
সুদীপ বসু-র গল্প -‘ টুটুল ও উল্টোদিকের অন্ধকার’
লিলি বলল, ‘এখন কী হবে ?’
আমি বললাম, ‘যা হবার।’
‘কী হবার ?’
‘একটাই তো রাস্তা ।’
‘কী রাস্তা ?’
আমি কোন উত্তর দিলাম না। লিলি অনেকক্ষণ জানলার বাইরে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। সেখানে আজ একটিমাত্র নীল তারা ফুটে আছে।
লিলির চোখমুখ থমথম করছে।
তারপর ফিসফিস করে বলল ‘তবে তাই হোক।’
ডিভোর্সের সময় গোল বাধল আমাদের সাড়ে পাঁচ বছরের ছেলে টুটুলকে নিয়ে। ও কার কাছে থাকবে ?
লিলি বলল, ‘ওকেই ডিসিশন নিতে দাও।’
আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। ঠিক হল ঠিক তিনবার প্রশ্ন করা হবে টুটুলকে। তারপর ওই সংখ্যাগরিষ্ঠতার যা হিসেব ….
প্রথমবার প্রশ্ন করা হল ঘুমের মধ্যে। আধো আধো জড়ানো গলায় টুটুল যা বলল, কিছুই বোঝা গেল না।
দ্বিতীয়বার রাগের মধ্যে। চোখ গোল গোল করে, ঠোঁট ফুলিয়ে, দুহাত শূন্যে বনবন করে ঘোরাতে ঘোরাতে টুটুল চিৎকার করে উঠল ‘বাপি তুমি চলে যাও। যাও এক্ষুণি।’
তৃতীয়বার কান্নার মধ্যে। লাল দুটো চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে, উসকো খুসকো চুল, টুটুল আমার বুকে মুখ চেপে ধরে জানিয়ে দিল সে আমাকে ছেড়ে কোত্থাও যাবে না। না, কখনো নয়।
নিমেষে সব হিসেব গোলমাল হয়ে গেল। গভির ধোঁয়াশার ভেতর পড়ে গেলাম আমরা।
রাতের পর রাত জেগে আলোচনা চলল। শলাপরামর্শ চলল। শেষে ঠিক হল টুটুলকে আমরা মাঝখান বরাবর আধাআধি ভাগ করে নেব।
অর্দ্ধেক টুটুল থাকবে আমার কাছে, বাকি অর্দ্ধেক লিলির।
তাই হল।
তারপর দিনের ওপর দিয়ে দিন চলে গেল। কত মাস-বছর-রোদ-নক্ষত্র-বজ্রপাত কেটে গেল। গাঢ় জোছনা এসে কতবার মিথ্যে করে দিয়ে গেল অন্ধকার।
দুবাড়িতে দুজনের আদরে-আহ্লাদে বড় হতে লাগল দুই অর্ধেক টুটুল।
তারপর প্রায় পনেরো-ষোলো বছর কেটে গেল।
বিচ্ছিন্নতা কি অবসাদ আনে ?
কে জানে !
অপরাধবোধ ?
কে জানে !
নিরাশা ? ক্লান্তি ?
জানি না তো !
অনেক বছর পর আমরা একে অপরের কাছে ভয়ঙ্করভাবে ফিরে আসতে চাইলাম আবার। কাছাকাছি আসতে চাইলাম।
কত বছরের হারানো সময়কে আবার ফেরত পেতে চাইলাম আমি ও লিলি।
‘সব ফাঁকফোঁকর, আঁচড়কামড়, ছায়া-অন্ধকার কি মেরামত হয়ে যায়নি অ্যাদ্দিনে ? কি গো ?’ লিলি জিজ্ঞেস করল।
আমি কিছু বললাম না।
লিলি পীড়াপীড়ি করতে লাগল, ‘কিগো চুপ করে থেকো না। কিছু বলো।’
আমি চুপ করে থাকলাম।
লিলি বলল, ‘চুপ করে থাকলে ভয় করে। সেই পুরনো ভয়।’
আবার গোল বাধল টুটুলকে নিয়ে। ঘরের দরজা-জানলা খুব শক্ত করে এঁটে খুব গোপনে আমরা দুজন দুই অর্ধেক টুটুলকে জুড়তে শুরু করলাম।
টুটুল চিৎকার করে উঠল, ‘বাপি, খুব লাগে !’
‘কোথায় ?’
‘বাঁহাতে, না না আরেকটু ওপরে। আরো ওপরে।’
আমরা বাঁ হাতটা এড়িয়ে গেলাম।
টুটুল চিৎকার করে উঠল, ‘জ্বলে যায় জ্বলে যায় …’
‘কোথায় ?’
‘পাঁজরে।’
পাঁজর পাঁজরের মতো রইল।
টুটুল চিৎকার করে উঠল
‘উফ্ ব্যথা খুউউব ব্যথা। ছাড়ো, ছেড়ে দাও।’
‘কোথায় ?’
‘ডানদিকে। পিঠের। মেরুদন্ডের ….’
আমরা মেরুদন্ডে আর হাত ছোঁয়ালাম না।
দুই অর্ধেক টুটুল শেষমেষ জুড়ল বটে কিন্তু খাপে খাপে মেলানো গেল না। কোথাও ছোটবড় কোথাও উতল-অবতল কোথাও আঁটো-আলগা হয়েই রইল।
সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে ধরে নিয়ে খুব ভোরের দিকে লিলি ঘুমিয়ে পড়ল।
আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
টুটুল জেগে রইল।
তারপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে।
এখন আর টুটুল প্রাণ খুলে হাসে না। এখন আর ওর কোনও বন্ধু নেই। সেজন্য আফশোসও নেই কোনো।
টুটুল শুধু বাঁ-পাটা একটু টেনে টেনে হাঁটে। বাঁ চোখটায় একটু ঝাপসা দেখে ইদানীং। মাঝেমধ্যে রাতের দিকে বুকে হালকা ব্যথা ওঠে। ঠোঁট দুটো অসম্ভব কালো হয়ে যাচ্ছে।
সেদিন সন্ধের মুখে বাড়ি ফিরছি, হঠাৎ দেখি আমাদের সরু গলির মুখটাতে একটা বাতিল লোহার বেঞ্চে টুটুল বসে আছে। একা। উল্টোদিকের অন্ধকারের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একঝলক. বললাম ‘কি টুটুলবাবু বাড়ি ফিরবে না?’
চকিতে আমার দিকে তাকাল। তাকিয়েই রইল। রক্তশূন্য, ফাঁকা। তারপর ধীরে ধীরে ওর গলার ভেতর থেকে একটা অদ্ভূত আওয়াজ বেরোতে লাগল। চোখের দৃষ্টিতে যেন একটা নতুন ছায়া এসে পড়েছে। আমি দ্রুত হাঁটতে শুরু করলাম।
আমার ভয় করল।
বোধহয়, বোধহয় আমায় চিনতে পারছে টুটুল।