চিন্তার চিহ্নমালা ১৬ <br /> সন্মাত্রানন্দ

চিন্তার চিহ্নমালা ১৬
সন্মাত্রানন্দ

বাইরের পৃথিবীতে সেই সূর্যকুণ্ডতীর আর সূর্যমন্দির খুঁজে না পেলেও নিজের মনের ভিতর তা গড়ে নিতে বাধা কোথায়? মানুষের ভিড়ের মধ্যে, যেখানে নানা মতের সংঘর্ষ, পারস্পরিক আক্রমণ, উত্তপ্ত বাগ্‌বিনিময়, সাংসারিক জটিলতা চলছে, এমনকি সেখানেও কখনও কখনও আমি চলে যাতে পারি সেই নিভৃত আকাশে তবে একা একা অনায়াসে। চারিপাশের শব্দসমুদ্র তখন নিভে যেতে পারে এক লহমায়। আমি তার মধ্যে আছি, অথচ নেই। আমার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে না কেউই। বাইরে কিছু একটা চলছে, তার হালকা আভাস, অল্প একটু আলো, দুয়েকটা শব্দের ওড়াউড়ি মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে ঢেউ তুলেই নিভে যাবে। আমার ভিতরে তারা ঢুকতে পারবে না।

অভিসারী, অপসারী

অবন ঠাকুরের ‘রাজকাহিনী’ মনে আছে? সেই যে বিশাল সূর্যকুণ্ডতীরের নির্জন সূর্যমন্দিরের নিঃসঙ্গ ব্রাহ্মণের কথা? সূর্য যেমন সমস্ত আকাশে একা, সূর্যের উপাসক সেই ব্রাহ্মণও তেমনই একা, তেমনই নিঃসঙ্গ ছিলেন। অবন ঠাকুরের আঁকা সে ছবি শব্দ দিয়ে গড়া নয়, শব্দশূন্যতা দিয়েই আঁকা। সেই ছবিটি মাঝে মাঝে মাথায় ভর করে। অমন একটা জনহীন মন্দির যদি থাকত কোথাও, চারিপাশে একটি মানুষও থাকত না, এত বৃদ্ধ হয়ে যেতাম আমি, স্মৃতি এমন দুর্বল হয়ে যেত যে অতীতের কোনো মানুষের মুখ, পুরোনো কোনো অভিজ্ঞতাই আর মনে পড়ত না আমার, তবে বেশ হত। সেই নিভৃত মন্দিরে সূর্যের পূজারি আমি একলা। একপাশে একটা পাতায় ছাওয়া কুটির থাকত, নিজের মতো দিনান্তে একবেলা দুটি ফুটিয়ে খেতাম আর ওই মন্দিরে ভোরে, প্রভাতে, সন্ধ্যায় আর রাত্রিতে পূজা, আরতি, ভোগনিবেদন করতাম। একটি অতি প্রাচীন পুথি, বহু জায়গা কীটদষ্ট, বহু জায়গায় অক্ষর গলিত হয়ে গেছে, জ্যোতির্বিদ্যার দুষ্প্রাপ্য কোনো পুথিই হবে সেটা। এর উপর আমি একটা সংক্ষিপ্ত টীকাই রচনা করতে চাইছি হয়তো। মধ্যনিশীথে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে সেই নির্জন পাতার কুটিরে বসে তুলট কাগজের উপর ময়ূরপুচ্ছপ্রান্তিক লেখনী দিয়ে আমি যেন লিখে চলেছি খসখস খসখস… রচনায় দ্রুততা থাকবে, কেননা আমাকে তো রাত্রে সামান্য ঘুমিয়ে আবার উঠে পড়তে হবে। ব্রাহ্ম মুহূর্তে সূর্যদেবতার মঙ্গলারতি করতে হবে যে!

ভোরবেলা আমি না আরতি করলে সবিতৃদেব তাঁর সাত ঘোড়ার রথে চেপে আকাশ-পরিভ্রমণে বের হতে পারবেন কীভাবে? আমি বোধিশঙ্খে সূর্যের উদ্দেশে একটি বিশেষার্ঘ্য স্থাপন করার পরেই তো তিনি সপ্তাশ্ববাহিত রথ বের করবেন। সেই রথের ঘোড়ারা সব আলো দিয়ে গড়া। তাদের কেশরে বিস্ফুলিঙ্গ, নিঃশ্বাসে বিদ্যুৎ স্ফুরিত হয়। সাতটি বৈদিক ছন্দের নামে সেই সাত ঘোড়ার নাম। অনুষ্টুপ, ত্রিষ্টুপ, গায়ত্রী, বৃহতী, জগতী, পংক্তি আর উষ্ণিক। সেই সব জ্যোতিরাশ্ব, প্রভারথ আর রথারূঢ় সূর্যদেবের দেহ হতে দশ দিকে আলোর কিরণ বিচ্ছুরিত হবে। তাই তো গ্রিকরা সূর্যকে ডাকতেন হেলিয়স নামে। সেই কিরণমালায় পৃথিবী উদ্‌বোধিত হবে। দিনকরের সেই অর্চিষ্মান আবির্ভাবের ভিতর আমি একাকী করজোড়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকব; আদিত্যদেবের কণ্ঠমালা হতে একটি পলাশ খসে পড়বে আর খসে পড়া সেই আগুনের শিখার মতো ফুল কুড়িয়ে এনে আমি রাখব আমার টীকাপুথির পৃষ্ঠার উপর—ঠিক সেইখানে, যেখান অবধি লিখে কাল রাতে ঘুমোতে গিয়েছিলাম।

এমন হলে বেশ হয়। বাইরের পৃথিবীতে সেই সূর্যকুণ্ডতীর আর সূর্যমন্দির খুঁজে না পেলেও নিজের মনের ভিতর তা গড়ে নিতে বাধা কোথায়? মানুষের ভিড়ের মধ্যে, যেখানে নানা মতের সংঘর্ষ, পারস্পরিক আক্রমণ, উত্তপ্ত বাগ্‌বিনিময়, সাংসারিক জটিলতা চলছে, এমনকি সেখানেও কখনও কখনও আমি চলে যাতে পারি সেই নিভৃত আকাশে তবে একা একা অনায়াসে। চারিপাশের শব্দসমুদ্র তখন নিভে যেতে পারে এক লহমায়। আমি তার মধ্যে আছি, অথচ নেই। আমার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে না কেউই। বাইরে কিছু একটা চলছে, তার হালকা আভাস, অল্প একটু আলো, দুয়েকটা শব্দের ওড়াউড়ি মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে ঢেউ তুলেই নিভে যাবে। আমার ভিতরে তারা ঢুকতে পারবে না।

অনেকে বলবেন, অনেকে বলেনও, এ হচ্ছে পলায়নপরতা। দায়বোধ থেকে, জীবনের কর্তব্যকর্ম থেকে, মানুষের সংসার থেকে এ এক ভীরু পলায়ন। কিন্তু সেক্ষেত্রে আমি বলব, কে কোথা থেকে পালিয়েছে, সেকথাটাই আগে তবে স্থির হোক। ভিড়াক্রান্ত মুখর জীবন থেকে আমি যদি পালিয়েছি খানিকক্ষণ অন্তরের নিভৃত মাজারে প্রাচীন কোনো মুরশেদের সমাধির পাশে ধূপ আর চিরাগ জ্বালবার জন্য, তাহলে হে মানুষ! তুমি যে প্রতিনিয়ত পালিয়ে যাচ্ছ নিজের থেকে ক্রমাগত জনসমাগমের ভিতর, সংসারের কূট জটিলতার ভিতর, তার কী হবে? আমি যদি পলাতক হই, তবে তো তুমি চিরপলাতক! অসংশোধনীয়ভাবে পলাতক। তোমার সাহস নেই নিজের মুখোমুখি দাঁড়াবার, নিজের স্খলন-পতন-ত্রুটিগুলির মুখোমুখি হওয়ার, একান্তে তাদের মোকাবিলা করার। তুমি যদি নিজের কাছে নিজে এতই অপ্রিয় হও, নিজেকে তুমি যদি এতই কম ভালোবাসো, তাহলে তুমি আশা করো কী করে যে অন্যরা তোমাকে ভালোবাসবে? নিজেকে তুমি সহ্য করতে পারো না নিজেই, অথচ তুমি চাইছ, অন্যরা তোমাকে সহ্য করুক। আর নিজেকে তুমি যখন এতটাই অপছন্দ করো, যার ফলে দিনের মধ্যে একবারও একান্তে নিজের মুখোমুখি হতে চাও না, তখন কেন আবার তুমি সমাজের মধ্যে আত্মপ্রতিষ্ঠা চাইছ? কেন প্রতিটি খেলায় জয়ী হতে চাইছ? এ জয় তুমি ছিনিয়ে আনতে চাইছ কার জন্যে? নিজের জন্যে? যে-নিজেকে তুমি ভালোবাসো না? নাকি তুমি এখন বলবে সেই আদ্যিকালের বস্তাপচা কথাটা:নিজের জন্য নয়, তুমি জয় ছিনিয়ে আনতে চাইছ সবার জন্যে, তোমার এ জয় আসলে মানবতার জয়? মানবতা চেয়েছিল তোমার কাছে হাত পেতে? বলেছিল, জয় এনে দাও মেলা থেকে, জয় খাব?

বলেনি। কেউ তোমাকে কিচ্ছু বলেনি। কিচ্ছু চায়নি। তুমি নিজে নিজেই খোয়াব দেখেছ, সবাই যেন তোমাকে চাইছে। সবাই যেন তোমার কাছে চাইছে। তারপর মানুষের ওষ্ঠে উচ্চারিত দুটো চারটে কথা শুনে তুমি ভেবেছ, তোমার স্বপ্নটা আসলে বাস্তব। তারপর থেকেই শুরু হয়েছে তোমার ‘ইন্দ্রধনু ধরিবার ক্লান্ত আয়োজন’। এই যে তোমার আবাল্যচর্চিত অনুপম বাচনের রীতি ও কৌশল, এই যে পুষ্পিত শব্দ সাজানোর অভ্যাস, এ সবের দ্বারা তুমি আড়াল করতে চাইছ কাকে? মা কৌশল্যা, তোমার পেটের কথাটি খোলসা করে বলো দেখি! তুমি আজন্ম স্বাপ্নিক, তুমি সকলকে নিয়ে একটি অলীক নগরের স্বপ্ন দেখে চলেছ আর সেই স্বপ্ন সাকার হচ্ছে না কেন, এই বলে আক্ষেপ করে চলেছ। চারিপাশের সমস্ত মানুষের উদ্দেশে অভিসম্পাত বর্ষণ করছ, কেন তারা তোমার স্বপ্নের মতো হল না, এই তোমার আক্ষেপ। তুমি আড়াল করতে চাইছ নিজেকে। নিজের কাছ থেকে নিজে পালিয়ে যাওয়ার ভীরুতাকে। পলায়নপর কে? পলায়নপর তো তুমিই! তুমিই তো পালাচ্ছ প্রতিদিন নৈঃশব্দ্য থেকে শব্দে, প্রেম থেকে অপ্রেমে, জ্ঞান থেকে অজ্ঞানে, আত্ম থেকে পরে, প্রকৃত আনন্দময় জীবন থেকে নিরানন্দ মিথ্যা জীবনের দিকে।

তার চেয়ে কত ভালো হত, যদি পৃথিবীর এই রণ-রক্ত-সফলতা-নিষ্ফলতা থেকে সরে আসতে পারতাম আমরা নিজেদের কাছে। অন্তত কিছু সময়ের জন্য। নিজের ক্ষতস্থানগুলোতে রক্তক্ষরণ বন্ধ করি। রথের ঘোড়াগুলোকে ঘাসজল খাওয়াই। তাদের ক্ষতস্থানে শুশ্রূষা করি। রথের ভাঙা চাকা সারাই করি। দেখি, এই কুরুক্ষেত্রের প্রান্তস্থ জমিতেও কোথাও ঘাসের উপর শিশির জমেছে। ধানক্ষেত পেরিয়ে সূর্যের উপর সাদা রেখা টেনে উড়ে যাচ্ছে মানস রাজহংস। এই দৃশ্য আমাকে স্নিগ্ধ করুক, স্থিতধী করুক। তারপর আবার এই জনান্তিক ছেড়ে আমি ফিরে যাব জনযুদ্ধে। দেখব, যাদের ফেলে চলে এসেছিলাম, তারা এখন আমার চোখে অনেকখানি পালটে গেছে। যাদের বন্ধু মনে হত আগে, যাদের শত্রু মনে হত আগে, এখন তারা মানুষ মাত্র, কেবলই সহযোদ্ধা, আর কিছু নয়।

এই ভিশন যদি পালটে না গিয়ে থাকে, তবে কিন্তু আমার এই স্বসমীপে সরে আসাও ব্যর্থ হয়েছে বলতে হবে। নিভৃতবাস তখনই সার্থক প্রমাণিত হবে, যখন জনকলরোলে ফিরে গিয়ে ভিশন পালটে যাবে। যুদ্ধ করতে করতে আমার দুচোখে বাষ্প জমেছিল, ঝাপসা হয়ে এসেছিল আমার দৃষ্টি, নবীনতা বা সজীবতা বিদায় নিয়েছিল আমার দেখা থেকে। কিছু সময়ের জন্যে চোখ ধুতে আমি থেমেছিলাম কোনো জনহীন সূর্যকুণ্ডের ধারে। যদি ঠিকঠাক নিজের কাছে নিজে বসবাস করে থাকি, যদি আমার দুচোখের কনীনিকায় শুশ্রূষার জল পৌঁছে গিয়ে থাকে, তবে পুনরায় রণপ্রাঙ্গনে ফিরে গিয়ে যেটি যা, সেটিকে সেইরূপেই স্পষ্ট দেখতে পাওয়ার কথা।

এই দুই রকমের অভিযাত্রা, বাহির থেকে ভিতরের দিকে এবং ভিতর থেকে বাহিরের দিকে—এই দুই প্রকার জার্নিই পরস্পর সম্পূরক। একটির পরীক্ষা হয় অন্যটিতে। বাইরের দিকে আমার চলা তখনই সম্যক, যখন আমি যে কোনো মুহূর্তেই থামতে পারি, থেমে ফিরে যেতে পারি নিজের কাছে। আর ভিতরের দিকে আমার চলা তখনই ঋতম্ভর, যখন আমি সুপেয় জলের উৎসে তৃষা তৃপ্ত করে ফিরে যেতে পারি আবার মানুষের কাছে। আমার ভৃঙ্গারে তখন সকলের জন্য প্রাণপ্রদ তীর্থবারি আছে, যা মৃতকে জাগিয়ে তু্লতে পারে মহাজাগরণের ভিতর।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (4)
  • comment-avatar
    সুদীপ ভট্টাচার্য্য 4 years

    বড় ভালো লাগল।

    • comment-avatar
      সন্মাত্রানন্দ 4 years

      ধন্যবাদ

  • comment-avatar
    Uma Basu 4 years

    চেতনায় ঢেউ তুলে দিল লেখাটা।বড় ভালো লাগল।

    • comment-avatar
      সন্মাত্রানন্দ 4 years

      তা যদি পেরে থাকে, তবে লেখাটি কথঞ্চিৎ সার্থক।

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes