জগাদার গবেষণাপাতা:চতুর্থ পর্ব;একটি ভাদুগাছ ও হারানো সরস্বতী
শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
এই যে বাগদেবীর আরাধনার দিন।শুধুই নেতিনেতি করে যাব নাকি মরণ!মনোবিদরা বলেন সব হলো দেখার ধরন।কালো চশমা পরলে কালো,আর সাদা পরলে সাদা।তাই একটি সত্যিকারের মানুষের কথা বলি এইবার যাঁর এই গড্ডলিকা বিরোধী সাঁতার শেষমেশ আমার ভিতরের 'দিওয়ার' খুলে রেখে দিল এতটুকু হলেও।বইটা পেয়েছিলাম ধ্যানবিন্দুতে।গ্রন্থপরিকল্পনা ও রূপায়ণ অভীকদার।দেবল দেবের "বিচ্যুত স্বদেশভূমি"।শুরুতেই রয়েছে আত্মচয়ন।"
বহু কষ্টে ব্যাঙ্কে ধার দেনা করে একটা ছোট্ট গাড়ি কিনেছিলাম চাকরিতে ঢোকার পর।নিতান্তই সাধারণ গাড়ি।বিলাসিতা করতে নয় অবশ্য।ঘর থেকে চাকুরিস্থল যাওয়াআসা,ঘরের লোকেদের স্কুল কলেজ,বাবা মায়ের চিকিৎসাজনিত বিপদ আপদ।সাত বছর লোনের ইএমআই গুণতে হয়েছিল।আমিই চালাতাম।ড্রাইভার রাখবার পয়সা ছিল না।সকলে বারণ করেছিল।বলেছিল বিপদে পড়ব।চাকরিটা পাকা হয়নি তখনও।তার উপর সংসারের চাপ,তেল খরচ।সেইসব পাত্তা না দিয়েই ফেললাম।সোনালি রঙের মারুতি অল্টো।তখন আমাদের গ্যারেজে বাবার বুলেট গাড়িটা পড়ে থাকত।বাবা একদিন বলল,বেচে দেবে।বাজারে নতুন মডেল বের হয়েছে।কে আর পুরনো বুলেট কিনতে চাইবে?তায় আবার তাকে সারাতে খরচ।লোহার দরেই বেচা হবে।আমি বেচতে দিলাম না।আসলে একটা গল্প শুনেছিলাম অনেক দিন আগে।এক গুজরাটি কোটিপতি এখনও তার বাবার ল্যামরেটা স্কুটার রেখে দিয়েছেন।ওই স্কুটারে চড়ে আজ যে বানিজ্যগোষ্ঠী ভারতের তেল-জল-নুন-জমি-আকাশ যখন তখন কিনে ফেলছে,সেই গোষ্ঠীর প্রথম পুরুষ ঘরে ঘরে গিয়ে পাঁচ দশ টাকা নগদ নিয়ে সুদের ব্যবসা শুরু করেছিলেন।একটা সাক্ষাৎকারে গুজু বলেছিলেন,ওই স্কুটারটা ওনাকে ওঁর অতীতকে ভুলতে দেয় না।কে জানে,প্রতিটি বাঙালি মধ্যবিত্তর ভিতর ভিতর সেই যে একটা চাঁদসদাগর ভাব রয়ে গেল,আর সেখানে কলপ দিয়ে গেল রায় আর কুশারি পরিবার,সেও বোধহয় একটু একটু পুরনোকে আঁকড়ে নিজেকে বোঝাতে চাইত ‘দিওয়ার’ সিনেমার ঢঙে।’মেরে পাস মা হ্যায়’।
সোনালী হলুদ গাড়ি দুবছর ঘুরতে না ঘুরতেই ধুসর হল।রোজ দুঘন্টা পথে গাড়ি নামাবার আগে তিনঘন্টা গাড়ি ধুতে লাগে।কিন্তু আমার সেসব দিব্বি লাগত।একদিন সার্ভিস সেন্টার মিষ্টিগালে টোল দিদিমণি বলল,”স্যার।আমাদের ভালো এক্সচেঞ্জ অফার আছে।গাড়ি বদল করে নিন।”আমি বললাম,”কেন?দিব্বি তো চলছে গাড়ি।”গাড়ি ঘিরে কতো স্মৃতি।কতো বিখ্যাত মানুষের স্পর্শ রয়েছে ওই গাড়িতে।মেয়েটা ঝিলাম নদীর মতো কলকল হেসে বলল,”না আসলে সাত বছর হতে চলল তো তাই।”খানিক রেগে গিয়ে বললাম,”পুরনো হয়ে গেলেই জিনিস বদলে নিতে হয় বুঝি?তাহলে তো বাপমা পুরনো হলেও পালটাতে হবে দেখছি।বৌয়ের কথা বাদই দিলাম।”আজও একথা শুনবার পর ঝিলামের সেই কেলেঘাই হয়ে যাবার ভয়ানক পরিবর্তন ভাবলে শিউরে উঠি।প্রতিবাদে বুকের আগুন নিভলেও শেষরক্ষে হয়নি।একদিন গাড়িটা মাঝপথে বসে গেল।অথচ দিব্বি সার্ভিসিং হয়।চাকা পালটাই,ব্যাটারি পালটাই।গাড়িমিস্ত্রি বলল,”পুরানা হো গ্যায়া।বহত খরচ।বেচ দিজিয়ে।লোন লে কর ন্যায়া লিজিয়ে।”খরচের বহর শুনে সত্যিই এক সপ্তাহ ঘুম এল না।চালতার অম্বল জিভে চিরেতার রসের মতো লাগল।তারপর একদিন বেচে নতুন গাড়ি নিলাম।আমার আর ল্যাম্রেটার মালিক থাকা হলো না।কী করে হবে।নদী জল হাওয়া বাস্তুর একটা ব্যাপার আছে তো নাকি।যখনতখন গুজু হব,চাঁদসদাগর হব বললেই হলো।মনকে বোঝালাম শশী কাপুরের ঢঙে।”মেরে পাস….”।
মাও কাছে থাকল না।শরিকি কোন্দল।মা বাবা চলে গেল অপরপক্ষে।একা হয়ে গেলাম।ন্যালাক্ষ্যাপার মতো বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়াই।ভাঙাচোরা রাজবাড়ির ছবি আঁকি।দেওয়াল জুড়ে আধখানা আঁকা সরস্বতীর ছবি দেখে মনে মনে রোমাঞ্চিত হই।তারপর দুবছর বাদে সেখানে এসে দেখি কোথায় ঠাকুরদালান,নহবতখানা।বড় বড় মার্বেলে লেখা,”রাজবাড়ি এনক্লেভ”।আটটা টাওয়ার।স্যুইমিং পুল,জিম,বার,ক্লাব হাউজ।রাজা ধুতি পাতলুন ছেড়ে থ্রি কোয়ার্টার অ্যাসিড ওয়াস ধরেছেন।’কালের কাল,মহাকাল’।প্রোমোটার চণ্ডীদা প্রতি দুমাসে একবার তারাপীঠ যাবেই।আমাকে বোঝায়।আমরা তো নধর।পুরনো পুরনো রাখবার বাতিক রাখবার বিলাসিতা আমার মতো পেটরোগা বাঙালির মানায় না।কিন্তু কী করি।ওই যে বললাম।জিনের প্রবলেম।পকেটে সুলেখা কোম্পানির ঝরণা কলম নিয়ে ঘুরি।ভাবতে থাকি এনক্লেভ নাহয় না আটকানো গেল।কিন্তু ওই যে ছোটবেলায় যা যা বাপমা শেখালো,সেগুলো?আবৃত্তির আসরে শোনা ‘চাবি’ কবিতাটা?পাড়ায় লাইব্রেরি নেই।কলেজ স্ট্রিট গড়িয়াহাটে পুরনো বই দোকান নেই।ভিতর থেকে শশীকাপুর প্রাণপণে বলে ওঠে,”আব্বে শালা।ভুলনা মাত।তুমহারে পাস….”।
আজ চারপাশে সরস্বতী পুজো।থুড়ি।একি বললাম আবার।মধ্যযুগীয় চিন্তার মতো।সরস্বতীর প্রয়োজন রাজা ভ্যালেন্টাইন মিটিয়ে দিয়েছেন।বিখ্যাত বুদ্ধিজীবিরা এই বসন্তপঞ্চমীর নাম রেখেছেন,”বাঙালির ভ্যালেন্টাইন ডে”।আহা,প্রেম ছাড়া কীই বা আছে।দুপুর ঠাকুরপো আর রাতের রাণু বৌদি।এছাড়া আর কীই বা আছে।পেচোদা হলে বলত,”আব্বে সহজিয়া চার্বাক হ হতভাগা।”‘রাজবাড়ি এনক্লেভ’র ঠিক কোন দেওয়ালে মেয়েটা সরস্বতীটা এঁকেছিল ভাবতে আপ্রাণ চেষ্টা করি।সিনেমাল অমিতাভ বচ্চন দাঁত বের করে বলেন,’তুমহারে পাশ ঘোড়ার ডিম হ্যায়’।এই যে এইসব লিখছি এতেও কীই চাপ কম?রক্তচাপ বলে একটা ব্যাপার আছে তো নাকি?এই চাপ আমেরিকার উনচল্লিশতম প্রেসিডেন্ট নোবেলবিজেতা জিমি কারটারকেও ছেড়েছে নাকি?আমেরিকার নৈতিক সংকট আলোচনা সম্পর্কিত বই ‘আওয়ার এনডেঞ্জার্ড ভ্যালুজ’এ স্বীকার করেছেন তিনি অকপটে।সমকামিতা আর এইআইভি প্রসঙ্গে বলতে বলতে বাইবেল টেনে পুরনো মানবিকতার সূত্র টেনে এক প্রকাশ্য সাংবাদিক সম্মেলনে বলতে গিয়েছিলেন,”অপরাধকে ঘৃণা করো।অপরাধীকে নয়।”এই কথা বলবার পরে পরেই আরেকটু হলেই ভোটা হারতে বসেছিলেন।এইসব দেখেশুনে আজকাল আমার ভিতর থেকে শশীকাপুর আর অভিতাভ দরজা বন্ধ করে চুপ করে বসে থাকেন।কিছুই বলেন না মুখে।দিনকাল ভালো নয়,কখন কোথা থেকে শনির দৃষ্টি পড়ে যায় ।
এই যে বাগদেবীর আরাধনার দিন।শুধুই নেতিনেতি করে যাব নাকি মরণ!মনোবিদরা বলেন সব হলো দেখার ধরন।কালো চশমা পরলে কালো,আর সাদা পরলে সাদা।তাই একটি সত্যিকারের মানুষের কথা বলি এইবার যাঁর এই গড্ডলিকা বিরোধী সাঁতার শেষমেশ আমার ভিতরের ‘দিওয়ার’ খুলে রেখে দিল এতটুকু হলেও।বইটা পেয়েছিলাম ধ্যানবিন্দুতে।গ্রন্থপরিকল্পনা ও রূপায়ণ অভীকদার।দেবল দেবের “বিচ্যুত স্বদেশভূমি”।শুরুতেই রয়েছে আত্মচয়ন।”বন্দে পিতরৌ জয়ামরদেবৌ যাভ্যামিন্ধিতা জ্ঞানৈষণা মে।”এই বইয়ের পাতায় জানতে পারলাম লেখকের এক অসামান্য সাধনার কথা।সমস্যা তো ছিলই।গাড়ি বাড়ি যখন ছাড়েনি,সেই মহাকালের প্রোমোটার গাছ পাখপাখালি ছাড়বে কেন?লেখক আক্ষেপের সঙ্গে বলছেন,”বনের আধুনিক অর্থ বদলে গিয়েছে,তার জৈবিক উপাদান এবং ব্যবহারিক উপযোগিতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে।”লেখক বলছেন বাংলার অনেক জায়গার নামের আড়ালে লুকিয়ে থাকা গাছটিই হয়তো কেউ কখনও দেখেননি।দেখার আগেই নিশ্ছিন্ন হয়ে গেছে অপ্রয়োজনীয় পুরনো হবার দোষে।যেমন ‘ধ’ গাছ।’পিঙ’ গাছ।”অর্থসর্বস্ব আধুনিকতার প্রসার এই সংস্কৃতিকে হঠিয়ে দিয়েছে।”গ্রামের ঘরেঘরে তাই আজ শুধুই শাল টিক মেহগিনি।এর মাঝেও লেখক লেখক একটি বিরলতম গাছকে সংরক্ষণ করতে পারলেন তার কাহিনী লিখেছেন তিনি ‘ভাদুর গপ্পো’ গদ্যে।গবেষক লেখক লুপ্তপ্রায় এই গাছটিকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছেন শেষমেশ ওড়িশার বসুধা প্রাঙ্গণে।গাছটির প্রজননে একটি জটিলতা ছিল।লেখক বলছেন,”অন্য অনেক গাছের মতন,ঐ গাছটির ফল কোনও একটি পশু বা পাখি না খেলে,তার পেট থেকে বীজটি জারিত হয়ে না বেরোলে অঙ্কুরোদ্গম হবে না।”টিস্যু কালচার ব্যর্থ হল।কোন সে পশু?অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানা গেল সেই পশুটি ‘ভাম’।দেবল দেবের ‘ভাদুর গপ্পো’ পড়তে পড়তে হারিয়ে যাওয়া সোনালী মারুতি অল্টো গাড়ি খুঁজে পাই।বাবার পুরনো জঙধরা বুলেট পিছু ডাকতে থাকে।মেয়েটার দেওয়ালের আঁকা ছবি হাতছানি দেয়।শশীকাপুরের গলা দিয়ে রামকুমার চট্টোপাধ্যায় ভেসে আসে।”দাঁড়াও শমন।আর কিছু ক্ষণ।কিছু কাজ আছে বাকি।”