শুভদীপ নায়কের কবিতাগুচ্ছ
স্মরণ, তোমাকে
( উৎসর্গ: কবি উৎপলকুমার বসু )
১
পেলাম না পণ্যের স্বীকৃতি, ভার পড়ে রইল দূরে, চোখের মণিতে ।
সারাদেহ ভরে গেল কালির হরফে, বৈচিত্রে । কোথায় রয়েছ তুমি !
পালক ফুটেছে তোমার কবিতার শরীরে, একদিন মনের ভিতরে
জমে ছিল ভয়, ছাই থেকে পুনরায় আগুন খোঁজার ঝুঁকি, সেসব
পাখির ঠোঁটের মতো বয়ে বয়ে বেড়িয়েছি এতকাল, দারুব্রহ্ম, মীন,
প্রেমঘটিত যুদ্ধ এবং নিত্য পুজোর প্রাক্কালে হয়েছিল তৃষ্ণা নিবারণ ।
একটি রঙিন সুতোর জট থেকে খুলে পড়ে ছায়া, উৎসবের দিনে
অহেতুক আঁধারে ভরে আছে শহরের যেসব গলি, জীবিত থাকলে
সেখানে দাঁড়িয়েই তোমাকে বলা যেত : সমস্ত সদর বন্ধ, নিজ নিজ
ইতিহাস লেখার ছলে প্রতিটি মানুষ বসন্ত হয়ে বাঁচে দূরের টিলায় ।
২
মনে নেই, ভুলভ্রান্তি আর কিছু ছিল কিনা পুরনো বাড়ির চৌকাঠে ।
যদি থাকে, নিয়ে যেও । ভুল থেকে কত ধারণা গড়ে ওঠে, সংস্কার
পাল্টে যায়, ভ্রান্তির ছাপ নিয়ে বেরিয়ে আসি সম্পর্ক থেকে, কিছুতেই
কাটে না পুরনো সংস্কার, ভয় । এইভাবে শতছিন্ন মানুষও একদিন
অন্যের সংস্পর্শে আসে, সশব্দে, আশঙ্কায় । ভাঙা পড়ে বাড়ি,
ঘর ছোট হয়ে আসে, আক্ষেপ বাড়তে থাকে, বয়স পেরিয়ে যায় দূরে ।
সর্বত্রই ভাঙা পড়লে বোঝা যায় এতদিন সবটা দাঁড়িয়েছিল শূন্য এক
জমির ওপরে, আসন্ন বিপদে, হয়তো পাহাড়ের ঢালে, মরা মৃত্তিকায়,
কিংবা ডুবন্ত চোরাবালি ঘিরে । যে পায়ে চিরকাল বেড় থাকার কথা,
সেই পায়ে লেগে আছে কাদা, সেই পায়ে নোনাবালি, ঢেউ, উচ্চারণ ।
এখন শুধুই প্রতীক্ষা, বিশেষণ আর সর্বনামে, যে বাতাসে উড়ে গেছে
গা থেকে খসে পড়া সামান্য পালক, সেই বাতাস জানতে চাইছে
অতীতের সম্বন্ধগুলোর চেয়ে তুমি কতটা পৃথক ? কতটা গোপন ?
৩
আয়নার স্বভাব ছিল তোমাকে উন্মোচিতা হতে দেখা, কখনো আঁধার রাতে
আয়নার শরীরে ফুটে উঠতে তুমি, সে শুধু বিবর্ণ মুখের ছবি দেখত । যে মুখে সহস্র
শীতকাল খসে গেছে, তুমি সন্ধান পাওনি, তুমি বিপন্ন হয়ে বেড়িয়েছ পাহাড়ে,
ঘাস-জঙ্গলের মাঝে দাঁড়িয়ে দেখেছ চারপাশে শৈলশিরার বিস্তৃত রজনী ।
মনে আছে, এই আয়নার সামনেই ব্লাউজের হুক বেঁধে দিয়ে বলেছিলাম, আজ
বহুদিন পর তোমাকে ঘিরে নেমেছে সৌজন্যের মেঘ, আঁকা হয়েছে বাড়তি দূরত্ব,
যে লেখায় তুমি নিখোঁজ বহুকাল, সে লেখায় ফিরেছ আজ স্বভাবদোষে, কটুযত্নে ।
এখন আর ব্লাউজের হাতায় নেই সুতো দিয়ে বোনা ফুলের কাজ, পরিবর্তে
সরু লেস, অঙ্গের সমাহার । আঙুলের প্রান্তে এখন অসহায় নখ, ঠোঁটও হারিয়েছে
চিকণ চুমুর স্বাদ, আয়নার স্বভাব ছিল তোমাকে কালো টিপ আর সিঁদুরে দেখা ।
৪
এই জন্মের যেটুকু আছে তার সবটা রেখে গেলাম, প্রয়োজন মতো খরচ করে ফেলো ।
যূথবদ্ধ মথের পাখনা, সাহসে কুড়ানো ফুল, ভাঙা তৈজসপত্র, হিসেব লেখার ঐ বাতিল
খাতাটা, জংধরা তালা, পরিত্যক্ত জুতোর চামড়া, সবেতেই পাবে আমাকে । এককথায়
আমি ছিলাম ব্যবহারকারীর ভূমিকায়, তাই ছাপ রেখেছি স্মৃতিতে, আমাকে ঠকাতে গিয়ে
করুণা এসেছে মনে, আমাকে ভুলতে অবজ্ঞার সাহায্য নিতে হয়েছে । তবুও একদিন হঠাৎ
মনে হয়েছে, নতুন করে কিছু পাওয়ার ছিল পুরনো অভ্যাসগুলোর থেকে । তাই, বৃষ্টিতে
সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে এলোচুলে ভিজে ছাতা হাতে ধরে এসেছ এখানে, বহুদিন পর জঙ্গলে ঘেরা
এই সমাধিক্ষেত্রে । তোমারও প্রশ্ন ছিল, কেন মানুষ স্মৃতির সঙ্গে সম্পর্কে যেতে রাজি নয় ?
কীভাবে আগেকার দূরত্ব মুছে দিয়ে নতুন করে ফিরে আসা যায় ? আমিও বই পড়তে পড়তে
ভেবেছি পৃষ্ঠা-শেষের জীবন কীভাবে ডুবতে পারে অদ্বিতীয় কোমল আভায় ! এসো বিস্তৃতি হয়ে,
দরজা খোলাই আছে, যেখানে যা ফেলে গেছ আমি তার কিছুই রাখিনি সরিয়ে । আছে ধূপদানি,
কর্কশ রেডিও, জ্বলন্ত বৃত্তের মধ্যে দিয়ে আর যা কিছু পালিয়ে গেছে, তা সঞ্চয়ের জন্য ছিল না ।
৫
মায়ার মতো মানুষের সবকিছুরই ইন্দ্রপতন ঘটে । চোখের কাজল
যে বয়সে যা পায়নি, কাজল হারানো চোখ তাই-ই খোঁজে সারাজীবন ।
অবলুপ্ত সৌন্দর্যকে ভালবাসবার সময় দেখেছি, সুন্দর নিজেকে
খেয়ালহীনতায় হারিয়েছে, বাঁধা পড়েছে । হঠাৎ সেই বন্ধন ভেঙে দেখি
আসন্ন বাঁকের মুখে পথ গেছে ঘুরে, যেন লজ্জা ভেঙে এই প্রথম
কোনও ফিঙে পাখি বসেছে আমার বাড়ির জানলায় । ভূলুণ্ঠিত আলো,
বনাঞ্চল, ঢালু ঘাসের জমি, এতদিন যা কিছু সংগ্রহে ছিল সমস্ত কবিতায়,
কোনও এক মানুষের শতপ্রশ্ন চাহনিতে সেসব বিক্রি হয়ে গেল ।
এই অনাদায় গোধূলিবেলায়, বিস্মৃতিপ্রান্তে, পাহাড়ের পথে, যেখানে
ভাঙা মানুষ, ভ্রান্ত মানুষ, মিছিলের শৃঙ্খলা থেকে বেরিয়ে এসে
নির্দ্বিধায় বিস্তার করে নিজেকে, স্বেচ্ছায় হারানো চাবির স্বপ্নে,
ত্রাস ও হিংসার বিনিময়ে, সেইসব মুখবায়বকে ভাসিয়ে দিয়ে এসে
পুনরায় বসেছি, দৃশ্যের মধ্যে ভুল করে ঝরে গেছে বহু ফুল, খবর রাখিনি ।
৬
নিজেকে পুনরাবিষ্কারে দক্ষ নই, তাই অলিখিত প্রতিশ্রুতির দলিল রেখে যাই ।
আরও একটি পরিকল্পিত চিঠি লিখে, নতুন করে বাড়ির পুজোয় তোমাকে
আসতে বলি । যারা আমার ভিতরে চিরকাল অন্ধকারে তাঁবু ফেলেছিল,
যারা প্রজ্জ্বলিত চাঁদকে কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে নিতম্বকম্বল দিয়ে ঢেকে
অকস্মাৎ ছিন্ন করে বানিয়ে তুলেছিল দারিদ্রহীন হ্রদ, তারা সব ফিরে গেছে
একে একে । শুধু পরিধিনাশক কিছু ছায়া এগিয়ে চলেছে, আমাকে ছোঁবে
তোমারই অনুপস্থিতিতে । তাই, নৃশংস অন্ধকার কাঁদে : পরার্থপর সুরের অভাবে
গানগুলো ঝরে যায় রাতে । দূরে বিস্তীর্ণ গাছের সারি, স্থিরজল ঠেলে ঠেলে
অনেক দেরিতে ফেরে আশাহীন নৌকো, মাছ নিয়ে, টাঙানো লণ্ঠন নিয়ে,
তার কিছু কথা ছিল, ছেঁড়া জাল ও বৈঠার সামান্য কাহিনি, আগুনের পাশে, বৃষ্টিতে ।
৭
অরণ্য পুড়ছে, এর চেয়ে নিদারুণ অখণ্ড অস্বস্তি আর কী হতে পারে !
যদিও প্রেরণা পুড়তে পারে, পুড়ে যেতে পারে নিঃশব্দে বেঁচে থাকা ক্ষমা,
অনেক দূরের তারা, সেও পোড়ে প্রেমে, ক্ষুধায়, বোধিসত্ত্ব স্নেহের জারণে ।
এই মাঘ-ফাল্গুন মাসে তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল বীরভূমে, শাড়ির ওপরে
জড়ানো সুতোর কাজ করা একটা শাল, তুমি বাজার থেকে রিক্সা নিয়ে
ফিরবে বলে দাঁড়িয়েছিলে । আমি পথভ্রান্ত বেমানান, কাঁধে বইয়ের ব্যাগ,
পরিচিত লেখার খাতাটা নিয়ে সন্ধের আড্ডার দিকে যাচ্ছি । মা হারা মাতাল
যেমন রাত্রে ফেরে না বাড়ি, জীবনের ফাঁকে ফাঁকে যেমন জলপতনের শব্দ,
ফুটে থাকা ফুল যেমন অনাদৃত সৌন্দর্য নিয়ে পোড়ে, তেমনই পুড়েছি আমি !
ঐ সমুদ্রটিলার নুন, ঐ রেললাইনের ভঙ্গুর পাথর, বন্ধ টিকিটঘর, রঙতামাশা,
সবই সীমার মধ্যে ছিল, আমি দেখিনি । শাড়ির পাড় চওড়া ছিল কিনা, শালের
আসল রঙ সবুজাভ নীল না কি স্পর্শকাতর মেরুন, দেখিনি রত্মমালা থেকে
ছিঁড়ে পড়া মাণিক্য হারিয়ে গিয়েছিল কিনা, শুধু পতনমুখী আলোয় দেখেছি
তোমার অরুন্ধতী মুখ । লেখা ছিল, ‘যাও সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ো সব ব্যাথা নিয়ে !’
৮
একদিন বাইরে তাকিয়ে দেখি ঊষাকাল ভাঙছে । যাদের সূর্যাস্ত অবধি যাওয়ার কথা
তারা জমায়েত হয়েছে ফেরিঘাটে । ওখানেই বিচরণ আমার, ওখানেই আজন্ম অস্তিত্বটুকু
দায়দাস হয়ে বেঁচে । ঐ অনন্ত, ঐ আতিথ্য থেকে বহুকাল হল সরে এসেছি । সম্পর্কে
কেন আমি সবটা তার মতো করে ভাববো ! সেখানেও অংশ আছে আমার, আছে জমি,
এখনো সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিছু শিশুগাছ, কাঁটার জঙ্গল, উঁইয়ের ঢিবি । আমারও
রয়েছে খাগের কলম, কালির দোয়াত, রঙের গভীরে ডুবন্ত তুলি, আমি তাই নিয়ে লিখব ।
একদিন অনুপম আঘাত থেকে বেরিয়ে এসে দেখি জন্ম নিচ্ছে প্রেম, বাকি সব মরে আছে
বীজের আশায়, জলের ফাঁকে, ক্ষতির অন্নে । আমিই শুধু ক্রান্তিহীন, জয়ের মাস্তুলে, ঝাউবনে,
ভাঙা হাড় বেছে বেছে এসেছি ভূর্জতটে, রাতের সাগরে । ব্যবহৃত খামের উল্টোপিঠে যেটুকু
শূন্যস্থান আছে, সেখানেই লিখে ফেলি অঙ্গীকার, কবিতা হয়তো । স্থান ফুরায়, এখনো
অনেক লেখা অনিয়ত, অপ্রকাশিত থেকে যায় । বৈকুণ্ঠকে কোথায় রেখেছে সে,— কোন ঠিকানায়!
অপরাহ্নে জাল বোনা দেখি, দুপুরে তাঁতের মেশিন চালাই, বাড়ির উঠোনে যারা আলপনা দিত,
তারা আজ নেই কোনও দূরের সীমানায় । টেবিলে ন্যস্ত থাকে খাতা, জীবনের হিসাব, অনাদায়ী ঋণ,
নিমন্ত্রণের ত্রুটি, শিমুলের মৃত্যুর বেশ কিছু খতিয়ান, এবং অনেক বছর পর এই আমি !
৯
বসতি ফুলের ডালি, আমি তাকে গ্রাম ভেবে ভুল করি ।
এসেছি কলকাতা থেকে, বইপত্র হাতে, ব্যাগভর্তি মন,
জামাকাপড়ে জড়ানো, আছে তাঁবু, লোহার পেরেক,
সম্পর্ক গাঁথার জন্য হাতুড়ি । যেহেতু পাহাড়ে এখন আর
বরফ পড়ে না, তাই ধাপ কেটে ঝুমচাষ শুরু করেছে লোকে ।
তিনদিকে সবুজ পাহাড়, বাদামি মাটির ঢাল পাথরে জড়ানো,
তাই গোপনে নদির স্রোত বয়ে চলে এখানে । যৎসামান্য বাড়ি,
দোকানবাজার, খাদ্য ও বিশ্রামাগার । আমি স্থান পেয়ে যাই,
আমি মৃত্যুর খুব কাছে, দারুণ অসুখে সব লিখে ফেলি,—
আলো জ্বালি, সন্তাপ মুছে ফেলি । তবুও রহস্য থাকে,
পড়ে থাকে ভাঙা শব্দ, পথ হারানো অক্ষর, বিচ্ছেদমুখী চিহ্ন !
আত্মীয়েরা পক্ষ নেয় তোমার, আমার সমর্থনে এগিয়ে আসে
মরশূন্য লাইব্রেরি । কথা ওঠে, অন্ত্যমিল থেকে সরে যায় ক্রিয়াপদ ।
স্ট্যান্ডে পৌঁছে দেখি বাজারে ফলের দোকান, রেলিং টানা
মদের দোকানে পর্যটকদের ভিড়, যানবাহনের খোঁজে
অনেকেই চলেছে খানিকটা নিচে, বুকস্টোরে । আছে সামগ্রী,—
অন্যায় ও অপব্যবহারের । লোহার কয়েদ ছিল এখানেই,
একদা যা ছিল বন্দি, এখন সেটাই হয়েছে ভ্রমণের উপযোগী,
জংশন আর অববাহিকায় খোলা আছে চায়ের আস্তানা,
বিদেশিরা বসে আছে সেখানে, শুধু সবুজ বনানীই হয়ে আছে অনিশ্চিত !
১০
তামার অচেনা রঙ, তবু সেটা আমাকে টানে, দ্বিপ্রহরে, ধূসর কম্বলে ।
তুমি তো ছিলে না সেই ভুলবোঝাবুঝির পরে, ছিল সে, কাঙাল হৃদয়ে,
অজ্ঞাত অভিসারে । যে সূত্রে পরিচয়, সেই সূত্রে এতকাল বাঁধা ছিল দূরে,
পীড়িত ছিল স্বপ্নে, আহত ছিল গানে । অভ্যাস খুলে ছড়ানো ছিল,
বালিশে ঘুমন্ত রাত, তার পাশে কবিতার বই, অন্য ঘরে, বিভেদদেওয়ালে ।
এ ঘর শূন্য দেখে ভরা এক সন্ধেতে এল ঝড়, বাসনা নিভেই ছিল এতদিন,
স্ফুলিঙ্গ জ্বলেনি, দণ্ডী কাটেনি, সবুজ পানের গায়ে এতকাল লাগেনি চুনাদাগ ।
তবু হাহাকারের মতো শস্যখেতে জন্ম নিল অচেনা গম, আত্মহত্যার আগে,
গ্লানির আগে, মানুষের এই পরাভব, তঞ্চকতা, জেদ, দুপায়ে ঘিয়ের আগুন,
একান্নবর্তী রক্ত, সবটুকু বোনা হল । বুনে নিল সে, বুঝতেই পারিনি— বৃশ্চিকের মতো
তার লতামূলে, চোরাটানে, প্রাণহননের শিকড়ে এতকাল লুকিয়ে ছিল সূচবেঁধা সন্ধান ।
১১
ফিরে এসেছে অবলুপ্ত পাহাড়, দুঃখের গুঁড়ো ভেবে ছড়িয়ো না তাকে,
বরং খোদিত পাথর ভেবে ক্ষমা করে দাও । কিছুই ছিল না যখন, শুধু
এই অহেতুক হ্রদ রেখে কী হবে ? বিক্রি করে উঠে যাই চলো, মিশে যাই
চারপাশে রাতটানা ধোঁয়ার আড়ালে, গাছের প্রদেশে, ফলের ঘ্রাণে, পিণ্ডে ।
যে রথ আর্তনাদে হয়ে আছে স্থির,— তুমি তার দড়ি ধরে টানো, আমি তার
চাকার অতলে পাতি মৃত তিতির । সহজে ফাটল ধরে এমন এক মৃৎপাত্রে
জেগে ওঠে ঘুম, তাসের প্যাকেট থেকে মোজাজোড়া বেরিয়ে এসে পাশে
গিয়ে বসে । যদিও পুরনো, তবুও রঙিন জামা পিছু নেয় পাখিদের । এই না কি
রীতি, এই না কি পরমা আহত প্রাণ, এই না কি চুলের কয়েদ ভেঙে চুমু খাওয়া
ভীষণ প্রতীতি । অচিন শবর তুমি, যত্নে ছিলে ঝর্নার দেহে, আজ ছুটে এলে,
সীমান্তবাহী মেঘ গেছে সরে , লতাসুদ্ধু গুল্ম যেন নিজেকে গুটিয়ে বিছানা
নিয়েছে খুঁজে, বরফও চাদর টেনে লীন হয়ে পড়ে আছে কেতুর গোপন ঘরে ।
১২
বাতিল কাগজে লিখে ফেলি চিন্তার সারাংশ, জানি কাউকে জানানোর নেই ।
কেউ এসে পড়বে না বিক্রি হয়ে যাওয়া কাগজের অংশ । ধরা পড়ব না আমি, যারা
হাতে পেয়ে চিনতে পারবে তারাও ঠিকানা খুঁজে পাবে না । এইভাবে পরিত্যক্ত
মানুষ সন্ধান দেয় শিকড়ের, পোকার, বাকলের গায়ে বিঁধে থাকা পিঁপড়ের ।
প্রতিটি ফলের ত্বক যুবতী, প্রতি ঢেউয়ে ভেসে ওঠে গভীরে তলিয়ে যাওয়া মাছ ।
বেড়ে ওঠে নিত্যবিরোধগুলো, ইদানিং শেষরাতে আলাপ হয়, অবতীর্ণ । কিছুকাল
ক্ষুধার চলন্ত ট্রেন সিগন্যালে থেমে যায়, কিছুদিন প্রতিটি তত্ত্ব ঘিরে সন্ত্রাস জন্ম নেয় ।
উড়ন্ত ডানার নিচে যেন শীত শেষ হয়ে আসে, গজিয়ে ওঠে বিষের ছত্রাক । রেলের ইয়ার্ডে
এক পুরনো গাছের নিচে কোথাও হয়ত ছিটকে পড়েছে সেই কাঁচা সূর্য, যার রঙ বহুদিন
আকাশে জাগেনি । সেসব কথার মালা আর এই নিরাপদ প্রশ্ন লিখে ফেলি, অম্লকূটের মতো ।
১৩
কিন্নর প্রবাহ, আমি তার নিহিত স্রোত থেকে তুলে এনেছি সংকল্প ।
তুলে না নিলে, পাথরের আঘাতে আঘাতে তা ভেঙে যেত, শ্যাওলা
ছুঁয়ে ফেলতে পারত তার নিশ্চেতন শরীরকে, গিরিখাতে ঝাঁপিয়ে
পড়তে পারত তার সমস্ত অস্তিত্ব । সব সৃষ্টির পর মানুষ নিজেকে
পরিণত করে ভুলে, অবতরণে । জলের জারণ যেন এইবার স্থির
করেছে সে আর কখনো গতি পাল্টাবে না সামান্য গড়ান পেলে ।
এই প্রবাহেও শান্ত বক পা নামিয়ে বসে আছে, বিস্ময়ে কাঁপি এই ভেবে,
তার ঠোঁটের ভিতরে আমি এক উপাস্য মাছ হয়ে থেকে যেতে পারব কিনা !
১৪
ভেঙে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা জীবন, এমন জীবন শুধু শতরঞ্চির হতে পারে ।
ক্রমশ বায়ুর টানে যে ঘূর্ণি তৈরি হয়েছে, তা শুধু সেই বুক বোঝে, জানে,
যেখানে এখনো জমায়েত হয় মধুকর তার প্রিয় দাবিটাকে নিয়ে । অথচ কত
অসহ্য ফুল তাকে বসতে দিল না, কত পরাগ সে এমনি নষ্ট করল দোষে,
সেসব পাতানো থাকে ছায়ার চাদরে, ছড়ানো থাকে শতরঞ্চিতে । যে পাখি
দুর্দিনের ভোরে চমৎকার গান গায়, যার চোখ এখনো অটুট এই ভ্রষ্ট খেয়ার পাশে,
সেই পাখিটাকে, তার মূর্তিটাকে ভেঙে ফেলি সময়মতো । এইবার আশ্রয়ে ফেরার
দিন এসে গেল, লালাবিষ আর স্বপ্নসুন্দর ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে দু’বাহুতে জড়িয়ে ধরি তাকে ।
‘এ তালার চাবি কোথায় রেখেছি তুমি জানো ?’—আশ্বিন সন্ধ্যায় এ প্রশ্নের উত্তরে
আজ আর কোনও বিতর্কে যেতে চাই না । যে স্বপ্নটি ছিঁড়ে যায়, তাতে সহজ পথের
কথা কোনওভাবে লেখা থাকে কি না জানা নেই । এই ভেবে এক আঁজলা জল তুলি ।
ভাবি, সে জল আমার নয় । তার নিচে মাছের সমাধি, কচ্ছপের দেশ, এসব অন্যকারোর ।
প্রবাহের দিকে যেন অভিমান জড়ো করে বসতি নিয়েছে শ্যাওলার দল, তারা সম্পর্কে ঘনিষ্ট,
সাগরের সমান হতাশ, কবিতায় সঞ্চিত, শিহরিত পাতার মতো ঝরে পড়ে শীতে, লগ্নে !
১৫
যে জন্ম আমার নয়, তাকে নিয়ে কতটুকু বিবরণ লিখি ! অবশ্য একদিন গভীর
প্রহেলিকা এসে আমাকে জানায়, এইবার যদি লিখে নিজেকে প্রকাশ করতে
না পারি, কঠিন ধানের জমি ভরে যাবে নোনাজলে, বালি আর সামুদ্রিক লবণে ।
বহুদিন পর লেখা নিয়ে বসতেই দেখা গেল আমি কাছিনৌকো হারিয়েছি, ভাঙা দাঁড়
অচেতন হয়ে পড়ে, নির্মাণ হয়নি । শিয়রে উড়ন্ত পাল, বাতাসের গতি আমি চিনি না
এখনো, শতছিন্ন জালে ঘিরে আছে আমার মিনতি, আমি শোক, বিপুল আঁধারে খুলে রাখা
প্রতিটি খাতার ছত্রে আমি তাই-ই লিখি ! কেননা, ইতিমধ্যে লৌকিকতা আমাকে দিয়েছে
হবিষ্যি । সেই নিয়ে আমি নেমে পড়ি মাঠে, ধানের গোড়ায় জমা অতিবর্ষার জলে ।
লোহার নতুন পাত পড়ে আছে একা, হারানো সবুজ কাঁটা কোনওভাবে এসে যেন বিঁধেছে
পাথরে । যেহেতু ঠিকানা বদল করে এই মহলে এসে উঠেছি, তাই সামনে ছড়ানো জমি
এখন আমার, সারিসারি গাছ আর প্রান্তে মাটির ঢিবি, সেও এখন আমার । ওদিকে
পুকুরঘাটে বাঁধানো সিঁড়ি, মেয়েদের স্নান, ঠুকরানো ফল, অগ্নিময় ফুল, জীবন্ত
সাপের খোলস, সবই আমার, শুধু জন্মটি বাদে ।
১৬
অনেক ঝুলন্ত টায়ার, তার মাঝে বন্ধ কারখানা, সেখানে নিযুক্ত ছিলাম আমি,
ভুল বোঝাবুঝি আর অহেতুক সব বৃষ্টির মধ্যে । সঙ্গে ছাতা আনিনি, তাই —
কর্তব্যহীন আশা আমাকে জানাতে আসে ভিজে ভিজে ফিরে যেতে হবে,
এ বৃষ্টি চলতেই থাকবে, যতদিন লেখার খাতাটা পুরোপুরি বন্ধ না হয়ে যায় ।
হাহাকার, মানুষের উল্লাস, পাখিদের শোকবার্তা আমাকে চিরকাল প্রস্তাব দেয়
যাতে স্বর্গের বিপরীতে আমি লিখি নরকের অন্তত কিছুটা, অস্তিত্বের অন্যপাড়ে আমি
যেন রেখে যাই আমার ভাঙনটুকু, যতটা ভেঙেছে আমায় দুঃখের দেবতা ।
কোথায় কোঠর ! কোথায় ছিন্নমূল পড়ে আছে একা ! এসবের খতিয়ান নেই,
এসবের নেই কোনও পুরনো দলিল, সুষ্ঠু গল্প, সমাগমস্রোত । বিষয়ে টালবাহানা,
পরিচয়ে দুর্বিষহ ক্রোধ, অবিদ্যায় ঢাকা পড়ে থাকে অন্ধকার, কত না নক্ষত্র
টেনে নিয়ে গেছে আমায়, হতবাক আমিও, নিরুপায় । সেখানে প্রতি প্রশ্নেই হয়ে থাকি
স্পর্শাতুর, সংশয় । শুধু ব্যতিক্রমী গাছ আমাকে দেখেছে তার নিজস্ব ছায়ায় ।
১৭
ভিজছে চন্দনকাঠ, তাই তটস্থ হয়ে ভাবি : নিশ্চয় কোনও দিন সহজিয়া
বনের ভিতরে ছিল গ্রীষ্মকালীন ছুটি । আজ রৌদ্র ভেঙেছে, নিষ্ঠুর
নিষ্কৃতি পেতে চেয়ে ফিরে এসেছে দুর্দমনীয় একটানা বর্ষাকাল । দিঘিতে
বুকডোবা জল, পরিপাটি চুল থেকে উঠে আসা ডিঙি তাতে সাঁতার দিয়েছে ।
প্রচণ্ড গরল যার, তার কাছে কিছুই রাখিনি । বিরতি প্রকাশ পায় এই শ্লেষে,
আছে প্রতিটি কেনাবেচায় শল্যের বিচার । জয়ী হই, বিষণ্ন হই সেই টানে ।
‘কেবলই দুপুর যায়, চেনা ভুলে নিয়ত জড়িয়ে পড়ি প্রবাদে’— মেঘের আড়ালে
অর্ধেক আলো নিয়ে জেগে ওঠে অবসন্ন সূর্য । যা-ই ভাবি, সেসব গিরিশৃঙ্গ মাত্রই
ঢাকা পড়ে আছে নখচিহ্নহীন বরফের অতলে, যেন জ্যামিতির খাতায় এঁকেছে সুরাহা ।
১৮
কবর, একদিন যা ছিল কাঁচামাটি আর নুড়ির সন্ধানে, শোয়ানো ছিল দেহ,
আত্মার বিশেষ যন্ত্রণা ছিল তাতে, ছিল ঈশ্বরের প্রতি সমবেদনা, তার সর্বস্ব আজ
ভরে গেছে পাথরের সারল্যে, ফুলের বন্ধনে, ভ্রাম্যমাণ পথিকের পদধূলিতে । দু’পাশে
পড়ে থাকা অসংখ্য বাঁশপাতাকে প্রশ্ন করি, ‘অতিকায় নক্ষত্র থেকে তোমরা কীভাবে
নিজেদের সরিয়ে নিলে ? কতদিন হল এইভাবে খসে পড়ে আছ অথচ কেউ মাড়িয়ে
যাচ্ছে না তোমাদের ?’ প্রশ্নহারা চোখ, শুধু পরিচয় নজরে পড়ে, ভিতরে কত খাদের
তফাৎ, কত না পার হয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা, রোপওয়ের তার, এইভাবে সব বোধ
শীতার্ত হয়েছে । বিপুল মরণস্রোত, তারই নিচে স্থাপত্য ও প্রেতপুরীর দুর্গ, সূর্যাস্তে
ফুটে ওঠা ঘাসফুল, তারা শুধু অল্প আঘাতেই বিপর্যস্ত, জটিলতা ঘিরে, তারিখের শাসনে ।
ভালো লাগলো সিরিজটি।