
প্রিয় বইয়ের তালিকা থেকে একজনের মাত্র দু’টি
গৌতম বসু
" বিমর্ষ বোধ করলেই তাঁর লেখা আজও নিয়মিত পড়ি, যদিও কয়েক ছত্র এগোবার পরই বুঝতে পারি, সব বৃত্তান্তই ─ ‘আস্তে আস্তে ভাঙো!’, ‘খোকার ভবিষ্যৎ’, ‘পত্রবাহক’,‘মনের মতো বৌ’, ‘গোখলে গান্ধীজী এবং গোবিন্দবাবু’, ‘আলেকজাণ্ডারের দিগ্বিজয়’, ‘মেয়েরা হারাবেই’, ‘ছত্রপতি শিবাজী’, ‘গদাইয়ের গাড়ি’, ‘আপনি কী হারাইতেছেন আপনি জানেন না’,‘হাওড়া-আমতা রেললাইন দুর্ঘটনা’ ─ এতগুলি বছর পরেও, মাথার এক কোণে রয়ে গেছে। শিব্রাম চক্রবর্তী তাঁর অনাড়ম্বর জীবনযাপন দিয়ে সাহিত্যের আদর্শ কেবল রক্ষা নয়, গৌরবান্বিত ক’রে গেছেন। আজকের মন নিয়ে, সেদিনের মেসের ঘরখানা লক্ষ ক’রে বুঝতে পারি, পূর্ণাঙ্গ জীবনের সঙ্গে কৃচ্ছ্রসাধনের অচ্ছেদ্য একটা সম্পর্ক আছে। লিখে, আলোচনায় অংশগ্রহণ ক’রে, আত্মপক্ষ সমর্থন ক’রে, এর নাগাল পাওয়া অসম্ভব; কেবল জীবনযাপনের দ্বারা একে প্রতিষ্ঠা করতে হয়, যেমন তিনি পেরেছিলেন। আমরা ওইভাবে ভাবি না আর, সেইজন্য আমাদের লেখা বহু যোজন এগোলেও, কোনওদিন, কোনওভাবে শিব্রাম চক্রবর্তীর নির্মল স্বভাব স্পর্শ করতে পারবে না।
প্রত্যেক সাহিত্যপাঠক তাঁর সর্বাধিক প্রিয় গ্রন্থের একটা তালিকা মনে-মনে বহন ক’রে বেড়ান, কেউ-কেউ অন্যদের তা জানা্তে দ্বিধাবোধ করেন, কেউ-কেউ করেন না। দ্বিধাবোধ পাঠকের স্বভাবের অন্তর্গত, সেই এলাকায় অতিরিক্ত কৌতূহল প্রকাশ করা হয়তো–বা অসমীচীন, কিন্তু ব্যক্তিগত পরিসরের বাইরেও, পরস্পরের মধ্যে এই তথ্য ভাগ না ক’রে নেওয়ার একটি অকাট্য যুক্তি আছে। পাঠকের মন তাঁর গ্রন্থরুচির মতোই পরিবর্তনশীল, দশ বছর আগে যে-বইটি তাঁকে সর্বক্ষণ টেনে রাখত, সেই বইটিরই স্মৃতি আজ তাঁর কাছে ফিকে হয়ে এসেছে। আবার, এর বিপরীত অবস্থাও সমান সত্য। সময়প্রবাহ কোনও বিশেষ বইয়ের সম্মান হরণ করে, এবং তার বিপরীতে, পূর্বে উপেক্ষিত কোনও বইকে প্রতিষ্ঠা দান করে, দু’রকম ঘটনাই নিজেদের পাঠকজীবনে আমরা দেখে এসেছি। এক কথায়, লেখকের মরণোত্তর নিয়তি তাঁর রচনাকর্মের উত্থানপতনের ভিতর দিয়ে কাজ করে। বইয়ের সঙ্গে দীর্ঘদিন বসবাস ক’রে, বিশেষ ক’রে বিশ্বের প্রধান গ্রন্থপ্রণেতাদের কিছু-কিছু লেখা পড়ার চেষ্টা ক’রে একটি অন্য বার্তাও আমায় ছুঁয়ে গেছে। লেখকজীবনের প্রস্তুতিপর্ব একবার পার হয়ে গেলে, একজন বড় লেখকের অন্তর্জীবনে, অন্তত সংখ্যার দিক থেকে, গ্রন্থের ভার হ্রাস পেতে থাকে। এমন কোনও নির্জন সমুদ্রতীর-বিষয়ে আমি কখনও শুনি নি, যেখানে লাইটহাউসের ভিড় দেখা গেছে। এই বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে, অর্থাৎ আশ্রয়ধর্মী গ্রন্থতালিকার প্রেক্ষিত থেকে রচিত গদ্যের সংখ্যা খুব বেশি নয়, কারণ নিজের রন্ধনশালার বৃত্তান্ত কেই-বা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে চান, কিন্তু ব্যতিক্রমগুলি প্রণিধানযোগ্য। অর্নেস্ট্ হেমিঙওয়ে(১৮৯৯-১৯৬১),তাঁর ছত্রিশ বছর বয়সে, মাত্র আঠারটি পুরানো বই নতুন ক’রে ফিরে পড়বার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। প্রসঙ্গত, তাঁর নির্বাচিত বইয়ের তালিকা এবং তাঁর নিজের লেখার কোনও সরল সমীকরণ লক্ষ করা যায় না, এবং এইখানে তাঁর রচনার উৎকর্ষও প্রমাণিত হয়। তাঁর পাঠাভ্যাস, তাঁর রচনাকর্মের একাধিক উপাদানের একটি অপেক্ষাকৃত গৌণ উপাদান হওয়ায়, পঠিত বইয়ের সঙ্গে তাঁর নিজের কথাসাহিত্যের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক প্রতীয়মান নয়; পড়ার এবং লেখার মধ্যকার ব্যবধান, অর্থাৎ, আত্তীকরণ, লেখকের প্রকৃত পরিচয় বহন করে। হেমিঙওয়ে যেমন পড়েন, তেমন লেখেন না, ওইজন্যই তিনি হেমিঙওয়ে। লেভ় টলস্টয়কেও (১৮২৮-১৯১০)তাঁর তেষট্টি বছর বয়সে একই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, এবং তিনি যে পন্থা অবলম্বন করেন, তা অতিবিচিত্র ধরনের সত্যকথন। নিজের জীবনকে তিনি প্রথমেই পাঁচটি ভাগে বিভক্ত ক’রে নেন, শৈশব থেকে ১৪ বছর, ১৪ থেকে ২০ বছর, ২০ থেকে ৩৫ বছর, ৩৫ থেকে ৫০ বছর, এবং অবশেষে ৫০ বছর বয়স থেকে বর্তমান, অর্থাৎ ৬৩ বছর। প্রত্যেক কালখণ্ডের জন্য তাঁর গ্রন্থতালিকা পৃথক। এখানেই থেমে যায় নি তাঁর সূক্ষ্মবিচার। তাঁর উপর প্রতিটি বইয়ের প্রভাবের তারতম্য বোঝাবার জন্য তিনি তিনটি পৃথক গোত্র উদ্ভাবন করেছেন: ‘এনরমাস’, ‘ভ়েরি গ্রেট’ এবং ‘গ্রেট’। লেভ় টলস্টয়, যিনি উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে সমগ্র বিশ্বের চেতনার ধারকের ভূমিকা নির্বাহ ক’রে গেছেন, তিনিও ৫০-৬৩ বছরের কালখণ্ডে মাত্র এগারোটি বইয়ের নামোল্লেখ করতে পেরেছেন!
আর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর? মৃত্যুশয্যায় শায়িত রবীন্দ্রনাথ একটিও গোটা বই স্মরণ করতে পারেন নি। তাঁর মুখের যে-অমূল্য কথাগুলি খাতায় টুকে রেখেছিলেন রানী চন্দ, সেগুলি আমরা বারবার পড়েছি, তবু গুরুত্ববিচারে, ‘আলাপচারি রবীন্দ্রনাথ’-এর দু’টি অংশ আরও একবার স্মরণ করি:
‘২৩ এপ্রিল, ১৯৪১। উদয়ন
দুপুর
… আমার সৃষ্টিশক্তির ভিতর দিয়ে যে রস, যে আনন্দ আমি পেয়েছি ─ তা অন্যদের মধ্যেও চালনা করে দিতে পেরেছিলুম। দুঃখ হয় মনে, যখন ভাবি যে, এ স্থায়ী হবে না। একদিন আর এ রস লোকে পাবে না এর থেকে। সাহিত্য বড় ক্ষণস্থায়ী। দেখলুম তো ─ কী দেশের, কী বিদেশের সাহিত্যের অবস্থা। একদিন যাকে নিয়ে লোকে এত হৈ-চৈ করেছে, দু-দিন বাদে মনে হয়েছে তা ছেলেমান্ষি। এ থাকে না; এমনি হতে বাধ্য। ভাষা যে নদীর কলস্রোতের মতোই, কেবলি যাচ্ছে আর নূতন আসছে। আজকের ভাষা কাল থাকছে না। তাই আমিও মেনে নিয়েছি; দুঃখ নেই মনে। যতদিন আমি আছি, তার পরে দোরে তোমরা তালা বন্ধ করে দিয়ো ─ বাতি নিভিয়ে দিয়ো; ─ আমার কিছু বলবার থাকবে না। …’
এবং ঠিক তার পরের দিন দুপুরেই, আবার:
‘২৪ এপ্রিল, ১৯৪১
… গীতিকাব্যের অনির্বচনীয়তা ফুটে ওঠে ভাষার ব্যঞ্জনার দ্বারা। ভাষা কালে কালে বদল হয় ও সেই সঙ্গে রসের সৌন্দর্য, গৌরব কমে যায়। একালের রস ভাবীকালের মানুষ পায় না। তার উজ্জ্বলতা তাদের কাছে ম্লান হয়ে যায়। একটা ছোট কথা ধর্-না কেন, ‘চরণ নখরে পড়ি দশ চাঁদ কাঁদে’; একদিন এই রসের কত উচ্ছ্বাস ছিল। আজ সেখানে একটি চাঁদও নেই, ঘোর অমাবস্যা। সে থাকত, তার পদবিক্ষেপ বুকে এসে লাগত, যদি সত্যিকারের চরণের ছন্দে তাল মিলিয়ে আসত। প্রাচীন সাহিত্যেরও অনেক রসের সৃষ্টি, তার উজ্জ্বলতা, তার স্বাদ ক্রমেই ম্লান হয়ে আসে; ভাষার পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তিত হতে থাকে। এক সময়ের বিশেষ আগ্রহের কাব্য আর-এক যুগের কালে গৌরব রক্ষা করে না। সাহিত্যের বাজারে হ্রাস-বৃদ্ধি হতে থাকে। কিন্তু চরিত্র-সৃষ্টির বিনাশ নেই। সাহিত্যে রসের স্বাদ পরিবর্তন হয় কিন্তু যখন সাহিত্যে, নাট্যে একটি জীবনকে পরিপূর্ণ রূপ দেওয়া যায়, যখন সেই সৃষ্টির ভিতরে যথার্থ মানবের পরিচয় থাকে ─ তার উজ্জ্বলতা কোনোকালে ম্লান হয় না। মানবের চিত্রশালায় সেই জীবনের সৃষ্টি অমর হয়ে থাকবে। সেটিই সাহিত্যের চিরস্থায়ী দিক। শকুন্তলা, ─ সে তো মরবে না কোনো দিন। তার সুখদুঃখও তো কালে কালে যুগে যুগে মানুষের মনকে নাড়া দেবে। শকুন্তলার নাট্যাংশ জীবন্ত হয়ে থাকবে। মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্র, দুর্যোধন, এমন-কি শকুনি, সেও ত অমর হয়ে আছে আমাদের কাছে। সেই শকুনি এখনো বসে বসে পাশাই খেলছে, আমরা তার উপরে আজও রাগ করছি। ভাঁড়ুদত্ত, ফল্স্টাফ্ ─ এরা সব আমাদের কাছে সেদিনও যেমন ভাবে দেখা দিয়েছিল আজও তেমনি। তাই বলছি, সাহিত্যের নাট্যশালায় যদি মানবচরিত্রের কোনো যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায়, তবে তার ধ্রুবত্ব নষ্ট হয় না কালের সঙ্গে সঙ্গে। তারা চিরকালের মানুষ। মানবরূপের সত্যতার দ্বারা চিরকাল আপনার সত্য রক্ষা করে। ভাষা আজ উজ্জ্বল না থাকতে পারে, কিন্তু মানবচরিত্রগুলির উজ্জ্বলতা ম্লান হবে না। তাই মানুষের চরিত্রকে যখন সাহিত্য রূপ দেয় তখন তা হারায় না।… ’
রবীন্দ্রনাথের এই মর্মভেদী উপলব্ধি নতুন ক’রে শোনবার পর আমরা নতুন ক’রে কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হই।
।। ২ ।।
এই দীর্ঘ ভূমিকার অবতারণা ক’রে আমি এইটুকুই তুলে ধরতে চেয়েছি, বড় লেখকদের বড় হওয়ার নেপথ্যে একটি প্রধান কারণ, অন্য কিছু নয়, তাঁদের আত্মনির্ভরশীলতা; তাঁরা প্রত্যেকেই, যে-যাঁর নিজের মতো ক’রে, বইয়ের জগৎ পিছনে ফেলে আসতে পেরেছেন। ‘After such knowledge, what forgiveness? ’ ─ টিএসঈ-র সেই পঙক্তি, যা আদৌ কোনও প্রশ্ন নয়, কেবল প্রশ্নের আকারে লিপিবদ্ধ এক গভীর উপলব্ধি, এমনি-এমনি লেখা হয় নি। আমি বুঝতে পারি, পাঠক হিসেবে সেই জায়গাটি আমার অনায়ত্ত রয়ে যাবে, কিন্তু তাতে লজ্জার কিছু দেখি না। আমার কয়েকখানি বইয়ের সংগ্রহ ঘিরে শ্লাঘাবোধ করবার কোনও কারণ আমি আর খুঁজে পাই না বটে, কিন্তু কেমন ক’রে অস্বীকার করি যে, অন্তত শতাধিক বই নিয়ে নিয়মিত ধস্তাধস্তি না-করলে আজও আমার চলে না ─ আজ ‘জার্নি টু আর্মেনিয়া’, তো আগামীকাল আরও একবার ‘শ্রীরাধার ক্রমবিকাশ’─ এই ভাবে কোনও-এক পরিণতিহীন, নির্বাক শাদাকালো চলচ্চিত্রের এক সদাব্যস্ত কুশীলব হয়ে আমার দিন কাটে। একটা নতুন দৃষ্টিকোণ, কয়েক বছর ধ’রে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। এখন আর কেবল বই পড়ি না, বইয়ের পৃষ্ঠার আড়াল থেকে মানুষটাকে লক্ষ করি; এর ফল, আপনারা কেউ-কেউ হয়তো আমায় সমর্থন করবেন, বহু সংখ্যক লেখকের সুলিখিত বইয়ের পক্ষে সন্তোষজনক নয়। হাইস্কুল রসায়নের প্র্যাক্টিকাল ক্লাসে বিপুল উৎসাহ সহযোগে আমরা ‘অ্যাসিড টেস্ট’ করতাম, বইয়ের পৃষ্ঠার ফাঁক দিয়ে লেখককে লক্ষ করতে থাকা, আমার নতুন রাসায়নিক পরীক্ষা।
‘অ্যাসিড টেস্ট’-এর ফলাফল দেখে অবাক হই, লক্ষ ক’রে বিপুল হর্ষও অনুভব করি, আমার কৈশোরের অন্যতম প্রিয় লেখক, শিবরাম ওরফে শিব্রাম চক্রবর্তী(১৯০৩-৮০), কি অক্লেশে ভিড় ঠেলে সম্মুখে এগিয়ে এসেছেন। তাঁর দু’টি বই ─ ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’ এবং ‘হাসির টেক্কা’ ─ ঘিরে বহু দশক জুড়ে জ’মে-থাকা কিছু কথা লিখতে রাখতে পেরে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে। বাঙালীর রসবোধ তলানিতে এসে ঠেকেছে, এ নিয়ে কোনও মনস্তাপ নেই আমার, কারণ অন্তিমদশাপ্রাপ্ত যে-লেখককে আমি আমার তরুণ বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, তিনি ছিলেন আদ্যন্ত বিষণ্ণ এক মানুষ। অন্য অবনতি-বিষয়ে ভেবে আমি অধিক দুঃখী; আমাদের আনন্দেবিষাদে, খেলার মাঠে আর রাজনীতির মঞ্চে, সর্বত্র, সুক্ষ্মরসের পরিবর্তে সারা গায়ে এত-এত মোটা দাগ কীভাবে এসে পড়ল, তা বুঝতে পারি না, মানতেও পারি না।
হর্ষবর্ধন আর গোবর্ধন, দু’জনেই স্বেচ্ছায় হাজির হয়েছেন গোখেল রোডে, সেনাবাহিনীর রিক্রুটিং আপিসে, প্রধানত এই আশঙ্কার টানে যে, স্বেচ্ছায় সেখানে উপস্থিত না হলে পেয়াদা এসে ওয়ারেন্ট দেখিয়ে বাড়ি থেকে তাঁদের পাকড়াও করবে, এবং ওয়ারেন্ট অমান্য ক’রে তাঁরা যদি পালাবার কোনওরকম চেষ্টা করেন, তার ফল হবে আরও ভয়ানক; দুই ভাইয়ের নামে হুলিয়া জারি হবে। রিক্রুটিং অফিসারের প্রশ্নের মুখে পড়লেন প্রথমে হর্ষবর্ধন:
‘ “নাম?”
“শ্রীহর্ষবর্ধন।”
“বয়েস?”
“বিয়াল্লিশ।”
“পিতার নাম?”
“পৌণ্ড্রবর্ধন। মায়ের নাম বলব?”
“না। দরকার নেই। ঠিকানা?”
“চেতলা।”
“পেশা? মানে, কী কাজ করেন?”
“কাঠের কারবার।” ইত্যাদি, ইত্যাদি।
প্রথম পর্ব মোটামুটি নির্বিঘ্নেই উতরে যাচ্ছিল, অকস্মাৎ রিক্রুটিং অফিসারের একটা প্রশ্নে গোটা মৌখিক পরীক্ষাটিই একটা সঙ্কটের মুখে এসে পড়ে।
‘ “বাহিনীর কোন্ বিভাগে ভরতি হতে চান আপনি?”
“আজ্ঞে?” প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারেন না হর্ষবর্ধন।
“নানান বিভাগ আছে তো আমাদের। পদাতিকবাহিনী, গোলন্দাজবাহিনী, বিমানবাহিনী─”
“আমি একেবারে জেনারেল হতে চাই মশাই! মানে, সেনাপতিটতি।” জানান হর্ষবর্ধন।
“পাগল হয়েছেন!” রিক্রুটিং অফিসার না–বলে পারেন না।
“সেটা একটা শর্ত নাকি?” হর্ষবর্ধন জানতে চান,“জেনারেল হতে হলে কি পাগল হতে হয়?”
অবান্তর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অফিসারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না, এবার গোবর্ধনের ডাক পড়ে।
‘ “নাম?”
“গোবর্ধন।”
“বয়েস?”
“বত্রিশ। আর বাকী সব ঐ ঐ ঐ ঐ।” ’
বাঙলাভাষায় উচ্চমানের অগণিত হাসির গল্প লেখা হয়েছে। সেই সব গল্পকারের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ক’রেই বলা চলে, হর্ষবর্ধনের প্রতিপ্রশ্ন “মায়ের নাম বলব?”, সেনাপতি হবার পূর্বশর্ত সম্পর্কে তাঁর জিজ্ঞাসা, এবং গোবর্ধনের ঘোষণা “আর বাকী সব ঐ ঐ ঐ ঐ” থেকে মনুষ্যপ্রকৃতির সরলভাবের প্রতি যে প্রীতি ঝ’রে পড়তে দেখা যায়, তা অতিবিরল! একটি অন্য গল্পে শিব্রাম লিখছেন, ‘অ্যামবুলেন্স চাপা পড়ার মতো বরাত বুঝি আর হয় না। মোটর চাপা পড়া গেল অথচ অ্যামবুলেন্স আসার জন্য তর সইতে হল না ─ যাতে চাপা পড়লাম তাতেই চেপে হাসপাতালে চলে গেলাম সটান। এর চেয়ে মজা আর কি আছে?’
গল্পকার শিব্রাম চক্রবর্তীর প্রতি যাঁদের ভাবাবেগ তীব্র, তাঁরা প্রত্যেকেই কম ক’রে বিশ-তিরিশটি গল্প বারবার প’ড়ে সমস্ত সংলাপ মুখস্থ ক’রে ফেলেছেন। এটি, আমার কাছে, সামান্য কথা নয়। বিনি, আইভিদি, প্রাণকেষ্ট, বদ্যিনাথ, হেডমাস্টার হরিনাথবাবু, সহপাঠী ও হারমোনিয়মবাদক রহমান(‘আকাশের চাঁদ ছিল রে!’), বন্ধু ও খুড়্শ্বশুরভক্ত নকুড়, জোয়ারদার (‘ফুঁ দিতে দিতে ক্লান্ত হলে, তাই দিয়ে আমি মাঝে-মাঝে জোয়ারদারের পিঠবাঁধা ব্যান্ড্টা বাজিয়ে নিচ্ছিলাম’), এবং অবশ্যই, হর্ষবর্ধন ও গোবর্ধন ─ এতগুলি নিষ্পাপ মানুষের সঙ্গে যাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল, তিনি নিজেও যে সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত এক ব্যক্তি, এ-বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নেই। শিব্রাম চক্রবর্তীকে চাক্ষুষ করবার বহু আগে আমরা ‘শৈলবাবুর রেখায়’ তাঁকে চিনি, এটাই বা কে-কবে শুনেছেন? আর, ১৩৪ নম্বর মুক্তারাম বাবুর স্ট্রীটের সেই প্রবাদপ্রতিম মেসবাড়ি! সে তো গল্পেরই চরিত্র!
মনে পড়ে, আমাদের এক অসমসাহসী সহপাঠীর পিছু-পিছু আমরা কয়েকজন, কম্পিত হৃদয়ে সেই মেসবাড়ির সিঁড়ি বেয়ে উঠে শিব্রাম চক্রবর্তীর দুয়ারে উপস্থিত হয়েছিলাম। দুই পাল্লার বিশাল দরজা আমাদের সামনে, যা একইসঙ্গে খোলা এবং বন্ধ। বন্ধ বললাম এই কারণে যে, দুই পাল্লার দুই মধ্যপ্রদেশে, দু’টি কড়ায়, ঘরের বাইরে থেকে লাগানো অন্তত সাড়েসাতশো গ্রাম ওজনের একটা তালা ঝুলছে; এবং, একইসঙ্গে খোলাও বটে, কারণ ঘরের ভিতর থেকে ছিটকিনি দিয়ে দোর বন্ধ করার চেষ্টাই করা হয় নি, বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেও আমরা ঘরের ভিতরের অনেকটাই দেখতে পাচ্ছি। চৌকিতে শুয়ে রয়েছেন একজন বৃদ্ধ, মুখাবয়ব অস্পষ্ট। শ্রীমান সাহস তালাটা ধ’রে কড়া নাড়ল দু’বার, অল্প থামল, তারপর আবার নাড়ল বার-দুয়েক, দ্বিতীয়বার একটু জোরে। আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। বৃদ্ধ ভদ্রলোক মন্থর গতিতে বালিশ থেকে মাথা তুলে, আধেক খোলা এবং আধেক রুদ্ধ দুয়ারের পিছন থেকে আমাদের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। শিব্রাম চক্রবর্তী। চোখের ভাষায় অভ্যর্থনা ছিল না ঠিকই, কিন্তু তিনি যে আমাদের হাঁকিয়ে দেবেন, এমনও মনে হচ্ছিল না। আরও কয়েক পল প্রবল অস্বস্তিতে কাটবার পর, বালিশের নিচ থেকে এক গোছা চাবি বার করলেন শিব্রাম চক্রবর্তী, এবং চৌকি ত্যাগ ক’রে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। গায়ে, কব্জি পর্যন্ত আবৃত ফুলহাতা গেঞ্জি এবং ঈষৎ অবিন্যস্ত লুঙ্গি। ঘরের ভিতর থেকে হাত বাড়িয়ে, ঘরের বাইরে থেকে লাগানো তালা খোলা হল, তিনি একপাশে সামান্য স’রে দাঁড়ালেন, এবং আমরা ক’জন এন.সি.সি.-র শৃঙ্খলাপরায়ণ, সারিবদ্ধ ক্যাডেটের মতো ঘরে প্রবেশ ক’রে তাঁর পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। তিনি আমাদের বসতে বললেন, আমরা পাশের চৌকিতে গিয়ে একে-একে সন্তর্পণে বসলাম। শ্রীমান সাহস কথা বলতে শুরু করল।
চৌকির ওপরে আল্ভা এডিসনের সময়ের, কিন্ত তেজস্বী একটা বাল্ব ঝুলছে। আমি চোখ ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে একটা খোলা বইয়ের মতো ক’রে প্রখ্যাত রসজ্ঞ শিব্রাম চক্রবর্তীর ঘরখানা পাঠ করতে লাগলাম। ঘরের এক কোণে একটা জলের কুঁজো চোখে পড়ল; আর, হ্যাঁ, প্রবাদে পরিণত হওয়া সেই দেওয়াল, যেখানে জগৎসংসারে তাঁর পরিচিত সকলের নামঠিকানা লেখা আছে। পরিবেশ ততক্ষণে অনেকটাই সহজ হয়ে এসেছে, চৌকিতে পা ঝুলিয়ে ব’সে-থাকা প্রবীণ মানুষটির মধ্যে আমরা আমাদের প্রিয় লেখককে দেখতে পাচ্ছি, উনিও বুঝতে পারছেন, অর্বাচীনদের এই দলে, কেউ-কেউ তাঁর সমস্ত লেখা গুলে খেয়েছে। দেওয়ালটা কাছ থেকে দেখে আসার অনুমতি পেতেই আমরা চৌকি ছেড়ে হুড়মুড়িয়ে উঠে যখন এগিয়ে গেছি তখন তিনি অস্ফুটস্বরে বললেন কয়েকটি কথা, যা নতুন ক’রে সাজিয়ে নিলে এইরকমই কিছু একটা দাঁড়ায়: অনেক ঠিকানা্র পিছনে আজ আর মানুষ নেই, যারা আজও আছে, তারাও আমার সঙ্গে মুছে যাচ্ছে। ওই ধরনের স্বগতোক্তি দীর্ঘায়িত করা চলে না। আমরা উঠে-পড়ার তোড়জোড় শুরু করলাম, তিনিও বাধা দিলেন না। সেই পুরানো দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হল; আমরা সারিবদ্ধ ভাবে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হলাম, তালা চাবি তাঁর হাতেই ছিল, তিনি ওই একইভাবে, ঘরের ভিতর থেকে হাত বাড়িয়ে নিজেকে তালাবন্দী ক’রে, আমাদের দিকে পিছন ফিরলেন।
বিমর্ষ বোধ করলেই তাঁর লেখা আজও নিয়মিত পড়ি, যদিও কয়েক ছত্র এগোবার পরই বুঝতে পারি, সব বৃত্তান্তই ─ ‘আস্তে আস্তে ভাঙো!’, ‘খোকার ভবিষ্যৎ’, ‘পত্রবাহক’,‘মনের মতো বৌ’, ‘গোখলে গান্ধীজী এবং গোবিন্দবাবু’, ‘আলেকজাণ্ডারের দিগ্বিজয়’, ‘মেয়েরা হারাবেই’, ‘ছত্রপতি শিবজী’, ‘গদাইয়ের গাড়ি’, ‘আপনি কী হারাইতেছেন আপনি জানেন না’,‘হাওড়া-আমতা রেললাইন দুর্ঘটনা’ ─ এতগুলি বছর পরেও, মাথার এক কোণে রয়ে গেছে। শিব্রাম চক্রবর্তী তাঁর অনাড়ম্বর জীবনযাপন দিয়ে সাহিত্যের আদর্শ কেবল রক্ষা নয়, গৌরবান্বিত ক’রে গেছেন। আজকের মন নিয়ে, সেদিনের মেসের ঘরখানা লক্ষ ক’রে বুঝতে পারি, পূর্ণাঙ্গ জীবনের সঙ্গে কৃচ্ছ্রসাধনের অচ্ছেদ্য একটা সম্পর্ক আছে। লিখে, আলোচনায় অংশগ্রহণ ক’রে, আত্মপক্ষ সমর্থন ক’রে, এর নাগাল পাওয়া অসম্ভব; কেবল জীবনযাপনের দ্বারা একে প্রতিষ্ঠা করতে হয়, যেমন তিনি পেরেছিলেন। আমরা ওইভাবে ভাবি না আর, সেইজন্য আমাদের লেখা বহু যোজন এগোলেও, কোনওদিন, কোনওভাবে শিব্রাম চক্রবর্তীর নির্মল স্বভাব স্পর্শ করতে পারবে না।