বহুত্ববাদী ভারত, একত্ববাদী শাসক <br /> বেবী সাউ

বহুত্ববাদী ভারত, একত্ববাদী শাসক
বেবী সাউ

এই দেশ তার নানা সমস্যা নিয়েও বহুত্ববাদকে ধারণ করেছে দিনের পর দিন। এই বহুত্ববাদী দর্শন কাউকে বর্জন না করে আপন করে। বিচ্ছিন্নতা নয় বরং মিলনেই এই বহুত্ববাদের সার্থকতা। তাই বিবিধের মাঝে মিলন মহানের সুর ভারতের জাতীয় সুর। কিন্তু যেকোন মৌলবাদের প্রবণতাই হলো, তা বহুত্ববাদের বিরোধিতা করা। তারা একত্ববাদে বিশ্বাসী। যে মায়ের দ্বারা এই পৃথিবীর মাটিতে প্রথম সূর্যোদয় দেখা সেই মা’কে লাঞ্ছিত হতে দেখেও, তার সমাধান না করা বিবেকবান ভারতীয় ঐতিহ্যের পরিপন্থী। এবং এই ধারণা থেকে হাজার হাজার মানুষ একটা সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন। ভারতকে তাঁরা ‘মা’ রূপে কল্পনা করেছেন। তাঁরা স্বাধীন এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন বলেই সম্ভব হয়েছিল একত্র হয়ে বিট্রিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমবেত লড়াইয়ের। সেই লড়াইয়ের ফল আমরা কেমন ভাবে পেলাম এবং তাতে কী ক্ষতি হলো, তা অন্য এক আলোচনার বিষয়।

রাষ্ট্র হলো এক রাজনৈতিক দেশ, যে ধারণ করে রাখে দেশের প্রতিটি মানুষেরই সংস্কৃতি, বিশ্বাস এবং ঐতিহ্যকে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাছে মানুষের একটাই আশা থাকে, সকলকে সমান ভাবে দেখবে এই রাষ্ট্র। রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিরা সংস্কৃতি এবং বিশ্বাসের প্রেক্ষিতে হবেন নিরপেক্ষ। কারণ তাঁরাই রাষ্ট্রের প্রতিনিধি। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি। সেক্ষেত্রে, সেই রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিরা যদি রাষ্ট্রীয় মঞ্চে ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসকে তুলে ধরার প্রয়াস করেন, তখন তা একপ্রকার মৌলবাদ। এই ভূমিকার কারণ, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক আচরণ। তাঁর ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস নিয়ে বলার কিছু নেই। কিন্তু এ কথা হয়তো ভাবতে হবে আমাদের, তিনি যতটা শ্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি, তার চেয়ে বেশি একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রধানমন্ত্রী। তিনি প্রতিনিধি এমন একটি দেশের, যার মূল দর্শনই হলো বহুত্ববাদী দর্শন। কিন্তু, ভারতের বর্তমান শাসনব্যবস্থায় সেই বহুত্ববাদী দর্শন প্রায় অস্তগত। সে কারণেই, ‘বিবিধের মাঝে মিলন’-কে বাদ দিয়ে, একত্ববাদের দিকেই তাঁরা এগিয়ে নিয়ে যান দেশকে। যে দেশের সংবিধানকে রক্ষা করার কাজ তাঁরা পেয়েছেন, জনগণ যাঁদের হাতে তুলে দিয়েছেন এ দেশের প্রজাতন্ত্রী কাঠামোকে বুক দিয়ে আগলে রাখার দায়িত্ব, সেই দেশের সংবিধানকে অমান্য করার কাজটিই তাঁরা ধাপে ধাপে করে চলেছেন।

অথচ ভারতবর্ষের ইতিহাস তা নয়। বিচ্ছিন্নতা নয় বরং মিলনেই এই বহুত্ববাদের সার্থকতা। কিন্তু যেকোন মৌলবাদের প্রবণতাই হলো, তা বহুত্ববাদের বিরোধী। তারা একত্ববাদে বিশ্বাসী। রামকৃষ্ণদেব, যিনি আমরা উনবিংশ শতাব্দীর একজন মুখ্য দার্শনিক, তাঁর চিন্তাধারায়ও সেই বহুত্ববাদী, ধর্মনিরপেক্ষ এক সমাজের ছবি আমরা স্পষ্ট ভাবে দেখি। বিশ্বে জনসংখ্যাগত দিক থেকে দেখলে ভারত কিছুদিন আগেই চিনকেও ছাড়িয়ে গেছে। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে, ভিন্নমত ভিন্নভাবনার বিভিন্ন মানুষ বসবাস করবেন এটাই স্বাভাবিক। আর যেহেতু স্বাধীনতা এবং আমাদের পবিত্র সংবিধানের প্রথম শর্তই হচ্ছে গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র — যেখানে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ ‘হিন্দুস্তান’ এই শব্দগুলোই বালখিল্য আচরণের মধ্যেই পড়ে। এবং আমরা এও জানি সিন্ধুসভ্যতার অধিবাসীরাই ‘হিন্দু’ নামে পরিচিত। আমরা চৈতন্যদেবকে দেখেছি যবন জাতকে আলিঙ্গন করছেন। এমনকি যে শ্রীরামকে নিয়ে এত মাতামাতি সেই রামও তো অযোধ্যায় ফিরে এসে প্রতিষ্ঠা করছেন গণতান্ত্রিক এক রাজ্য। তিনি প্রজাদের অভিমতকে মূল্য দিচ্ছেন। বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন বিভীষণ এবং হনুমানের মতো অনার্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে। তিনি গুহকচণ্ডালের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করছেন। আশ্রয় নিচ্ছেন তার বাড়িতে।

এই ঐতিহ্যের ধারায় পরবর্তীকালে আমরা কবীরকে পাই। পাই লালন ফকিরকে। তারও আগে যদি আমরা দেখি বেদ এবং উপনিষদের মূল বিষয়? ভারতের যে ধর্মনিরপেক্ষ, বহুত্ববাদের ধারণা তা আসলে আমাদের বেদ পুরাণ থেকেই গৃহীত হয়েছে। এবং আমাদের পবিত্র সংবিধানে সেই ধারাটিকেই মূল্য দেওয়া হয়েছে। আর এই কথাটি মুঘল সম্রাট আকবর বুঝতে পেরেছিলেন বলেই ‘দীন-ই-ইলাহি’ মতো এক আইন চালু করেছিলেন যাতে স্পষ্ট এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের স্বপ্নকে আমরা পাই। রামকৃষ্ণদেব বলেছেন, “আমার ধর্ম ঠিক, আর অপরের ধর্ম ভুল– এ মত ভাল না। ঈশ্বর এক বই দুই নাই।… কেউ বলে আল্লাহ, কেউ বলে কৃষ্ণ, কেউ বলে শিব, কেউ বলে ব্রহ্ম।… হিন্দু বলছে জল, খ্রীষ্টান বলছে ওয়াটার, মুসলমান বলছে পানি — কিন্তু বস্তু তো এক।” এবং এটাই সনাতন ধর্ম তথা উপনিষদের মূল সুর। স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকার শিকাগো শহরে তাঁর বক্তৃতার মাধ্যমে সারাবিশ্বকে জানান দেন সনাতন ধর্মের মূল ব্যাখ্যা। তিনি পরবর্তীকালে বলেন, “আমি এমন একটা ভারত চাই যার মস্তিষ্ক হবে বৈদান্তিক আর দেহ হবে ইসলামিক”।

“সনাতনমেনমাহুরুতাদ্য স্যাপ্তুনর্ণবঃ।/অহোরাত্রো প্রজায়তে অন্যো অন্যস্য রূপয়ো।।”(অথর্ববেদ ১০।৮।২৩) এর ভাবার্থ করলে দাঁড়ায় সর্বব্যাপক স্থায়ী নিত্য পরমাত্মা যিনি নিত্য নতুনভাবে প্রকাশিত হন। দিন ও রাত্রি উভয়ে একে অপরের দ্বিবিধ রূপ দ্বারা উৎপন্ন হয়ে থাকেন। সনাতন শব্দটির অর্থ হচ্ছে চিরন্তন। এই ধর্ম হল মানবধর্ম। কোনো জাতি বা সম্প্রদায় ভিত্তিক নয়। এটা একটা পন্থা। বৈদিক ভারতে আমরা দেখেছি শত্রুর সঙ্গেও মানুষ সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার করছেন। শ্রীরাম রাবণকে ‘শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মজ্ঞানী’ বলে উল্লেখ করছেন।

বর্তমানে প্রফেসর অমর্ত্য সেন তাঁর ‘ আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়া’ নামক বইটিতে দেখিয়েছেন প্রাচীন ভারতের মাহাত্মের কথা। স্পষ্টভাবে তিনি উল্লেখ করেছেন, ঋকবেদের মধ্যেও লোকায়ত দর্শন এবং বস্তুবাদী ভাব এবং এটাই আমাদের ভারতবর্ষের ঐতিহ্য। রবীন্দ্রনাথ থেকে নজরুল দু’জনেই দেখিয়েছেন মানবিক গুণই, মানবতাবাদী ভাবধারাই ভারতের শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্য। বৈদিক ভারতে আরেকটি দিক আমরা পাই, সাধু-সন্ত-মুনি-ঋষিদের কাজই ছিল মানবকল্যাণের নিত্যনতুন পথ আবিষ্কার করা। কিন্তু এখনকার যে ভারত তা উপনিষদ পরিপন্থী। শ্রীচৈতন্য থেকে শ্রীরামকৃষ্ণদেব, এন কে গান্ধী, স্বামী বিবেকানন্দ, রাজা রামমোহন রায়, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এঁদের মূল দর্শন, চিন্তাধারা আজকের এই ভারত মানে না। আজকের ভারত বেদ, উপনিষদের মূল নীতির পরিপন্থী। ভারতের আত্মা ধর্মনিরপেক্ষতার দর্শনকে ধারণ করে।” যত মত তত পথ” -ই ভারতের ঐতিহ্য এবং সমাজ ব্যবস্থাকে উন্নত করতে পারে, বিশ্বের দরবারে শ্রেষ্ঠ আসন এনে দিতে পারে।

কিন্তু একদেশদর্শীনীতি ধারণ মানেই বেদ, উপনিষদকে অস্বীকার করা এবং এটা সনাতন ধর্মেরও পরিপন্থী। ভারতের আত্মা ধর্মনিরপেক্ষতার দর্শনকে ধারণ করে। কিন্তু রাষ্ট্র যদি পার্লামেন্টের মতো জায়গায় একটি বিশেষ ধর্মের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসকে উপস্থাপন করে, তবে বুঝতে হবে অশনি সঙ্কেত দেখতে পাচ্ছি আমরা। দেশের সংবিধানকেই বিপন্ন করে এ কেমন রাষ্ট্রস্থাপন? মনে পড়ে, ‘আপনারে স্থাপিয়াছ, জগতের দেবতারে নয়’। আর সবচেয়ে বড় বিপদ হলো, রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরাই এখন ভারতীয় রাষ্ট্রের মূল কাঠামোকেই ধ্বংস করছে। অচিরেই এ দেশ এক ধর্মীয় মৌলবাদী রাষ্ট্রের দিকে হেঁটে যাচ্ছে, সন্দেহ নেই। বিপদ দরজায় কড়া নাড়ছে। আর আমরা চুপচাপ এভাবে পবিত্র সংবিধানের লাঞ্ছনা দেখে যাব?

কয়েকদিন আগে একটু লেখায় পড়লাম বিভিন্ন স্কুলে নাকি ছাত্রদের রোলকলের সময় উঠে দাঁড়িয়ে বলতে হবে – জয় শ্রী রাম। এর পর হয়তো এই ফতোয়া আসতে চলেছে আমাদের অফিসে গেলে বলতে হবে জয় শ্রী রাম, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে রামমন্দিরের কোনও ছবি দেখলেই হাত তুলে বলতে হবে জয় শ্রী রাম। জয় শ্রী রাম না বলে ঘুম থেকে ওঠা যাবে না। অথবা ঘুমোতে যাওয়ার আগে জয় শ্রী রাম না বললে আমাদের ঘুমে বারণ। সারা ভারতের লোকের মহামন্ত্র হয়ে উঠবে জয় শ্রী রাম ধ্বনি। এ রাম কোন রাম? এই রামই কি সেই রাম, যাকে নিয়ে কবীর গান লিখেছিলেন, কবিতা লিখেছিলেন, না কি এই সেই রাম যাকে নিয়ে কৃত্তিবাস, তুলসীদাসের রামায়ণ। এর রাম হল ক্ষমতার রাম, যাকে গান্ধীজি বা কবীর বা সূরদাস চিনতেন না। এ রামের নাম করে ক্ষমতা নিজেকে সিংহাসনে বসাচ্ছে। এই একত্ববাদী রাম বহুত্ববাদী ভারতের রাম নয়। যেমন, হিন্দুত্ববাদ নয় হিন্দু দর্শন।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes