেছ তাহলে হৃদয়ের কি পরিস্থিতি বুঝতে পারছি।

আবার সেই ছদ্মবেশ ধারণ। আবার সেই ঘোড়াও পিঠে চেপে রক্ষীর বেশে গমন।

সোমদেব অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ভাবছে এত দিন কেন সে রাজকন্যার সঙ্গে আলাপিত হয় নি।

বুঝতে পারছে আর এক মুহূর্ত তাকে ছেড়ে সে থাকতে পারবে না।

ওরা দুজনে দৃষ্টিপথের বাইরে চলে গেলে সেও নদী তীর ত্যাগ করল।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes