শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী-র গুচ্ছ কবিতা
আয়নার প্রতি আয়নার মতো
১
আমাকে দেখতে দেখতে তুমি, তোমাকে দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। মাঝে মাঝে তোমার জামা বদলে দিতে যাই, আমারও বদলে যায়।
চোখে কাজল আঁকতে আঁকতে দেখি তুমি সেজে উঠছো। তুমি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলে, বুঝি আমারও হেসে ফেলা হল। আমি কেঁদে ফেলি যদি, চেষ্টা করি তোমাকে থামাবার, কিন্তু পেরে উঠি না।
আসলে আমি তোমার দিকে আর তুমি আমার দিকে তাকিয়েছি বলেই দুজনেই ব্যর্থ হয়ে আছি।
২
আমার সামান্যাতীত সংসারে আসবাব কম। তা সত্বেও এই যে তুমি দেওয়ালের ক্রীড়াক্ষেত্র কিছুমাত্র দখল করেছ সেও খুব বঙ্কিম বিষয়। তোমাকে কি আসবাব বলব? তোমাকে আসবাব বললে নিজেকেও অতিরিক্ত মনে হয়।
৩
মাঝেমাঝে খুঁটিয়ে দেখি নিজেকে, তোমার ভিতর। গভীর চোখের নিচে দেখা যায় সামান্য মেধার কারুকাজ ধীরে ধীরে বয়স পেয়েছে। একটু একটু করে ঘন হয়ে ছায়া হয়ে আছে বকুল-শিরীষ মেয়েবেলা। অপাঙ্গে লাস্যের কণা ক্রমে ক্রমে ম্লান হয়ে এলে, প্রবাসের অবান্তর গেহ দেখা যায় কখনও কখনও।
৪
ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে হয় কখনও কখনও। অসত্য প্রেমের মতো, পুরোনো ভ্রমের মতো, মিথের ঈশ্বরের মতো, সমস্ত বিভেদ-স্বর ভেঙে ফেলতে ইচ্ছা হয় আমার। আকাঙ্খার সহজতা ফলাফলে আসেনা কখনও। অথচ সহজে কত বিকেলের রোদ ভেঙে যায় গ্রিলের আঘাতে। তোমাকে ভাঙলে বুঝি নিজেকেও ভেঙে ফেলা হবে?
৫
বেলা ঝরে পড়তে পড়তে আলোর গাছ ফাঁকা হয়ে আসছে। তলানির শীতটুকু চাছিমুছি করে খেতে খেতে পোয়াতি কুকুরের কাঁপন ধরতে থাকে ভিতরের ঘুমে। অবেলায় স্নান-পরবর্তী, সারা দেহে ফোঁটা ফোঁটা জলের বিরহটুকু নিয়ে তোমার সামনে এসে দাঁড়াতে সংকোচ হয় না। কারণ তুমি তো জানো এইসব বিরহবাষ্প জমে জমে মেঘ হওয়া হবেনা কখনো।
৬
কখনও বিরাগহেতু দাঁড়িয়েছি তোমার সামনে মুখে মেলে খবর কাগজ। কিছুটা আড়াল আর কিছুটা ব্যতিক্রম চেয়ে। সছিদ্র পাতা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ওপারে তোমায়।
প্রথম পাতার থেকে পরম যত্নে যেন তুলে নিয়ে পোড়া মৃতদেহ ঠায় চেয়ে আছ। কাঠকয়লার মতো পোড়া মেয়েটির থেকে নিজেকে আলাদা করে দেখতে পাচ্ছিনা। ব্যতিক্রমী হতে গিয়ে আমিও খবর হয়ে গেছি।
৭
আসন্নপ্রসবার মতো মেধাহীন যন্ত্রণার ঢেলা ছুঁড়ে মেরেছি। চিড় ধরে গেছে। তবুও তোমাকে পুরো ভেঙে ফেলা যায়নি এখনও। মন নেই, গোপন নেই, কী এক আশ্চর্য মৌজে অকস্মাৎ চুমুর মতো নিয়ে ফেলো বর্তিষ্ণু দেহে তোমার । নিজেকে তোমার থেকে কিছুতেই তাড়াতে পারিনা।
আমার পড়ন্ত রোদ তোমার উপরে পড়ে, তাতেও ফাটল দেখা যায়।
৮
আবহাওয়া পাল্টে গেলে, সমস্ত হাওয়া আমার দিকে ঘুরে যাবে একদিন। আমায় দেখতে দেখতে তুমি, ডানা মেলে দেবে – উড়ুক্কু মাছেদের মতো একবার ডানা আর একবার পাখনা নাড়তে নাড়তে আমাদের পৃথিবী বদলে যাবে। পূর্বপুরুষের ভিটে দেখবার জন্য, বন্ধুকে বুকে টানবার জন্য তখন আর ভিসা লাগবে না। পশুদের মতন করে ভালোবাসা সহজ হয়ে যাবে। সঙ্গমের জন্য কোনো আড়ালও খুঁজতে লাগবেনা। বিপন্ন ইতিহাস আর সহজ যৌনতা ছাড়া পরস্পরকে দেওয়ার মতো আর তো তেমন কিছু নেই।