
সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়-এর দশটি কবিতা
একটা পৃথিবী হঠাৎ মা হারা হয়ে গেল
একটা পৃথিবী হঠাৎ মা হারা হয়ে গেল
ভাত ফুটল। খেতে বসলাম….অথচ
তুমি নেই!
ঘামের গন্ধ থেকে জন্ম নিল না আমার তৃপ্তি!
কতবার তোমাকে আলতো খোঁপায়
একমনে বই পড়ছ , সোফার একপাশে একা,
আলগা মুড়ির বাটি
আলগোছে গিলে নিচ্ছো ক্লান্তির প্রতিটা দিন।
বোঝেনি রাত কতটা আঁধার ছিল
একগাল হাসিতে,
ভেবেছি আলোয় ভরে উঠছে ঘর।
শীতের উঠোনে ক্যাকটাসের কাঁটা
যন্ত্রণা দিত তোমায়, মনে মনে।
অথচ কি জাদুস্পর্শে তুমি শুধু মা হয়ে উঠেছিলে সবার।
একটা পৃথিবী হঠাৎ একা হয়ে গেল
কতদিন না দেখা…
শুনেছি ক্ষয়প্রাপ্ত শরীর আগুনে পোড়ার আগে
কষ্ট পেয়েছে বড়ো,
ছুঁয়েও দেখিনি সে যন্ত্রণা।
আজ মনে হয়, মা রা হয়ত এমনই,
না বলে চলে যায়, চুপিচুপি…
যাতে আমাদের ঘুম না ভাঙে!
জীবন
গুছিয়ে রাখার মতো একটা জীবন চেয়েছি শুধু,
আলো এসে রোজ মেঝের এককোণে পড়ে।
অচেতন শরীর হাইতোলা ঘুমে জড়িয়ে নেয়
কাচা শাড়ি। এত পরিপাটী সহ্য হয় না আমার!
নির্জন ভাঙে পাখিদের ডাকি।
কখন ফ্ল্যাটের তিনপা বারান্দা লম্বা উঠোন হয়ে যায়, বলতে পারিনা গুছিয়ে।
ঘুলঘুলিগুলো ক্রমশ ছোট হতে হতে বন্ধ হয়ে যায় একদিন। অন্ধকার জমে।
ঠান্ডা হাওয়া জমিয়ে দেয় হাত পা,
চামড়ায় খড়ি ফোটে।
একটা জীবন, ওল্টানো পাতার দুটো পিঠ…
যা চায়, তা সাদা,
যা হয় তাতে অদৃষ্টের নীলছাপ।
আমরা পেরিয়ে যাই, একের পর এক পাহাড়, জঙ্গল আর মানুষ নামের এক বিশাল সমুদ্র!
এমনিই কথা ছিল
চাদরের নীচে জমে উঠছে শীত,
স্বপ্নগুলো হলং থেকে দীঘা
ফায়ারপ্লেসের পাশে
সেঁকে নিচ্ছে তন্দুরি চিকেন।
দেখা হবে, এমনিই কথা ছিল।
কথা ছিল প্রতিটা ঋতু শীতকাল হবে।
সূর্যোদয়ে সোনার হলং ছেড়ে উড়ে যাবে
কফির গরম ধোঁয়া।
দেখা হবে
হয়ত এবার…
শূন্যতায় নিথর হয়ে আসে শীত।
তোমার নিঃশ্বাসটুকু উষ্ণতা ছড়ায় বন্ধ চোখে।
জেগে ওঠে রোম।
চাদরে জড়িয়ে রাখি। দূরে সমুদ্রের ডাক…
আর বুকের ভেতর একটা সাদা গাড়ি
ছুটে চলে হলং থেকে দীঘা…
বাহিন রাজবাড়ির পথে
দুধারে তরুণ ধানগাছ,
ভেসে যাচ্ছে আলো।
এক মানুষ ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে একা
সবুজ ঢেউয়ে ভেজা কালো শরীর,
দেখছি দূর থেকে, কিভাবে মিলিয়ে যাচ্ছি
ক্রমশ হাওয়ার ভেতর।
মাথার ওপর দুরন্ত আকাশ
রাঙা আলোয় ভেজা মুখ
কত দিন কত বছর পর যেন
ঠান্ডা হাওয়া এসে মুছে দিচ্ছে বিন্দু বিন্দু ঘাম!
এই যে কাঁধ ছুঁয়ে ঢলে পড়া
কিংবা উড়ন্ত চুলের ফাঁকে আড়চোখে দেখা
চামড়ার মেটে রঙ…
এভাবে হঠাৎ না এলে কখনো কি জানা হত
এখনো এত কাশ ভরে আছে মৃত্যু শহরে?
সাদা পাজামার থুরথুরে বুড়ো,
কিংবা যারা বলে দিয়েছে পথ…
ফেলে আসা খাল বিল
দুপাশে দরগা আর মন্দির…
দাঁড়িয়ে আছি সামনে
ছাতিম গন্ধ মাখা সূর্যাস্ত রঙের এক বিধ্বস্ত রাজবাড়ি।
ভেসে আসা বিস্মৃত ঝাড়বাতির আওয়াজ
নাড়িয়ে দিচ্ছে শ্যাওলার দেওয়াল।
ঘন্টা বাজছে পিছনের ঠাকুর দালানে হয়ত
নাগরের জল, চলেছে আনমনে…
অন্ধকারে পশ্চিমের বাঁশবন ।
পাখিরা তখন খুঁজে নিচ্ছে নিবিড় আশ্রয়,
ঠিক যেমন আমিও তাকিয়ে আছি
তোমার চোখের দিকে, অপলক!
আমি তাকে শীত বলে ডাকি
ঘুম ভাঙলে চুমু এঁকে দেয় ঠোঁট
কপাল ছুঁয়ে কত শরতের মেঘ
প্রতিবার শীত এলে এমনই কুয়াশা ঢেকে যায়
বাড়তে থাকে এক দুরন্ত কাঙাল!
চারদিকে অশ্বত্থের জড় বন, বোঝেনা
সবুজ ঘাসের ভেতরেও লুকিয়ে থাকে হীরের শিশির।
কতবার চেয়েছি সব তছনছ করে বলি,
এ পৃথিবী আমার নয়।
সন্ধ্যাপ্রদীপ হাতে আজো একা দাঁড়িয়ে ধূলোপথে
দূর থেকে বাঁশির লাল সুর,
ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে কাছে,
আমি তাকে শীত নামে ডাকি।
তুমি এমনই জড়িয়ে থাকো ভোরের রোদ
ঘুমের ভেতর লেপ্টে দাও চাদর
অথচ যে পথ আমাকে এগিয়ে নিয়ে যায় শীতের রুক্ষ্মতায়
সেখানে শুধু উত্তরের বাতাস
কাঙাল, ভালোবাসা ভুলে যায়।
ইচ্ছে হয় চিৎকার করি নিষিদ্ধ অন্ধকারে
এ পৃথিবী আমার নয়
যেখানে তুমি নেই সেখানে কোনদিন সকাল হয় না যে!
কবিতা আসলে মেঘ বৃষ্টি জল
বন্ধ দরজার ভেতর তৈরী হচ্ছে ঘর
তবুও বোঝনা। ভাবো, এসব কবিতা।
আত্মহত্যার পর আবার কালো মেঘ
পশ্চিমের জানলা দিয়ে নির্জন দুপুর
পুরোনো বইগুলো নড়েচড়ে বসে।
ওদের গায়ে হারানো শহরের দাগ
ঘুলঘুলি ছুট ধূসর পায়রারা…
পালাতে চাইছে যেন মৃত্যু থেকে।
চেপে ধরেছি ভিজে বালি।
কেটে যাচ্ছে শরীর।
একটা বিচ্ছেদ যেন শিরদাঁড়া নিয়ে
ছুট দিচ্ছে গোটা জন্মটুকু অস্বীকার করে…
বোঝাতে পারিনি। ভেবেছিলে নিছক কবিতা।
অক্ষর সাজে মেঘ, বৃষ্টি, জলে…
ঘরের ভেতর মানুষ কিংবা ঘর, পোড়ে।
ভাবো, এই তো আলো জ্বলছে
বইয়ের ছায়ায় হলুদ ল্যাম্পশেড।
আসলে তখন ঘুম থেকে বহুদূরে, এক মায়াবী কুয়াশায়
জড়িয়ে আছে শীতের শহর।
আচমকা একসাথে হলে
বারবার তাকে দেখে শেখা।
ভেতরে আঁধার কাঁদে, সামনে দাঁড়িয়ে থাকো একা,
পারিনা তো ছুঁতে তবু…. কেন এত বাঁধভাঙা শোক?
সময় থমকে যাক। আলো এসে মুখোমুখি হোক।
ক্রমশ লুকানো জল, ভাসিয়ে দিয়েছে চরাচর
শোক বুঝি সাদা হয়? যন্ত্রণা পুড়িয়ে দেয় ঘর?
কিকরে থাকছ চুপ? এত স্থির যেন এক গাছ?
পোড়ে না আগুনে বুক? বেঁধেনা কি পায়ে ভাঙা কাঁচ?
যতটা সহজ ভাবি, অভিনয়, পাথরের চাঁই
তোমাকে সামনে রেখে দাঁড়াবার বলটুকু পাই।
শরীরে বাড়ছে বিষ, রাত নামে জানলার কোলে
কি হত বলতো চাঁদ, আচমকা একসাথে হলে?
কুয়াশা
আমাকে ভোলায় রাত
একতারা বেজে ওঠে, তাকিয়ে দেখেছ বুঝি জল?
অবসাদে ভোগে তারা চুপিসারে কাঁদে চলাচল।
তুমি তো দূরের মেঘ। ভেসে আছো জলমগ্নতায়
নেশা যেন ঘিরে আছে, কুয়াশা মোড়ানো শূন্যতায়।
ছাপোষা দুপুর দিন
পার হয় রামধনু। তুলে রাখি সিঁদুরের লাল
গোপনে গোপনে সে ও চৌকাঠে দুটোপা রাখে কাল।
সে ও এক সেতু যেন, ফেরা আর না ফেরার মাঝে
তবুও কেন যে তার, আনমনা বাঁশি সেই বাজে?
ঘোরের ভেতর যেন, পিক তার পেখম ছড়ায়
একবারো না তাকিয়ে কুয়াশায় কে মিলিয়ে যায়?
কুয়াশা২
প্রতি পল যেন এক, বর্ষায় গেঁথে রাখা হরিণ
কিভাবে কাটছে জানো শূন্যতায় ঘেরা এই দিন?
বোঝো কি চোখের ভাষা? চুপ থাকা সেসব উত্তর?
তুমিও নীরব তাই, ভাঙনের পর যেন ঝড়…
বলেছিলে তাই আমি আজো ঢেউ গুনে গুনে রাখি
আগুনে পোড়ার পর কলসের ছাই হয়ে থাকি।
একবার দেখা দাও বনের ভেতরে ফোটা ফুল
কতটা এগিয়ে পথ? ছেড়ে আসা সেইসব ভুল?
আজো কে দাঁড়িয়ে ওই, কুয়াশার পথটুকু খোঁজে?
সেও কি আমার মতো কুয়াশাকে লিখে রাখা বোঝে?
মিলিয়ে যাই কুয়াশার ভেতর
কিভাবে ফুল ছেড়ে থাকে, হাওয়া?
ঈষৎ হলুদ পাতার ভেতর ছটফট করে শিরা
দেখা হয়নি কতদিন
জমে আছে কথার পাহাড়।
একটা ট্রেন ছুটে যায়
রেললাইন কেঁপে ওঠে
বুকের ভেতর নড়ে যায় মাটি!
শুনতে পাও অদৃশ্য নিঃশ্বাস?
তারাদের সাথে সংসার পাতি।
ঝগড়া আর কাটাকুটি খেলা
সন্ধের ছাদ বড়ো প্রিয়।
এখানে আমরা শুধু হাওয়ামুখ
বিষাদের ঝঞ্ঝাট নেই
অন্ধকারের ভেতর ধূসর আলপথ
ছুটতে ছুটতে…বুকের ওপর নিঃশ্বাস ফেলি
থুতনি চেপে ধরে চুম্বক
ঠোঁটের দুটো তিল চকচক করে ওঠে,
আমরা মিলিয়ে যাই কুয়াশার ভেতর!