
‘নমনীয় প্রত্যক্ষতা’ এ গ্রন্থে সার্থক শিল্পে পরিণত হয়েছে
পার্থজিৎ চন্দ
হিন্দোল ভট্টাচার্য’র ‘এসেছি রচিত হতে’ কাব্যগ্রন্থের পাঠ-পরাপাঠের পর বারবার মনে হতে বাধ্য গভীর দর্শন আশ্রিত এ গ্রন্থ কি শুধুই তত্ত্বচিন্তার বিন্যাস ধারণ করে রয়েছে? যে কোনও ডিসকোর্স’কে শিল্পে উত্তীর্ণ করার জন্য বিরল দক্ষতার প্রয়োজন। অস্বীকার করার উপায় নেই, হিন্দোল ঋজু গদ্যরীতিকে আশ্রয় করে যা লিখেছেন তার পরতে পরতে লুকিয়ে রয়েছে ডিসকোর্স তৈরি হবার উপাদান। কিন্তু হিন্দোল ‘ডিসকোর্স’ লেখেননি, সে লেখা হয়ে উঠেছে সার্থক শিল্প। শুধু সেটুকুই নয়, আধিপত্যবাদী বর্গ ও সংস্কৃতির বিপ্রতীপে একটি শিখাও জ্বলে রয়েছে এ কাব্যগ্রন্থের ভেতর। বহু জায়গায় হিন্দোল প্রবল রাজনৈতিক, কিন্তু তা যূথচারী মানুষের ক্ষমতা দখলের পাশবিক উল্লাস নয়।
গ্রন্থ- এসেছি রচিত হতে
কবি- হিন্দোল ভট্টাচার্য
সপ্তর্ষি প্রকাশন
১৫০ টাকা
প্রচ্ছদ- কুনাল সেন
শিল্প শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার অনুশীলন, একজন কবির যাত্রা প্রতিদিন স্বাধীন থেকে অধিকতর স্বাধীন জগতের দিকে যাত্রা। সেখানে প্রাকরণিক চতুরতা থেকে শুরু করে ফর্ম-সংক্রান্ত বহু বিষয়ই ‘আপাতভাবে’ তুচ্ছ হয়ে যায়। বিষয় ও প্রকরণ একে অপরকে আশ্রয় করে পরিস্ফূট হতে থাকে।
হিন্দোল ভট্টাচার্য’র সম্প্রতি প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘এসেছি রচিত হতে’ পাঠ করে এ ধারণা আরও পুষ্ট হয়। মানুষের শিল্প ও দর্শনের ইতিহাসে ক্ষুদ্রের সঙ্গে বৃহতের, সসীমের সঙ্গে অসীমের সম্পর্ক সন্ধান আবহমানের। স্রষ্টার কাছেও তা তীব্র কৌতুহলের ও রহস্যময়। কঠ-উপনিষদ থেকে শুরু করে এ সন্ধান আজও চলেছে। হিন্দোল ভট্টাচার্য’র এই কাব্যগ্রন্থেও সে খোঁজ বর্তমান, এই অনুসন্ধানই কাব্যগ্রন্থটির মূল সুর বহন করে চলেছে।
কাব্যগ্রন্থটির নাম ও গ্রন্থনামের কবিতাটি পড়তে পড়তে এক মুহূর্তের জন্য মনে পড়ে যেতে পারে ওক্তাভিও পাজ-এর বিখ্যাত কবিতা ‘ব্রাদারহুডঃ হোমেজ টু ক্লডিয়াস টলেমি’র তিনটি পঙ্ক্তি’র কথা। পাজ লিখেছিলেন, ‘আমিও লিখিত হচ্ছি / এবং ঠিক এ মুহূর্তে কেউ / আমাকে পাঠও করছে’। যদিও পরমুহূর্তেই আবিষ্কার করা যাবে, পাজ-এর সঙ্গে হিন্দোলের দর্শনগত পার্থক্য’ও রয়েছে, কারণ হিন্দোল লিখছেন, ‘এ পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও, একজনও আমায় পড়ার মতো না থাকলেও, আমায় রচিত হতে হবে’।
মহাজাগতিক বস্তুসমূহের সঙ্গে একাত্মতা ও সম্পর্ক আবিষ্কারের থেকেও হিন্দোল এ গ্রন্থে সন্ধান করেছেন প্রাত্যহিকতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিষয় ও ঘটনাসমূহের সঙ্গে তাঁর সংযোগকে। ফলে তিনি সন্ধান পেয়ে যান একটি গোধূলির, লেখেন, ‘ধানক্ষেতের যে দিকটায় বিষণ্ণ গোধূলি এসে পড়ে, আমি সেইদিকে দাঁড়িয়ে থাকতাম। দূর থেকে শুনতে পেতাম মায়ের ডাক – টুকুন, টুকুন, টুকুন… / ভাবছি, ছন্দ কি শুধু ছন্দেই রয়েছে? কবিতা কি শুধুই কবিতাই? অন্য কিছু নয়?’
হিন্দোলের কবিতায় ছন্দের ভেতর দিয়ে রেজাউল ও সরস্বতী নদীর সংযোগ ঘটে যায়, সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের এ নিদর্শন বাংলার নিজস্ব সম্পদ। কিন্তু হিন্দোলের তুলে ধরা প্রশ্নটি গূঢ়, তিনি তলে তলে মুছে দিতে চেয়েছেন গদ্য ও কবিতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা অনড় প্রাচীরটিকেও। এ কারণেও এই গ্রন্থ আমাদের অবশ্য পাঠ্য হয়ে ওঠার দাবি রাখে।
প্রবেশক-সহ এ কাব্যগ্রন্থের সত্তর’টি কবিতার অধিকাংশেই এক বাস্তবিক ‘আমি’র আশ্রয় নিয়েছেন হিন্দোল। সে ‘আমি’ অবলীলায় পেরিয়ে যেতে পারে একটি-দু’টি শতাব্দী, তাঁর সময়খণ্ড থেকে তাকিয়ে থাকতে পারে সে সব ঘটনা ও বস্তুর দিকে যাদের গায়ে সামগ্রিক বিস্মরণের শ্যাওলা জমেছে। মায়াভরা চোখে যে ‘আমি’ চেয়ে রয়েছে তার সঙ্গে ঘটনাক্রম বা বিষয়ের নিরাপদ দূরত্ব নেই। বরং সে নিজে প্রায় প্রতিটি ঘটনা ও বিষয়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে।
বহু পরিচিত ‘আর্ম-চেয়ার নস্টালজিয়া’ থেকে সৃষ্টি হওয়া কবিতার থেকে হিন্দোলের এ কবিতাগুলি বহুদূরের। শুধু তাই নয়, ডিকলোনাইজেশন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাবার সময় ফিকে হয়ে আসা উপনিবেশিক প্রবণতা ও স্থানিক বিষয়কে কেন্দ্র করে বহু সাহিত্য রচিত হয়েছে। বাংলাভাষায় এমন উদাহরণ বিরল নয়; হিন্দোলের ‘এসেছি রচিত হতে’ এক্ষেত্রে বড় ব্যতিক্রম। যে মহানগরের স্মৃতি সেপিয়া টোনের মতো ফিকে হয়ে আসছে, তার গলি-কানাগলির রহস্যময় অবস্থানের সঙ্গে হিন্দোল মিশিয়ে দিয়েছেন গূঢ় দার্শনিক নানা প্রশ্ন। গভীর জিজ্ঞাসার সঙ্গে মিশে রয়েছে ব্যক্তির অন্তর্গত বিষাদ ও আনন্দ।
বাংলা কবিতার ছন্দের রীতিসিদ্ধ চলনের বদলে হিন্দোল আস্থা জ্ঞাপন করেছেন ছন্দস্পন্দনের উপর। শব্দ ব্যবহারের ‘রিভার্স অর্ডার’ প্রায় নেই বইটিতে, বিন্দুমাত্র দুষ্প্রবেশ্যতা নেই কবিতাগুলিতে। অথচ আশ্চর্য দক্ষতায় কবি গূঢ় প্রশ্নগুলিকে কূটাভাসের ভেতর জাগিয়ে রাখতে পেরেছেন। তিনি এ কলকাতার ভেতর জেগে থাকা ছোট মন্দির দেখলেন, দেখলেন, ‘অন্নপূর্ণার থালা কখনই শূন্য থাকে না। সন্ধেবেলায় কখন যে কে এসে ছোটো একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে যায়, তাও নজর করে না কেউ’ (পুজো)। কিন্তু হিন্দোলের মতো উল্লেখ্য ও গুরুত্বপূর্ণ কবি শুধুমাত্র এ পর্যবেক্ষণ নিয়ে তৃপ্ত থাকবেন না, সেখান থেকে জন্ম নেবে শিল্পের মহারহস্য ও জিজ্ঞাসা। ঠিক সেটিই ঘটে যখন কবিতাটির শেষে আমরা পাই, ‘মহাকাল ও মহামায়া তাকিয়ে থাকেন একে অপরের দিকে। দীর্ঘশ্বাস পড়ে ধীরে। / মহামায়া জানেন, অন্ধকার, ঠিক অন্ধকার নয়। আলোও নয়, ততখানি আলো’।
এ কাব্যগ্রন্থ সম-সময়ের কর্কট-প্রবণতা ও বিশেষ বিশেষ কারণে ইতিহাসের যে নির্মিত ন্যারেটিভ তার বিপরীতে জেগে ওঠা নতুন চর ও প্রতিরোধ’ও বটে। হিন্দোল ইতিহাসবোধ ও শুভবোধকে আশ্রয় করে তার বাইরে অবস্থিত পথটিকে চিনিয়ে দিয়েছেন। গত সাতশো বছর ধরে বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে কী কী ঘটেছে কয়েকটি শব্দের আঁচড়ে হিন্দোল তা তুলে ধরছেন, লিখছেন, ‘বৌদ্ধরা পাড়ি দিয়েছে অন্য কোথাও। মাঝেমাঝেই দক্ষিণ থেকে আসছে মারাঠা বর্গীরা। আর উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে নিষ্ঠুর যবন। কাছেই পীরবাবার আস্তানা। সেখানে শান্তিকামী কিছু যবন সন্ধ্যা অতিক্রম করেন। তাঁদের চোখে করুণা’ (কালভৈরব)।
আর এই গভীর বোধ থেকে, বীক্ষণ থেকে সৃষ্টি হয় হিন্দোলের শিল্প, ‘…যখন আমায় কোলে তুলে নিলেন মন্দিরের পুরোহিত রমাকান্ত, যখন আমার সামনে গান গেয়ে যেতেন পীর বদরুদ্দিন মহম্মদ, আমি একটা কথাই বলতে চাইতাম। / মহাকাল নির্বিকার। কিন্তু তাঁর স্মৃতি, নির্বিকার নয়’।
হিন্দোলের এই কাব্যগ্রন্থ পড়তে পড়তে মনে হয় পোস্ট-সেকুলার যুগে, যখন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ফিরে আসছে ‘ফোবিয়া’র সমনাম হয়ে তখন একজন কবিই আবিষ্কার করতে পারেন, সন্ধান দিতে পারেন ভিন্ন বাস্তবতার। হিন্দোলের খোঁজ সন্ধান পেয়েছে তেমনই জাকিরদা, মঈদুলের। মঈদুল মরেনি, সে ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক, তার ‘গ্রেট গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার হিন্দু ছিলেন। রীতিমতো তান্ত্রিক’।
সম-সময়ের বাংলা কবিতায় মানুষের বেঁচে থাকার অনুপম শিল্প এমন শিল্পিত আকারে কম’ই ধরা পড়েছে। দাঙ্গা থেকে দেশভাগ- উদ্বাস্তু হয়ে ওঠা মানুষের বেঁচে থাকার আশ্চর্য সবুজ সংগ্রাম, জমিদখলের মাঝখানে বস্তির জীবন- হিন্দোলের লিখিত শব্দের ভেতর দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে মনে হয় তবুও মানুষের বেঁচে থাকার কাছাকাছি কোথাও ভোরবেলা ফুটে থাকে আলো-জবাফুল।
মহাকালের স্মৃতির ভেতর জমে থাকা স্তর ও প্রকোষ্ঠগুলির সন্ধানে এ-কাব্যগ্রন্থে অবিরত নিজেকে সংযুক্ত করে করে গেছেন হিন্দোল। যে কলকাতার ভিতর আজও অন্ধ-পিসিমা চেয়ে থাকেন ‘নকশাল’ ভ্রাতুষ্পুত্রের বাড়ি ফিরে আসার দিকে, রামতনু বসু লেনে আকাশবাণীর আবহ ও উনুনের ধোঁয়া মিশে যায়, নর্মান বেথুনের সমাধিক্ষেত্রে – খালাসিটোলা – শ্যামবাজার জেগে থাকে, সে কলকাতার দিকে তাকিয়ে থাকেন কবি।
কাব্যগ্রন্থটির কাছে বারবার ফিরে এসে মনে হয় শিল্পের জরায়ুর মধ্যে যে পবিত্র শিখা জ্বলে তার সন্ধান পান একমাত্র একাকী, নির্জন, নারকীয় বাস্তবতার কাছে বারবার প্রত্যাখ্যাত হওয়া, অপমানিত হওয়া মানুষ। পোস্টট্রুথের এ পৃথিবীতে একমাত্র কবির প্রজ্ঞাই তাকে দিয়ে উচ্চারণ করিয়ে নিতে পারে, ‘অথবা চোখের জলই সেই ঈশ্বর, যার জন্য মানুষ অপেক্ষা করে’।
হিন্দোল ভট্টাচার্য’র ‘এসেছি রচিত হতে’ কাব্যগ্রন্থের পাঠ-পরাপাঠের পর বারবার মনে হতে বাধ্য গভীর দর্শন আশ্রিত এ গ্রন্থ কি শুধুই তত্ত্বচিন্তার বিন্যাস ধারণ করে রয়েছে? যে কোনও ডিসকোর্স’কে শিল্পে উত্তীর্ণ করার জন্য বিরল দক্ষতার প্রয়োজন। অস্বীকার করার উপায় নেই, হিন্দোল ঋজু গদ্যরীতিকে আশ্রয় করে যা লিখেছেন তার পরতে পরতে লুকিয়ে রয়েছে ডিসকোর্স তৈরি হবার উপাদান। কিন্তু হিন্দোল ‘ডিসকোর্স’ লেখেননি, সে লেখা হয়ে উঠেছে সার্থক শিল্প। শুধু সেটুকুই নয়, আধিপত্যবাদী বর্গ ও সংস্কৃতির বিপ্রতীপে একটি শিখাও জ্বলে রয়েছে এ কাব্যগ্রন্থের ভেতর। বহু জায়গায় হিন্দোল প্রবল রাজনৈতিক, কিন্তু তা যূথচারী মানুষের ক্ষমতা দখলের পাশবিক উল্লাস নয়।
বরং এ গ্রন্থ একক মানুষের শান্ত অভিযাত্রা ও পর্যবেক্ষণের নিরাভরণ প্রকাশ।নস্টালজিয়া, জীবন ও যাপনের টুকরো টুকরো ছবি জুড়ে জুড়ে তৈরি হয়েছে মহা-ক্যানভাস। কাহিনির ছায়া শুশুকের মতো ঘাই দিয়ে আবার ডুবে গেছে জলের তলায়। কোনও পরিণতির কথা বলতে চায়নি এ কাব্য; একটি ‘জার্নি’ ও তার বাঁকে বাঁকে ফুটে থাকা মৌলপ্রশ্নগুলিকে ধরে রাখতে চেয়েছে শুধু।
সাম্প্রতিক বাংলা কবিতায় এ কাব্যগ্রন্থ এক উজ্জ্বল সংযোজন। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত কথিত ‘নমনীয় প্রত্যক্ষতা’ এ গ্রন্থে সার্থক শিল্পে পরিণত হয়েছে।
লেখাটি যদি ভালো লাগে, আবহমানে নিজের ইচ্ছেমতো ফোন পের মাধ্যমে
অবদান রাখতে পারেন, এই কিউ আর কোড স্ক্যান করে। ফোন পে করুন 9051781537
অথবা স্ক্যান করুন পেমেন্টের লিংক
কবিতার বইয়ের এমন গভীর আলোচনা আজকাল কমই চোখে পড়ে। সমালোচক বইটির অ্যানাটমি করেছেন সুচারুভাবে, হাড়-মজ্জায় উঁকি দিয়েছেন, বলা যায়।