ইরানের ছোটোগল্প <br />  গোলাম হোসেন নজ়রি

ইরানের ছোটোগল্প
গোলাম হোসেন নজ়রি

গোলাম হোসেন নজ়রির জন্ম ১৯৩৩ সালে, ইরানের হামাদান প্রদেশের মালয়ের শহরে। ১৯৬২ সালে তিনি তেহরান বিশ্ববিদ্যলয়ের ডেন্টাল স্কুল থেকে স্নাতক হয়ে পরের বছর দাঁতের ডাক্তার হয়ে জার্মানিতে অভিবাসী হয়ে যান। ইংরেজি থেকে তরজমা নীলাঞ্জন হাজরা

রাত্রিতে মথগুলো

ওদের অবাক করে দিয়েছিলাম। ঘরে ঢুকে দেখি প্রায় মেঝে অবধি ঝোলানো পুরু টেবিলক্লথে ঢাকা নীচু টেবিলটা ঘিরে ওরা তিনজন বসে আছে। টেবিলের তলায় জল ভরা সামোভারের ভেতরে গনগনে কয়লা জ্বলছে। আমায় দেখামাত্র মা প্রায় লাফিয়ে উঠে হাত দুটো বাড়িয়ে দিল। চামড়া কুঁচকে গেছে। নিমেষ বুঝলাম আমি আজও সেই স্কুল পালিয়ে মায়ের বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে দেওয়া বাচ্চাই রয়ে গেছি। নিজেকে বললাম, “আরে ব্যাটা, তুই না বড়ো হয়ে গেছিস।” কিন্তু আমি আর কোনোদিন বড় হব না। বয়স্ক হয়ে উঠবো না।
ভাই আর বোনকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলাম। তারপর ফের গোল হয়ে বসলাম সকলে টেবিলটা ঘিরে। মায়ের চোখ দুটো আমার মুখের ওপর থেকে সরছিল না।
“এবার বল্,” মা জানতে চাইল। আমি ঢোঁক গিললাম।
“ব…ল্। কোথায় ছিলি এই দুবছর? কী করছিলি?
“কিচ্ছু না।”
“খুব ক্লান্ত না রে?”
চুপ করে রইলাম। ভাই আমার উল্টো দিকে বসে আছে। গোঁফ রাখতে শুরু করেছে দেখছি। আর চোখ দুটো… চোখ দুটোতে একটা ভয়ের ভাব।
“কী করছিস আজকাল?” জিগ্যেস করলাম ওকে।
“কিচ্ছু না।”
বোনের সঙ্গে কোনো কথা হলো না। কেবল দুজনে দুজনকে দেখছিলাম। হিম দৃষ্টিতে। চুপচাপ। হেরে যাওয়া প্রেমিক প্রেমিকার মতো। কেবল দুজনে দুজনকে দেখছিলাম।
টেবিলের ওপর সেই পুরোনো কেরোসিনের ল্যাম্পটা জ্বলছিল। টেবিলটার ছায়ায় কয়েকটা মথ উড়ে বেড়াচ্ছিল। কিচ্ছু বদলায়নি: সেই দরজা, সেই দেওয়াল, সেই জানালাগুলো, পর্দা এমনকি কড়িকাঠগুলোও। কিচ্ছুটি বদলায়নি।
শুধু মাকে কেমন যেন আরো পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছিল, আর ভয়ার্ত দেখাচ্ছিল ভায়ের চোখ দুটো। আর বোন? সে চিবুকটা টেবিলের কিনারে রেখে বসেছিল টুকটুকে পুতুলের মতো আর কাচের চোখদুটো নিয়ে তাকিয়ে ছিল বাতির শিখাটার দিকে।
“তুই কি বোবা হয়ে গেলি নাকি রে?” মা বলে উঠল।
“কী বললে তুমি খুশি হবে বলোতো?”
“কী আর? কোথায় ছিলি তুই এই দু বছর? কী করছিলি?”
“কিচ্ছু না।”
“তুই খুব ক্লান্ত। দাঁড়া তোকে একটু চা করে দিই।”
না। কিছুই বদলায়নি। দরজা, দেওয়াল, জানালা, পর্দাগুলো, কড়িকাঠ। সব সেই একই আছে। বোধ হয় শুধু আমাদের বুকের মধ্যে কোথায় কী যেন একটা ভেঙে গিয়েছিল। কী যেন একটা ভেঙে ফেলা হয়েছিল।
টেবিলটার ওপর বাতিটা জ্বলছিল। মথগুলো আর উড়ে না বেড়িয়ে দেওয়ালে আটকেছিল। সামোভারটা থেকে জল ফোটার শব্দ আসছিল। পুতুলের কাটা মাথার মতো বোনের মাথাটা টেবিলটার কোণায় পড়েছিল। ধীরে ধীরে রাত বেড়ে চলল। আমরা একে অপরের দিকে তাকাতে থাকলাম নীরব বিষাদে।

ছাঁচ

আমার যে অ্যাপ্রেন্টিস তাকে চলে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে বললাম, বললাম জিনিসপত্র রেখে… ও জানে যাওয়ার আগে কী কী করা দরকার। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে জানালার কাছে অপেক্ষা করতে লাগলাম। শহরটার ওপর অন্ধকার আর নীরবতা নেমে আসছিল খুব উঁচু কালো জলপ্রপাতের মতো। মনে মনে ভাবলাম, ‘এটা ভালো লক্ষণ। অন্ধকারে মানুষ একটু জিরিয়ে নেয়— অন্ধকারে তারা নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করে।’’ আর ঠিক সেই মুহূর্তে হলটার দরজার কাছে পায়ের শব্দ পেলাম। ঘুরে দাঁড়ালাম। আমার অ্যাপ্রেন্টিস ভয়ে আমার দিকে তাকালো, তার চোখের বার্তা বুঝে ফেললাম আমি। ভাবলাম, ‘‘অতঃপর যাই ঘটুক না কেন, তা অপ্রত্যাশিত। অতঃপর যাই ঘটুক না কেন আমি তার দায়িত্ব নেব না।’’
দরজাটা খুলে গেল এবং ঢুকলেন চওড়া কাঁধের এক ব্যক্তি — ‘‘নমস্কার ডাক্তারবাবু।’’ এবং এক্ষণে আমার মনে পড়ল আমি একজন দাঁতের ডাক্তার। যে কথাটা আমি বহু বছর ভুলে গিয়েছিলাম: একটা প্রত্যন্ত শহরের এক সস্তার, বেচারা ডেন্টিস্ট।
লোকটি চেয়ারটায় বসে পড়লেন আর আমি তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কী এক গুরুতর পরিস্থিতি! যেন আমি ঘুম থেকে জেগে উঠছি। যেন একটা দুনিয়া থেকে আর একটা দুনিয়ায় আমায় ছুড়ে ফেলা হচ্ছে। যেন আমি বেড়ে উঠছি আমার পাগুলো থেকে… আমার পাগুলো, এক কল্পিত উদ্ভিদের এই তিক্ত শিকড়। তৎক্ষণাত ঠিক করলাম রোগীটিকে সব কথা বলে দেব, বলে দেব যে, সন্ধ্যার এ সময়ে, এই প্রত্যন্ত শহরে অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ওত পেতে আছে অন্ধকারে এবং তাঁর জানা উচিত যে, যাই ঘটুক না কেন আমি তার দায়িত্ব নেব না।
কাজেই শুরু করলাম, ‘‘তা হলে বলুন, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?’’
‘‘আমি আমার দাঁতের জন্য এসেছি। কিছুকাল আগে আপনি আমার দাঁতের পাটির ছাঁচ তুলেছিলেন।’’
স্পষ্টতই এই ব্যক্তি আমাকে গালগপ্পো শোনাচ্ছেন, কিংবা হয়তো নিজের অজান্তেই তিনি আমাকে কোনো পুরনো বই থেকে কোনো গল্প বলছেন। যাই হোক, বহু বছর হয়ে গেল আমি কারো দাঁতের পাটির ছাঁচ তুলিনি। খানিকটা ধন্দে পড়েই আমি আমার সার্জারির জিনিসপত্তর রাখার ঘরটায় গেলাম। এ ঘরে, অন্যত্র, এ রকম অন্যান্য ঘরে রাখা আছে — নকল দাঁতের পাটি, পরচুলো, চশমা, হিয়ারিং এইড, হার্নিয়ার রুগিদের পরার বেল্ট, আরও টুকিটাকি কত কিছু— মৃত্যুর হাতছানি আর ভেঙচির বিরুদ্ধে সুরক্ষার নানা যন্ত্রপাতি। আমি কয়েক পাটি নকল দাঁত তুলে রোগীর কাছে ফিরে এলাম। তাঁর মুখে একটা একটা করে পরালাম, কিন্তু একটাও খাপে খাপে বসল না।
তাঁকে বলতে বাধ্য হলাম, ‘‘দেখুন মশাই, বিশ্বাস করুন বহু বছর আমি কারো দাঁতের পাটির ছাঁচ তুলিনি। আমি বলতে চাইছি, আজকাল দাঁত আর চোয়ালের জন্য কারখানাগুলো হরেক মাপের নকল দাঁতের পাটি তৈরি করে। যাঁরা ইচ্ছুক, আমরা এই নকল পাটি তাঁদের পরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। সাধারণত মাপে মাপে হয়ে যায়। যদি একটাও খাপে খাপ না খায় তা হলে ছোট্টো একটা অপারেশন করে আমরা চোয়ালের মাপ বদলে নকল দাঁতের পাটির মাপে করে দিই। আপনার ক্ষেত্রে — যেমনটা আপনি নিজেই দেখলেন… আপনাকে অনুমতি দিতে হবে যাতে আমরা একটা ছোট্টো অপারেশন করে…
তিনি বেশ একটা পরিতোষে ভরা হাসি দিলেন। আমার অ্যাপ্রেন্টিস তাঁর গলায় একটা বড়সড় সফেদ ন্যাপকিন বেঁধে আমার হাতে স্ক্যালপেলটা তুলে দিল। লোকটি মুখটা খুলল, আমি তাঁর সামনে ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে। যেন আমি ঘুম থেকে জেগে উঠছি। কী বিপজ্জনক পরিস্থিতি! আমার অ্যাপ্রেন্টিস ডুকরে কাঁদছিল। তার বয়স ষোল, সে এখনো কাঁদতে পারে। আমি ঝুঁকে পড়ে রোগীর মুখের মধ্যে ছুরিটা ঢুকিয়ে দিলাম। তখনও ছুরিটায় চাপ দিইনি, তাঁর মুখ থেকে ভলকে ভলকে রক্ত উঠে এল, মনে হল এ রক্তপাত কখনো থামবেনা।

কৈশোর আর সেই পাহাড়টা

আমার স্বপ্নে সর্বদাই একজন সেনাপতি থাকে (এবং সে আমি, আমি স্বয়ং), যে, পুরনো দিনের নায়কদের পোশাকে, হাতে গদা আর ঢাল নিয়ে, শিরস্ত্রান পরে, পাহাড় থেকে নেমে এসে একা শত্রুপক্ষের সেনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমার আহত সেনাপতি মাঠের মাঝখানে পড়ে মারা যায়।
আমি দায়সারা ভাবে দেওয়ালে একটা লাইন টানলাম আর ভাবলাম আমার পরে অন্য কোনো একটি ছটফটে হাসিখুশি ছেলে লাইনটাকে তার অভিপ্রেত শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাবে। আমার স্বপ্নে সর্বদাই একটি ছটফটে হাসিখুশি ছেলে থাকে (এবং সে আমি, আমি স্বয়ং), যে দেওয়ালে মোটা মোটা দাগ টানে।
পাহাড়ের চূড়া থেকে আমি ওদের দেখতে পেলাম। মহিলার পাগুলো নিরাবরণ এবং লোকটি বোধগম্যই নয় এমন সব বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করছিল।
আমরা একে অপরকে বেশ কয়েকদিন দেখার পরে একদিন আমি ঠিক করলাম মহিলাটিকে পাহাড়ের ওপারে নিয়ে যাব ওই সব বিচিত্র, বোধগম্য নয় এমন অঙ্গভঙ্গিগুলোকে একটা অর্থ দিতে। দূর থেকে পাহাড়টাকে এখন স্তনের ডগার মতো দেখাচ্ছিল।
আমার স্বপ্নে সর্বদাই একটি ছোট্টো মেয়ে থাকে, একটা সুন্দর পাল্কিতে, ইতিহাসের গভীরে, চলেছে নামহীন সব রাস্তা দিয়ে অজানা গন্তব্যের দিকে।
শেষ-না-হওয়া হোমওয়ার্ক, ইতিহাসের বইয়ের পাতার ভিতরে হারিয়ে যাওয়া পাল্কিটা, বন্ধ খাতা আর সমাধান-না-হওয়া অঙ্ক, আর সেই পাহাড়টা যেটা এখন স্তনের বোঁটার মত দেখাচ্ছে। রাত্রে আমি ডুকরে কাঁদতাম।
বাচ্চা ছেলেটা দেওয়ালে একটা দাগ টানল, দ্রুত হেঁটে গেল পাহাড়টার ওপরের দিকে এবং নেমে পড়ল অপর পার দিয়ে, পুরনো দিনের নায়কের পোশাকে, হাতে গদা আর ঢাল নিয়ে এবং শিরস্ত্রান পরে। মৃত্যু-আঘাতে আহত আমার সেনাপতি মাঠের মাঝখানে।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (1)
  • comment-avatar
    ঈশিতা ভাদুড়ী 3 years

    ভালো অনুবাদ

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes